আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও প্রশ্নবিদ্ধ সিডিএ

চট্টগ্রাম মহানগরীর অধিকাংশ পাকা দালান নির্মাণে (নির্মিত ও নির্মাণাধীন) চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) অনুমোদন রয়েছে। অনুরূপ অনুমোদন পত্র প্রাপ্তিতে সহায়তা প্রদানের জন্য রয়েছে বিশাল সংঘবদ্ধ অভিজ্ঞ জনগোষ্ঠী। সিডিএ এলাকাভুক্ত যেকোন জমিতে দালান নির্মাণে সিডিএ অফিস থেকে নকশা অনুমোদন বাধ্যতামূলক। “Building Construction Act 1952” থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক “চট্টগ্রাম মহানগর ইমারত (নির্মাণ, উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও অপসারণ) বিধিমালা ২০০৮” পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বেশ কয়েকটি বিধিমালা জারীকরণের মাধ্যমে চট্টগ্রামের নির্দিষ্ট এলাকার জনগণের নিকট থেকে দালান নির্মাণ খাতে সরকারীভাবে নির্দিষ্ট পরিমাণ তহবিল সংগ্রহের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এরই পাশাপাশি সিডিএ এবং বেসরকারী সংস্থায় কর্মরত কিছু সংখ্যক অসাধু প্রকৌশলীকে সুযোগ দেওয়া হয়েছে নকশা প্রণয়ন, নকশা অনুমোদন ও নকশা অনুযায়ী দালান নির্মাণ নিশ্চিতকরণের নামে জনসাধারণকে ঠকিয়ে, ধমকিয়ে, প্রতারণার মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করার জন্যে।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঐ কাগুজে অনুমোদনপত্র জমি-মালিকের ব্যাংক-লোন সংগ্রহ, সিডিএ এর লোকজনের ধমকানি প্রতিরোধ ইত্যাদি ব্যাপার ছাড়া অন্য কোন কাজে আসে না। অপরদিকে, অনুমোদিত নকশা সংগ্রহকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে নকশা-বহির্ভূতভাবে দালান নির্মাণে উৎসাহিত করা হয়। ফলশ্রুতিতে সৃষ্টি হচ্ছে আলো-বাতাসহীন, ঘুট-ঘুটে, দমবন্ধ হওয়া নগরী, সংকুচিত হচ্ছে চলাচল ব্যবস্থা ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা। নগরীতে ক্রমবর্ধমান যানজট সমস্যা ও জলাবদ্ধতার পিছনেও প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে এই অসাধু চক্র। নিজেদের পকেট ভারী করে এসব দুর্নীতিবাজ লোকেরাই আমাদের প্রিয় শহরকে পরিণত করছে ইট-বালি-সিমেন্ট-রডের জঞ্জালে।



দালান নির্মাণের নকশা অনুমোদন ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট সিডিএ এবং বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে অভিযোগের ভিত্তি হিসেবে নিম্নোক্ত তথ্যাবলী সবিনয়ে উল্লেখ করা হল।

২০০৮ এর পূর্ববর্তী কথা বাদ দিয়ে “চট্টগ্রাম মহানগর ইমারত (নির্মাণ, উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও অপসারণ) বিধিমালা ২০০৮” অনুযায়ী সিডিএ এলাকাধীন যেকোন দালান নির্মাণের জন্য নকশা প্রণয়ন করবেন সিডিএ-এর নিবন্ধনকৃত যোগ্য পুরপ্রকৌশলী অথবা প্রকৌশলী-সংস্থা। ঐ নকশা বাস্তবসম্মত কিনা তা যাচাইবাছাই করবেন সিডিএ-এর অথারাইজড অফিসার ও তার সহকারীবৃন্দ, তারাও প্রকৌশলী। অনুমোদনের পর নকশা অনুযায়ী কাজ সম্পাদনের দায়িত্ব পালন করবেন সিডিএ-এর নিবন্ধনকৃত কোন পুরপ্রকৌশলী; যিনি কাজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি স্তরের অগ্রগতি প্রতিবেদন নির্দিষ্ট ছকে পেশ করবেন। উল্লেখ্য, প্রতিটি স্তরের কাজ শেষে সরেজমিনে যাচাই করে পরবর্তী স্তরে অগ্রসর হওয়ার জন্য অনুমতি দিবেন সিডিএ-এর পদাধিকারী প্রকৌশলীগণ।

দালানের নির্মাণকাজ শেষে পুর-প্রকৌশল, যান্ত্রিক-প্রকৌশল, তড়িৎ-প্রকৌশল, অগ্নিনির্বাপণ ও নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা এই মর্মে প্রত্যয়ন করবেন যে, নির্মিত দালানটি অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী হয়েছে এবং ব্যবহারের উপযুক্ত। ঐ প্রত্যয়নপত্র পাওয়ার পর সরেজমিনে পরিদর্শন শেষে সিডিএ-এর অথারাইজড অফিসার ৪০৩ নং ফরমে ব্যবহার-সনদপত্র ইস্যু করবেন অথবা কাজে ত্রুটি থাকলে ৪০৪ নং ফরমে সংশ্লিষ্ট ভবন ব্যবহারের আবেদন প্রত্যাখ্যান করবেন। ইমারত নির্মাণের নকশা প্রণয়ন থেকে অনুমোদনান্তে নির্মিত ভবনের নির্মাণকাজের প্রতিধাপে সিডিএ এবং মালিকপক্ষের প্রকৌশলীর (সিডিএ-নিবন্ধিত) নিবিড় তদারকীতে নির্মিত ভবনে কোনপ্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতির অবকাশ নেই। এ অবস্থায় যদি কোন ত্রুটি চিহ্নিত হয়, তবে তার দায় প্রকৌশলীরা এড়াতে পারেন না।

