আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমাদের গণতন্ত্রের রকমফের

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সংকটটা আসলে কোথায়, এ প্রশ্ন অনেকেই করেন। সংকটের অনেক মাত্রাও অনেকের জানা আছে। কিন্তু সমাধানের কতটুকু ধারেকাছে আমরা পেঁৗছতে পারি সে বিষয়ে সবাই সন্দিহান। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের যে সংকট তার শুরু মূলত আজকের নয়। স্বাধীনতার পর দেশে যে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছিল তাতে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হলেও তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের অনাগ্রহ ও একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং পরবর্তীতে দেশে সামরিক শাসনের কারণে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকশিত হতে পারেনি। ১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটি সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়। মজার বিষয় হলো চিরবৈরিতার এই প্রধান দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ঐকমত্যের কারণে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে যে গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হয়, আজ তার চরম বিপর্যয়ের কারণও এই দুই দল। মাঝখান দিয়ে দেশব্যাপী অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির সুযোগ নিয়েছে জামায়াত, আরও পরিষ্কার করে বললে জামায়াতকে দেশব্যাপী অস্থিতিশীলতা তৈরি করার পথ নিরন্তরই নির্মাণ করে দিচ্ছে বিএনপি।

সংবিধানের ধারা ৭(১) এই যে, 'প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।' সংবিধানের অন্যতম সরল এবং নির্ভেজাল একটি ধারা এটি। অথচ গত ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে প্রজাতন্ত্রের ক্ষমতার এই মালিকরা কতটুকু তাদের অধিকার চর্চার সুযোগ পেয়েছে তা অনেক বড় প্রশ্ন। সরকার বা নির্বাচন কমিশনের ভাষ্যমতে, যদি ৪০ শতাংশ ভোটও পড়ে তাহলেও প্রায় সাত কোটি ভোটার তাদের 'এক দিনে গণতান্ত্রিক অধিকার' প্রয়োগ করতে পারেনি। প্রশ্নটি হলো, এই গণতন্ত্রটি প্রজাতন্ত্রের প্রকৃত ক্ষমতার মালিকদের সঙ্গে কতটা নোংরাভাবে প্রতারণা করে?

বিগত প্রত্যেকটা নির্বাচন নিয়ে পরাজিত দল সূক্ষ্ম বা স্থূল কারচুপির কথা বললেও এবারের নির্বাচনে সে প্রশ্ন ওঠেনি কারণ এবারের নির্বাচনে কেউ পরাজিত হয়নি। বিএনপির সে প্রশ্ন তোলার সুযোগও নেই কারণ তারা নির্বাচনেই আসেনি। যে প্রশ্নটি এখনকার সবচেয়ে বড় প্রশ্ন তা হলো, বর্তমান নির্বাচিত সরকার আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কতটা গ্রহণযোগ্যতা পাবে। অবশ্য বর্তমান সরকার আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলকে কতটা গ্রাহ্য করছে সেটাও প্রশ্ন। এমন একটি পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ সরকার যদি আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি সামলে উঠতে পারে তবে তা হবে তার জন্য সফলতা। আওয়ামী লীগ সরকারের এই ব্যক্তিগত সফলতা দেশের সার্বিক গণতন্ত্র কিংবা গণতন্ত্রায়নের সফলতা এ কথা বলা অপলাপ। শক্তিশালী বিরোধী দল ছাড়া গণতন্ত্র অকল্পনীয়। পোষা বিরোধী দল দিয়ে সংসদে খোশগল্প হয়তো করা যাবে, তবে একদলতন্ত্র ঠেকানো যাবে না। অবশ্য প্রকৃত বিরোধী দলও সংসদ বর্জন কিংবা সরকারি চাপে একদলতন্ত্র এ দেশে ঠেকাতে পারে না। এরশাদ দেশের সংকটকালীন আত্দহত্যার হুমকি দিয়ে যে 'লৌহ মানবের' পরিচয় দিয়েছেন এবং তার রাজনৈতিক অতীত গণতন্ত্রে কি ভূমিকা রাখবে তা প্রশ্নসাপেক্ষ। আমাদের দেশের গণতন্ত্রটি এই পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে, একে এখন অপগণতন্ত্র বললেও অত্যুক্তি হবে না। গণতন্ত্র রক্ষার নামে দুই দল যে অপশক্তির চর্চা করছে তা অপগণতন্ত্রকেই প্রতিষ্ঠায় প্রয়াসী। এই অপগণতন্ত্রের শিকার দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী থেকে খুদে শিক্ষার্থীরা। ব্যবসায়ীরা দেখেছেন রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা কীভাবে অর্থনৈতিক পরিবেশ ধ্বংস করে আর দুই শতাধিক বিদ্যালয় অপগণতন্ত্রের শিকার হয়ে নিজে জ্বলছে, জ্বালাচ্ছে লক্ষাধিক খুদে শিক্ষার্থীদের। শুধু ধর্মের নামে সংখ্যালঘুদের (যারাও প্রজাতন্ত্রের ক্ষমতার মালিক) আপন ভিটে ছেড়ে চরম শঙ্কায়, চরম নিরাপত্তাহীনতায় শুধু বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করছেন। দুই দলকেই নির্ভর করতে হচ্ছে কথিত 'গণতন্ত্র রপ্তানিকারক' কিছু প্রভুরাষ্ট্রের অঙ্গুলি সংকেতের দিকে।

বাংলাদেশে বর্তমানে এই যে পরিস্থিতি, তা থেকে উত্তরণের প্রাথমিক উপায় হলো উভয়কেই আপসহীন মূর্তি ত্যাগ করে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। প্রজাতন্ত্রের ক্ষমতার মালিক জনগণের স্বার্থে দুই নেত্রী বার বার আপসহীন নেত্রী হয়ে উঠেছেন, এখন এই জনগণের স্বার্থেই এই দুই নেত্রীকেই আপস করা শিখতে হবে, তৈরি করতে হবে স্থিতিশীল রাজনৈতিক সংস্কৃতি চর্চার মনোবৃত্তি।

এ দেশে দ্রুত প্রকৃত গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে সংলাপ বা সমঝোতার বিকল্প নেই। নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনার সংলাপের আমন্ত্রণে সাড়া না দিয়ে খালেদা জিয়া যেমন প্রশংসা পাননি আবার সাংবিধানিক দায় এড়াতে গিয়ে বিতর্কিত নির্বাচনে জয়ী হয়েও শেখ হাসিনা প্রশংসিত হননি। এ সংকট কাটিয়ে উঠতে তাই যত দ্রুত সংলাপ হবে ততই দেশের মঙ্গল। যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এই দেশ স্বাধীন করা সেই পাকিস্তানের দোসর রাজাকার-আলবদরদের এ দেশে ধর্মীয় রাজনীতি করার সুযোগ থাকা উচিত নয়, তাই বিএনপিকে জামায়াত সঙ্গ ত্যাগ করতে হবে, সহিংস রাজনীতি পরিত্যাগ করতে হবে, অন্যদিকে সংলাপ ফলপ্রসূ করার পরিবেশ এখন তৈরি করার দায় সরকার পক্ষের।

লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমফিল গবেষক এবং দফতর সম্পাদক, বাংলাদেশ রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতি।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.