আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রতারণার ফাঁদে নাগরিক জীবন

হরেকরকম প্রতারণার বেড়াজালে বন্দী নগরীর মানুষ। ফুটপাত থেকে শুরু করে অফিস-আদালতের নানা পর্যায়েই চলে নিত্যনতুন প্রতারণা। ঘরে বসে ফেরিওয়ালাদের জিনিসপত্র কিনতে গিয়ে ওজনে ঠকতে হয়, মসজিদ-মাদ্রাসা-এতিমখানার নামে টাউট-বাটপারদের হাতে তুলে দিতে হয় নগদ টাকার চাঁদা। গন্তব্যে যেতে সিএনজি ট্যাঙ্ িও ক্যাবের মিটার জালিয়াতির কবলে পড়ে 'অতিরিক্ত ভাড়া' পরিশোধের পরও গুনতে হয় ২০-২৫-৫০ টাকার বাড়তি বকশিশ।

রাস্তা, বাজার, কর্মস্থলসহ সর্বত্রই আরও কত রকমের ফাঁদ, মওকায় যে লোকজনের পকেট খালি হয় তার ইয়ত্তা নেই। জীবনযাত্রার সব ক্ষেত্রই প্রতারণার অক্টোপাসে বন্দী হয়ে পড়ছে, পদে পদে ওত পেতে থাকছে নানামুখী বিপদ। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রকমের অন্তত ২০০ প্রতারক সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে এবং তাদের কাছে প্রতিদিন সহস্রাধিক লোক প্রতারণার শিকার হয়। ডিএমপিভুক্ত থানাগুলোর লিপিবদ্ধ মামলা-জিডি ও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতারণার খবরাখবরের সূত্র ধরে এ পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে।

জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে 'প্রতারণাও' ইদানীং ডিজিটাল রূপ পেতে শুরু করেছে। এখন ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড যেমন জালিয়াতি করে অন্যের অ্যাকাউন্ট খালি করা হচ্ছে, তেমনি গলা কাটা পাসপোর্ট তৈরি, বিদেশি ভুয়া ওয়ার্কপারমিট ও নিয়োগপত্র প্রস্তুত করলেও সহজে তা জাল প্রমাণের উপায় থাকে না। জাল টাকার ছড়াছড়ি আছে বাজারজুড়ে। মোবাইল ফোনে লাখ লাখ টাকা লটারি পাওয়ার প্রলোভনযুক্ত মেসেজ বানিয়েও প্রতারণা করা হচ্ছে অহরহ।

নানা কূটকৌশল-বুদ্ধির ফাঁদে শুধু যে গ্রামীণ এলাকার সহজ-সরল মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা নয়, শহুরে শিক্ষিত সচেতন বাসিন্দারাও এসব প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়ে সর্বস্ব খুইয়ে চলছে অহরহ। বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে প্রতারণার নানা বেহাল চিত্র। দেখা গেছে, খোদ রাজধানীতেই প্রতিনিয়ত চলছে শতাধিক রকমের প্রতারণা। প্রসূতি মায়ের সন্তান প্রসব থেকে শুরু করে শিক্ষা, চিকিৎসা, চাকরি, বিয়ে এমনকি মৃত্যুর পর লাশ দাফন পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই প্রতারণার একচ্ছত্র দাপট রয়েছে।

