আধা পাগলের লেখা লেখি... হয়তো শুধুই মস্তিস্ক বিকৃতি...
... ১ ...
নায়লাকে ছেড়ে কিছুতেই আসতে ইচ্ছে করছিল না তাও আসতে হয়েছে। নায়লার জন্মের পর একদিনের জন্যেও ওকে ছেড়ে থাকিনি, সেখানে আজ প্রায় ৯দিন ভীনদেশে পড়ে আছি। টিকেট কনফার্ম হয়ে গেছে, কাল রাতের ফ্লাইটে দেশের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাবো। অফিসের কাজের কারনে আসতে হয়েছে, বিদেশ ভ্রমণ আবার অফিসের কাজ সেরে যাওয়া, রথ দেখা আর কলা বেচা একই সাথে। বস যেখানে নিজে আমাকে কাজের জন্যে পাঠাচ্ছেন সেখানে আমার ওজর আপত্তিও খাটেনি।
সাথে দিয়েছেন আনিস ভাইকে, লোকটা আমার বেশ সিনিয়র। তাকে ভালোই লাগে কিন্তু একটা ব্যাপারে মেজাজ খুব খারাপ করে দেয় তা হল সিগারেট, লোকটা এত সিগারেট খায় ! এক সময় অবশ্য আমিও খেতাম কিন্তু নায়লার জন্মের পর আর একটাও খাই নি।
নায়লার সাথে খানিক আগে কথা হয়েছিল জিজ্ঞাসা করেছিলাম তোমার জন্যে কি আনবো মা ? বলেছিল "বাবা তুমি চলে আসো আর একটা পুতুল আনবে"
আনিস ভাই যে কই গেল, লোকটা আজব একটা ক্যারেক্টার। মালদ্বীপ আসার সময় উনার জন্যেই আরেকটু হলে ফ্লাইট মিস হতে যাচ্ছিল। সিগারেট খেতে ইচ্ছে হয়েছে ড্রাইভারকে দিয়ে গাড়ি সাইড করিয়ে সিগারেট কিনতে গিয়েছিলেন।
ওনার আবার ফিক্সড ব্র্যান্ড, আমি অবশ্য সবই খেতাম। ওনার সিগারেটের পাল্লায় পড়ে ট্রাফিক সিগন্যাল আর ভিআইপি যাবার কারনে প্রায় দেড় ঘন্টা নস্ট হয়েছিল। ওনার কথা ছিল প্লেন তো চেন্নাই হয়ে যাবে আর বেশ বড় জার্নি, এই সময়ের মধ্যে একটা সিগারেট ও খেতে পাড়বেন না তাই ! আমিতো অবাক মানুষ দুঃসময়ের জন্য খাদ্য সঞ্চয় করে জানতাম আর এই লোক ! কাল যাবার সময় কোন বিপত্তি না বাধালেই চলে।
... ২ ....
সব ঝামেলা শেষ করে প্লেনে চেপে বসেছি, কিছু সময় পর প্লেন ছাড়বে। আমার সিট জানালার পাশেই।
শীতকাল বাইরে বেশ ঠাণ্ডা। পাখার উপরে হালকা বরফ জমেছে বলেই মনে হল। দেখেই ভয় হল, এই বরফের জন্যে বিপত্তি ঘটে অনেক। প্লেনের পাখার নিচে থাকা ইঞ্জিনের সামনে কি যেন একটা সেন্সর থাকে, ওইটার সামনে কিছু আটকে গেলেও সর্বনাশ ঘটে যেতে পারে। প্লেন ছাড়লো নির্ধারিত সময়ের কিছু পড়ে, ভয়টা আরো জেকে বসতে শুরু করেছে।
