আমি ছিলাম একটি ষাঁড় গরুর শরীরের সাথে আটকানো একটি চামড়া , সব লোকেরা তখন আমাকে গরুর চামড়া বলেই ডাকত । রাখাল প্রায় প্রতিদিনই এসে আমাকে চিমটি কেটে দেখত, আমি কি অবস্থায় আছি , পাতলা হয়েছি না মোটা ? মাঝে মধ্য সে আমাকে এমন ভাবে জোরে চিমটি কাটত যে আমার কষ্ট যন্ত্রনাতে গরু মহাশয় লাফালাফি আর ছোটাছুটি শুরু করে দিতেন । দিনে দিনে আমি ( চামড়া) গরুর সাথে বড় হতে লাগলাম, গরু বড় হলে আমিও বড় হই । কিছু দিনের ভিতরে ভালই বড় হলাম ইউরিয়া সারের প্রভাবে । সামনে আসছে কোরবানির ঈদ গরুর রাখাল প্রতিদিন এসে এখান আর চিমটি কেটে যায় না ।
দিনে ২/১ বার এসে হাত বুলাইয়া আদর করে যায় । মনে মনে আমি ভাবি এত আদর কেন আমার জন্য ? শুনলাম গরু নাকি বিক্রি করে দিবে হাটে নিয়ে কোরবানি ঈদ উপলক্ষে অন্য মানুষের কাছে । কি আর করার মনে মনে আমি সান্তুনা নিলাম গরুর যা হবে আমি (চামড়ারও) তাই হবে । সেদিন বিকালে দেখি আমার সামনে ৪/৫ জন লোক ঘুরাঘুরি করছে তারা আমাকে নিয়ে যাবে, তারা নাকি গরুর দালাল, কি আর করার গরুর সাথে তো আমার শরীরের যোগসূত্র আছে সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা তেই আটকানো ছিলাম গরুর সাথে । ঐ দিন আমার শরীরকে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে সাবাই গরুকে ট্রাকের উপরে উঠাল সাথে ছিল আরও ২/৩ টা গরু তাদের সিং গুল ছিল অনেক বড়বড় মানে ইন্ডিয়ান বইল আমাকে দেখা মাত্রিই তারা দিল কয়েকটা গুতা , আমার শরীর দিয়ে রক্ত বের হতে লাগল , চুপ করে কষ্ট সহ্য করে ঢাকার গাবতলি হাটে আসলাম যেই বেপারি গরু গুল কিনেছিলেন সে আমার কটা শরীরীরে নাপা ট্যাবলেট আর নেবানল পাউডার গুড় করে মেখে দিলেন।
আমার শরীর ৩ দিনে ভাল হতে থাকল । গরু বিক্রয় হয়ে গেল সাথে আমিও বিক্রয় হয়ে গেলাম। গরু কোরবানও হয়ে গেল ধার ছুরী দিয়ে আস্তে আস্তে আমাকে গরুর শরীর থেকে আলাদা করে দেয়া হল। গরুর শরীর থেকে আমাকে আলাদা করার জন্য যাই করা হল না কেন আমি অনেক ব্যথা অনুভব করেছি, এই রকম ব্যথা আমি আর কখন পাই নাই । জিবন আছে কিন্তু আমার গায়ে কোন শক্তি নেই ।
আমার সারা শরীর রক্তে মাখা সেই অবস্থায় এক কিনারাতে আমাকে ভাজ করে রাখা হল । মাঝে মাঝে কুকুর আসে আমাকে খেতে তাদেরকে আবার তাড়িয়ে দেওয়া হয় যাতে আমাকে না খেতে পারে। পাড়ার মাস্তানরা আসল আমাকে কম মূল্য কিনে নিয়ে যেতে তাদের পকেটে ছিল পিস্তল আর হাতে ছিল লোহার পাইপ । আমার দাম তখন শুনেছিলাম ২ হাজার টাকা কিন্তু অস্ত্রের মুখে আমার দাম ধরা হয় তখন মাত্র পাচশত টাকা । আমাকে নিয়ে যাওয়া হল ভেনগাড়িতে করে কোন এক ট্যানারিতে , ট্যানারির লোকজন আমাকে দেখা মাত্র আমার শরীররে লবন লাগিয়ে দিল যাতে করে আমি আরো কিছুদিন বেঁচে থাকতে পারি ।
লবণ লাগানর পর আমার শরীরে আমি শান্তি অনুভব করতে লাগলাম । কিন্তু আমার শরীর দিয়ে দূরগন্থ ছড়াতে লাগল , সবার মুখে কাপড় কিন্তু আমার করার কিছুই করার নাই । সেদিন ছিল আমর জিবনের শেষ দিন । টেনে হিঁচড়ে আমাকে বিভিন্ন মেডিসিন দিয়ে ধোয়ার পর সেদ্ধ করা হয় এবং আমি সাথেসাথে মৃত্যুর কোলে ঢুলে পরি । মৃত্যুর পর তারা আমার পুরো শরীর শক্ত করে ফেলে এবং আমাকে অধিক মূল্যে বাটা কোম্পানইর কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়।
