ষোড়শ শতকে অভিনয়-কলা হিসেবে যাত্রার উদ্ভব হলেও এর বিকাশ শুরু হয় অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে। যাত্রার উৎপত্তি যেমন থিয়েটার তথা নাটকের আগে, যাত্রার বিকাশও তেমনি নাটকের আগেই শুরু হয়েছে। তাই নাটকের আলোচনা করতে গেলে যাত্রার প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়া ঐতিহ্যকে অস্বীকার করার পর্যায়ে পড়ে। কিন্তু নির্মম বাস্তবতা এই যে, আমাদের দেশে নাটককেন্দ্রিক আলোচনার যাত্রার উপস্থিতি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। যাত্রাওয়ালা কৃষ্ণকমল গোস্বামী (১৮১০-১৮৮৮) যাত্রার ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে ব্রতী হন। ১৮৬০ সালে তার রচিত 'স্বপ্নবিলাস' ও 'দিব্যোন্মাদ' পালার মাধ্যমে যাত্রা নতুন প্রাণ পায়। তৎকালীন পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডেই ছিল তার পালা পরিবেশনের অঞ্চল। তার রচিত পালা দুটি ১৮৭২ ও ১৮৭৩ সালে ঢাকা থেকেই গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। কৃষ্ণকমলের যাত্রাপালাই যাত্রা সাহিত্যের প্রথম মুদ্রিত দলিল। এরপর ১৮৭৪ সালে প্রকাশিত হয় তার 'বিচিত্রবিলাস' যাত্রাপালা। এই তিনটি পালা নিয়ে গবেষণা করে নিশিকান্ত চট্টোপাধ্যায় পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৮৬০ সালকে তাই আধুনিক যাত্রার আনুষ্ঠানিক অভিযাত্রার মাহেন্দ্রক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এ সময়ের আরেকটি যাত্রার কথা জানা যায় হৃদয়নাথ মজুমদার নামে ঢাকার এক আইনজীবীর স্মৃতিকথা থেকে। গবেষক মুনতাসীর মামুন এই স্মৃতিকথা থেকে তথ্য নিয়ে জানিয়েছেন যে, যাত্রার জন্য ঢাকা ছিল বিখ্যাত। 'সীতার বনবাস' হলো ঢাকার প্রথম যাত্রা। তারপর একরামপুর থেকে 'স্বপ্নবিলাস' নামে একটি যাত্রা মঞ্চস্থ হলো। এই যাত্রা শহরে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। 'স্বপ্নবিলাস'-এর সাফল্যের পর একরামপুর থেকে পরপর মঞ্চস্থ হলো 'রাই-উন্মাদিনী' ও 'বিচিত্রবিলাস'। নবাবপুরের বাবুদের তখন বেশ নামডাক। যাত্রা প্রতিযোগিতায় তারাও পিছিয়ে থাকতে চাইলেন না। তাদের উদ্যোগে মঞ্চস্থ হলো 'ধনকুণ্ডু' 'নৌকাকুণ্ডু' এবং 'ব্রাহ্মের গীতা'। কিন্তু এর কোনোটাই জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি। ঢাকার শেষ এমেচার যাত্রা 'কোকিল সংবাদ'। সুভাড্যার কয়েকজন ভদ্রলোক মিলে এর আয়োজন করেন।
হৃদয়নাথ মজুমদার 'সীতার বনবাস'কে ঢাকার প্রথম যাত্রা অভিহিত করেছেন। বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক, গবেষক ও রাজনীতিবিদ সত্যেন সেন (১৯০৭-১৯৮১) একে নাটক হিসেবে অভিহিত করেছেন এবং তা 'স্বপ্নবিলাস'-এর আগে অভিনীত হয়েছিল বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। তিনি 'সীতার বনবাস'কে উনিশ শতকের শেষ ভাগে পরিবেশিত নাটক হিসেবে মনে করেছেন। কিন্তু এটি যদি 'স্বপ্নবিলাস'-এর আগে অভিনীত হয় তাহলে এর অভিনয়কাল ১৮৬০ সালের আগে হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ এ সময়ে কৃষ্ণকমল গোস্বামীর 'স্বপ্নবিলাস' নামের যাত্রাপালা রচিত ও অভিনীত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাছাড়া 'সীতার বনবাস' থিয়েটার মঞ্চে অভিনেয় নাটক মনে না করে যাত্রামঞ্চে অভিনেয় পালা মনে করাই সঙ্গত। কারণ এটি প্রত্যন্ত গ্রামের খোলা মঞ্চে অর্থাৎ যাত্রামঞ্চে অভিনীত হওয়ার উপযোগী।