এই শীতের মাঝেও ঘামতে শুরু করলাম। আনিস ভাইকে বলতে ইচ্ছা করছে আমার ভালো ঠেকছে না, নেমে যাই। কিন্তু এটা তো আমার দেশের মুড়ির টিন বাস না যে চাইলে সম্ভব। প্লেন রান ওয়ে ছাড়তে শুরু করলো, একটু পর মাটি ছেড়ে উপরে উঠে এল। কিছু সময় পরই যেন প্লেনটা কেপে উঠলো।
দোয়া দুরুদ পড়বো, ভয়ের চোটে পড়তেও পারছি না। সিট বেল্ট বাধা, ইচ্ছে করছে একটানে খুলে ফেলে প্লেনের দরজা খুলে প্যারাসুট নিয়ে লাফিয়ে পড়ি। এর মধ্যে স্পিকারে ককপিট থেকে ক্যাপ্টেনের ভয়েস শুনতে পাচ্ছি, আমি কনফার্ম আজ আমি মারা যাচ্ছি। পাশে তাকিয়ে দেখি আনিস ভাই নির্বিকার বসে আছেন। ভয় আমাকে আরও পেয়ে বসলো "ভাবলাম আজ আমরা মারা যাব উনি বুঝতে পেরেই হয়তো চুপ কেননা আমাদের কিছুই করার নেই।
কিছু সময় পর সব নরমাল। ঘটনা গুলো মাত্র কয়েক সেকেন্ডের।
এই প্রথম আমার দিকে আনিস ভাই তাকালেন, আমার চেহারায় ঘাম দেখে কিছু অবাক হলেন। এয়ার হোস্টেজকে ডাক দিলেন, এয়ার হোস্টেজ কি লাগবে এসে জানতে চাইলেন, যা লাগবে তা দিয়েও গেল কিন্তু এয়ার হোস্টেজ বার বার আমার দিকে তাকাচ্ছে, আমার তাকে চেনা চেনা লাগছে কিন্তু কিছুতেই কিছু মনে পড়ছে না। আনিস ভাই পানির বোতল আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন খাও আর জিজ্ঞাসা করলেন কি হয়েছে আমার? আমি বলতেই তিনি হাসিতে ফেটে পড়লেন।
আমার রাগ হচ্ছে মরতে যাচ্ছিলাম এখানে হাসার কি আছে। আনিস ভাই বললেন আমাদের প্লেনের কিছু আগে আরেকটা প্লেন টেক অফ করেছিল যার কারনে এমনটা হয়েছে, যেটাকে বলে ওয়েভ টার্বুলেন্স। প্লেনের পাখার কারনে একটা বৃত্তাকার বাতাসের ঘুর্নি তৈরী হয়। আমাদের প্লেন সেটাই ফেস করেছে আর ক্যাপ্টেন এইটাই বলছিলেন। আনিস ভাই এর আগেও বেশ কয়েকবার এয়ারবাসে ট্রাভেল করেছেন হয়তো এ জন্যেই এত নির্বিকার ছিলেন।
আমি ভয় পাওয়াতে ক্যাপ্টেনের কথা কিছু শুনি নাই। মীম ঠিকই বলে আমি আসলেই অনেক ভীতু।
ভয় কেটে গেলেও খুঁতখুতানি গেল না, খুঁতখুতানিটা এয়ার হোস্টেজকে নিয়ে। মেয়েটাকে চেনা চেনা লাগতেছে আর মেয়েটাও বার বার তাকাচ্ছে, রহস্যের কুল কিনারা করতে না পেরে চিন্তা ভাবনা বাদ দিয়ে জানলা দিয়ে নিচে তাকায় নিলয়। নিচটা খুব সুন্দর লাগছে, নিচে অন্ধকারের মধ্যেও কত আলো জ্বলে আছে, দেখতে ভালোই লাগছে।
নায়লা সাথে থাকলে ভালোই হত বাপ বেটিতে মিলে কথা বলা যেত। ভাবতে ভাবতেই একসময় ঘুমিয়ে পড়ে নিলয়।
... ৩ ...