তারা আমার মৃত দেহকে নানা ভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখল যে , আমাকে দিয়ে কি বানানো যেতে পারে জুতা না ব্যাগ না বেল্ট । অবশেষে তারা সিধান্ত নেয় যে আমাকে দিয়ে তারা জুতা বানাবে আমি তৈরি হয়ে গেলাম জুতোতে আর আমার নামের ও পরিবর্তন হয়ে গেল জুততে । আমাকে দিসপ্লে করা হল বাটার শোরুমে সারাদিন আমাকে সাবাই নারেচারে আবার পায়ে পরেও দেখে কিন্তু আমাকে কেও নেয় না কারান আমি দিসপ্ল্রতে থাকি । দিনে দিনে আমি দোকানে থেকেই পুরাতন হতে থাকি । আমি এতটাই পুরোন হলাম আমার যে দাম সেই দামে কেউ আর আমাকে কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করে না ।
এ জন্য আমাকে রিজেক্ত মাল হিসেবে গোডাউনে আরও অন্যান্য জুতার সাথে বস্তাবন্ধি করে হল । এরপর , কিছুদিন পরে আমাকে ৬০% ডিসকাউন্তে মার্কেট এ ছেরে দেয়া হল । আমি বিক্রয় হয়ে গেলাম ভার্সিটি পড়ুয়া এক ছাত্রের কাছে । আমি তার পায়ে চড়তে থাকলাম , সে আমাকে টয়লেট , বাজার , ভার্সিটি সব জায়গাতে পায়ে করে নিয়ে যায় । ভালই আমার দিন কাটতে লাগল , বছর ঘুরে আবার ইদ এসে পরলো।
সবাই পাড়ি জামালো দেশের বাড়ির দিকে , আমিও আমার মনিবের সাথে রওনা দিলাম তার গ্রামের বাড়ি জাওয়ার জন্য । মনিব আমাকে রেখে আরাম করে চেয়ার এ বসল হঠাৎ করে এক চোর এসে আমাকে নিয়ে যায় এবং সাথে সাথে সেই চোর আমাকে সদর ঘাট নিয়ে বিক্রি করে দেয় । আমার নামে তখন অমূল পরিবর্তন আসে সবাই আমাকে বলতে থাকে চোরাই জুতা । আমি তখন মনে মনে হাসলাম আর বলাম আমাকে যে চুরি করল তার নামের কিছু হল না কিন্তু আমার নাম হয়ে গেল চোরাই জুতা । সদর ঘাট লঞ্চ এসে ভিড়ল শত শত মানুষ নামছে আমি দেখছি তাদেরকে, কেও কেও আবার আমাকে দেখছে ।
সবাই আমাকে দেখতে দেখতে হঠাৎ আমি বিক্রি হয়ে যাই এক মুরব্বির কাছে , কত টাকা বিক্রয় হয়েছি সেটা সবার অজানাই থাক , মুরিব্বি আমকে পেয়ে খুব খুশি কম দামে একটা বাটার জুত তার হয়েছে । মুরুব্বি আমাকে নিয়ে মসজিদে জেতেন ওজু করতেন , দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পরতেন , জার ফলে দিনে পাঁচ বার মুরব্বি ওজু করতেন ফলে আমার গোসল ও হয়ে যেত । সে দিন ছিল ৫ মে , মুরব্বি প্রতিদিনের মত ফজরের নামাজ পড়ে আমাকে নিয়ে হাটা দিলেন মতিঝিলের শাপলা চত্তরে । সেই শাপলা চত্তরে অনেক মানুষ । সারদিন দেখতে দেখতে আমার দিন কেটে গেল ।
রাতের সোডিয়াম আলোতেও আমি সবকিছু পর্যবেক্ষণ করতে ছিলাম আর মনে করছিলাম কখন মুরব্বির সাথে বাড়ি যাব । ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করে রাস্তার লাইট গুল বন্ধ হয়ে গেল আকাশ লাল হয়ে গেল । চারদিকে ছুটাছুটি আশেপাশের অলিতে গলিতে সবাই ছুটছে জিবন রক্ষা করতে । আমরা প্রান রক্ষার তো কোন দারকার নাই কারন আমিতো আগে থেকেই মৃত । আমি নিজের চোখে দেখেছি কি ভাবে একজন মানুষ আরেক জন মানুষকে হত্যা করে ।
কি ভাবে সস্ত্র বাহিনি নিরস্র মানুষের অপর হামলা আর গুলি চালায়ে । তারা সাবাই ত ঈদের আনন্দ একসাথে ভাগ করে নেয়, একই কাতারে নামাজ পরে, এক সূর্যর আলো তে বেড়ে উঠে, সবার পায়ের তালুওত সমান। আমি এবার ভাবছি একজন মানুষ আরেক জন মানুষকে কি করে হত্যা হত্যা পারে । বনের পশু পাখিও তাদের জাত ভাই কে হত্যা করে না কিন্তু মানুষতো আরও সভ্য আধুনিক, কেন তারা একজন আরেক জনকে মারছে ? এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মুরব্বি আমাকে নিয়ে পিচ ঢালা রাস্তায় পড়ে গেলেন । আমাকে পায়ে নিয়েই সে পড়ে রইলেন আশেপাশে আরও অনেক লোক তারা লাশ হয়ে পড়ে রইলেন পিচ ঢালা রাস্তার পাশে ।
রাতের আঁধারে আমি ডাস্টবিনের ময়লা হয়ে যাই। সিটি করপরেশনের গাড়িতে করে আমামে মুরব্বির সাথে মাটি চাপা দেয়া হয় । আমার মৃত্যুর পর আমার হয় জিবন অবসান । আমার জিবন অবসানের একটাই সার্থকতা আমি একজন মানুষের সাথে আমার জিবন অবসান ঘটাতে পেরেছি ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।