সহজবোধ্য সরল বাংলা ভাষায় প্রণীত “চট্টগ্রাম মহানগর ইমারত (নির্মাণ, উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও অপসারণ) বিধিমালা ২০০৮” পুস্তকাকারে (বাংলাদেশ গেজেট, অতিরিক্ত, অক্টোবর ৮, ২০০৮ ইং, পৃষ্ঠা ৫৯৮৯ থেকে পৃষ্ঠা ৬১১৬) ২০০ টাকার বিনিময়ে সিডিএ ভবনের নীচ তলায় পূবালী ব্যাংকে পাওয়া যায়।

এই গেজেট অনুযায়ী অক্টোবর ২০০৮ থেকে পরবর্তী সময়ে সিডিএ আওতাধীন এলাকায় নির্মিত এবং নির্মাণাধীন সব ইমারত সিডিএ-এর নিয়ন্ত্রণে সন্তোষজনকভাবে নির্মিত হয়েছে এবং হচ্ছে বলে আশা করা যায়। কোন ব্যত্যয় ঘটলে সিডিএ তার প্রতিকার করবে- সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমরা সে দাবী রাখতেই পারি।

বাস্তবে কি ঘটছে? এক দালান থেকে অপর দালানের দূরত্ব উচ্চতাভেদে ন্যূনতম কত থাকতে হয়, সংশ্লিষ্ট রাস্তা থেকে ন্যূনতম কত দূরত্বে দালানটি দাঁড়ানো উচিত, তা’ সাধারণ জনগণ প্রত্যেকের জানা থাকার কথা নয়। কিন্তু সিডিএ-এর কর্মকর্তা/কর্মচারীরা তো দেখেই বুঝতে পারেন। সিডিএ-এর রেওয়াজ হল, কোন অভিযোগ না আসলে ওসব দেখা হবে না, যদি অভিযোগ আসে তবে দালাল মারফত অভিযোগকারীকে যেকোন প্রকারে নিবৃত করা হবে।

তাই যদি না হয়, দালানের পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে দালান হচ্ছে কিভাবে? রাস্তার নালা ঘেঁষে ভবন উঠছে কিভাবে? কার অবহেলায় ও প্ররোচনায় এই অনিয়ম? দায়িত্ব বর্তাবে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীর দিকে। কেননা বিধি অনুযায়ী তাদের একপক্ষ এই দায়িত্ব পালনের জন্য সরকারী তহবিল থেকে বেতন নিচ্ছেন এবং অন্যপক্ষ দালান মালিকের কাছ থেকে সম্মানী নিচ্ছেন।
বলা হয়ে থাকে, জমির মালিক/মালিক-প্রতিষ্ঠান সিডিএ-এর আইন অমান্য করে অনুমোদিত নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে দালান নির্মাণ করেছেন বা করছেন। তাই যদি হয়, তবে আমরা ধরে নিতে পারি সিডিএ সরকারী বিধিমালা বাস্তবায়নে অক্ষম অথবা অবহেলা করছে। নকশার ব্যত্যয় হওয়ায় নির্মাণ কাজ স্থগিত হয়েছে অথবা নির্মাণ কাজে সংশোধনী আনা হয়েছে এমন নজির নেই, যদি না কেউ অভিযোগ করে থাকে।

আরো বলা হয়ে থাকে, ওপর তলা থেকে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের কারণে ইমারত নির্মাণ বিধিমালার অধিকাংশই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। যদি তাই হয়, তবে সিডিএ-এর কর্মকর্তা/কর্মচারীদের প্রতি আহ্বান রইল, “সততার দাবীতে চাকরীতে ইস্তফা দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন; জনগণ আপনাদের পাশে থাকবে। পেশাজীবিদের নিজের পেশায় দক্ষতা থাকলে হালাল রোজগারের সুযোগ সবসময়ই আছে। ”

এটা সত্যিই অভাবনীয় ব্যাপার যে, সিডিএ-এর বর্তমান চেয়ারম্যান কোন প্রকৌশলী নন। রাজনৈতিক পরিচিতি উল্লেখ না করে বলা যায়, একজন প্রশাসক হিসেবে তাঁর দক্ষতা ও সদিচ্ছার যথেষ্ঠ প্রমাণ তিনি রেখেছেন।

কিন্তু তিনি একা কত করবেন? দশচক্রে ভগবান ভূত!

প্রতিভাবান ও সৎমনোভাবাপন্ন কিছু প্রকৌশলীর প্রতি সম্মান রেখে সিডিএ-সংশ্লিষ্ট কিছু অসাধু বা অযোগ্য প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে এই বর্ণিত অভিযোগ বাস্তব চিত্রের প্রেক্ষাপটে উপস্থাপিত; কারো প্রতি ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে নয়। তবুও কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অভিযোগের সত্যতা নিয়ে চ্যালেঞ্জ করলে নমুনা হিসেবে কিছু দালিলিক প্রমাণ রয়েছে। সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞ ও উচ্চপদস্থ প্রকৌশলীবৃন্দের প্রতি সবিনয় নিবেদন, আপনারা সমাজের বিবেক, আশা-ভরসার অন্যতম অবস্থান। জনগণ শত সীমাবদ্ধতার মাঝেও আপনাদের কাছ থেকেই সমাধান কামনা করে। শুভস্য শীঘ্রম।



মূল লেখকঃ ইঞ্জিনিয়ার এ.টি.এম. নাজির এবং এডভোকেট সাখাওয়াত হোসাইন চৌধুরী
অনুলিখনেঃ আবীর চৌধুরী।

সোর্স: http://prothom-aloblog.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.