গতকাল সৌরভের এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে। বিয়ের দিন ঠিক হয়েছে ১৫ দিন পর বাদ জুম্মা। সে নিজেই পছন্দ করেছে পাত্রী। মেয়েও দেখতে সুন্দর আর সবকিছু ঠিকঠাক দেখে ফ্যামিলিও আপত্তি করেনি। আর মেয়ে পক্ষ থেকে তো আপত্তি করার কোন প্রশ্ন আসেনা।
কারণ সৌরভের ফ্যামিলি তো খারাপ না। উচ্চ মধ্যবিত্ত একটা ফ্যামিলি, বাবা মার একমাত্র সন্তান, আর একটা ভাল মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরী করছে, সৌরভের আচার, ব্যবহার, চরিত্র সবই ভাল আর সবচেয়ে বড় কথা ছেলে মেয়ে দুইজন দুইজনকে পছন্দ করে। অর্থাৎ মেয়ে সুখে থাকার জন্য যা যা দরকার সবকিছুই ঠিক তাই সৌরভের ফ্যামিলি থেকে প্রস্তাব পাওয়া মাত্রই তারাও রাজি হয়ে গেছে।
সৌরভের বয়স এখন ৩২ বছর। বিয়ে করার জন্য পারফেক্ট একটা বয়স।
বাড়ি থেকে অবশ্য অনেক আগে থেকেই বিয়ের কথা বলছিল কিন্তু সৌরভ তাতে রাজি হচ্ছিল না। তার মতে লাইফ চলবে তার ইচ্ছে মত যখন যা খুশি করবে, যেখানে যেতে ইচ্ছে করবে সেখানেই যাবে, আর হ্যা একা তো সবসময় থাকা যায়না তাই একটা সুন্দর গার্ল ফ্রেন্ড থাকবে এই শেষ কিন্তু বিয়ের কথা বললে একটা বাধা, বন্ধন, দায়ীত্ব, কেমন যেন একটা গদবাধা রুটিন আর তার মনে হয় বিয়ে করলে বয়স বেশী হয়ে যায়। নিজের ইচ্ছে মত সব কিছু করার অধিকারটুকু থাকেনা তাই এতদিন যেভাবে পারে বিয়েটা পিছিয়ে দিতে চাইতো । বাবা মা এমনভাবে বলল যে না বলা তার জন্য অসম্ভব হয়ে গেছিল। তাই শেষ পর্যন্ত রাজিই হয়ে গেল।
কিন্তু গেল কিছুদিন যাবৎ তার কেমন যেন লাগছে। কোন কিছুতেই মন বসাতে পারছেনা। অস্থির লাগছে, মনে হচ্ছে নিজের বিবেক তাকে সবসময় দোষারোপ করছে। এনগেজমেন্টের দিনও সে খুব আপসেট ছিল। এটা খেয়াল করেছিল সৌরভের হবু বউ রিদিমা।
প্রশ্ন করেছিল এক ফাঁকে কিন্তু সেরকম কোন কিছু না বলে এড়িয়ে গিয়েছিল। সব সময় সে খুঁজে বেড়াচ্ছিল যে কেন এমন হচ্ছে। রিদিমার ফোন রিসিভ করলে ঠিক মত কথা বলেনা। অনেক সময় রিসিভ করেনা। তার বাবা মাও খেয়াল করেছে যে ছেলে কেমন যেন চুপ চাপ হয়ে গেছে।
তাকে এসে প্রশ্ন করে কি হয়েছে তোর? রিদিমার সাথে কোন ঝগড়া বা কোন কিছু? উত্তরে বলে না মা ওর সাথে ঝগড়া হবে কেন? এমনি ভাল লাগছেনা। কাউকে কোন সদুত্তর দিতে না পেরে নিজেই খুব বিরক্ত হয়ে আছে সৌরভ।
পড়ন্ত বিকেলে সে পার্কে এসে বসে আছে। বর্তমানে এমন একটা অবস্থা যে পার্কে নিরিবিলি কোন জায়গা খুঁজে পাওয়া খুব দুঃস্কর হয়ে গেছে। তার পরও মোটামুটি শান্ত একটা পরিবেশ দেখে বসেছে।
নিজের কাছে বার বার প্রশ্ন করছে কেন এমন লাগছে তার। পকেটের মোবাইলটা বন্ধ করে চুপচাপ ভাবতে লাগলো কেন এমন হচ্ছে। তার লাইফের প্রথম থেকে ঘটে যাওয়া এক একটি ছোট ছোট ব্যাপার মনে করার চেষ্টা করতে লাগলো। কোন কিছুই এটার সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়। হঠাৎ মুনিয়ার কথা মনে হতেই মনে একটা নাড়া দিল।
তাহলে কি এই নামটাই তার খারাপ লাগার কারণ?