বিভিন্ন পয়েন্টে আলাদা আলাদা চক্র প্রতারণার জাল বিছিয়ে নানা কায়দায় মানুষ ঠকিয়ে আখের গোছাচ্ছে। নগরীর ফুটপাতে নাক-কান-গলা রোগসহ দুরারোগ্য সব ব্যাধি থেকে মুক্তির স্লোগান নিয়ে ভুয়া চিকিৎসকরা বসছে নানা ওষুধের পসরা সাজিয়ে। এইডস-ক্যান্সারের মতো ভয়াবহ রোগ নিরাময়ের গ্যারান্টি দিয়ে তাবিজ-কবজের বেচাকেনা চলে, ঝাড়-ফুঁক, পানি পড়ায় রোগ-ব্যাধির পাশাপাশি যাবতীয় বিপদ-আপদ কাটিয়ে দেওয়ারও দাবি তুলছে ভণ্ডরা। জাদু-টোনা দিয়ে শত্রুকে বশে আনা, অন্যের স্ত্রী বশীকরণ, মনের মানুষকে পাওয়ার অব্যর্থ কবজ; এমনকি অপারেশন না করে ঝাড়-ফুঁক দিয়েই পেটের পাথর অপসারণ করার মতো কামেল লোকের ছড়াছড়ি রয়েছে অলিগলিতে। এদেরই একটি গ্রুপ আবার অভিজাত অফিস সাজিয়ে আধ্যাত্দিক তন্ত্রমন্ত্রের সাধক হিসেবে প্রতারণা করে চলেছে। মগবাজার, পীরজঙ্গি মাজারসংলগ্ন, গুলিস্তান, আরামবাগ, ইত্তেফাক মোড় এলাকায় পীরবাবা, সাঁইজি, আধ্যাত্দিক সাধনাকারী মা সুফিয়ার বিশ্বচ্যালেঞ্জ ইত্যাদি নামে প্রচারের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে ও পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে নিরীহ লোকজনকে বলির পাঁঠা বানানো হয়। তাদের স্লোগান হলো তদবিরে তকদির খোলে। নয়াপল্টন, মৌচাক, বাংলামোটর, ফার্মগেট এলাকায় আছে পাথরে ভাগ্য ফেরানোসহ জ্যোতিষীবিদ্যায় শনিরদশা কাটানোর হরেকরকম কসরত। গভীর রাতে জিনের বাদশাহ সেজে মোবাইল ফোনে কল দিয়ে নাকি সুরে কথা বলা হয়, বলে দেওয়া হয় অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ। মোটা অঙ্কের সেলামি দাবি করে বলে দেওয়া হয় জিনের বাদশাহকে খুশি করলে আপনার বাড়িতেই মাটির নিচে থাকা গুপ্তধনের সন্ধান দেবেন জিনবাবা। চাহিদামতো সেলামি আর গুপ্তধন ওঠানোর খরচ হাতিয়ে নিয়েই নিরুদ্দেশ হয়ে যান কথিত জিনের বাদশাহ। রোগবালাই নিরাময়ে যে কোনো হাসপাতালের উদ্দেশ্যে গেলেই দালাল চক্রের বেহাল উৎপাত চোখে পড়ে। অ্যাম্বুলেন্স বা অন্য কোনো যানবাহন থেকে রোগী নামানো, রেজিস্টার খাতায় নিবন্ধন, কোন ডাক্তার রোগীর চিকিৎসা করবেন এ সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে হাসপাতাল গেটের দালালরা। দালাল চক্রের উৎপাত আছে কোর্ট-কাচারি, বিআরটিএ অফিস, বাস টার্মিনাল, সাবরেজিস্ট্রি অফিস, যে কোনো থানার গেটে, পাসপোর্ট দফতরসহ নাগরিক সেবা প্রদানকারী প্রায় প্রতিটি পয়েন্টে। প্রতারণামূলক লটারির দৌরাত্দ্য ইদানীং কিছুটা কমলেও বেড়ে গেছে চাকরি দেওয়ার নামে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ফন্দিফিকির। রাস্তাঘাটের যেখানে সেখানে দেখা যায় পার্টটাইম চাকরির বিজ্ঞাপন। এগুলো বেশির ভাগই প্রতারকদের পাতা ফাঁদ, পা দিলেই বিপদ। সংঘবদ্ধ একটি চক্র খাদ্য অধিদফতর, রেল বিভাগ, সেনাবাহিনী, ভূমি জরিপ অধিদফতরসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থায় চাকরি দেওয়ার নামে একযোগে ১৫ হাজার তরুণ-যুবককে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে। চাকরি দেওয়ার নামে ঘুষ বাবদ প্রায় ৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার একপর্যায়ে চক্রের সদস্যরা ঢাকা মহানগর ডিবি সদস্যদের জালে আটকে পড়ে। শুধু রাস্তার বিজ্ঞাপন কেন, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েও চাকরি দেওয়ার নামে আজকাল অনেক প্রতারণার ঘটনা ঘটছে। পত্রিকায় জম্পেশ বিজ্ঞাপন দিয়ে চাকরিপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে আবেদনপত্র আহ্বান করা হয়। আবেদনপত্রের সঙ্গে পরীক্ষার ফি বাবদ টাকা পাঠাতে বলা হয়। নির্দিষ্ট দিনে অফিসে গিয়ে দেখা যায় কর্তৃপক্ষ পরীক্ষার ফি বাবদ প্রদত্ত টাকা নিয়ে উধাও। ভুয়া মসজিদ-মাদ্রাসার নামে টাকা তোলে একদল প্রতারক। মাজারগুলোয় এখন ধর্মীয় কর্মকাণ্ড মুখ্য বিষয় নয়। এগুলো টাকা, দান, হাদিয়া বা দক্ষিণা তোলার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ইমিগ্র্যান্ট ভিসা দেওয়ার লোভ দেখিয়ে সর্বস্বান্ত করা হয়েছে অনেককে। বেকার যুবক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী থেকে শুরু করে সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তাও রয়েছে এ তালিকায়। তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হয় ৪ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত, কানাডার ইমিগ্র্যান্ট ভিসা দেওয়ার নামে অভিনব কায়দায় টাকা নেওয়া হয়। প্রতারিতরা বিষয়টি নিয়ে চাপ সৃষ্টি করলে অনেকের চেক দিয়ে সান্ত্বনা দেওয়া হয়। পরে আকরাম টাওয়ার, পুরানা পল্টন, ফার্মগেট, বনানীসহ অন্যান্য অফিস রাতের অাঁধারে গুটিয়ে নিয়ে সিন্ডিকেট সদস্যরা পালিয়ে যান। বিভিন্ন ম্যারেজ মিডিয়ার সহযোগিতায় প্রতারণার ফাঁদ এখনো চলছে বহালতবিয়তে। সুন্দরী নারীদের সঙ্গে নিয়ে ম্যারেজ মিডিয়ার ছদ্মাবরণে গড়ে তোলা প্রতারক চক্রের মূল টার্গেট হচ্ছে ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী এবং সরকারি প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। সমাজে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচিত পর্যায়ের লোকজন প্রতারণার শিকার হলে অনেকেই সামাজিক সম্মানের কারণে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চান না। প্রতারকদের কল্যাণে গ্রাহকরা ফা, ডেভিডফ, ভার্সাচি, নাইকি, এডিডাস ইত্যাদি বিশ্বমানের যে কোনো পণ্য ফেলনা দামে রাজধানীর ফুটপাত থেকেই সংগ্রহ করতে পারছেন। বিশ্বের এমন কোনো ব্র্যান্ডের পণ্য নেই যা ফার্মগেটের ওভারব্রিজে বা গুলিস্তানের ফুটপাতে পাওয়া যায় না। 'বাটা' জুতার 'রাটা' সংস্করণ, ফেয়ার অ্যান্ড লাভলির জায়গায় কেয়ার অ্যান্ড লাভলিও সুলভে মেলে! প্রতারকরা তাদের কাজে এতটাই সিদ্ধহস্ত যে তাদের প্রতারণামূলক কাজকে রীতিমতো শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে।

