ক্লিন'স অল্টারনেটিভ ওয়ার্ল্ড
সপ্তাহান্ত ঘরে শুয়ে বসে কাটানো যায়, আবার আড্ডা গল্পে পার্টিতেও যোগ দিতে বাধা নেই। অনেকটাই যেমন খুশি তেমন কাটুক দিন এবং রাত।
কিন্তু শুক্রবার থেকেই পরিকল্পনা ছিলো এ সপ্তাহের শনি এবং রবিবার নিয়ে। শনিবারের দিনটা পরিকল্পনা ছাড়িয়ে অপরিকল্পনায় গিয়ে বেশ ভালোভাবে কাটলো।
সকাল শুরু হলো অক্সফোর্ড এক্সামিনেশন স্কুলে ফেন্সিং দেখা দিয়ে।
আমাদের এক বন্ধু অক্সফোর্ডের হয়ে কেমব্রিজ টিমের বিপক্ষে খেলছে। সুতরাং আরো কয়েকজন মিলে গেলাম। ১০৭ তম বার্ষিক ম্যাচ ছিলো এটি। শত বছরের পুরনো প্রতিযোগিতা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এবার আমরা হারলাম।
খুব কষ্ট লাগলো মনে। অক্সফোর্ড কেম্ব্রিজ অনেকটা ভারত-পাকিস্তানের মতো বিষয়। এক দেশ আরেক দেশের কাছে হারতে চায় না।
এ বছর শুনলাম আরো কয়েকটা খেলায় কেম্ব্রিজের কাছে ধরাশায়ী হচ্ছে অক্সফোর্ড। সামনে অবশ্য রোয়িং আছে।
ওটাই এখন মান রক্ষার বড় ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যাইহোক, খেলা দেখতে দেখতেই পরিকল্পনা হলো কোথাও দুপুরের খাবার খেয়ে পোর্ট মেডোতে হাঁটতে যাবার। আমরা চারজনের দল। পরে আরো দুজন যোগ দেবে।
পোর্ট মেডো হচ্ছে একটু নিচু বিশাল খোলা জায়গা- অক্সফোর্ড এর শহরকেন্দ্র ছাড়িয়ে অল্প একটু হাঁটলেই ওখানে পৌঁছে যাওয়া যায়।
নদীর পাড় ঘেষে সবুজ প্রান্তর- দুর্বাঢাকা। ওখানে বিকেলে কারো হাত ধরে হেঁটে আসা যায়, পিকনিক করা করা যায়, অথবা সাইকেলে করে বেড়িয়ে আসা যায়। আর সন্ধ্যার আগে আগে গেলে নদীতে সুর্য়াস্ত দেখার সুযোগ থাকে।
এসবই অবশ্য গ্রীষ্মের বর্ণনা। এখন এখানে বসন্ত শুরু হয়েছে।
সপ্তাহ কয়েক আগে যে বন্যা হয়েছিলো তার পানি এখনো নামে নি পুরোটা। তাই নিচু পোর্ট মেডো এখন বিরাট জলাভূমি। সুদীর্ঘ লেকের মতো মনে হয়। আমরা গেলাম পাঁচ জন। এই রূপটাও অনেক ভালো লাগলো।
নদীর পাড় জেগে উঠেছে। সে শুকনো তটরেখা ধরে আমরা ঘণ্টা দেড়েক হাটলাম। অনেক মানুষই আবার যাওয়া শুরু করেছে ওখানে।
আজ চমৎকার রোদ ছিলো। সে রোদে আর বাতাসে মাতাল করার মতো পরিপ্বার্শ।
ওখানে একটা পাব আছে- 'দ্য পার্চ' নামে। সম্ভবত সপ্তাহ খানেক হলো বন্যার পানি থেকে জেগে উঠেছে। ওটা খোলা। আমরা সেখানে গেলাম। গিয়ে ইনডিয়ান কয়েক বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে গেলো।
গত বছর খানেকের অক্সফোর্ড জীবনের এই এক প্রাপ্তি- যেখানেই যাই পরিচিত কাউকে না কাউকে পেয়ে যাই।
আমাদের কেউ নিলো চা, কেউ একটু ভারি কিছু। আমি মধ্যম- ফ্রেঞ্চ ফ্রাই। কাটলো আরো ঘণ্টা খানেক ওখানে। তারপর ফিরলাম বাসায়।
আমার এক জার্মান বন্ধু তার এক বন্ধুকে অক্সফোর্ড দেখাচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে অক্সফোর্ড ইউনিয়নের একটা বিতর্কে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করে দিতে হলো। এমনিতে বিতর্কে যেতে প্রবেশ ফি আছে। কিন্তু আজ খুব কম লোক থাকায় তারা টাকা নিলো না। বিতর্কের বিষয়- আর্ট ইন এমপাওয়ারমেন্ট।
নারী দিবস উপলক্ষ্যে কয়েকজন নারী পরিচালক কে নিয়ে একটা ছোট্ট আলোচনা আয়োজন।
অক্সফোর্ড ইউনিয়নে বসে থাকতে থাকতে দেখা হলো অক্সফোর্ড-কেম্ব্রিজ বায়োটেক রাউন্ডটেবল (ওবিআর) নামে একটি সংগঠনের সভাপতির সাথে। ওর সাথে আগে দেখা হয়েছিলো আরেকটা অনুষ্ঠানে। বাংলাদেশে ওবিআর-এর একটা চ্যাপ্টার খোলার বিষয়ে কথা বলেছিলাম। সেটা নিয়ে এগুনো হয় নি।
আজ দেখা হওয়ায় ও আবার সেটা মনে করিয়ে দিলো।
ওর সাথে কথা বলছিলো আরো একটা ছেলে। বিদায় নিচ্ছি বলে ওর দিকেও হাত বাড়ালাম। ও ওর নাম বললো- হাকোন।
আমি বললাম-
তুমি কি অক্সফোর্ড ইন্সপায়ার এর প্রোগ্রামে এসেছো?
