দিল্লির মসনদ দখলের ভোটযুদ্ধে প্রতি ১০ বছর পর পর উপমহাদেশের প্রাচীন রাজনৈতিক দল এবং ধর্মনিরপেক্ষ উদার গণতান্ত্রিক ভারতের নীতির পথে অবিচল কংগ্রেসের জন্য নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। করুণ পরাজয় ১০ বছর পর পর কংগ্রেসের নিয়তিতে যেন লেখা হয়ে গেছে। এবারও টানা ১০ বছরের শাসনের পর লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস নিয়তির সেই অমোঘ বিধান ভোটযুদ্ধের করুণ পরাজয় দেখতে যাচ্ছে। জনমত জরিপ, ভারতজুড়ে মাতামাতি, পর্যবেক্ষক মহলের মতামত এবং সাধারণ মানুষের আলোচনায় কংগ্রেসের পরাজয় ভোটের আগেই নির্ধারণ হয়ে গেছে। দিল্লি সফরকালে সাধারণ ট্যাঙ্চিালক থেকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের সঙ্গে আলাপকালে এই আভাস পাওয়া গেছে।
যদিও কংগ্রেস সভানেত্রী ও মনমোহন সরকারের নেপথ্য শক্তি সোনিয়া গান্ধী সভা-সমাবেশে বলছেন, বিগত লোকসভা নির্বাচনে যেভাবে জনমত জরিপ ভুল প্রমাণ করে ভারতবাসীর রায় কংগ্রেস পেয়েছিল এবারের লোকসভা নির্বাচনে তারই পুনরাবৃত্তি ঘটতে যাচ্ছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ভোটের ময়দানে সোনিয়া গান্ধী কংগ্রেস নেতা-কর্মীদের চাঙ্গা রাখতেই এমনটি বলছেন। অব দ্য রেকর্ডে নানা জায়গায় কংগ্রেস নেতাদের অনেকেই স্বীকার করছেন, জনমত এবার তাদের অনুকূলে নয়। তারা বিরোধী দলে বসবেন কিন্তু যদি নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসে তাহলে ভারতবাসীর কপালে কী লেখা হবে তা জনগণই হিসাব করবে। যদিও প্রকাশ্যে কংগ্রেস নেতারা বলছেন, আমরা সব আসনেই শক্তিশালী প্রার্থী দিচ্ছি এবং ১০ বছরের শাসনামলের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে ভোট চাইছি।
পর্যবেক্ষকদের ভাষায় শরীরে অসুখ বাঁধা কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী পরিবারের চতুর্থ পুরুষ রাহুল গান্ধীকেই সভা-সমাবেশে সামনে এগিয়ে দিচ্ছেন। নিজে পিছু হটে রাহুলকে এই হিসাব থেকেই এগিয়ে দিচ্ছেন। এবারের লোকসভা নির্বাচনী ফলাফলে তার ছেলে বিরোধী দলের নেতা হলেও ভবিষ্যতে গণরায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর আসনে অভিষিক্ত হবেন।
পর্যবেক্ষকদের মতে, পণ্ডিত, সৎ ড. মনমোহন সিং ১০ বছরের শাসনামলে দক্ষ প্রশাসক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। অনেকের প্রশ্ন রয়েছে, মনমোহন প্রধানমন্ত্রী হলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা নিয়ে।
কেউ কেউ বলছেন, মনমোহন যা বিশ্বাস করেন না, তেমন সিদ্ধান্তও তাকে নিতে হয়েছে। ক্ষমতার নেপথ্যে সমালোচকদের ভাষায় মূলত সোনিয়াই ছিলেন। কংগ্রেস জোট সরকার যেমন অনেক শরিককে সঙ্গে ধরে রাখতে পারেনি তেমনি শক্তিশালী নেতৃত্ব দিয়ে দুর্নীতির লাগাম টানতে পারেনি। বিশেষ করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতি কংগ্রেসের জনপ্রিয়তা তলানিতে নিয়ে গেছে। আন্না হাজারি থেকে দিলি্লর পদত্যাগী মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়ালসহ সবাই কংগ্রেস সরকারকে দুর্নীতির অভিযোগে জনতার কাঠগড়ায় নিন্দিত করেছে।
আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো দূরে থাক কাজের বিনিময়ে খাদ্যসহ নানা সামাজিক প্রকল্প রাজকোষ খালি করে দিলেও মানুষকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। অলিম্পিক গেমস, টুজি ও কয়লা প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির গল্প ভারতের ১২০ কোটি মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঢেউ খেলে গেছে। এই ঢেউ কংগ্রেসকে গণঅসন্তোষে ফেলেছে। রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা দূরে থাক, পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মতো নেতৃত্বই দেখাতে পারেনি কংগ্রেস। এমনকি এই লোকসভা নির্বাচনে চিদাম্বরমের মতো সিনিয়র নেতা ও মন্ত্রী এবারের লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী না হয়ে নিজের ছেলেকে ভোটযুদ্ধে ঠেলে দিয়েছেন।
কংগ্রেসের ক্রাইসিস ম্যানেজারখ্যাত ও রাজনীতির মাস্টারমাইন্ড বলে পরিচিত প্রবীণ রাজনীতিবিদ প্রণব মুখার্জিকে রাষ্ট্রপতি ভবনে পাঠিয়ে কংগ্রেস তুরুপের শেষ তাসটিও হারিয়ে ফেলেছেন। দেশের মানুষ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ওপর প্রণব মুখার্জির গ্রহণযোগ্যতা ও প্রভাবের মাত্রা যতটা ছিল আজকের কংগ্রেসের নেতৃত্বে তা ধারণ করার মতো নেতৃত্বই গান্ধী পরিবারের পাশে নেই। ভোটের লড়াইয়ে ঝড় তুলে আসা ২০০২ সালের রক্তাক্ত গুজরাট দাঙ্গার খলনায়ক বিজেপির নরেন্দ্র মোদি পার্টির সিনিয়র নেতাদের কোণঠাসা করে, বিজেপিকে পর্যন্ত পেছনে ফেলে যেভাবে উঠে আসছেন তাতে অনেকেই বলছেন, লোকসভার ২০০ আসন লাভ করলেই তিনি প্রধানমন্ত্রী। সবাই মিলে যদি তাকে ১৬০-৭০ আসনে আটকে দিতে পারেন তাহলে নরেন্দ্র মোদি দিলি্লর মসনদের কাছে এসেও শেষ হোঁচটটি খেয়ে ফেলবেন। সেখানে কংগ্রেসসহ নানা দল মিলে আঞ্চলিক দলগুলোর ওপর নির্ভর করে একটি দুর্বল সরকার গঠনের পথ নেবে।
নির্বাচনের আগে কেউ বলতে পারছেন না সেটি সম্ভব কিনা। ভোটের হাওয়া এবং জনমত জরিপে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসছেন এমনটি যেন সবাই প্রায় মেনেই নিচ্ছেন। যে পশ্চিমারা নরেন্দ্র মোদিকে দাঙ্গাবাজ বলে নিন্দা করতেন তারাও সুর বদলাচ্ছেন। ভারতের পথে পথে, টিভি চ্যানেল ও রেডিওতে নরেন্দ্র মোদির সরকারের বিজ্ঞাপন তুঙ্গে। কংগ্রেসের বিজ্ঞাপন থাকলেও মোদির বিজ্ঞাপনের কাছে তা একেবারেই ম্রিয়মাণ।
লোকসভার ৫৪৩টি আসনের ২০০টিতেই বিজেপি শক্তিশালী প্রার্থী দিতে পারছে না। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি হিন্দি বলয়কে টার্গেট করে এক নম্বরে ভারত স্লোগান নিয়ে জোর প্রচারণা চালাচ্ছেন। তার সভা-সমাবেশও এতটাই উজ্জ্বল যে, রাহুল গান্ধীর জনসভায় মানুষ টানতে পারছেন না। সরকার গঠনে ২৭২ আসনের দরকার। নরেন্দ্র মোদি ২০০ জয় করলেই আঞ্চলিক দলগুলো সরকার গঠনে ভাগ নিয়ে সমর্থন দিয়ে বসবে এমনটি সবার ধারণা।
শোবিজ জগতের স্টারদেরও মোদি প্রাধান্য দিচ্ছেন প্রার্থী করার ক্ষেত্রে। অনেকের ধারণা পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি আসনের অন্তত ৩৪টিতেই তৃণমূল কংগ্রেস বিজয়ী হবে। সেই ক্ষেত্রে মমতার সরকারে অংশগ্রহণ না হলেও সমর্থন দানে শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে থাকবেন না বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা। তিস্তার পানি বণ্টন ও সীমানা ইস্যুতে কংগ্রেস যতটা বাংলাদেশের উদার ও বন্ধুভাবাপন্ন ছিল সে ক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদির সরকার গঠন হলে শেষ আশার আলো বাংলাদেশের জন্য নিভে যাবে এমন আলোচনাও ঠাঁই পাচ্ছে অনেকের মধ্যে। মমতা গোপনে বাংলাদেশকে কংগ্রেস সরকার তিস্তার পানি দিচ্ছে এই অভিযোগে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি সমালোচনার তীরই ছুড়ছেন না তিস্তা চুক্তিতেও ভাগড়া দিয়েছেন।
