'যাত্রা' এই শব্দটির সঙ্গে বাঙালির দীর্ঘকাল ব্যাপ্ত শিকড় বিস্তারী সংস্কৃতির আনন্দ-বেদনার সম্পর্ক রয়েছে। বাঙালি জাতির হাজার বছরের শিল্পভাবনার পথ-পরিক্রমায় অযুত চিত্রকল্প হয়ে আজও টিকে আছে 'যাত্রা'। কিন্তু তারপরও কালের এবং শিল্পবিদ্বেষী পরাক্রমী মানুষের দেওয়া ক্ষতচিহ্ন স্থায়ী হয়ে গেছে যাত্রার শরীরে। তবু দেখি উদ্ভবের পর থেকে আজ অবধি 'যাত্রা' ছুটে চলেছে সময়ের প্রতিবন্ধকতা এড়িয়ে নানান বাঁক-বাঁকান্তর পেরিয়ে অজানা গন্তব্যের অভিমুখে। কিন্তু কোথায় সেই গন্তব্য? এই প্রশ্নটির উত্তর খুঁজে পেলেই বর্তমান যাত্রাশিল্প সংকট অনুধাবন করা সহজ হবে। একইসঙ্গে এ কথাটিও ভাবতে হবে যে, গন্তব্য যার থাকে তার একটি আরম্ভও থাকে। আরম্ভের কালটা প্রাচীন হতে পারে আবার অর্বাচীন হতে পারে। তবে কি 'যাত্রা' বাঙালির নাট্য অভিযাত্রার সমান বয়সী? 'যাত্রা' কি তবে বাঙালির শিল্পতীর্থভূমে অভিগমনের আদিকারের শিল্প আঙ্গিকের পঙ্ক্তিভুক্ত? এই দুটো প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতবেধ সূচিত হয়েছে। কিন্তু শিল্পরসপিপাসুর কাছে তারিখ, সাল ও কাল বিচারের চেয়ে যাত্রার বিষয় ও ভাব-রসের মধ্যে কেমন-তার মধুচক্র তৈরি হয়েছে তা-ই মূল বিবেচনার বিষয়। ইতিহাস বিচারে দেখা যায় যাত্রার গড়ন-গঠনের সময় থেকেই এর শিল্পীরা ধুপের মতো নিজেদের পুড়িয়ে শিল্পসুগন্ধ বিলিয়েছেন বাংলার জনপদে। কিন্তু সেই সুগন্ধধুপের ধূম্ররেখায় অাঁকা কি হয়েছে তাদের রেখাচিত্র? হয়নি। কারণ শাসকের রক্তচক্ষু কখনই 'যাত্রা'কে স্বস্তি দেয়নি। সে কথা একালের বাংলাদেশেও সমান সত্য। আজ যাত্রার উপেক্ষিত রূপটি দেখে মনে হয় যে বন্ধুর শিল্প-পথের সেই নিবেদিতপ্রাণ পথিকরা পঙ্ক্তিচ্যুত হয়েছেন সমাজ ও রাষ্ট্রের অনাদরে অবহেলায়। অথচ যাত্রার উদ্ভবকালের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, শুভ শিল্পবাসনা থেকে মানুষের চিত্তে নির্মল আনন্দের জাগরণী গান শোনানোর জন্যই যাত্রার জন্ম হয়েছিল। আর যারা এই যাত্রার পদে-পায়োরে-সুরে-সংলাপে এ দেশের মাটি ও মানুষের অন্তরলীন সুরের নিবিড়লীন ঐক্যতান তৈরি করেছিলেন তাদের কষ্ট ও বঞ্চনার মধ্যেই লুকিয়ে আছে যাত্রার অন্তর্গত সংকটের স্বরূপ। একসময় বাংলাদেশের জনপদ ও মানুষকে উদ্বেলিত করেছে যে 'যাত্রা' এর শরীরে কালের ক্ষতচিহ্ন কেন অঙ্কিত হয়েছে তারও সূত্র অনুসন্ধান জরুরি।
আমরা প্রায়শই ঔপনিবেশিক মানসিকতাপুষ্ট ও সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিজাত শিল্প বিচারের মাপকাঠিতে মেপে ঐতিহ্যবাহী যাত্রাশিল্প ও শিল্পীদের লোকনাটক এবং লোকশিল্পীর তকমা এঁটে দিয়েছি। পাশ্চাত্য নন্দনতত্ত্বের শিক্ষা অনুযায়ী আমরা বাঙালির নাট্য পরিবেশনার মধ্যে ধ্রুপদী শিল্পশৈলী বিদ্যমান কিনা তার পরিমাপ করতে চেয়েছি। কিন্তু একবারও আমরা ভাবিনি যে সমগ্র জাতির অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে আছে যে শিল্প তা পাশ্চাত্যের শিক্ষা অনুযায়ী লৌকিক নয়, তা বাঙালির নিজস্ব নন্দন ভাবনার বিচারে ধ্রুপদী মানোচ্চতায় আসীন। বাঙালির ঐতিহ্যবাহী নাট্যধারায় এই 