- হ্যা
-লন্ডন থেকে?
- হ্যা।
তোমার তো আজ রাতে আমার রুমে থাকার কথা। বললাম আমি।
এই অভাবনীয় সাক্ষাতে দুজনেই বেশ অবাক হলাম। বিষয়টা হচ্ছে-
অক্সফোর্ড ইন্সপায়ার সংগঠনটি একট সম্মেলনের আয়োজন করেছে। অক্সফোডর্ের বাইরে থেকে যারা এসেছে তাদের কাউকে কাউকে তারা আগ্রহী শিক্ষার্থীদের রুমে এক রাত থাকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে।
আমি একজনকে অতিথি হিসেবে নিতে রাজী হয়েছিলাম। হাকোন হচ্ছে আমার অতিথি।
কিন্তু সন্ধ্যায় ও মেসেজ করে জানিয়েছিলো যে ও রাতে অক্সফোর্ডে থাকবে না। একটা বিশেষ কারণে লন্ডনে চলে যেতে হচ্ছে।
সেই হাকোন-এর সাথে সম্পুর্ণ কাকতালীয়ভাবে দেখা হয়ে গেলো।
যাই হোক, দুজনেরই বিস্ময় কাটলো কথায় কথায়। ওর সাথে আলাপ শেষ করে গেলাম বিতর্কের অনুষ্ঠানে। আমার থাকার ইচ্ছা ছিলো না। কিন্তু আলোচনা শুনতে শুনতে থেকেই গেলাম। তারা সংঘর্ষপ্রবন দেশগুলোতে নারীদের নিয়ে সিনেমা তৈরির অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছিলেন।
তারা সবাই ভীষণ নারীবাদী। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে তারা সবাই আফগানিস্তান বা কঙ্গোতে নারীদের সমস্যা সমাধানে পশ্চিম যে ব্যবস্থা নিচ্ছে তার সমালোচনা করলেন। তারা বললেন- এখানে বসে আমরা যা ভাবি, মাঠের চিত্র তার চেয়ে ভিন্ন। তাই বেশিরভাগ টাকাই গচ্ছা যাচ্ছে। সমস্যার গোড়া ঠিক রেখে মাথা ভালো করার চেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য।
একটু পরে খেয়াল করে দেখলাম পুরো রুমে আমি একাই ছেলে। ভয় কাটিয়ে শেষের দিকে আমি কিছু প্রশ্ন আর মন্তব্যে অংশ নিলাম।
ওখান থেকে বের হয়ে আবার হাকোন এর সাথে দেখা। কালও ও আবার আসবে। হয়তো দেখা হতে পারে।
আমার বন্ধূদের নিয়ে গেলাম কলেজে। সেখানে একটা বপ ছিলো। থিম হচ্ছে একসিডেন্ট এন্ড ইমারজেন্সি। অর্থাত এখানে রোগী, ডাক্তার, নার্স হিসেবে ড্রেস আপ করে আসতে হবে। এধরনের বপে অবশ্য নার্সরাই বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করে।
তার কারণ বিস্তারিত করার দরকার নেই। আজও যারা নার্স হিসেবে আসলো তারাই অন্যদের বেশি কুপোকাত করলো।
আমি ভিতরে ঢুকলাম না। আমার বন্ধুদের থেকে বিদায় নিয়ে গেটে কিছুক্ষণ হেল্প করলাম অন্যদের। রাত তখন সাড়ে দশটা।
তখনো অনেকে আসছে। এন্ট্রি ফি পাচ পাউন্ড। কিন্তু ভিতরে ঢোকার পর যত খুশি পানীয় পানের সুবিধা আছে। সে কারণে সপ্তাহান্তের রাত হিসেবে এটা বড় কোন বিষয় না এখানকার শিক্ষার্থীদের কাছে।
সোয়া এগারোটায় বের হয়ে কলেজে একটা চাবি জমা দিয়ে সাইকেলে চড়লাম বাসায় ফেরার জন্য।
মাথার উপরে স্বচ্ছ কাচের মতো আকাশ। অর্ধেক চাঁদ সেখানে ঝলমল করছে। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে অতীব্র জোছনায় আকন্ঠ হয়ে বাসায় ফিরলাম। ঘরে ঢোকার আগে আবার তাকালাম আকাশের দিকে।
একটা প্লেন উড়ে যাবার আলোর রেখা চোখে পড়লো।
মাস খানেক পরে ওরকম একটা আলোর রেখা ধরে আমি ফিরবো সত্যিকার ঘরে। সে আনন্দটা এখনই বড্ড বড় করে উছলে উঠলো মনে।
উইনচেস্টার রোড
অক্সফোর্ড
১০.০৩.১৪
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।