নরেন্দ্র মোদিকে সমর্থন দিলে এই ইস্যুতে তিনি দিলি্ল সরকারের মন পাবেন। এমনটি পর্যবেক্ষকদের ধারণা। কংগ্রেস মোদি ক্ষমতায় এলে আবার রক্তাক্ত দাঙ্গার আশঙ্কা তুলে ধরে ভোটারদের পক্ষে টানার শেষ চেষ্টা করছে। কিন্তু মোদি বলছেন, তিনি দাঙ্গার কথা বলছেন না, দাঙ্গার কথা বলছে কংগ্রেস। দাঙ্গার জুজুর ভয় দেখিয়ে কংগ্রেস ভোট নিতে চায়।
কিন্তু তিনি চান ভারতের উন্নয়ন। শক্তিশালী ভারত ও দুর্নীতির অবসান। দুর্নীতির বিরুদ্ধে দিলি্লতে ঝড় তুলেছেন কেজরিওয়াল। কংগ্রেস তাকে রুখতে পারেনি। বিধানসভায় রাজনীতিতে নবীন আম আদমি পার্টির কেজরিওয়াল ২৮টি আসন নিয়ে যাবেন ফলাফলের আগে কেউ ভাবতে পারেননি।
দিলি্লর ৭টি আসনের মধ্যে ৪-৫টি আসন নিয়ে সরকার গঠনে ভূমিকা রাখবেন কেজরিওয়াল। সুশীল সমাজ আমল না দিলেও দিলি্লর পথে পথে সাধারণ দরিদ্র মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হচ্ছে কেজরিওয়াল, কেজরিওয়াল। তাদের ভাষ্য, কেজরিওয়াল সৎ তার সঙ্গে দুর্নীতিবাজ নেতৃত্ব নেই। কংগ্রেসের ১০ বছরে ধনী-গরিবের ব্যবধান বেড়েছে অনেক। তাদের দুর্নীতিতে কংগ্রেস নেতা সুরেশকানমাদী জেলে গেছেন।
ভারতের রেলের কালোবিড়াল প্রবণবনশাল দুর্নীতির কারণে মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করেছেন।
রাজনৈতিক আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল কংগ্রেস ও গান্ধী পরিবার একসুতায় বাঁধা। ভারতকে এগিয়ে নিতে কংগ্রেস ও গান্ধী পরিবারের ভূমিকা উজ্জ্বল। কিন্তু প্রতি ১০ বছর পর পরই নিয়তির অমোঘ বিধানে কংগ্রেসকে ভোটযুদ্ধে ভরাডুবি দেখতে হয়। আর কংগ্রেসবিরোধী প্লাটফর্মে পরিবর্তনের দায়িত্ব নিয়ে বারবার বিভিন্ন নেতার আবির্ভাব ঘটে।
এবারও তাই ঘটতে যাচ্ছে। এবার কংগ্রেসবিরোধী মঞ্চ দখল করে নিয়েছেন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ও সেখানকার ব্যাপক উন্নয়নের রূপকার নরেন্দ্র মোদি। দিলি্লতে সমাজকর্মী আন্না হাজারে আর কেজরিওয়ালরা। নরেন্দ্র মোদি স্বপ্ন দেখাচ্ছেন, আর দুর্নীতি অন্যায় নয়, উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান। তরুণরাও তার দিকে ঝুঁকছেন।
উত্তর প্রদেশে ৮০টি আসন, বিহারে ৪০টি আসন। এগুলো মোদি দখল করতে চান। উত্তর প্রদেশে বিজেপির বর্তমান রয়েছে ১০টির মতো আসন। সেটিকে ৫০-এ নিয়ে যেতে চান। ভোটের আগে কংগ্রেসবিরোধী স্বপ্নের সওদাগর মোদি কতটা পাবেন আগে কেউ বলতে পারছেন না।
জরিপ বলছে, ২০০ ছাড়িয়ে যাবেন। '৬২ সালে চীন ভারত আক্রমণ করেছিল। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু সেই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না পেরে '৬৪ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। '৬৭ সালে ইন্দিরার নেতৃত্বে কংগ্রেস ক্ষমতায় এলেও '৭৭ সালের নির্বাচনে করুণ ভরাডুবি ঘটেছিল। কংগ্রেস ছেড়ে যাওয়া মুরারজি দেশাই কংগ্রেসবিরোধী মঞ্চ থেকে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।
ইন্দিরার দৃঢ় নেতৃত্ব ও বিচক্ষণতার কারণে রাজনীতির দাবা খেলায় জিতে দ্রুত ক্ষমতায় এলেও তার মৃত্যুর পর ছেলে রাজীব গান্ধী এসেছিলেন মিস্টার ক্লিনম্যান ইমেজ নিয়ে। বোফোর্স ক্যালেঙ্কারির পর '৮৯ সালে সেই কংগ্রেসবিরোধী প্লাটফরম থেকে এসেছিলেন ভিপি সিং। ১০ বছর আগে সোনিয়ার ক্যারিশমায় ক্ষমতায় আসা কংগ্রেসের ফের ভরাডুবি হতে যাচ্ছে এই নির্বাচনে। এবারও ভারতে কংগ্রেসবিরোধী প্লাটফর্মের প্রধানমন্ত্রী আসছেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।