সাগরের ঢেউ একটা মিলিয়ে যাওয়ার আগেই আরেকটা আছড়ে পড়ে তার উপরে। সেটা মিলিয়ে যাওয়ার আগে আরেকটা। অনিঃশেষ এই ঢেউ ভাঙার খেলা দেখতে ভালো লাগে, যদি সময় এবং মন ভালো থাকে। কিন্তু উচ্চ জলোচ্ছ্বাস ভালো লাগে না কারোরই। আজকাল সকালে দৈনিক পত্রিকা পড়তে বসলে এই উপমাটাই মনে আসছে। রোজ ভাবি, আগামী দিনে কিছু ভালো খবর থাকবে, যা দেখে একটু শান্ত হবে মন। কখনো তেমন হয় না তা নয়। কিন্তু প্রায় সপ্তাহখানেক ধরে যে খবরগুলো পড়ছি, তাতে দম আটকে যাচ্ছে।
সব তো বলা যাবে না, কয়েকটার কথা বলতে চাই। প্রথমেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩-১৪টি হল দখলের ঘটনা নিয়ে দুঃখ এবং ক্ষোভ প্রকাশ করছি। মাস্টারি করে জীবন কাটালাম তো! তাই গায়ে লাগে ছাত্রদের বঞ্চনার ব্যাপার। খবরটা প্রথমে দেখি টিভি প্রতিবেদনে। তারপর তো পত্রপত্রিকা সয়লাব হল দখলের বয়ানি লেখালেখিতে। দু-চার মাস বা দু-চার বছর নয়, দুই যুগ ধরে প্রভাবশালী ও পুলিশের দ্বারা বেদখলে আছে অন্তত ১০টি হল (বাংলাদেশ প্রতিদিন ২৬-০২-১৪)। জাল দলিলের মাধ্যমে চলছে বেআইনি ভোগদখল। জমিদার কিশোরী লাল রায় চৌধুরী ১৮৮৭ সালে জগন্নাথ স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের সম্পত্তির একাধিক বাড়ি শিক্ষার্থীদের বসবাসের জন্য দান করেন। ১৯৮৫ সালের আগ পর্যন্ত, মানে প্রায় একশ বছর ওই সব আবাসন জগন্নাথ কলেজের শিক্ষার্থীরাই ব্যবহার করত। এরশাদের সময় ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় স্থানীয় প্রভাবশালীদের। তখন কলেজ প্রশাসনের দুর্বল সমঝোতার কারণে আবাসনগুলো দখল করে নেয় স্থানীয় লোক এবং ভূমিদস্যুরা। সে তো আদিকালের বদ্যি কথা। তারপর আর সুবিচার কিছু হয়নি বা হলগুলো জবরদখলদারদের হাত থেকে উদ্ধার করা হয়নি। ভাবাই যায় না বিষয়টি।
হলগুলোর সবই পুরান ঢাকায়। পাটুয়াটুলীর তিব্বত হল এবং ওয়াইজঘাট এলাকায় কুমারটুলির হল দুটি শুধু বেদখল নয়, পুলিশ এবং স্থানীয় এমপি তা এখন নিজেদের সম্পদ বলে দাবি করছে। হাজী মোহাম্মদ সেলিম সেখানে 'সিটি শপিং কমপ্লেঙ্' গড়ে তোলে। দিব্যি চলছে বাণিজ্য। কত রাজা এলো, কত রাজা গেল, পুলিশ আর এমপির দখল থেকেই গেল।
পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারের ৮২ নম্বর রাধিকা বসাক লেনে শহীদ সাহাবুদ্দীন হল। ২০১০ সালের ২১ জানুয়ারি জেলা প্রশাসক এক চিঠিতে এ হলের দখলদার হিসেবে ফারহানা গংয়ের নাম উল্লেখ করেন। পুলিশ সদস্যরা দখল নিয়ে আগে থেকেই সেখানে বাস করত। কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতা আমিনুল হক বিপ্লব ওই হলের দখল নিয়ে সেখানে পাঁচতলা ভবন গড়ে তোলেন।