মুনিয়া তারই ক্লাশমেট ছিল। প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়ার সময় তার সাথে পরিচয়। হালকা পাতলা গড়ন, গোলগাল মুখ, চোখে একটা চশমাও পরতো। সুন্দরীতো বলাই যায়। তাদের ফ্যামিলিতে বাবা মা ছাড়াও একটা ভাই ছিল।
যতটুকু মনে পড়ে তার একটা ফুফু থাকতো তার গ্রামের বাড়িতে। এখানে একটা হোস্টেলে থাকতো। তার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায়। বাবা মার ইচ্ছে ছিল যে মেয়েকে ইঞ্জিনিয়ার বানাবে। তাই পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স না পাওয়ায় তাকে তাকে ঢাকায় প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে দেয়।
পরিচয়ের পর এটা সৌরভ বুঝতে পারে যে মেয়েটার মেধা নেহায়েত কম না। পড়াশোনাতে খুব এটেনন্টিভ ছিল। রেজাল্টও ভাল ছিল মেয়েটির। ৩য় সেমিস্টারে এসে দুইজনের মধ্যে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়।
সৌরভ পড়াশোনায় খুব বেশী এটেন্টিভ ছিলনা।
সত্যি বলতে কি তার পড়াশোনা করতে ভাল লাগতো না। ক্লাশের সব নোট সাজেশন সব কিছুই মুনিয়াই সৌরভের জন্য নিয়ে রাখতো। যেখান থেকে পেত দুই কপি করে ফটোকপি করে রাখতো। সৌরভ জানতোই না যে কিভাবে এগুলো করা হয়েছে। বন্ধুরাতো বলতো যে একটা গার্লফ্রেন্ড জুটিয়েছিস যে কিনা পারলে তো পরীক্ষা দিয়ে দেয়।
সৌরভ মজা পেত। ভালই চলছিল সবকিছু । কিন্তু একটা ট্যুর সব ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল।
ফাইনাল সেমিস্টার পরীক্ষার পর সবাই বিভিন্ন যায়গায় চলে যাবে বলে পরীক্ষার কিছুদিন মাস ছয়েক আগেই একটা ইসকারসন এর ব্যবস্থা করা হল। সাত দিনের ট্যুর।
কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, চিটাগাং। খুব মজা হচ্ছিল। একটু বেশী মজা হলে যা হয় তাই হয়েছিল। পাঁচ সাতজন বন্ধু মিলে হার্ড ড্রিংক্স খেতে লাগল। মুনিয়াও ছিল সাথে।
এগুলো যদিও তার ভাল লাগেনা তার পরও একদিন বলে সৌরভকে না করেনাই। সৌরভ অভ্যস্ত না হাওয়ায় ভাসতে লাগল। অবস্থা বেগতিক দেখে তাড়াতাড়ি তাকে হোটেলে নিয়ে যাওয়া হল। কয়েকবার বমিও করে ফেলেছে এর মধ্যে। এই অবস্থায় তাকে ফেলে যেতে পারলো না মুনিয়া।
তার বন্ধুরা থাকতে চাইল কিন্তু মুনিয়া বলল, না তোদের থাকতে হবেনা যা তোরা মজা কর আমি আছি। মুনিয়া যে সৌরভকে অনেক বেশি ভালবাসে আর মেয়েটা অনেক বেশী দায়িত্বশীল তাই আর বেশী টেনশান না করে চলে গেল। শুধু যাওয়ার সময় বলে গেল যে বেশী সমস্যা হলে ফোন দিস।
