আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিদায়ের আগে

লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই,তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ। (http://www.ishakkhan.blogspot.com)


সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকা খুব নিরীহ একটি কাজ বলে মনে হলেও আসলে ভয়ংকর। কারণ, একের পর এক চিন্তাভাবনা এসে ভর করতে থাকে।

চিন্তাগুলোর বেশীরভাগই কাজের নয়, অকাজের। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ জুড়ে থাকে হতাশা, ভয়, কুচিন্তা ইত্যাদি। সমাধান? একটাও না। আক্ষেপ? অনেক, অনেক এবং অনেক। ঘুরন্ত পাখার ব্লেড থেকে যেন চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়তে থাকে আক্ষেপ, আর কুৎসিত সব বিষয়গুলো।




ম্যা’ম, আম্মুকে একটু দেখে আসি?
একটু আগেই না দেখে এলে?
আমার ভয় লাগছে, ম্যা’ম!
আচ্ছা, যাও। যাবে আর আসবে। এতবার তোমার আম্মুকে দেখে আসতে হয় কেন?

ছেলেটা বেরিয়ে যায়, ক্লাস থেকে। ওর আম্মুকে দেখে আসবে।

আমরা আনন্দ শ্রেণীতে পড়ি।

ছেলেটা আমাদের সাথে ছ’মাস ধরে ক্লাস করছে, তারপরও মা-ন্যাওটা স্বভাবটা একেবারেই ছাড়তে পারে নি। একটু পর পর ওর আম্মুকে দেখে আসতে হয়। যেতে না দিলে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে। ওর আম্মু দাঁড়িয়ে থাকেন ক্লাস থেকে একটু দূরে। ওর সবকিছুতেই ওর আম্মু, স্কুলে নিয়ে আসেন, ছুটি হলে নিয়ে যান, খাইয়ে দেন, কাপড় পরিয়ে দেন, বাড়ির কাজগুলোও বোধহয় করে দেন।

স্কুলের পুরো সময়টা ক্লাসের বাইরেই তাঁকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, যাতে ছেলে ভয় না পায়। একবার দশ মিনিটের জন্য কোথাও গেছিলেন, ছেলে পা ছড়িয়ে আকাশ ফাটিয়ে কেঁদেছিল।
ছেলেটা বোকা, ভারী বোকা। আমরা রোজ ওকে ক্ষেপাই, কী, তোমার আম্মু ন্যাপি বদলে দিয়েছেন তো?

শুনে বোকা ছেলেটা কাঁদে। আমরা মজা পাই, হা হা করে হেসে গড়িয়ে পড়ি।



ছেলেটা ওর আম্মুকে দেখে ফিরতেই ম্যামের বকা উপেক্ষা করে আমরা ভেংচি কাটতে লেগে যাই, আম্মু! আম্মু! ম্যা’ম, আ-ম-মু-কে দে-কে আ-তি?

ছেলেটা কাঁদো কাঁদো মুখ করে বসে পড়ে এক কোণে।


আজ মনে হচ্ছে, বড্ড বাড়াবাড়ি করেছি ওর সাথে। এতটা না করলেও তো চলত। আমি যদি ওর মতই বোকা হতাম, আর দশ মিনিটের জন্য আমার মা চোখের আড়াল হতেই যদি ভীষণ ভয় কিংবা কান্না পেত, আর যদি সবাই আমাকে ওভাবে মুখ ভ্যাংচাত, তাহলে কেমন লাগতো?