তখনো আমি এয়ার হোস্টেজের জব টা পাই নি, টুক টাক কিছু করতাম আর কি। প্রতিদিন ই বাসে করে ফিরতে হত আমাকে। প্রতিদিনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাড়ি ফেরা লাগে।
যাতায়াতের জন্যে এই মুড়ির টিন বাস গুলোই যা ভরসা, আমরাও যেমন আমাদের দেশের বাসও তেমন। ডানে বামে এবরো থেবড়ো রাস্তায় ঝাকিয়ে কাপিয়ে মুড়ির টিন বাস চলছে, বাসের সাথে তাল মিলিয়ে মাথাও দুলছে। চুল গুলা আউলা ঝাউলা, ঠিক যেন কাউয়ার বাসা। নাহ কাউয়ার বাসাও এর চাইতে সুন্দর। চোখে আবার একটা ঢেউটিন দিছে।
গলার মাফলারে ধুলা লেগে আছে। এক কানে ইয়ার ফোনের দড়ি ঝুলছে আরেক কানের টা গলার পাশে ঝুলতেছে ! চোখে ঢেউটিনের জন্যে বুঝাও যায় না কোনদিকে তাকিয়ে আছে। শীত নাই গ্রীষ্ম/বর্ষা নাই বাসে যাবার সবাই প্রায়ই এই উদ্ভট ক্যারেক্টার টাকে দেখতে হয় । প্রতিদিন একই যায়গায় একটুও চেঞ্জ হয় না। সেদিন ড্রাইভার খেয়াল না করায় স্পিড না কমিয়ে স্পিড ব্রেকার উপর দিয়ে বাস যাওয়াতে বেশ ভালোই ঝাকুনি লাগে, বাসের যাত্রীরা ড্রাইভের গুস্টি উদ্ধারে ব্যস্ত।
আমার চোখ গিয়ে পড়ে সেই আজব ক্যারেক্টারের উপর। চোখের চশমা খসে পড়েছে, পাবলিকটা ঘুমাচ্ছে ! নড়ে চড়ে মাথা বাসের সাইডে লাগিয়ে আবার ঘুম দিল, আজব একটা পাবলিক। আরে এইটা তো নিলয় ! রিন্তির টিচার !
নিলয়কে প্রথম দেখেছিলাম আমাদের পাড়ায়। সেদিন কেন যেন আমার খুব মন মেজাজ খারাপ ছিল। বাসার কাছা কাছি তখন, গলিটা পেরুলেই বাসা।
নিলয় আমার পিছু নিয়েছিল। অনেকটা দূর হতেই সে "এই যে আপু শুনছেন, হ্যালো, এই যে আপু বলে চেচাতে চেচাতে আসছিল" আমার মেজাজ তখন একেবারে লিমিট ছাড়িয়ে গেছে, ভেবেছিলাম এলাকার বজ্জাত ছেলে গুলোর কোন একটা প্রতিদিনের মত আজো আমার পিছু নিয়েছে। তারপর ফিরে তাকালেই কিছু একটা বলে দৌড় দিবে। এসব ঘটনা আমার বাসায় কেউ ই জানতো না, আমি বললে তবেই তো জানবে !
পিছন থেকে ডাক আসছেই, আর সহ্য করতে পারলাম, চোখ মুখ পাকিয়ে চৌদ্দ গুস্টি তুলে গালি দেব বলে ঘুড়ে দাড়ালাম। "সমস্যা কি আপনার ফেড়িওয়ালাদের মতন চেচাচ্ছেন কেন? আর আমার পিছন পিছন আসছেন কেন?" এমন কিছু হয়তো নিলয় আশা করেনি, ভ্যাবা চ্যাকা খেয়ে গেল, খুব হাসি পাচ্ছিল, আরো কিছু বলতে যাব এমন সময় আমার দিকে কাগজ কিছু একটা বাড়িয়ে দিল ! আমি হাতেই নিয়েই থ, আমার এইচএসসি রেজিস্ট্রেশন কার্ড, গলির মুখে পড়ে গিয়েছিল, নিলয় কিছু না বলেই হাটা দিল ! অবশ্য আমার চেহারা আর ব্যবহারের পর এমন কিছু অস্বাভাবিক না।
এই ঘটনার মাস দেড়েক পরে আমি জানতে পাড়ি গত ৪মাস যাবত সে আমার ছোট বোন রিন্তিকে পড়ায়।
নিলয় ছেলেটা বেশ আজব আর ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার। আম্মুর সাথে প্যাচাল শুরু করলাম দেখি আরও কিছু জানা যায় কিনা, মার কাছ থেকে খুব একটা জানা গেলো না, যা জানলাম তা ওই না জানার সমান ই। তাও যা হল খারাপ না। রিন্তির পড়ার সময়ে মাঝে মধ্যে আসে পাশে চক্কর কাটতাম দেখার জন্যে ওই আজব ক্যারেক্টার টা কি করে।
তার কাজকর্মে আমার খুব হাসি পেত। সারাদিন মেজাজ খারাপ করে আসার পর মজা পাবার জন্যে হলেও আমি আসার জন্যে চেস্টা করতাম। মাঝে মধ্যে দেখতাম ছেলেটা আমার দিকে তাকাচ্ছে। ততদিনে এয়ার হোস্টেজের জবটা আমি পেয়ে যাই। তখন বুঝতে শুরু করি আমার মধ্যে কিছু একটা পরিবর্তন ঘটেছে এই আজব ক্যারেক্টার টাকে নিয়ে.....।
স্পিকারে ক্যাপ্টেনের ভয়েস শুনতেই ভাবনায় ছেদ পড়ে রুহির, সবাইকে সিট বেল্ট বেধে নেয়ার জন্য বলা হচ্ছে।
... ৪ ...