বাঙালি সমাজ, ভাষা ও সাহিত্যের অগ্রণী পুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১) এই 'সীতার বনবাস'-এর কাহিনীকার হিসেবে যাত্রার ইতিহাসেও স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। ১৮৬৪ সালে অন্নদাপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'শকুন্তলা গীতাভিনয়' রচিত ও অভিনীত হয়। হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায় এটিই প্রথম বাংলা গীতাভিনয়। ঢাকায় এ সময় নবাবপুরের বাবুদের সঙ্গে রেষারেষির রেশ ধরে সূত্রাপুর ও একরামপুরের বাবুরা মৈষুণ্ডির গোবিন্দ চক্রবর্তীর লেখা 'নারদ সম্বাদ' বা 'প্রভাসলীলা' পালা মঞ্চস্থ করেছিল। এরপর রামকুমার বসাকের পালা ধনকুণ্ড, 'নৌকাকুণ্ড', 'ব্রহ্মার গীত' এবং গোবিন্দ চক্রবর্তীর অপর পালা 'কুণ্ডেশ্বরীর মিলন'ও তেমন জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারেনি। ঢাকায় কৃষ্ণকমলের যাত্রাপালার আরও সংবাদ জানা যায় আলেকজান্ডার ফর্বেস সম্পাদিত দ্য বেঙ্গল টাইমস পত্রিকার চিঠিপত্র কলামে। ১৮৮৭ সালে লেখা 'থিয়েট্রিক্যাল' শিরোনামের এই চিঠিতে প্রায় ১২ বছর আগের অর্থাৎ ১৮৭৫ সালে অনুষ্ঠিত কৃষ্ণকমলের যাত্রাপালার উল্লেখ রয়েছে। ১৮৮৩ সালে ঢাকার ব্রাহ্মসমাজের আবাসিক এলাকা হিসেবে পরিচিত বিধানপল্লীতে অর্থাৎ বর্তমানে নিমতলীর কাছাকাছি কোনো স্থানে 'ধারাতলে স্বর্গধাম' নামে একটি যাত্রাপালার আয়োজন হয়। অভিনয়ের সমস্ত আয়োজন হয়। সোমবার দুইশত টিকিট বিক্রয় হয় এবং রাত ১টার সময় অভিনয় আরম্ভ হয়। ১৯১০ সালে ঢাকায় 'অক্ষয়বাবু' নামের এক ব্যক্তি একটি যাত্রাদল খোলেন। এই দল 'অক্ষয়বাবুর দল' নামে পরিচিতি পায়। ১৯২৪ সালে ফরিদপুরে জীবনবাবু নামের এক ব্যক্তির বাড়িতে যাত্রার দল এসেছিল। তারা 'কালাপাহাড়' বা 'ধর্মবিপ্লব' পালার অভিনয় করে সুনাম অর্জন করে। ফরিদপুরের ওই পালার সফল মঞ্চায়নের সংবাদে প্রাণিত হয়ে ১৯২৫ সালে ঢাকার ফরাশগঞ্জে সৌখিন যাত্রার এই পালা মঞ্চায়ন করে বলে জানা যায়। ফরাশগঞ্জে বৈরাগীটোলা পাড়ায় হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের লোকই সম্প্রীতির সঙ্গে বাস করত। একইসঙ্গে তারা পাড়ার যাত্রায় বা নাটকে অভিনয় করত। 'কালাপাহাড়' বা 'ধর্মবিপ্লব' পালাকে সত্যেন সেন নাটক বলেছেন। এটি আসলে যাত্রাপালা। ঐতিহাসিক এই পালার রচয়িতার নাম চয়ে পাগলা। মুসলমানদের মধ্যে তিনি প্রথম পালা রচনার প্রবৃত্ত হন এবং প্রথম মুসলিম পালাকার হিসেবে স্বীকৃত হন। এটি বিশের দশকের একটি জনপ্রিয় পালা। পেশাদার দল ছাড়াও সৌখিন দলে এই পালা অভিনীত হয়। ১৯৯৩ সালে 'দেশ অপেরা' (মিলনকান্তি দে, ঢাকা) জন্ম নেয়। 'দেশ অপেরা' মূলত ঢাকাকেন্দ্রিক পরিবেশনার মধ্যে তার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখে। 'বিদ্রোহী নজরুল', 'এই দেশ এই মাটি' প্রভৃতি পালার মাধ্যমে অধিকারী অভিনেতা নির্দেশক সংগঠক মিলনকান্তি দে নাগরিক জীবনে যাত্রাকে পেঁৗছে দেওয়ার গুরুদায়িত্ব পালন করে চলছেন। ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আরও যাত্রাদল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। যাত্রানুষ্ঠানের খবর সংবাদপত্রের পাতায় নিয়মিত গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হয় না। একসময় সাপ্তাহিক 'চিত্রালী', সাপ্তাহিক 'সিনেমা', সাপ্তাহিক 'পূর্বাণী' ও মাসিক 'ঝিনুক' পত্রিকায় নিয়মিত যাত্রার সংবাদ ছাপা হতো। মাত্র দুই-তিনজন যাত্রার লোকই এ সকল পত্রিকায় সংবাদ ও প্রতিবেদন রচনা করত। তাই তাদের পছন্দের দলগুলোর কথাই বারবার এসেছে ওই সকল পত্রিকায়। কোনো কোনো দলের খবর কখনই পত্রিকায় ছাপা হয়নি। দলমালিকরা তাদের কর্মকাণ্ডের দলিলপত্রও সংরক্ষণ করেন না। তাই যাত্রাদলের ক্রমবিকাশের ইতিহাস পুঙ্খানু ও পূর্ণাঙ্গ করা সম্ভবপর নয়। সামাজিক ও রাষ্ট্রিক নানান প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশে এখনো যাত্রাদল টিকে আছে এবং নতুন দলের জন্ম হচ্ছে (এটি নিঃসন্দেহে স্বকীয় ঐতিহ্যের প্রতি সাধারণ মানুষের চিরন্তন আকর্ষণের স্বাভাবিক প্রতিফল।
লেখক : কবি, সাংবাদিক ও ফোকলোরবিদ
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।