এশীয় দুই শক্তি ভারত ও চীনের পর এবার বাংলাদেশকে পাশে পেতে আগ্রহ দেখাচ্ছে আরেক অর্থনৈতিক শক্তি জাপান। দেশটি পুবের দেশগুলোর অর্থনৈতিক জোট আসিয়ানে অন্তর্ভুক্ত করতে চায় বাংলাদেশকে। ভারতের পর কৌশলগত অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশকে পাশে পাওয়ার ক্ষেত্রে শত্রুমনোভাবাপন্ন দুই দেশ চীন ও জাপানের সাম্প্রতিক আগ্রহের পেছনে বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং বঙ্গোপসাগরের বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনার বিষয়টিই কাজ করছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জানা গেছে, আসিয়ানে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে সম্প্রতি জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) বাংলাদেশ প্রধান মি. মিকিও হাতেদা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সঙ্গে কথা বলেছেন। জাইকাপ্রধান বলেছেন, বাংলাদেশ চাইলে আসিয়ানের 'রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ (আরকেপ)'-এর সদস্য হতে পারে।
জাইকার এ ধরনের প্রস্তাব পেয়ে গভর্নর ড. আতিউর রহমান বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মাহবুব আহমেদের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, 'ঢাকাস্থ জাইকাপ্রধান একটি প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন। এই কমিটিতে বাংলাদেশও অংশগ্রহণ করতে পারে। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের আগ্রহ থাকলে জাইকাপ্রধানের সঙ্গে আপনি (বাণিজ্য সচিব) কথা বলতে পারেন। আমি মার্চের মাঝামাঝি জাপান সরকারের আমন্ত্রণে ওই দেশে যাচ্ছি। তার আগে সরকারের মনোভাব জানতে পারলে আমিও এ নিয়ে জাপান সরকারের সঙ্গে কথা বলতে পারি।' জানা গেছে, গভর্নরের চিঠি এবং চিঠির সঙ্গে পাঠানো জাইকাপ্রধানের প্রতিবেদনটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশের জন্য এ ধরনের জোটের অর্থনৈতিক গুরুত্ব থাকায় জাইকাপ্রধানের সঙ্গে বাণিজ্য সচিব বৈঠক করবেন বলেও জানা গেছে।
আরকেপ কী : আসিয়ানের ১০ সদস্যরাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, মিয়ানমার, ব্রনেই, কম্বোডিয়া ও লাওস অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে (এফটিএ) যে অংশীদারি তৈরি করেছে, সেটিকেই 'রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ' (আরকেপ) নামে ডাকা হয়। আরকেপের মাধ্যমে আসিয়ানে অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো হচ্ছে- অস্ট্রেলিয়া, চীন, ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও নিউজিল্যান্ড। গত বছরের মে মাসে আরকেপের সদস্যরাষ্ট্রগুলোর বাণিজ্য সমঝোতা কমিটির (টিএনসি) প্রথম বৈঠক হয় ব্রুনেইয়ের দারুসসালামে। বৈঠকে আরকেপ যে যৌথ বিবৃতি দিয়েছে সেখানে সদস্যরাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একটি আধুনিক, উচ্চপর্যায়ের, সমঝোতামূলক অর্থনৈতিক অংশীদারি সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, এর মাধ্যমে ওই অঞ্চলের দেশগুলো আঞ্চলিক বাণিজ্য সম্প্রসারণ সুবিধা, বিনিয়োগ এবং বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের শরিক হতে পারবে।
বাংলাদেশের সম্ভাবনা : অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড বাদে আরকেপের সদস্য এশিয়ার চার অর্থনৈতিক শক্তি চীন, জাপান, ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সর্বাধিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। সবগুলো দেশই অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী। বিশেষ করে এই চার দেশ থেকেই বাংলাদেশের শিল্পের জন্য সবচেয়ে বেশি কাঁচামাল ও শিল্পোৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ভারউ যন্ত্রপাতি, মেশিন, গাড়ি, মোটরবাইক, ট্রাক-লরিসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানি হয়ে থাকে। এ ছাড়া এই গ্রুপটির মাধ্যমে আসিয়ানের ১০ সদস্যরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ারও সুযোগ থাকছে। এর মাধ্যমে আসিয়ানে অন্তর্ভুক্ত হতে পারলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক গুরুত্বের পাশাপাশি মর্যাদাও বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। সার্কের (সাফটা) মাধ্যমে প্রায় তিন দশক ধরে বাংলাদেশের সঙ্গে পাশর্্ববর্তী ভারতের অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। চীন ও জাপানের সঙ্গে সে অর্থে বাংলাদেশের কোনো অর্থনৈতিক জোট নেই। সে কারণে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারকে নিয়ে বিসিআইএম নামে একটি অর্থনৈতিক জোট গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে চীন। বিসিআইএম গঠনের প্রস্তুতি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে বলেও জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। চীনের এই জোট গঠনের কারণ হচ্ছে এ অঞ্চলে একটি অর্থনৈতিক যোগাযোগ (করিডর) সৃষ্টি করা। এ ছাড়া বঙ্গোপসাগরে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান, বিশাল অর্থনৈতিক জোনের দিকেও দৃষ্টি রয়েছে চীনের। বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা অব্যাহত থাকলেও এত দিন বাংলাদেশকে নিয়ে এ ধরনের সম্পর্ক তৈরির বিষয়টি খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে ভাবেনি জাপান। তবে চীনের বিসিআইএম প্রস্তাবের পর এবার আগ বাড়িয়েই আগ্রহ দেখাল দেশটি। আর এ পরিস্থিতিতে আসিয়ানে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে জাপানের আগ্রহ মূলত এ অঞ্চলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও ভৌগোলিক সম্ভাবনাকেই চিহ্নিত করে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা পরিষদের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক ড. এম কে মুজেরি বলেন, 'আঞ্চলিক প্রেক্ষাপট এবং অর্থনৈতিক গুরুত্বের ওপর নির্ভর করেই এ ধরনের জোট গঠনে বিশেষ বিশেষ দেশ আগ্রহী হয়। এ মুহূর্তে পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সেন্টার হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। বিগত কয়েক বছরে আমাদের বাণিজ্য সম্ভাবনা বেড়েছে কয়েক গুণ। একটি শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ বাজারও সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত নিরাপত্তার প্রশ্নেও বঙ্গোপসাগরের গুরুত্ব বেড়েছে। সে কারণেই এশিয়ার অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে বাংলাদেশ।'
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।