আরমানিটোলার বটতলায় এসি রায় রোডে প্রায় ২৬ কাঠা জমির ওপর অবস্থিত আবদুর রহমান হল। ১৯৯০ সালের পর থেকে সেখানে ১৭ পুলিশ সদস্যের পরিবার বাস করছে। এটিকে দীর্ঘমেয়াদি ইজারা দেওয়ার জন্য ২০১০ সালে ভূমি মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানায় বিশ্ব প্রশাসন। আরমানিটোলার মাহুতটুলি এলাকায় ৪০ কাঠা জমির ওপর অবস্থিত শহীদ আনোয়ার শফিক হল। জেলা প্রশাসক এই হলকে সমসী ওয়েলফেয়ার হিসেবে চিহ্নিত করেন। তারপর হলটি ভেঙে এক অংশে গোডাউন বানিয়েছেন এক ব্যবসায়ী। আর এক অংশে বসানো হয়েছে ন্যাশনাল ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক (বাবুবাজার শাখা)। গায়ে লাগা কিছু ওষুধের দোকান।
১৫, ১৭ ও ২০ নম্বর যদুনাথ বসাক লেনে প্রায় ২৩ কাঠা জমির ওপর সাইদুর রহমান ও রউফ মজুমদার হল। এখানে গড়ে তোলা হয়েছে রিকশার গ্যারেজ, দোকানপাট ও ব্যাংকের গোডাউন। এই সম্পদ নিয়ে সরকার ও স্থানীয় প্রভাবশালী লোকের মধ্যে মামলা-মোকদ্দমা চলছে এখনো। বাকি হলগুলোরও একই অবস্থা। কোথাও গোডাউন, কোথাও পার্টি অফিস, কোথাও পুলিশ পরিবার, কোথাও প্রভাবশালীদের বানানো দোকান ইত্যাদি।
ছাত্রদের হলে ছাত্রদের ঠাঁই নেই কোথাও। ১৯৮৫ সালে ঢাবির জগন্নাথ হল ভেঙে পড়লে ১৯৮৮ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের পুরনো হলগুলো পরিত্যক্ত ঘোষণা করে এবং শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেয়। শিক্ষার্থীরা হল ছেড়েও দেয়। তারপর থেকেই হলগুলো বারোয়ারি সম্পত্তি হয়ে যায়। যে যেমনভাবে পেরেছে, জমি এবং দালান দখল করেছে সরকারের চোখের সামনেই এবং এখনো সরকারের চোখের সামনেই তা ভোগদখলও করছে। রীতিমতো দাঙ্গা করছে অবৈধ দখল ছাড়ার আইনি এবং ন্যায্য দাবি শুনলে। জঙ্গির মতো আচরণ করছে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। হয়রানি হয়ে যাচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা।
দ্বিতীয় ঘটনা হলো, অন্ধদের জমি দখল করে মদের কারখানা চালাচ্ছে যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম ওরফে বাবুল। এ খবরটাও টিভি প্রতিবেদনে দেখিয়েছে। অবিশ্বাস্য মনে হলেও ঘটনা সত্যি। দৈনিক পত্রিকাতে যমুনা গ্রুপের বেআইনি কর্মকাণ্ডের কথা বেশ কয়বার দেখেছি। ভেবেছি, সবাই যখন দেখে না, কানে শোনে না, মুখে কিছু বলে না, তো আমি কেন কিছু লেখতে যাব এসব নিয়ে? কিন্তু আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল অন্ধদের জমি দখল করার প্রতিবেদন দেখে। সত্যি ক্যারিশমা আছে মানুষটার! প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশ অমান্য করে প্রায় ১২ বছর ধরে অন্ধদের জন্য বরাদ্দকৃত ১৪ বিঘা জমি নিজের দখলে রেখেছে যমুনা গ্রুপের বাবুল এবং সিনাটান করে হান্টার মদ তৈরি করছে। সফিপুর বন বিভাগের দেওয়া ওই জমিতে অন্ধদের জন্য 'টেক' পল্লী গড়ে তোলেন স্থানীয় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা। ঘাম, শ্রম আর দৃষ্টিহীনতার কষ্টে আয় করা টাকা লগি্ন করেছিল তারা। বেঁচে থাকার জন্য ওইটুকু জমি ছাড়া আর কোনো সম্পদ অন্ধদের ছিল না। মাথার ওপর ছাদটুকু পেয়েই তারা খুশি ছিল। অনাহার-অর্ধাহারে ওখানে বাস করত ৪৫টি