রাজধানী ঢাকাকে একটি তিলোত্তমা নগরী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) বাস্তবসম্মতভাবে সংশোধন করে তা বাস্তবায়নের দাবি তোলা হয়েছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের একটি স্ট্যান্ডিং কমিটির সভায়। কমিটির সদস্যরা বলেছেন, বর্তমানে যে ড্যাপ আছে তা ত্রুটিপূর্ণ। এটি বাস্তবায়নযোগ্য নয়।
ওই কমিটি প্রয়োজনে বিদেশ থেকে নগর পরিকল্পনাবিদ এনে ড্যাপ বাস্তবায়নের একটি 'অ্যাকশন প্ল্যান' তৈরি করে সরকারের কাছে দেবে। পাশাপাশি তারা সব পক্ষকে নিয়ে একটি সেমিনারেরও আয়োজন করবে। ড্যাপ এখনো চূড়ান্ত নয় বলেন উল্লেখ করে কমিটির সভায় চূড়ান্ত করার আগে ড্যাপের সব কার্যক্রম স্থগিত করার দাবি করা হয়। ২০১০ সালের জুন মাসে ড্যাপের একটি গেজেট প্রকাশ করে সরকার। কিন্তু ত্রুটিপূর্ণ ড্যাপের বিরুদ্ধে ঢাকার বাসিন্দারা ফুঁসে উঠলে সেটি পুনর্মূল্যায়ন করার জন্য একটি সাত সদস্যের মন্ত্রিসভা কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে এ বিষয়টি উল্লেখ করে বলা হয়, চূড়ান্ত নয় এমন কিছু দিয়ে কোনো কার্যক্রম চলতে পারে না। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই বিভিন্ন খাতের জন্য স্ট্যান্ডিং কমিটি গঠন করে ওই খাতের সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখে। তাদের 'স্ট্যান্ডিং কমিটি অন ইমপ্লিমেন্টেশন অব ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ)'-এর প্রথম সভা ছিল গতকাল। মতিঝিলের ফেডারেশন ভবনে অনুষ্ঠিত ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন কমিটির চেয়ারম্যান গোলাম সারওয়ার মিলন। কমিটির কো-চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ল্যান্ড ডেভেলপারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলডিএ) সভাপতি বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান, বিএলডিএ'র মহাসচিব ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল মহিউদ্দিন, এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি মো. হেলাল উদ্দিনসহ কমিটির সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। কমিটির ডিরেক্টর ইন চার্জ কে এম আখতারুজ্জামান সভাটি সঞ্চালনা করেন। সভায় ড্যাপ কীভাবে বাস্তবসম্মত করে বাস্তবায়ন করা যায় তা নিয়ে আলোচনা হয়। কমিটির চেয়ারম্যান গোলাম সারোয়ার মিলন জানান, সভায় কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সিদ্ধান্তের মধ্যে রয়েছে, ড্যাপ বাস্তবায়নের জন্য একটি অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করে সরকারের কাছে জমা দেওয়া হবে। প্রয়োজনে সিঙ্গাপুর থেকে নগর পরিকল্পনাবিদ এনে প্রস্তাব তৈরি করা হবে যাতে ড্যাপ কার্যকর ও বাস্তবসম্মতভাবে বাস্তবায়ন করা যায়।
সিঙ্গাপুর থেকে নগর পরিকল্পনাবিদ আনার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় যে, সিঙ্গাপুর বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ। সেখানকার পরিকল্পনাবিদরা ভালো বলতে পারবেন কীভাবে ঢাকাকে পরিকল্পিত নগরী হিসেবে গড়ে তোলা যায়।
গোলাম সারওয়ার মিলন জানান, কমিটি ড্যাপ নিয়ে সব পক্ষের উপস্থিতিতে এক মাসের মধ্যে একটি সেমিনার আয়োজন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগামী ১০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে স্ট্যান্ডিং কমিটি আরেকটি সভা করে সেমিনারের দিন ঠিক করবে। ওই সেমিনারে ওয়ার্কিং পেপার তৈরি ও ড্যাপ বাস্তবায়নের অ্যাকশন প্ল্যান তৈরির জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিনি বলেন, 'আমরা ঢাকাকে সুন্দর নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে ড্যাপের বাস্তবায়ন চাই। তবে যে ড্যাপ করা হয়েছে তা ত্রুটিপূর্ণ। ড্যাপকে গ্রহণযোগ্য ও বাস্তবসম্মত হতে হবে।' সভায় ২০১৬ থেকে ২০৩৫ সালের জন্য রাজউকের মহাপরিকল্পনা তৈরির কমিটিতে এফবিসিসিআই, বিএলডিএ ও আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব-এর দুজন করে প্রতিনিধি রাখার দাবি করা হয় স্ট্যান্ডিং কমিটির বৈঠকে।