ঝাকি খেয়ে ঘুম ভাঙ্গে নিলয়, ঘুম কাতর চোখে বাইরে তাকিয়ে দেখে প্লেনে ল্যান্ড করছে। হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখার চেস্টা করছে নিলয়, ঘোর ভাঙ্গতেই ধুর এইটা "তো ওই দেশের সময়, প্লেন ল্যান্ড করলো মাত্র চেন্নাইতে। " সময়ের হিসাব মিলানো যাবে না। এখানে থাকবে আরো এক ঘন্টা, তারপর আবার উড়াল দিবে।
দেশে যেতে আরও প্রায় ৪ ঘন্টা। ওয়াশরুম থেকে মুখে চোখে পানি দিয়ে ফিরে এসে সিটে বসার সময় সেই এয়ার হোস্টেজকে দেখতে পেল নিলয়। এবার ঠিক চিনতে পারে নিলয় !
এতো রুহি ! ওর ছোট বোনকেই তো পড়াতাম। রিন্তিকে যখন পড়াতাম তখন প্রায় প্রতিদিন ই ওকে দেখতাম। দেখা হতো না, এমন হয়নি বলাই যায় অন্তত যতদিন ওদের এলাকায় ছিলাম।
রিন্তিকে পড়ানোর কাজটা সাব্বির যোগাড় করে দেয়। সাব্বির আমার কলেজ সময়ের থেকে ফ্রেন্ড। আমি ওদের এলাকার মেসে ওঠার কয়েক মাস পড়ে টিউশনিটা পাই, তখনো আমি বেকার বলা যায়। রিন্তিদের বাসায় প্রতিদিন ই মুড়ির টিন বাসের এক বিশাল জার্নির পড় যেতাম, আন্টি প্রতিদিন ই নাস্তা দিতেন বেশী করে। হয়তোবা সেটা আমার আর্থিক অবস্থার কথা চিন্তা করে কিংবা মেসে কি খাই না খাই তা ভেবে কিংবা অন্যকিছুও হতে পারে।
রিন্তিরা দু বোন ছিল, হয়তোবা তাদের কোন ছেলে নেই তা নিয়ে কোন আক্ষেপ বা ছেলের প্রতি কোন দুর্বলতা থাকতেও পারে আন্টির। এ নিয়ে অবশ্য খুব একটা মাথা ঘামাতাম না।
মাস শেষ আমাকে টাকা খামে করে দেয়া হত। প্রথমদিকে হলুদ খামে করে টাকা দেয়া হত কিন্তু মাস কয়েক পর খাম বদলে গেল। হলুদ খামের বদলে অন্য খামে করে টাকা দেয়া হত।
যখন খাম দেয়া হত সেদিন নাস্তা রুহি নিয়ে আসতো, আমার দিকে তাকাতো, আমি ভাবতাম হয়তো টাকা পাচ্ছি সে রি-অ্যাকশনটা কেমন দেখতে চায়। আমি অপেক্ষা করতাম কখন রুহি রুম থেকে যায়, বড়ই অস্বস্তি লাগতো মেয়েটা আসে পাশে থাকলে। টাকা পাবার দিন একটু তাড়াতাড়ি ই বাসায় যাবার জন্যে চেস্টা করতাম, হয়তো নিজের পাওনা বা অনেক কস্টের বিনিময়ে প্রাপ্তি বলে টাকা নিয়ে তাড়াতাড়ি ফিরতে চেস্টা করতাম।
পরের মাস থেকে ঘটনা আবার বদলে গেল, এবারো খামকে কেন্দ্রকে করে। হলুদ খামের পর এতদিন বাই এয়ারমেইল লেখা খাম গুলো পেতাম।
প্রথম মাসে টাকা গুলো সাদা একটা কাগজে জড়ানো ছিল। পরের দুমাস খামের মধ্যে কাগজ ছিল ঠিকই তবে টাকার সাথে জড়ানো না, ব্ল্যাঙ্ক পেপার বলা যায়। আমি রহস্যের কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। এবারের খামটা নীল রঙ্গের। নীল রঙ্গের খাম দেখে কেমন যেন টেনশন লাগছিল, কোনমতে পড়ানো শেষ করে বাসায় গেলাম।
খামের মধ্যে এবারো যথারীতি একটা কাগজ, তবে এবার খামের সাথে কাগজের রঙ ও বদলে গেল। নীল খামের সাথে নীল রঙ্গের কাগজ।
... ৫ ....