কার ফোন?
কেউ না, একটা বন্ধু।
ও আচ্ছা।


আমি বইয়ের পাতায় মন দেয়ার ভান করি।

স্ত্রী একটু অন্য ঘরে যেতেই আমি পড়িমরি করে গিয়ে ফোনটা হাতে তুলে নিই। আঁতিপাঁতি করে খুঁজতে হয় না, এইমাত্র কার কাছ থেকে ফোন এসেছিল স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এই তো। হুম, ওর বান্ধবী বলেই মনে হচ্ছে।

ভাগ্যিস কোন অচেনা পুরুষের নম্বর নয়।


এই কাজটা করেছি স্ত্রীর সাথে। দিনের পর দিন গোয়েন্দাগিরি। ওর অগোচরে ওর ফোনের কললিস্ট ঘেঁটেছি। রাত্তিরে সে ঘুমিয়ে পড়লে সন্তর্পণে উঠে ওর ডায়রি ঘেঁটেছি।

এমনকি আলমারির গোপন কুঠুরিগুলোতে আপত্তিকর ছবি, চিরকুট কিংবা এমন কিছু লুকিয়ে রেখেছে কীনা, তা-ও খুঁজতে বাকি রাখি নি। সে যখন ইন্টারনেটে কারো সাথে চ্যাট করছে, পা টিপে টিপে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছি প্রেমালাপ চলছে কীনা দেখতে।

অথচ সামনে কেমন করতাম? সোনামানিক, তোমাকে কি আমি সন্দেহ করতে পারি? সন্দেহ করে ছোটলোকেরা। আমার মন কিন্তু খুব উদার, সন্দেহের বীজ সেখানে কখনো উপ্ত হয় না। সংকীর্ণমনাদের মত আমি সবকিছুতে প্রশ্নবোধক জুড়ে দিই না!

নিজেকেই যে গাল দিয়ে যাচ্ছি, মাথাতেই আসে নি!



মুচকি হেসে বোকা মেয়েটা আমাকে সবসময় বিশ্বাস করে গেছে।

কোনোদিন টের পায় নি, আমি সবসময় খুঁজে বেড়াচ্ছি ওর জীবনে এমন কিছু আছে কীনা, যাতে বিন্দুমাত্র আপত্তি করা চলে, যেগুলো নিয়ে ওকে চেপে ধরা যায়, যেগুলো নিয়ে কটু কথা বলে ওর দম বন্ধ করে দেয়া যায়। ওকে হাতের মুঠোয় রাখার জন্য কি মরিয়াই না ছিলাম আমি!

আমার স্ত্রী একইসাথে ভালো ছিল, এবং সরল, যাকে সোজা বাংলায় বলে “বোকা”। এমন কিছু নেই, যা আমার সাথে শেয়ার করে নি, সুখের হোক কিংবা দুঃখের। শেয়ার না করলেও অবশ্য ক্ষতি ছিল না, আমি সব ঘেঁটে বের করে নিতাম।

বোকা মেয়েরা নিশ্চয়ই স্ত্রী হিসেবে খুবই ভালো হয়, নইলে এত বছর গোয়েন্দাগিরি করলাম অথচ সংসার কি দিব্যি চলল!

সে অবশ্য আমার ওপর কখনো নজরদারি করে নি।

জোর করে নিজের কাছে আমাকে আটকে রাখতেও চায় নি। মুক্ত পরিবেশে ওর ওপর গুপ্তচরগিরি করে গেছি।

সবচেয়ে সুখের ব্যাপার, আমার ডায়রি কোনোদিন সে ঘাঁটে নি। নইলে সে ঠিকই জিজ্ঞেস করত, “......” মেয়েটা কে? ওকে একা পেয়ে তুমি জড়িয়ে ধরেছিলে কেন? কেনই বা সে তীব্র ঘৃণা আর ভয় নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল? তোমরা পুরুষেরা এত লোভী কেন?

আমার মত মানুষেরা কখনো ধরা পড়ে না, দিব্যি সবার ওপর ছড়ি ঘুরিয়ে যায়! কিন্তু আজ একটু একটু মনে হচ্ছে, বিশ্বাসের, পবিত্রতার, প্রেমের এ সম্পর্কটা এভাবে তিক্ত না করলেও চলত। এতটা নিচে না নামলেও পারতাম।

সবাইকে অবিশ্বাস করা চলে, তাই বলে জীবনসঙ্গিনীকে? একটু হলেও (!) সীমা ছাড়ানো হয়েছে বৈকি।