জমি কেনার পর দেখা যায় জমির ভুয়া মালিক সেজে যিনি বিক্রি করেছেন তিনি শুধুই একজন নিয়োজিত দালাল মাত্র। জমির বায়নানামার স্ট্যাম্প থেকে দলিলপত্র পর্যন্ত সবই হয়েছে জাল। রোগ যেটাই হোক একগাদা অপ্রয়োজনীয় টেস্ট আর বেশি পরিমাণ ওষুধ ধরিয়ে দিচ্ছেন ডাক্তার। বিপদে পড়ে অ্যাডভোকেটের কাছে গেলে কোর্ট চত্বরেই প্রতারক চক্রের কবলে পড়েন অসংখ্য ভুক্তভোগী। তারা এমন সব ব্যবস্থা করে দেন তাতে বাদী-বিবাদী যারাই হোন মাসের পর মাস আদালতে দৌড়াতে হয়- এমন অগণিত প্রতারণার নাগপাশে বন্দী গোটা দেশ। যেন পদে পদে ওত পেতে থাকে বিপদ। নাটকে, ফিল্মে অভিনয়ের জন্য অনেকেই মরিয়া। তরুণ-তরুণীদের এ রকম স্বপ্ন ও সাধকে পুঁজি করে অনেকেই প্রতারণার ব্যবসা ফেঁদে বসেছে। ফিল্ম ও সিনেমার লাইনে টাকা ঢেলে নিঃস্ব হচ্ছে অনেকে। লম্পটদের খপ্পরে পড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তরুণীরা। রঙিন স্বপ্নে বিভোর হয়ে তারা সর্বস্ব খুইয়ে দেয়। কারও কারও পরিণতি হয় আরও ভয়াবহ।

১০-১২ বছর ধরে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) ব্যবসার নামে দেশজুড়ে রাতারাতি বড়লোক বনে যাওয়ার জন্য সীমাহীন ছোটাছুটি শুরু হয়। ফ্ল্যাট, বাড়ি, গাড়ি, এলসিডি টিভি আরও কত কী তারা পেয়ে যায়। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ধাপ পর্যায়ের এজেন্টরা আর তৃণমূল পর্যায়ের লাখ লাখ গ্রাহক কোটি কোটি টাকা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। ইউনিপেটুইউ, ইউনিগেটওয়ে বাংলাদেশ, নিউওয়েসহ আরও শতেক নামে এমএলএম দোকান খুলে প্রতারণা চললেও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ বাধা দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করেননি।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.