কাগজটা খুব সুন্দর করে ভাজ করা, কাগজে কিছু লেখা আছে মনে হচ্ছে। কাগজ খুললাম, হাতের লেখাটা বেশ সুন্দর কিন্তু লেখাটা পড়ে মনটা আর সুন্দর থাকলো না। আমার নামে অভিযোগ "আপনি আতেল কেন? চুল কাউয়ার বাসা কেন? " প্রথমদিনের অভিজ্ঞতার তুলনায় এটা ভালো, ওইদিন যা ফেস করেছি তার থেকে এর ভালো কি আশা করা যায়।
পরের কয়েকমাস ও যথারীতি কাগজের রঙ খামের রঙ্গের সাথে মিলিয়ে আসছে। খাম বেগুনী হলে কাগজ ও বেগুনী, খাম বাদামী তো কাগজ ও বাদামী। তবে একটা জিনিস ঠিক থাকছে, তা হল অভিযোগ, আমার নামে প্রতিমাসেই একটা করে অভিযোগ থাকতোই।
এই খামের ঘটনা রিন্তির চোখে পড়তো না, খাম সব সময় নাশতার প্লেটের নিচে রেখে যেত। এভাবেই চলছিল।
সে বার ও মাসের শেষের দিকের ঘটনা, সামনে ঈদ, ঈদের দিন পাঁচেক আগের ঘটনা। রুহি নাশতা নিয়ে এসেছে, খাম নাশতার প্লেটের নিচে। রুহির হাতের দিকে আমার চোখ পড়লো অবশ্য এতে আমার কানের ভুমিকা আছে, ঝুন ঝুন শব্দ শুনতে পেয়েছিলাম, শব্দের উৎস খেয়াল করতে গিয়ে রুহির হাতের দিকে তাকিয়েছিলাম। হাত ভর্তি কাচের চুরি, খুব সুন্দর লাগছিল। এই প্রথম আমি রুহি চলে যাবার সময় ঘুরে তাকালাম, মুখটা বেশ হাসি হাসি।
নাশতা খেতে গিয়ে খেয়াল করলাম, এবারো বেতন এসেছে রঙ্গিন খামে, তবে এবারের খামটা একটু আলাদা। খামটা বেশ কালারফুল, রঙ ধনুর সব রঙ আছে কেবল লাল রঙ বাদে। আর খামটা হাতে করে বানানো হয়েছে। বাসায় এসে খাম খুললাম, ভিতরে টিস্যু পেপার ভাজ করা, তার উপর নকশা কাটা। ভাজ খুললাম এবারো কিছু লেখা, এবার অভিযোগ নয় শুধু লেখা "ঈদ মুবারাক" কিছুটা অবাক হলাম খামের সাথে মিল রেখে "ঈদ মুবারাক" লেখাতেও লাল রঙ নেই।
ঘটনা টায় কেমন যেন খটকা লাগছে।
কালারস বাই মান্থ ব্যাপারে আমি কিছুটা জানতাম, সেখানে কালার ব্যবহার করে মাসকে রিপ্রেজেন্ট করা হত। কোথাও আবার ব্রাইটস্টোন কালার ব্যবহার করা হত, সে যে কি হিসেব করে এই রঙ ব্যবহার করতেছে বুঝলাম না। আবার হাতের চুরির কথা মনে পড়তেই খেয়াল হলো সেখানেও লাল রঙের কোন চুরি ছিল না। রহস্যের কুল কিনারা হচ্ছে না।
রুহিকে নিয়ে আমার মাথায় ও কিছু হচ্ছিল বুঝতে পারলাম ঈদের ছুটিতে। সাব্বিরের বাসায় গিয়েছিলাম দাওয়াত খেতে। সাব্বিরের সাথে কথায় কথায় রুহির ব্যাপারটা উঠলো। রুহির প্রতি যে আমার একটা টান আসতে শুরু করেছে তা পরিষ্কার। সাব্বিরকে খুলে বললাম, আপেল খাচ্ছিল সাব্বির বারান্দার দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে।
আপেল খাওয়া ছেড়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।
- কি রে কি হলো? ওভাবে কি দেখছিস?