অসহায় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী পরিবার। হান্টার মদের কারখানা নির্মাণের জন্য ওই জমির ওপর লুব্ধ দৃষ্টি পড়ে বাবুলের। ২০০১ সালে হঠাৎ এক দিন বাবুল তার সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে এসে আচমকা হামলা করে ৪৫টি অন্ধ পরিবারকে উচ্ছেদ করে। ওই সময় প্রতিবাদ করতে গিয়ে গুপ্তহত্যার শিকার হন অন্ধ সেলিম, বারেক ও আফাজ। অন্ধরা সবাই এখন ছিন্নমূল। পথের ভিখারি। স্থানীয় প্রশাসন তো জানেই ঘটনাটা। তারা কিছুই করেনি। বর্তমানে বেশ কিছু দিন ধরে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর এখনো প্রতিকার পায়নি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী অসহায় পরিবারগুলো। যে কোনো সচেতন সৎ মানুষ এসব খবর পড়ে মর্মযাতনায় কষ্ট পায়। লেখালেখিও হয়। কিন্তু ফল তো কিছু দেখতে পাই না। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমরা সব্বাই কি দৃষ্টি এবং শ্রবণ প্রতিবন্ধী হয়ে গেলাম? ক্যান্সার যেমন জীবনের নীরব ঘাতক, সমাজের বুকে ভূমিদস্যুরা তেমনি সমাজজীবনের নীরব ঘাতক। তবে এদের দেখা যায়। কারণ ভূমিদস্যুরাও জঙ্গি আচরণে জমি দখল করে।
তবে হ্যাঁ, টেক্কা দিয়েছে তিন দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ছিনতাইয়ের ঘটনা। ওরা সামাজিক পরিভাষার ব্যাকরণ মতে সত্যি সত্যি জঙ্গি। ওই শ্রেণীর জঙ্গিদের জেল-জরিমানা ফাঁসির শাস্তিও হয়। হল জবরদখলকারী কিংবা অন্ধ প্রতিবন্ধীদের জমি দখল করে মদের কারখানা নির্মাণকারীদের জন্য না হয় কোনো শাস্তি নেই, ওদের জেল-জরিমানাও নেই। জেলখানা বদল করার জন্য প্রিজন ভ্যানে আনা-নেওয়ার বালাই নেই। ওরা সামজে বুকটান করে চলে। নকল দলিল তৈরি করে স্থানীয় প্রশাসনেরই সাহায্যে। ওদের অবৈধ ভোগদখলের কথা সব আমলের সরকারই জানতে পারে। জানে পুলিশ এবং প্রশাসন। কিন্তু ওই নীরব জঙ্গিদের কিচ্ছুটি বলে না কেউ। দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল এবং ন্যায়পর না থাকার জন্য এখন জঙ্গিরাও যে বিপুলভাবে দায়ী, সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ে দুর্নীতিবাজরাও যে চরম দণ্ড পাওয়ার যোগ্য, সে কথাটাও বলে না কেউ শক্ত ভাষায়। প্রতিকারের শব্দ উচ্চারণ তো বহু দূরের বিষয়। মাঝে মাঝে ভাবি, সমস্যা কোথায় আমাদের? সবাই আঙ্গুল তোলে পেশাদার চোর-ডাকাত-জঙ্গিদের দিকে। আর তারা যদি হয় জেএমবির সদস্য, তাহলে তো হাই পাওয়ার ফোকাস সেদিকে। ঢাকা পড়ে 'বাবুল' এবং হল দখলের কথা।
তবে হ্যাঁ, দেশে তোলপাড় তুলেছে তিন জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনা। গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে প্রিজন ভ্যানে ময়মনসিংহ আদালতে নেওয়ার পথে মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত জেএমবির তিন বন্দীকে ফিল্মি স্টাইলে ছিনতাই করে নেয় বাইরে থাকা জেএমবির সদস্যরাই। প্রিজন ভ্যান বাহকদের ওপর বোমা হামলা ও গুলি চালানোর সময় এক কনস্টেবল গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। আর একজনকে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হয়। বন্দীরা পালিয়ে গেলেও টাঙ্গাইলে ধরা পড়ে একজন। পর দিনের সংবাদ হলো, বন্দুকযুদ্ধে ধৃত জঙ্গি রাকিব নিহত। বাকিরা পলাতক।