কিছুক্ষন পর সৌরভ নিজেকে আবিষ্কার করল সে মুনিয়াকে জড়িয়ে ধরে আছে। পরে মুনিয়ার লজ্জা রাঙ্গা গাল বলে দিচ্ছে কি হয়েছে।
মুনিয়ার মুখের কথায় আরও বেশী অবাক হয়েছে সৌরভ। হাজার না করা সত্যেও সে এতই বেশি জোর করছিল যে মুনিয়া নিজেকে বেশিক্ষন আটকে রাখতে পারেনাই। হাজার হলেও অনেক বেশী ভাল বেসে ফেলেছিল যে মুনিয়া সৌরভকে। শেষপর্যন্ত নিজেকে সৌরভের কাছে উজার করেই দিয়েছিল। অবশ্য তার ফল পেয়েছিল দুই মাস পর।
যা হয়েছে তা একটা ঘোর ছিল বলে দুইজনেই স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু দুই মাস পর মুনিয়া বুঝতে পারে সেই ঘোর তার শরীরে আরেকটি শরীরের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। নিজে সিওর হবার জন্য বার বার পরীক্ষা করেছে কিন্তু বারবাই একই রেজাল্ট। কি করবে না করবে কিছু বুঝতে না পেরে খুব তাড়াতাড়ি সৌরভকে ফোন করে দেখা করতে বলে। বিকেলে লেকের ধারে দুই জন বসে আছে।
মুনিয়া কিছুক্ষন চুপচাপ থেকে সৌরভকে বলল ব্যাপারটা যেটার জন্য সৌরভ মোটেও প্রস্তুত ছিল না। কিছুক্ষন চুপচাপ থাকার পর সৌরভ যেটা বলল সেটর জন্য মুনিয়াও প্রস্তুত ছিলনা।
সৌরভ বলল যে মানুষ বছর বছর ট্রাই করে হয়না আর তুমি এটা কি বললা? অবাক হয়ে তাকালো মুনিয়া সৌরভের দিকে। আরও বলল যে ” আর যদি কনসেপ্ট করেই থাক তবে যতদ্রুত সম্ভব এবরসন করে ফেল”। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়েই রইলো মুনিয়া।
একবার শুধু সৌরভ তাকালো মুনিয়ার দিকে তার চোখ গুলো ছলছল করছে। আর তাকাতে পারলো না। কারন সে জানে যে সে কতটা অন্যায় কথা বলেছে। কিন্তু তার এই সময় এই দায়ীত্ব নেয়ার ক্ষমতা বা সাহস কোনটাই নাই। তার দুইটা কথায় মুনিয়া অনেক কিছু বুঝতে পারলো সৌরভ কি বলতে চাইছে।
চোখের জল আর ধরে রাখতে পারলোনা। মনে হয় সৌরভকে তার চোখের সেই পানি দেখাতেও লজ্জা বোধ করেছিল তাই চোখ নামিয়ে ফেলেছিল। তারপর কোন কথা ছাড়াই সেখান থেকে চলে গিয়েছিল।
তারপর ক্লাশে এসে সবার সাথে স্বাভাবিক ব্যবহার ই করতো। এমনকি সৌরভের সাথে।
সৌরভ একটা হাফ ছেড়ে বেঁচেছিল যে যাক এটা সে ভাল ভাবেই নিয়েছে। বুঝতে পেরেছে যে এই অবস্থায় এই সব দায়ীত্ব নেয়া কঠিন ই না একে বারে অসম্ভব। একবার জিজ্ঞেস করেছিল যে কবে করাচ্ছো? উত্তরে হেসে বলেছিল টেনশান নিওনা কিছুদিনের মধ্যেই করে ফেলবো। কিন্তু তার ভেতরে যে কি চলছিল সেটা তখনও বুঝতে পারেনাই সৌরভ।
পরীক্ষার দিন দেখে মুনিয়া নাই।
পরীক্ষা শেষে তার রুমমেট কে জিজ্ঞেস করাতে বলে বাড়ি চলে গেছে। বিকেলে বলে যে একটু বাইরে যাব তারপর আর ফেরেনি। একবার ফোন করেছিল আননোন নাম্বার থেকে যে সে বাড়ি যাচ্ছে। আর ফিরবেনা। তার পর তার মোবাইল বন্ধ।