- দেখলাম তোর ঘাড়ে কটা মাথা আছে
- কি সব বলতেছিস কিছুই তো বুঝতে পারছি না
- তুই ওর ফ্যামিলির সম্পর্কে কতটুকু জানিস?
- ওর বাবা ম্যান পাওয়ারের বিজনেস করে
- আর থাম, ম্যান পাওয়ার না ছাই, আদম পাচার করে
- তুই জানিস কিভাবে?
- লোকে কি বোবা নাকি? লোকের থেকে শুনেছি
- ধুর মানুষ তো কতকিছুই বলে
- বাপে করে আদম পাচার আর মেয়ে এয়ার হোস্টেজ, দেখবি কোন দিন যেন তোরেও পাচার করে দিছে। তুই ই না বললি তো "বাই এয়ারমেইল" লেখা খামে পেমেন্ট দিস।
- হুম তো?
- তো কিছু না, আর ওর বাপে মানুষ ও ভালো না, যেদিন ঠ্যালা খাবি সেদিন বুঝবি। সময় থাকতে কেটে পর।
বন্ধুদের ক্যারেক্টার টা আজব এই শালারা বন্ধুর প্রেম ঠিক করতে পারলে শাবল, হাতুড়ি নিয়ে পড়ে আবার ক্যাটর ক্যাটর, জ্ঞান দেয়ার সাথে নানা রকম উপদেশ দেয়, বাধা ও দেয়। সাব্বিরের কথা শুনে কিছুটা মন খারাপ হয়ে যায়। এটাকে ছাড়িয়ে নিতে চেস্টা করলাম কিন্তু যতই বের হতে চাইছি ততই যেন আটকে যাচ্ছি। ঈদের ছুটির এই কটা দিন যেন আর শেষ হচ্ছে না, আগে বন্ধ চাইতাম আর এবারই প্রথম বন্ধ পেয়ে যেন দম আটকে মারা যাচ্ছি। রুহিকে দেখতে ইচ্ছে করেছিল কয়েকবার..................।
।
.... ৬ ....
ঈদের বন্ধটা কাটতেই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। রিন্তিকে পড়াতে গেলাম। রুহির সাথে দেখা হল না। রুহির সাথে আমার যে আগে প্রতিদিন দেখা হত তাও না, তবে প্রতি ২/৩ দিনে একবার দেখা হতোই।
পর পর দুদিন কেটে গেল রুহিকে দেখতে পেলাম না। ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেড দের নরমালি মাসে ১৩-১৫ দিন কাজ করতে হয় সে হিসাব করলে আজ দেখা হবার একটা চান্স আছে কিন্তু সেদিন ও দেখা হলো না। মন খারাপ করে বাসায় ফিরলাম। আমি নিজের সাথে যুদ্ধ করছিলাম কেন আমার এমন হচ্ছে। ঈদ ছিল গত ৩ তারিখে, আগের মাসের ২৯শে পড়ানো শেষ করেছিলাম।
আর ঈদের পর আন্টির বলে দেয়া ৯তারিখেই পড়াতে এসেছিলাম, তারপর ৬ দিন কেটে গেল কিন্তু দেখা হল। শুক্রবারটা কোনভাবে পার হয়ে গেল। শনিবার পড়ানো শেষ করে ফেরার জন্যে বের হয়েছি, আজো দেখা হলো ভেবে যখন বের হচ্ছিলাম সেই মুহুর্তেই দেখা হল, কেমন যে একটা স্বস্তি পেলাম। মাসের ২৫ তারিখের পরই সে মাসের বেতন পেয়ে যাই আমি।
সে মাসে সাদা খামে বেতন পেলাম, রঙিন খাম থেকে হঠাৎ কেন আবার সাদা হল বুঝলাম না।
খামের সাথে ভেতরের জিনিসটাও সাদা, একটা টিস্যু। এবার কি অভিযোগ তা জানার জন্যে টিস্যুর ভাজ খুলতে শুরু করলাম, টিস্যুর এর ভাজ খুলতেই চোখে পড়লো “স্টুপিড” লেখা, আবার অ্যারো সাইন দেয়া, অপর পাশে “ইডিয়েট” লেখা এবং সেখানেও একটা অ্যারো। “ইডিয়েট” লেখা ভাজ খোলার আগেই দেখা উচিৎ ছিল আমার। “স্টুপিড” থেকে অ্যারো “ইডিয়েট” এর দিকে আবার “ইডিয়েট” থেকে “অ্যারো” স্টুপিডের দিকে। কিছুক্ষন পর খেয়াল করলাম অ্যারো গুলো যেভাবে দিয়েছে তা ভাজ খোলার পর চোখের মত দেখায়।