সভায় বিএলডিএর সভাপতি আহমেদ আকবর সোবহান বলেন, 'ঢাকা মহানগরীকে একটি তিলোত্তমা নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে অবশ্যই ড্যাপের প্রয়োজন আছে। তবে সেটি হতে হবে জনকল্যাণমুখী ও বাস্তবসম্মত। আমাদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বনামধন্য নগর পরিকল্পনাবিদদের নিয়ে স্বার্থসংশ্লিষ্ট সকলের অংশগ্রহণে সবার জন্য উপকারী একটি ড্যাপ প্রণয়ন করতে হবে।' তিনি বলেন, 'আমাদের সুযোগ দেওয়া হলে আমরা ঢাকাকে তিলোত্তমা নগরী হিসেবে গড়ে তুলব।'
বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের প্রশংসা করে বলেন, 'নতুন মন্ত্রী নিজে একজন প্রকৌশলী। তিনি এর আগেও পূর্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন। তার অভিজ্ঞতা এ খাতকে সামনে এগিয়ে নিতে সহায়তা করবে।'
বিএলডিএর মহাসচিব মোস্তফা কামাল মহিউদ্দিন সভায় আবাসন খাতের দুরবস্থার চিত্র তুলে ধরে বলেন, 'ড্যাপের কারণে গত ১০ বছরে কোনো আবাসন প্রকল্প অনুমোদন করতে পারেনি রাজউক। এ কারণে বেসরকারি খাতে ৫০টিরও বেশি আবাসন প্রকল্প আটকে আছে। এমনকি রাজউকও নিজেদের তিনটি প্রকল্প হস্তান্তর করতে পারেনি।'
নতুন প্রকল্প অনুমোদন না করায় আবাসন খাত ও সংশ্লিষ্ট প্রায় ৩০০টি উপখাতে বিপর্যয় নেমে এসেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, আবাসন খাতে প্রায় এক লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আছে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের একটা বড় অংশ বিনিয়োগ হয়েছে এ খাতে। আবাসন খাতের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আড়াই কোটি মানুষের জীবিকা নির্ভর করে। নতুন আবাসন প্রকল্প না হওয়ায় এ খাতের ২৫ লাখ শ্রমিক ইতোমধ্যে বেকার হয়ে গেছে। একটি দেশের সভ্যতার মাপকাঠি উন্নত আবাসন বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'ঢাকাকে সুন্দর নগরী করতে অবশ্যই ড্যাপ বাস্তবায়ন প্রয়োজন। তবে তা বাস্তবসম্মত হতে হবে।' সভায় এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি হেলাল উদ্দিন একই এলাকার এক ভবনকে চার তলা, আরেক ভবনকে ১০ তলা পর্যন্ত অনুমোদন দেওয়ায় রাজউকের সমালোচনা করে বলেন, তার নিজের ভবনটি চার তলার অনুমোদন পাওয়ায় ওই পর্যন্ত নির্মাণ করেছেন। পরে পাশের দুটি ভবন ১০ তলা হওয়ায় এখন সেগুলো থেকে তার ভবনের ছাদে ময়লা ফেলা হয়। তিনি জোনিং করার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলেন, একটি এলাকায় সব ভবনকে একটি নির্দিষ্ট উচ্চতা পর্যন্ত অনুমোদন দিতে হবে। উন্নত শহরগুলোতে এ নীতি আছে। রাজউকের পরিচালক (প্ল্যান প্রিপারেশন) মো. সিরাজুল ইসলাম সভায় জানান, ২০১৬-২০৩৫ পর্যন্ত সময়ের জন্য একটি মহাপরিকল্পনা তৈরির কাজ রাজউক অনেকখানি এগিয়ে এনেছে। ওই পরিকল্পনা সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার জন্য শীঘ্রই একটি 'পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের' আয়োজন করা হবে। এতে স্বার্থসংশ্লিষ্ট সবাই উপস্থিত থাকবেন। এফবিসিসিআইয়ের সাবেক পরিচালক ও ড্যাপ সংক্রান্ত স্ট্যান্ডিং কমিটির আগেরবারের চেয়ারম্যান সৈয়দ মো. শামসুল কাউনান কুতুব ড্যাপ নিয়ে এফবিসিসিআইকে জোরালো ভূমিকা নেওয়ার পরামর্শ দেন। বর্তমান পরিচালক ওবায়দুর রহমান ঢাকাকে 'বসবাসের অযোগ্য' শহরের তকমা থেকে বেরিয়ে আসতে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়ার তাগিদ দেন। এফবিসিসিআইয়ের স্ট্যান্ডিং কমিটিতে একজন চেয়ারম্যান, একজন ডিরেক্টর ইন চার্জ, ১১ জন কো-চেয়ারম্যান ও ৯০ জন সদস্য রয়েছেন। গতকালের প্রথম সভায় কো-চেয়ারম্যান জীবা আমিনা খান, সদস্য মো. আখতারুজ্জামান মঞ্জু, আইনুল হক সোহেল, মনিরুল ইসলাম, মো. সোহেল খান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।