আঞ্চলিক বাণিজ্যের কাঠামো উন্নয়নে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটান সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে পণ্য পরিবহনে সময়ক্ষেপণ হওয়ায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা আগ্রহই হারিয়ে ফেলছেন। দক্ষিণ এশিয়ার এই চার দেশের সীমান্ত বাণিজ্য নিয়ে নয়াদিলি্লভিত্তিক গবেষণা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড ইনফর্মেশন সিস্টেমের (আরআইএস) সাম্প্রতিক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সীমান্তে উপযুক্ত অবকাঠামো ও শুল্ক বিভাগে সমন্বয়ের অভাবও দীর্ঘসূত্রিতার কারণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। অবশ্য, ভারতের ক্ষেত্রেও একই ধরনের সমস্যা রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে। যদিও প্রতিবেদনে তা চিহ্নিত করা হয়নি।
সম্প্রতি দিলি্লতে বাণিজ্য মন্ত্রীদের সম্মেলনে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য বাড়াতে নানা পরিকল্পনা ও উদ্যোগের কথা জানানো হয়। এর আগে বাংলাদেশের পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার ঘোষণা করে ভারত। নেপাল-ভুটানের সঙ্গে ভারত ও বাংলাদেশের বাণিজ্য বিষয়ক কয়েক দফায় আলোচনাও হয়। সরকারগুলো সব বাধা উন্নয়নে নিজেদের মধ্যে প্রতিশ্রুত। তবে ব্যবসায়ীদের দীর্ঘসূত্রিতার একটি অভিযোগ ছিলই। এমন পরিস্থিতিতে নয়াদিলি্লর থিঙ্ক ট্যাংক আরআইএস বাস্তব পরিস্থিতির একটি অংশ তুলে বলেছে, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এক ঘণ্টার ৫৪ কিলোমিটার রাস্তায় যেতে সময় লাগে ২৯ দিন! উদাহরণ হিসেবে, নেপালের কাঁকড়ভিটা থেকে বাংলাদেশের ফুলবাড়ী পর্যন্ত ৫৪ কিলোমিটার করিডরের কথা বলা হয়েছে। এক ঘণ্টার এই রাস্তায় বাংলাদেশের তৈরি একটি 'ব্যাটারি' নিয়ে যেতে ট্রাকের ড্রাইভার ও কাস্টম এজেন্টের প্রয়োজন ৭৪টা ডকুমেন্ট (স্বাক্ষরিত কাগজ)। এর সঙ্গে লাগে নানা ধরনের কাগজের ফটোকপি। একবার যেতেই ট্রাকের ড্রাইভার ও কাস্টম এজেন্টকে সবমিলিয়ে ১৪ থেকে ১৫ জন কর্মকর্তার কাছে যেতে হয় পথেই। ফলে বাংলাদেশ থেকে একটা গাড়ির ব্যাটারি নেপালে রপ্তানি করতে গড়ে লেগে যাচ্ছে ২৯ দিনেরও বেশি। এতে খরচ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। অন্যদিকে, ভুটান থেকে বাংলাদেশের ফুড প্রোসেসিং ইন্ডাস্ট্রির জন্য কমলা নিয়ে আসা হয় বাংলাবান্ধা সীমান্ত দিয়ে। কিন্তু সেখানকার রাস্তা খারাপ, বিদ্যুৎ নেই, চার্জও অনেক বেশি। এ কারণে কাঁকড়ভিটা, ধুলাবাড়ী বা বাংলাবান্ধায় ট্রাকের ভেতরে পচতে থাকা কমলা নিয়ে গাড়ি চালকদের কাগজের ফাইল নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করতে দেখা যায়। আরআইএসের গবেষক ড. প্রবীর দে বলেছেন, এর মধ্যে ভারতের অংশে বেশি সময় লাগছে না, কিন্তু যেহেতু অন্য তিনটি দেশে রপ্তানি সংক্রান্ত প্রক্রিয়া ডিজিটাল হয়নি, তাই নথিপত্রের ঝামেলা থেকে যাচ্ছে। গবেষক বলেছেন, ভারত ছাড়া বাকি তিনটি দেশে এই সফটওয়্যার থাকলেও কম্পিউটার চালানোর মতো