মেসেজে অর্থ বুঝলাম তার রাগী চোখ আর আমাকে একসাথে “স্টুপিড ইডিয়েট” বলেছে। একজন “স্টুপিড” যে কিনা “ইডিয়েট” আবার একজন “ইডিয়েট” যে কিনা “স্টুপিড” এভাবে চিন্তা করে ব্যাপারটায় মজা পেলাম যদিও “স্টুপিড ইডিয়েটেরঃ চিন্তা ভাবনা। টিস্যুর লেয়ার টা খুললাম আসমানী রঙের জেল পেনে লেখা “আকাশে সাদা মেঘ ভাসে” এর মর্মার্থ আমার দ্বারা উদ্ধার হলো না। মাসের হিসেবে দেখলাম সেপ্টেম্বর অর্থাৎ শরৎ কাল। তারমানে মেঘের রঙ সাদা তার সাথে মিল রেখেছে কিন্তু লাইনটার অর্থ কি ??
... ৭ ....
পরের মাসে ১৬ তারিখ, আন্টি আসলেন।
দুবছর ধরে রিন্তিকে কিন্তু পড়াই পড়ানোর সময় কখনোই তিনি আমার সামনে আসেননি। কথা বলেছেন পড়ানোর পর। আন্টি বলে গেলেন পড়ানো শেষে একটু বসবে কথা আছে তোমার সাথে। ভাবলাম রিন্তির পড়া নিয়ে কিছু বলবে, সামনে নভেম্বর পরীক্ষা, বাসায় হয়তো পড়ে না। সেদিন খাম আসলো, আমি কিছুটা অবাক এত তাড়াতাড়ি কখনোই তো বেতন দেয়া হয় না।
আজকের খামটা কালো রঙের। আর আজ রুহির চেহারা আমি দেখতে পাই নি, সে রেখেই চলে গিয়েছে। পড়ানো শেষ করে বসে রইলাম কিছুক্ষণ পড় আন্টি আসলেন বললেন কাল থেকে আর তোমাকে আসতে হবে না, কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই তিনি চলে গেলেন। টিউশনি চলে যাওয়ায় মন খারাপ হয়ে গেল কিন্তু কেন এমন হল বুঝতে পারছি না।
কালো খাম তাও বুঝতে পারছি না, হ্যালোউইন হয় অক্টোবরে সে জন্যে কালো ব্যহহার করা হয় কিন্তু যোগসুত্র কোথায় ! ভাবতে ভাবতে বাসায় চলে এলাম।
বাসায় এসে খাম খুললাম, দুমাসের বেতনের টাকা দেয়া হয়েছে। খামের ভেতর কালো রঙের কাগজ, তাতে অ্যাশ কালার ইউজ করে কিছু লেখা আছে,
“প্রতিমাসেই আপনার কাছে ভিন্ন রঙের খাম গিয়েছে, একেক সময় একেক রঙ ব্যবহার করেছি। কখনো প্রকৃতির সাথে মিলিয়ে, কখনো মনের অবস্থার সাথে মিলিয়ে, কখনো বা অন্যকিছু। এবার কালো কেন তাই ভাবছেন তো? আপনার সাথে আমার আর দেখা হবে না, বিষাদের রঙ নীল কিন্তু বিষাদ বেশী হলে চারপাশে অনেক রঙ থাকলো তা বিবর্ন লাগে। আর বিবর্ন মানে সাদা কালো তাই না।