সাধারণ মানুষ এর চেয়ে বেশি খবর জানতেও চায় না। আগ্রহ বেশি এলিটদের। যাদের কাজ কম। টাকা বেশি। সময় কাটানোর জন্য হাওয়াই গবেষণায় কেটে যায় অনেক সময়। ক্রমশ প্রকাশ্য ঘটনার জন্য অপেক্ষা করে থাকেন তারা। লাভের ভাগ আমরাও কিছু পাই। তাই তো জানতে পারলাম যে জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনাটা সাজানো নাটক। এনকাউন্টারে আসামির মৃত্যু-নাটকের মতো। প্রায়শই যে নাটকের খবর পত্রিকায় আসে।
জানা গেল, পুলিশের মোবাইল ব্যবহার করেই জঙ্গিরা তাদের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। প্রিজন ভ্যানে বন্দী আনা-নেওয়াটা খুবই গোপনীয় কাজ। পুলিশ এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ছাড়া অন্য কারও জানার কথাই নয় যে ভ্যানে কে বা কারা কোথায় যাচ্ছে? সেই গোপনীয়তা যদি পুলিশ রক্ষীরাই ভেঙে দেয়, তাহলে আর ভরসা কোথায়? পুলিশের মোবাইল ব্যবহার করেছে জঙ্গিরা, এটা তো রূপকথার কাহিনীকেও ছাড়িয়ে গেছে। জঙ্গিরা নাকি জেলের ভেতর থেকেও মোবাইলে তাদের বাইরে থাকা সঙ্গী-সাথীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে এবং গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা পরিচালনা করে। জেলপ্রহরীরা জানে সবই। দুর্দান্ত দুর্ধর্ষ জঙ্গিরা জেলের ভেতরে শরীরচর্চা করে।
গোয়েন্দা সূত্র মাঝে মাঝে পুটুস পুটুস সবজান্তাসূচক কথা বলে। জঙ্গি মামলার দীর্ঘসূত্রতা এবং নিরাপত্তা দুর্বলতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করেন। কিন্তু সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে এত সব অব্যবস্থাপনার কৈফিয়ৎ তেমনভাবে চানকি কেউ? কিংবা প্রতিবিধানের কথা? তার মানে, জেল পুলিশ আদালত চত্বর, প্রিজন ভ্যান, হাইসিকিউরিটি_ এসব কোনোটার ওপরই আমরা আস্থা রাখতে পারব না? এমনকি উপজেলা নির্বাচনে সেনাবাহিনী নামানোর পরও কোথাও কোথাও দাঙ্গা, মারামারি, খুন, ব্যালট বাঙ্ ছিনতাই, ভোট ডাকাতি সবই হয়েছে। দেশের আমজনতা বিপদের সময় ভরসা পেতে চায় যাদের কাছে, যেমন_ বিচার, পুলিশের সাহায্য, সেনাবাহিনীর প্রবল তদারকি, সেগুলোও যদি জীবনের স্বস্তি শান্তি নিরাপত্তা না দিতে পারে, তাহলে কোথায় দাঁড়াবে তারা? আমজনতার কাতারে দাঁড়িয়ে একই প্রশ্ন আমাদের। কোথায় যাব আমরা? এই সোনার দেশটাকে বড্ড ভালোবাসি আমরা। এ দেশে বহু ভালো মানুষও আছে। গুটিকয় সন্ত্রাসী এবং জঙ্গি সব ভালো তছনছ করে দেবে, তা কী করে হয়? এটা মানা যায় না কোনো মতেই।
লেখক : সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।