পুরানা ঢাকার ব্যবসায়ী শাহেদের কাছে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করে সন্ত্রাসীরা। শাহেদ পুলিশকে জানান, নিরাপত্তা চেয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। কিন্তু ব্যবসায়ী শাহেদ নিরাপদ থাকেননি। চাঁদাবাজদের হাতেই গত ১৩ জানুয়ারি দিনদুপুরে তিনি নির্মমভাবে খুন হন।
নিউমার্কেট এলিফ্যান্ট রোডের একটি চায়ের দোকান থেকে ব্যবসায়ী সুলতান হাওলাদারকে (৪০) আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে ধরে নিয়ে যায় অজ্ঞাত ব্যক্তিরা।
পরদিন নিউমার্কেট থানায় জিডি করেন তার স্ত্রী বিউটি, যার নম্বর ৬৬৩। জিডির তদন্ত দূরে থাক, পুলিশের পক্ষ থেকে কেউ খোঁজও করেনি। বিউটির ধারণা, তার স্বামী সুলতান আর বেঁচে নেই। জানমালের নিরাপত্তা চেয়ে থানায় করা সাধারণ মানুষের এমন অসংখ্য জিডির তদন্তই হয় না। অথচ এক্ষেত্রে প্রথম আইনি ধাপটিই হলো জিডি।
তদন্ত না হওয়ায় মানুষের জীবন হয়ে উঠছে সংকটাপন্ন। জিডি করার পর অনেককেই খুনের শিকার হতে হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশে (ডিএমপি) গত এক বছরে হত্যার হুমকিসহ বিভিন্ন কারণে লিপিবদ্ধ লক্ষাধিক জিডির কোনো তদন্তই হয়নি। ডিএমপির ৪৯টি থানাসহ পুলিশের বিভিন্ন দফতরে এসব জিডি এখন ফাইলবন্দী।
ডিএমপি কর্মকর্তারা জানান, হাজার হাজার মামলা তদন্তের জন্যই যেখানে পর্যাপ্ত সময় মেলে না, সেখানে সব জিডির তদন্ত অসম্ভব।
এটা করতে হলে পুলিশের জনবল দ্বিগুণ করতে হবে। তাছাড়া বহু জিডির তদন্ত করেও ঘটনার অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। জিডির বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হলে অপরাধ উল্লেখযোগ্যভাবে কমতে পারে বলে মনে করেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এএসএম শাহজাহান। তিনি বলেন, 'জিডির কাজই হলো, বিষয়টি নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে তদন্তে নামা। কিন্তু আমাদের দেশে দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর কেবল সহায়ক তথ্য হিসেবে কাজ করে জিডি।
' জানা গেছে, প্রতিদিনই রাজধানীর কোথাও না কোথাও হুমকির ঘটনা ঘটছে। সশরীরে, চিরকুটে, টেলিফোনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে হুমকি দিচ্ছে অপরাধীরা। শিক্ষক, ব্যবসায়ী, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, সাংস্কৃতিক কর্মী, চাকরিজীবী, শ্রমজীবী, রাজনৈতিক নেতাসহ নানা শ্রেণী-পেশার মানুষকে হুমকিতে পড়তে হচ্ছে। নিজেদের জানমালের নিরাপত্তায় পুলিশের সাহায্য পেতে জিডি করে থাকেন ভুক্তভোগীরা। এ ছাড়া মূল্যবান যে কোনো জিনিস যেমন- সনদপত্র, দলিল, লাইসেন্স, পাসপোর্ট, রসিদ, চেকবই, ক্রেডিট কার্ড, স্বর্ণালঙ্কার, নগদ অর্থ ইত্যাদি হারালেও থানায় জিডি করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও বাদীর অভিযোগ শুনতে তদন্ত কর্মকর্তাদের অনাগ্রহই জিডির তদন্ত না হওয়ার অন্যতম কারণ। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, জবাবদিহি না থাকায় এটি শুধু কাগুজে কার্যক্রমে পরিণত হয়েছে। ডিএমপির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শুধু রাজধানীর ৪৯ থানায় বছরে গড়ে প্রায় পাঁচ লাখ জিডি হয়। অনেক ভুক্তভোগীর অভিযোগ, জিডিতে বিপদ বরং বাড়ে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুলিশ কোনো খোঁজখবরই নেয় না।