সকালে তার বাবার নাম্বারে ফোন করাতে জানতে পারি তার বাড়িতে চলে গেছে। কেন এমন করল জানিনা। তুমি জানো কিছূ? না তো বলে তাড়াতাড়ি চলে গেল সেখান থেকে। যাবার সময় মুনিয়ার বাবার নাম্বারটা নিয়ে গেল।
তার বাবার নাম্বারে বেশ কয়েকবার ফোন করার পর মুনিয়াকে পেয়েছিল।
কিন্তু সে বলেছিল যে আমি তোমার কাছে কোনদিন কিছু চাইনি কিন্তু একটা জিনিষ তুমি আমাকে দাও, তুমি আমার বা আমার বাবার নাম্বারে আর ফোন দিও না। আমি যা করেছি তা আমার ভালর জন্য করেছি। তোমার ভালর জন্যও করেছি। তুমি পরীক্ষা ভাল ভাবে দাও। বাই।
কোন কথাও বলতে পারলোনা সৌরভ। তারপর আর ফোন করেনাই। কারণ তো সে জানে, আর সৌরভও চাচ্ছিল না যে তাদের ঘটে যাওয়া ব্যপারটা নিয়ে আর বেশি আলোচনা হোক।
রেজাল্ট এর পর দেশের বাইরে এম বি এ করতে চলে যায় সৌরভ। আড়াই বছর পর দেশে ফিরে।
তারপর তার বাবার লবিং এ একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরীও হয়ে যায়। কিন্তু এর মধ্যে মুনিয়ার কথাও সে ভুলে যায়। নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটে আর তার মধ্যে রিদিমার সাথে পরিচয়। এই সব কারনে মুনিয়ার চ্যাপটার একেবারেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। মনেই হয়নি তার যে এমন একটা সময় সে পার করে এসেছে।
একটা সিকিউরিটি গার্ড এর হুমকি ধামকিতে সে বর্তমানে ফিরে আসে। আজ সে গার্ড এর ব্যবহারে একেবারেই বিকক্ত নয়। শুধু সরি বলে সে পার্ক থেকে বের হয়ে আসে। তার মনে একটা স্বস্তি ফিরে এসেছে যে সে বুঝতে পেরেছে যে তার অস্বস্তি টা কোথায় ছিল। কিন্তু আরেকটা টেনশান তার মাথায় ঘুরপাক খেতে শুরু করল।
রিদিমার সাথে বিয়ে করলে কি সে শান্তিতে থাকতে পারবে? প্রতিনিয়ত কি মনে হবেনা যে সে একটা অন্যায় করে দিব্যি আছে? আসলেই কি সুখে থাকতে পারবে? মুনিয়ার কাছে কি সে ক্ষমা চাইবে? আদৌ কি সে তাকে ক্ষমা করছে? নাকি ক্ষমা করবে? আর যতদিন না সে এই ব্যাপারটা নিশ্চিত হচ্ছে ততদিন কি সুখে থাকতে পারবে? নাকি সে গিয়ে মুনিয়ার কাছে ক্ষমা চাইবে? হয়তো মুনিয়ার এখন দুইটা বাচ্চা হয়ে গেছে। সংসার করছে। দিব্যি আছে। এখন তার সামনে যাওয়া মানে আবার সেই সময়ে ফিরে যাওয়া যেখান থেকে বের হতে চাইছে সৌরভ আর হয়তো মুনিয়াও ভুলতে চাইছে। আর এই দিকে রিদিমা, বিয়ে করলে তার সাথে কি শান্তি পাবে? আর এই ব্যাপারটা না বলে বিয়ে করলে রিদিমাকে কি ঠকানো হবেনা?