উপযুক্ত লোকবলের অভাব আছে। আর এই সমস্যাটা সবচেয়ে বেশি ভুটানে। বাংলাদেশে অবকাঠামো সংকট ছাড়াও রয়েছে ঢাকা ও চট্টগ্রামে কাস্টম হাউস এজেন্টদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব। বাংলাদেশে সার্বিকভাবে নিয়ন্ত্রণেরও অভাব আছে। তিনি নথিপত্রের পাশাপাশি দীর্ঘসূত্রিতার আরেকটি কারণ হিসেবে এলসি অ্যাকাউন্ট খুলতে দেরি হওয়াকে উল্লেখ করেছেন। গবেষক বলেছেন, অ্যাসিকোডা সফটওয়্যারের সাহায্যে আমদানি-রপ্তানির পুরো হিসাব রাখা যায়, যেখানে ফাইলপত্রের প্রয়োজনই হবে না এবং কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষণও সম্ভব হবে।
বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের অভিযোগ, প্রতিবেশী এই দেশগুলোর সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নিয়ে বাণিজ্য বাড়ানোর চেষ্টা চালানো হচ্ছে। কিন্তু দীর্ঘ দিনের এই পদ্ধতি নিয়ে রয়েছে সমস্যা। ডিজিটালাইজেশনের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া সত্ত্বেও তা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি বিভিন্ন আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায়। এ ছাড়া দুর্নীতির সুযোগ থাকায় কর্মকর্তারা যোগসাজশ করে ডিজিটাল পদ্ধতি এড়িয়ে চলেন। করিডরগুলোর এ সমস্যা সমাধানে সরকারের বিশেষায়িত পদক্ষেপের দাবি রপ্তানিকারকদের। তবে বাংলাদেশে যেসব সমস্যার কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে, ঠিক একই ধরনের সমস্যা ভারতেও রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। বাংলাদেশ-ভারত, ভুটান ও নেপালের ট্রানজিট নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন এমন এক কর্মকর্তা জানান, আরআইএসের গবেষক যে অভিযোগ করেছেন, সেটি ঠিক নয়। প্রকৃত অর্থে আখাউড়া ছাড়া বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের আর কোনো শুল্ক স্টেশন ডিজিটালাইজেশন হয়নি। সেখানে ভারতের কর্মকর্তারাও প্রচলিত পদ্ধতিতে শুল্ক ছাড়পত্রের কার্যক্রম চালান। এমনকি ভারতের উত্তরপূর্ব রাজ্যগুলোতে ব্যাংকিং সমস্যা বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। ব্যাংকগুলোতে প্রয়োজনীয় ফরেন এঙ্চেঞ্জ শাখা না থাকায় আমদানি-রপ্তানির সমস্যা হচ্ছে। এ ছাড়া উপযুক্ত শুল্ক কর্মকর্তার অভাবে রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রতিটি সীমান্ত বন্দরে পণ্য ছাড়ের জন্য উপযুক্ত শুল্ক কর্মকর্তা থাকেন। কিন্তু ভারতে শুধু পেট্রাপোল ছাড়া অন্য কোনো সীমান্ত বন্দরে শুল্ক কর্মকর্তা নেই। ফলে অন্যান্য বন্দরে দিনের পর দিন পণ্য আটকে থাকে। এতে উভয় দেশেরই আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হয়। এ সমস্যা সমাধানে অনুরোধের পর ভারতের শুল্ক স্টেশনগুলোর অবকাঠামো উন্নয়নে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। সে অনুযায়ী আখাউড়া স্থলবন্দর ডিজিটালাইজেশন সম্পন্ন হয়েছে। এ ছাড়া বেনাপোল স্থলবন্দরে এটি প্রক্রিয়াধীন।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।