'যাত্রা' প্রাচীন কি অর্বাচীন তা জানার চেয়ে জরুরি হলো 'যাত্রা' কেমনতর আনন্দ-আস্বাদনের স্বাদ এনে দিয়েছিল বাংলার গ্রামীণ জনপদের মানুষদের। জনগণের চিত্তে আনন্দের জোগান দেওয়ার বাসনা থেকেই বাঙালির শিল্প ইতিহাসে যোগ হয়েছিল এই ঐতিহ্যবাহী নাট্যধারা 'যাত্রা'। কিন্তু অভিজাত ও অনভিজাত এবং আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক সংকটে নিপতিত এই গণমাধ্যমটি ক্রমাগত বিষয়-বৈচিত্র্যহীন এবং উপেক্ষিত নাট্য আঙ্গিক হয়েই থাকল। যাত্রার এই ক্রমাগত পরিণামহীন ও শিরোনামহীন হয়ে ওঠার পেছনে সমাজ এবং রাষ্ট্রের উপেক্ষার ক্ষেত্রগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে।
বাংলাদেশের যাত্রার সামগ্রিক অবক্ষয়, সংকট ও বিকাশের পথে অন্তরায় হিসেবে কাজ করেছে রাষ্ট্রের আনুকূল্যহীনতা, ঔপনিবেশিক মানসিকতা, শিল্পে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির অনুপ্রবেশ, গ্রামীণ জীবনে অর্থনৈতিক অবক্ষয় এবং সমাজের লেখাপড়া জানা মানুষদের 'যাত্রা' সম্পর্কে অনীহা। ফলে সমাজচ্যুত এবং উপেক্ষিত একটি ঘেরাটোপে বন্দী হয়ে গেছে 'যাত্রা' এবং যাত্রাশিল্পীরা। রাষ্ট্র সেখানে সহযোগিতার হাত বাড়ায় না, সমাজ যেখানে সহমর্মিতার অভয়বাণী শোনায় না, 'যাত্রা' কীভাবে সেই বৃত্তের ভেতরে সবল হয়ে টিকে থাকতে পারে? তাই রাষ্ট্র, সমাজ এবং সময়ের প্রেক্ষাপটে যাত্রাশিল্পের সংকট পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। সংকট আর ব্যক্তিক পর্যায়ে না থেকে যাত্রার সমগ্র সত্তার ভেতরে প্রবিষ্ট হয়েছে ধীরে ধীরে।
এই সমাজ, অর্থনীতি এবং মানসিকতার সংকটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শিল্পশৈলী ও নাট্য বিষয়ের সংকট। যাত্রার উদ্ভব ও বিকাশকালে খোলা মঞ্চে নিরাভরণ অভিনয়ে শিল্পী যে দৃশ্যকল্প তৈরি করে দর্শকের মনের শূন্যস্থানগুলো পূরণ করেছেন তার বদলে আধুনিকতার নামে অপসংস্কৃতির হাওয়া লেগে যাত্রার চরিত্রধর্ম বদলে গেছে। এই পরিবর্তনের সঙ্গে না শিল্পীরা একাত্দ হতে পেরেছেন, না অসীম সাহসে পরিহার করতে পেরেছেন। এর ফলে ঐতিহ্যবাহী যাত্রাভিনয়ের সঙ্গে, যাত্রাশিল্পীর শিল্পবোধের সঙ্গে কিংবা দর্শকের অভিরুচির সঙ্গে সংঘাত তৈরি হয়ে যায়। বাংলাদেশের 'যাত্রা' পেশাদারী শিল্প মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে নানারকম ঝুঁকির মুখে পড়েছে। পেশাদার অভিনেতা-অভিনেত্রী হিসেবে যখনই শিল্পীরা এই পেশায় আসেন তখন তাদের সামনে তিনটি সমস্যা তীব্রভাবে দেখা দেয়। প্রথমত, ব্রিটিশকালের নেতিবাচক কালাকানুন দ্বারা পরিচালিত 'যাত্রা' শিল্পের সঙ্গে পেশাদার অভিনেতা-অভিনেত্রীর স্বার্থ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত কিনা। দ্বিতীয়, যে টাকায় চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন তার পুরোটা শিল্পীর হাতে আসবে কিনা। তৃতীয়ত, সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকবে কিনা। এ ছাড়াও 'যাত্রা' মালিকদের মধ্যে কাজ করে অনিশ্চয়তা ও সংশয়। লেখক : শিক্ষাবিদ
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।