আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যাত্রাশিল্পের সম্ভাবনা**

দেবতার মনোতুষ্টির জন্য বৈদিককালে দেবতার সামনে নৃত্যগীত পরিবেশিত হতো। তার প্রমাণ মেলে পৌরাণিক যুগে দেবতার স্নান উপলক্ষে শোভাযাত্রায়। ওই শোভাযাত্রায় পরিবেশিত হতো নাচ, গান অথবা বিভিন্ন ক্রীড়ানৈপুণ্য। বাংলার শৈব ও সূর্যপূজা সূর্যের দক্ষিণ দিকে যাত্রা শুরুর মুহূর্ত থেকে অনুষ্ঠিত হতো। সূর্যোৎসবের প্রচলন করেন এ অঞ্চলে ভ্রমণকারী নর্ত্তক সম্প্রদায়। সূর্যোৎসব আজও পূর্বভারত এবং বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান উৎসব হিসেবে বিবেচিত। শৈব উৎসব থেকে নাট্য এবং যাত্রার উৎপত্তি। ষোড়শ শতকে প্রথম অভিনয় অর্থে 'যাত্রা' শব্দের প্রমাণ মেলে। এ যাত্রা শুরু হতো শ্রীকৃষ্ণের রথযাত্রার পর থেকে দুর্গাপূজার সপ্তমীর দিন পর্যন্ত। এ সময় পালা রচনা এবং মহড়া অনুষ্ঠিত হতো। ধারণা করা হয়, প্রাথমিক পর্যায়ের লোকাভিনয় নাট্য ও যাত্রা সৃষ্টির প্রধান উপাদান। জনমনে ধর্মের চিরন্তন আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য রসাত্দক সংগীতভিত্তিক যাত্রা অভিনীত হতো।

প্রাচীন নাট্যধারায় দুই ধরনের নাটকের সন্ধান পাওয়া যায়, যার একটি মঞ্চস্থ হতো উন্মুক্ত মঞ্চে অন্যটি প্রেক্ষাগৃহে। বিভিন্ন সময় এর শিল্পরীতি পরিবর্তিত হলেও যাত্রা বাংলার ঐতিহ্য হিসেবে আজও রয়ে গেছে জনপদের মুক্ত মঞ্চে। বাংলাদেশের যাত্রায় নৃত্যগীতি পরিবেশনাসহ অভিনয় প্রদর্শন-এর প্রধান উপাদান। যাত্রা একেবারেই দেশীয় শিল্পমাধ্যম। কেবল বাংলা এবং উড়িয়া ভাষায় এর প্রচলন রয়েছে। যাত্রার আরেক নাম পালাগান। এতে নাচ এবং গান অপরিহার্য। মঞ্চ চারদিক খোলা থাকে। অন্যদিকে থিয়েটার বা নাটক পৃথিবীর সকল ভাষায় হয়। এর মঞ্চ একদিকে উন্মুক্ত থাকে। এখানে আলোর ব্যবহারসহ দৃশ্যের বর্ণনার সুযোগ রয়েছে। তাছাড়া নাটকে নাচ অনিবার্য নয়। আর যাত্রাপালার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে_ . দৃশ্যপটহীনতা, খ. অভিনয় নৈপুণ্যের ওপর গুরুত্ব প্রদান এবং দর্শক ও অভিনেতাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সানি্নধ্য সংরক্ষণ, গ. চরিত্রের একটি বক্তব্যের এক অংশ সংলাপে এবং অন্য অংশ গানে পরিবেশন করা হয়, ঘ. যাত্রার রূপক চরিত্রে বিবেকের উপস্থিতি, ঙ. নাচের উপস্থাপন এবং বহু রসের অবতারণা। যাত্রার কাহিনী হিসেবে রামায়ণ, মহাভারত ও অন্যান্য ধর্মীয় পুরাণ ছিল সাধারণ জনমনের প্রধান আকর্ষণ। সংলাপের রীতি জাঁকালো অভিনেতার বাগভঙ্গিতে কৃত্রিমতা দৃশ্যমান। কৃষ্ণযাত্রা কিংবা কালীয়দমনে নাচসহ অতিনাটকীয় প্রবণতা লক্ষণীয়। যাত্রা উপস্থাপনায় গীতিবাক্য এবং মীড়প্রধান কাব্যগীতির প্রভাব কমে গিয়ে নাগরিক জীবনের গানের যোগ ঘটে। যাত্রা প্রচলিত ঝুমুর, পাঁচালি অঙ্গের গানের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ, আসাম অঞ্চলে জনপ্রিয় 'দোহার' কিংবা 'দোহা'র প্রভাবমুক্ত হয়। বিশ শতকের গোড়ার দিকে পালা পরিবেশনকালে কল্পনাত্দক অভিনবত্বে সংযোজিত হয় 'বিবেক' চরিত্র। বিবেক চরিত্র মূলত ভালো বা মন্দের প্রতীক। উনিশ শতকে যাত্রাপালায় কবিগানের মতোই দোহারের কণ্ঠে গান এবং অভিনয়াংশের প্রাধান্য বাড়ে। আর টপ্পা বা গীতাভিনয়েও যাত্রার চরিত্র অভিনয়ের অনুপ্রবেশ নজরে পড়ে। যাত্রার মূূল অভিনয় শুরু হওয়ার আগে কিছু প্রাথমিক কৃত্যাদি সম্পন্ন হয়। যাত্রা অত্যন্ত শক্তিশালী শিল্পমাধ্যম। এর পরিবেশনকালে জনমানুষের অংশগ্রহণ থাকে সর্বাধিক, সুতরাং মানুষের সাংস্কৃতিক সচেতনতা বাড়াতে যাত্রার বিকল্প নেই। সিনেমা হলের মতো ব্যক্তিমালিকানাধীন যাত্রামঞ্চ নির্মাণ, টেলিভিশন চ্যানেলে যাত্রানুষ্ঠান প্রচার, সরকারি অনুদান, শিল্পীদের উৎসাহিত করতে সম্মাননা জানাতে হবে। যাত্রার নামে অশ্লীলতা বন্ধ করতে হবে। তবেই যাত্রাশিল্প অনেকদূর এগিয়ে যাবে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.