আমি আর আমার স্ত্রী হাসিমুখে তাকিয়ে আছি ছবিটার দিকে। খোকার ছবি।

গ্র্যাজুয়েশনের দিন ছবিটা তোলা হয়েছিল। খোকার পরনে কালো গাউন, মাথায় মর্টার বোর্ড।

কি দৃঢ় চোখে তাকিয়ে আছে। হাতে শক্ত করে ধরা লাল ফিতে দিয়ে বাঁধা সার্টিফিকেট।

একটু খেয়াল করলেই দেখা যায়, ওর চোখ দুটোতে মিশে আছে গভীর বিষাদ।
সে যে অন্য কিছু হতে চেয়েছিল। আমার গোঁ, আমার চাওয়া পূরণ করতে ওকে যে এ পথে যেতে হয়েছে।

আজ সে যে পেশায় আছে, তা তো নিজের ইচ্ছেয় নয়, ওর পিতা যাতে গর্ব করে আর দশজনকে বলতে পারে যে সন্তান তাঁর আশা পূর্ণ করেছে, সেজন্য। কোনোদিন সে মাথা উঁচু করে বলতে পারবে না, খুশি মনে বুকে আঙুল রেখে বন্ধুর সাথে একটু গর্ব করতে পারবে না, এই দ্যাখ্‌, অন্য কারো চাওয়ায় নয়, আমি নিজের চাওয়ায় এতদূর এসেছি।

মনে মনে সে কি সারাজীবন আমাকে দোষ দিয়ে যাবে না? একবার হলেও কি এ চিন্তা আসবে না, কেন আমি বাবার পথে হাঁটলাম, কেন নিজের পথে নয়? কেন নিজের আনন্দময় স্বপ্নগুলো এক পাকাচুলো বুড়োর জন্য বিসর্জন দিলাম? কেন আমাকে ঘাড় গুঁজে অন্য কারো ইচ্ছে পূরণের খেসারত দিয়ে যেতে হবে?

আরও ভয়ংকর ব্যাপার, আমি নিজে তো যা পাই নি, তার সবটুকু নির্দয়ের মত মেটাতে চেয়েছি আমাদের খোকাকে দিয়ে, কারো দিকে তাকাই নি, জিজ্ঞাসা করার অবকাশ দিই নি যে সে কী চায়। খোকা যদি এর শোধ নেয় ওর সন্তানের ওপর? ঠিক আমার মতই ওর যত অপূর্ণতা, তার সব মেটাতে যদি ওর সন্তানের ওপর চড়াও হয়, চাপিয়ে দেয় অপরিসীম ভার? আমি কি এক মহাপাপের ধারা শুরু করেছি? যে মহাপাপ চলতে থাকবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে?

দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবি, ঠিক হয় নি, একেবারেই ঠিক হয় নি।


এমন সময় দরজায় ছায়া পড়ে।

ঐ তো, এসে গেছেন তিনি।

ভদ্রলোককে (?) চেনার প্রয়োজন নেই। কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে এসেছেন, কাজেই তাঁর উদ্দেশ্য স্পষ্ট বোঝা যায়। আমাকে নিতে এসেছেন তিনি, এবার যেতে হবে। তাঁর সাথে যেতে হবে।

ফেরাবার উপায় নেই, কাজেই আপত্তি করা নিরর্থক। এবার সিলিং থেকে পাকাপাকিভাবে চোখ নামাতে হয়।


মাত্র দু’মিনিটে সুদীর্ঘ জীবনের পথ পরিক্রমার সব তুচ্ছতা, মালিন্য, ক্লেদ, পাপ, ভুল, অসম্পূর্ণতা, অসামঞ্জস্যতা নিয়ে ভাবা, আর সেগুলোর অন্তত কয়েকটি শুধরে নেয়া কিংবা মুছে ফেলার সাধ বোধহয় মৃত্যুশয্যায় যাবার আগে কারো হয় না।


আমি কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা লোকটির দিকে হাত বাড়িয়ে দিই। বলি, চলুন।




(২০ অক্টোবর, ২০১৩)



অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।