সৌরভ ভাবলো আবারো স্বার্থপর হতে হবে তাকে।
অন্তত রিদিমার জন্য। আর নিজে থেকে রিদিমাকে এখন এই ব্যাপারটা বলতেও পারবেনা। তাই প্ল্যান করলো যে সে যাবে মুনিয়ার কাছে, গিয়ে ক্ষমা চাইবে আর রিদিমাও স্বচক্ষে দেখে নিক। যদি মেনে নিতে পারে তবে রিদিমাকে বিয়ে করবে, না হলে করবেনা। কিন্তু অন্তত নিজের মনকে স্বান্তনা দেয়া যাবে যে সে রিদিমাকে ঠকায় নি।
আর মুনিয়া যদি ক্ষমা করে দেয় তাইলে হয়তো বাকি জীবনটা এই অপরাধ বোধ থেকে কিছুটা হলেও মুক্ত হওয়া যাবে। সঙ্গে সঙ্গে যাদের সাথে যোগাযোগ ছিল তাদের ফোন করে জিজ্ঞেস করাতে কেউই মুনিয়ার ব্যাপারে কিছু বলতে পারলো না। তাই সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলল যে দেরি করা ঠিক হবেনা কালই যাবে মুনিয়ার বাড়িতে। সেখান থেকে ঠিকানা নিয়ে মুনিয়ার স্বামীর বাড়ি।
বাসায় ফিরতে ফিরতে রিদিমাকে বলল চল কাল একটা লং ড্রাইভে যাই।
অনেকদিন একটা ফ্র্ন্ডে এর বাসায় যাওয়া হয়না। রিদিমা রাজি হয়ে গেল। সকালে সে রিদিমাকে নিয়ে রওনা দিল ময়মনসিংহ এর উদ্দেশ্যে।
মুক্তাগাছায় এসে থামলো। মনে করতে থাকলো তার বাসার ঠিকানাটা কি।
বলেছিল মুনিয়া যে বাসস্ট্যান্ড এ নেমে যে কাউকে জিজ্ঞেস করলে বলে দিবে সোবহান চেয়ারম্যান এর বাড়ী কোনটা। একটা লোক কে জিজ্ঞেস করাতে সত্যি সত্যি বলে দিল যে সোবহান চেয়ারম্যান এর বাড়ির রাস্তা। গাড়ি নিয়ে হাতের বামে মাটির রাস্তা ধরে সামনে এগিয়ে বামে মোড় তার পর ডানে একটু এগুলেই যে তিন তালা বাড়ি সেইটাই নাকি মুনিয়াদের বাড়ি। মনের ভেতর এক আতংক আর অস্থিরতা নিয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে বাড়ির সামনে দাঁড়ায়। এখন মুনিয়ার সকল কথা মনে পড়ছে।
বলেছিল যে আমার বাড়ির সামনে একটা বড় পুকুর আছে। আর বাড়ির পেছনে মেহগনীর বাগান। গাড়ি থেকে রিদিমাকে নিয়ে এগিয়ে গেল বাড়ির মেইন গেটের দিকে। রিদিমা জানেও না এখানে কি হতে চলেছে। বরং অনেকদিন পর সৌরভের সাথে ঘুরতে এসে তার ভালই লাগছে।
আসার সময় কত কথাই না বলেছে সে।
দরজার বেল বাজাতেই একজন কাজের লোক দরজা খুলে বলল কারে চান? বলল চেয়ারম্যান সাহেব আছেন? নাতো বাড়িতে তো কেউই নাই, চেয়ারম্যান সাব গেছে সদরে আর ভাই ভাবী ঢাকায়। আপনারা কই থাইকা আইছুইন? বলল ঢাকা থেকে। পরে চেয়ারম্যান সাহেবের ওয়াইফের কথা বলাতে আছে বলে ভেতরে নিয়ে গেল। বসার ঘরে বসে আছে তারা দুইজন।
রিদিমা নিজেকে বারবার ঠিকঠাক করে নিচ্ছে। কিছুক্ষণপর আন্টি এলে কুশল বিনিময় করে জিজ্ঞেস করল তোমরা কোথা থেকে এসেছো?