তাই কস্ট থেকেই কালো। ঈদের সময় লাল রঙ নেই বলে অবাক হয়েছিলেন তাই না? আমি জানতাম আপনি অবাক হবেন এবং ভাববেন কেন? কেন লাল ছিল না জানেন? আপনি একটা গাধা আর ভীতু আপনাকে দিয়ে যে হবে না তা ভালো করেই বুঝে গিয়েছিলাম, আপনি তো আর আমাকে কিছু বলবেন না, আমিই বলতাম আপনাকে আমার ভালোলাগা, ভালবাসার কথা। ভালবাসা তো লাল রঙের হার্ট দিয়ে বোঝায় তাই না? তাই লাল সেদিন বাকি রেখেছিলাম। এখন ভাবছেন দেখা কেন হবে না আর কেনই বা আপনার টিউশনি চলে গেল? আপনাকে দেব বলে লাল খামে, লাল কাগজে লিখে রেখেছিলাম অনেক আগেই। সময়ের অপেক্ষা করছিলাম কেবল।
রক্তের রঙ লাল তাই না? বলি হয়ে গেল এটা, বুঝতে পারছেন না তাই তো? খামটা আমার বইয়ের ভাজে রেখেছিলাম। রুম গুছাতে গিয়ে কোন একসময় সেটা আপনার হাতে আমার প্রবেশ পত্র পড়ে যাবার মতই আমার বাবার হাতে পড়ে যায়। তারপর তো সব বুঝতেই পারছেন। শুরুর হবার আগেই সব শেষ হয়ে গেল। ভালো থাকবেন।
লেখাটা পড়ে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল কিন্তু চোখ দিয়ে এক ফোটাও পানি ঝড়ে নি। কান্নায় শোক নাকি মন্দীভূত হয়, আমি পাড়লাম না কাঁদতে। পরের দুমাস খুব খারাপ গেল, মাঝে দু একবার রাস্তায় দাড়িয়ে থেকে রুহিকে দেখার চেস্টাও করেছি কিন্তু কখনোই দেখা হয়নি। তারপর এলাকা ছেড়ে চলে যাই, বাস্তবতা আরও কত কি চিন্তা করে আর ফিরে দেখার সুযোগ হয়নি। তারপরের সবই অতীত কিছুই নেই স্মৃতি ছাড়া।
ভাবতেই ভাবতেই ক্যাপ্টেনের ভয়েস কানে আসলো। প্লেন টেক অফ করবে, আর প্রায় আড়াই ঘন্টা পর দেশে পৌছে যাব। মাঝের সময়টা একবারের জন্যেও রুহিকে দেখতে পেলাম না, হয়তো চাইছে না আমার সামনে। রুহির সংসার তার পরিবার এর বাকিদের ব্যাপারে আর কিছু জানা হলো না। আমিও আর ভাবলাম না রুহিকে নিয়ে।
যে রুহিকে অতীতে ফেলে এসেছি, যখন তাকে ভাবার ছিল তখনই ভাবলাম না আজ কেন ! আজ যেখানে আমার পরিবার আছে, আমাকে নিয়ে যখন অন্য কেউ স্বপ্ন বোনে তখন কেন স্মৃতি। এসব ভাবতে ভাবতেই সময় পেরিয়ে গেল। প্লেন ল্যান্ড করলো দেশে, ঘড়ির সময় রাত প্রায় পৌনে পাঁচটা, রাত না ভোর ই বলা চলে তবে কুয়াশার অন্ধকার ঠান্ডা বাতাসের দাপট আর চারপাশের এত আলোয় পরিবেশটা অন্যরকম আছে। ভেবেছিলাম নামার সময় রুহিকে হয়তোবা দেখতে পাবো। যাত্রীরা আগে নেমে যায়, তারপর ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেড কিছু কাজ থাকে যা শেষ করার পর তারা বের হবে।
এয়ারপোর্টের ঝামেলা মিটিয়ে বাইরে এসে দেখি আমার স্ত্রী, মেয়ে অপেক্ষা করছে। অফিস থেকে গাড়ি পাঠানো হয়েছিল আমাদের জন্যে। আনিস ভাই ড্রাইভারের পাশের সিটে বসলেন আর আমরা পেছনে। নায়লা ঘুমাচ্ছে আমার গায়ে হেলান দিয়ে। অন্ধকারে আলো ছড়িয়ে ছুটে চলছে মাইক্রোবাস, সেই সাথে আমরাও।
এভাবেই হয়তো আলো আঁধারের মাঝে জীবন এগিয়ে যেতে থাকে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।