উল্টো হয়রানির শিকার হতে হয়। আর তদন্ত শুরু করলেও তাতে অগ্রগতি থাকে না। এক্ষেত্রে পুলিশের সহযোগিতা না পেলেও যাদের বিরুদ্ধে জিডি করা হয়, তারা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। জানতে চাইলে ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন বিভাগের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান বলেন, 'জিডি করার মানে হচ্ছে, এ বিষয়ে তদন্ত করতে হবে। আমরা তদন্ত করি।
নির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে হাজার হাজার বিষয়ে হাজার হাজার জিডি হয়, এগুলোর হিসাব রাখা কঠিন। ' ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা যায়, রাজধানীর প্রায় ২৮ শতাংশ মানুষ জিডি করার জন্য 'স্পিড মানি' বা ঘুষ দেন। ঘুষ না দিলে জিডি তালিকাভুক্ত করা হয় না। এ ছাড়া নিম্নবর্গের বা স্বল্পশিক্ষিত মানুষ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জিডি করতে গিয়ে পুলিশের দুর্ব্যবহারের শিকার হন।
পুলিশ ও অন্যান্য সূত্রে জানা গেছে, জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে থানায় জিডির পর ঢাকা মহানগরীতে বেশ কয়েক ব্যক্তি খুন হয়েছেন। পল্লবীতে আবদুল কুদ্দুস নামে একজনকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়। এর আগে তার পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় জিডি করেও পুলিশের সহযোগিতা মেলেনি। চাঁদা না দেওয়ায় গত ৪ আগস্ট কাফরুলের শেওড়াপাড়ায় সন্ত্রাসীরা নূরুল ইসলাম (৪০) নামে এক ঝুট ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা করে। স্ত্রী ইয়াসমিন জানান, মৃত্যুর আগে তার স্বামী নিরাপত্তা চেয়ে থানায় জিডি করেন।
পুরান ঢাকার হাজী আহমদ হোসেন খুন হওয়ার আগে নিরাপত্তা চেয়ে জিডি করেছিলেন। জিডির কয়েক দিনের মধ্যেই সন্ত্রাসীরা তাকে গুলি করে হত্যা করে। কাফরুলের উত্তর ভাসানটেকে ওয়ালিউল্লাহ (৫০) নামে এক ফার্নিচার ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তিনিও সন্ত্রাসীদের হুমকিতে ভীত হয়ে জিডি করেছিলেন। পুরান ঢাকার স্বর্ণ ব্যবসায়ী প্রেমকৃষ্ণ থানায় জিডি করার পর সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহত হন।
সন্ত্রাসীরা তার কাছে ২০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছিল। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভিআইপি কেউ থানায় জিডি করলে পুলিশ সেগুলোর খোঁজখবর নেয়। তাদের নিরাপত্তায়ও ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কিন্তু সাধারণ নাগরিকদের ক্ষেত্রে পুলিশ একটি জিডি নম্বর দিয়েই দায়িত্ব শেষ করে। জিডির পর আবার অনেক ক্ষেত্রে তদবির করলে কাজ হয়।
তা না হলে থানায় জিডি পড়ে থাকে মাসের পর মাস। এসব কারণে সাধারণ মানুষ হুমকিতে পড়লেও থানা পুলিশের কাছে যেতে চান না। অনেক সময় তারা সন্ত্রাসীদের সঙ্গে আপস-মীমাংসা করতে বাধ্য হন। পুলিশের এই দায়িত্বহীনতার ক্ষেত্রে মাঝে মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে এর সংখ্যা খুবই কম।
মধ্যবাড্ডার সংযোগ সড়কে সম্প্রতি নিরাপত্তাকর্মী কবির হোসেনকে গুলি করে সন্ত্রাসীরা। কোয়ালিটি ফার্নিচার নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক সাইফুলের কাছে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা না পেয়ে সন্ত্রাসীরা এ ঘটনা ঘটায়। এই চাঁদা দাবি ও প্রাণনাশের হুমকির বিষয়ে সাইফুল আগে জিডি করলেও পুলিশ গুরুত্ব দেয়নি। এ ঘটনায় কর্তব্যে অবহেলার দায়ে বাড্ডা থানার এসআই মনিরুজ্জামান আকন্দের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।