- ঢাকা থেকে।
- কি ব্যাপার?
- ব্যাপার তেমন কিছু না। আমরা একটু এসেছিলাম ময়মনসিংহে তাই ভাবলাম একটু দেখা করে যাই। ও আচ্ছা বলতে ভুলে গেছি যে আমি মুনিয়ার বন্ধু।
ওর সাথেই দেখা করতে এসেছি। অনেকদিন প্রায় ৬-৭ বছর দেখাই হয়নি। এদিকে এসেছিলাম তাই ভাবলাম ওর সাথে দেখা করে যাই। ও এখন কোথায়?
কোন কথা বলল না আন্টি। চুপচাপ বসে থাকলো।
রিদিমার দিকে তাকিয়ে দেখল তার মনেও অনেক প্রশ্ন এসে ভিড় করতে
শুরু করেছে। কিন্তু বলার সময় এখন নয়। সেগুলোকে সম্পূর্ন রুপে ইগনোর করে আন্টিকে আবার প্রশ্ন করলো
- ও কোথায় থাকে?
- এখানেই থাকে।
একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে কথাটা বলল আন্টি। শুনে বুকের ভেতর ধক করে উঠল।
কিছুক্ষনের মধ্যেই হয়তো মুনিয়ার সাথে
দেখা হয়ে যাবে। কি বলবে? কি হবে। একটু সময়ের মধ্যেই হয়তো সব পরিবর্তন হয়ে যাবে। তার পরও সাহস করে বলল ওর সাথে একটু দেখা করা যাবে? আন্টি হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে বলল - এস।
তারপর ভেতরের দিকে নিয়ে গেল।
সৌরভ শুধু ভাবতে লাগল কোন ঘরটাতে যে নিয়ে যাবে। বাস্তবতার সাথে মুখোমুখি হতে মাত্র কয়েক মূহুর্ত। কিন্তু উনি পেছন দরজা দিয়ে বাড়ির পেছনের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। মনে হল হয়তো সেই মেহেগনীর বাগানে সে বসে আছে। এখনো বদলায়নি।
কিছুটা টেনশান আর কিছুটা নার্ভাসনেস নিয়ে উনার পেছন পেছন এগিয়ে যাচ্ছে। বাইরে বের হয়ে সৌরভের চোখ হন্যে হয়ে খুঁজছে মুনিয়াকে। একসময় আন্টি থেমে গেলেন। কিন্তু মুনিয়াকে দেখা যাচ্ছেনাতো। আন্টি আঙ্গুলের ইশারা করে সামনে দেখিয়ে বললেন এই যে মুনিয়া।
সামনে একটা কবর। চারপাশে দেয়াল। ভেতরে মাটি বসে গেছে। অনেক গাছ লতা পাতা উঠেছে তাতে। দেখেই মনে হচ্ছে অনেক আগের কবর এইটা।
হাত পা সৌরভের অবশ হয়ে গেল। বুকটা ভারী হয়ে গেল। মনের মাঝে হাজার প্রশ্ন এলোমেলো ঘুরপাক খাচ্ছে কিন্তু কোন কথায় মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না। শুধু একটা কথায় মুখ দিয়ে বের হল কিভাবে?
আন্টি বলতে লাগলেন - জানিনা আমারা কি পাপ করেছিলাম? স্বপ্ন দেখেছিলাম যে মেয়েকে ইঞ্জিনিয়ার বানাবো। ঢাকায় পাঠালাম তাকে পড়তে।
ওর ভাই কত করে নিষেধ করল তারপরও পাঠালাম। কিন্তু ওখানে একটা ছেলের সাথে সম্পর্ক তৈরি হয়। তাতে মেয়েটা আমার গর্ভবতী হয়। এমন অবস্থায় সে বাড়ি আসে যে তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েও কিছু করতে পারিনি। বাচ্চাটা জন্ম নেয়ার পর কাউকে কিছু না বলে অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়ে মেয়েটা আমার চলে যায়।
খুব অভিমানী মেয়ে। কতবার করে বললাম ছেলেটা কে বল আমরা তার কাছে যাব কিন্তু সে নাম বলেনি। তার বাবা চেয়ারম্যান বলে অনেক কথা শুনতে হচ্ছিল তাই নিজেই নিজেকে শেষ করে গেল। তবুও ছেলেটার নাম ঠিকানা কিছুই বলে যাইনি। শুধু লিখে গিয়েছিল যে আমার বাচ্চাটাকে একটু দেখে রেখো।
এটা পাপের না মা এটা ভালবাসার ফসল।
উনি কান্না আর ধরে রাখতে পারলেন না। দৌড়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেলেন। সৌরভ আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। হাঁটুর উপর বসে পড়ল।
তার পৃথিবী অসার হয়ে গেল। ভাবতে পারেনাই যে এই দিন তার জন্য অপেক্ষা করছিল। কত বড় পাপ সে করেছে। একটা মানুষের মৃত্যুর জন্য সে দায়ী। মুনিয়ার কি শুধু এই দোষ ছিল যে সে সৌরভকে ভালবেসেছিল? কত ঝড় ঝাপটা তার উপর দিয়ে গেছে।
তার সে দিব্যি সুখে দিন কাটিয়েছে। মাথা নিচু করে কাঁদতে লাগলো। অঝরে চোখের জল গড়াতে লাগলো।
একটা ছোট হাতের স্পর্শ পেল সৌরভ। বাচ্চাটি সামনে এসে বলল তুমি কাদছো ক্যানো? জল সিক্ত নয়নে বাচ্চার দিকে তাকিয়ে থাকলো সৌরভ।
বুঝতে বাকি থাকলো না যে এটি মুনিয়ার সন্তান। অর্থাৎ তারই সন্তান। তার চোখ যেন প্রশ্ন করছে আমার মাকে তুমি কেন মেরে ফেললে? তুমি একটা খুনি। তাকে জড়িয়ে ধরল সৌরভ। বুকের সাথে নিয়ে এবার হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল।
তার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে দৌড় দিয়ে ভেতরে চলে গেল। ক্ষমার অযোগ্য সৌরভ কবরের দেয়ালে মাথা রেখে কাঁদতে লাগলো।
রিদিমা সৌরভকে জিজ্ঞেস করলো
- তুমি বাচ্চাকে দেখে এভাবে কাদতে শুরু করলে কেন?
উত্তরে সৌরভ বলল
- কারণ আমি তার বাবা।
**----------------------------------//ÑÑÑÑÑÑÑÑÑÑÑÑÑÑÑÑÑÑÑÑÑÑÑÑÑÑÑ**
কয়েক বছর পর
একাকী বসে আছে সৌরভ। গাছের ছায়ায়।
নদীর পাড়ে। সামনে যতদুর যায় অসীমের দিকে তাকিয়ে সীমানা খুঁজতে থাকে। কিন্তু পায়না। সব সময় কিছু একটা খুঁজে। চল বাবা বাসায় যেতে হবে, কথাটা তার বাবাই বলে কিন্তু কোন রিয়াকশান নাই।
জোর করে নিয়ে আসে। বর্তমানে সে মানসিক রুগী। ডাক্তার বলেছে যে, ভাল তাকে করা যায় যে নিজে থেকে ভাল হতে চায় কিন্তু সে তো নিজে থেকেই ভালই হতে চায়না। ওয়েদার চ্যাঞ্জ করান দেখেন কিছু হয় কি। তাই খোলা হাওয়ায় তাকে নিয়ে আসে তার বাবা মা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।