দেড় বছর পর্যন্ত শিশির (ছদ্মনাম) ছিল একেবারেই স্বাভাবিক। বসা, হামাগুড়ি দেওয়া, হাঁটা—এগুলো সে যথাসময়েই করেছে। কিন্তু দেড় বছরেও ছেলে কোনো কথা বলে না! আচরণেও কী যেন সমস্যা! চিন্তিত হয়ে ওঠেন বাবা-মা। চিকিত্সকের পরামর্শে ‘শ্রবণ পরীক্ষা’ করার পরও কোনো সমস্যা ধরা পড়েনি। দুই বছর বয়সের পর থেকে আরও কিছু পরিবর্তন দেখা যায় শিশিরের—সমবয়সী শিশুদের সঙ্গে মিশতে আগ্রহ নেই, সারাক্ষণ যেন নিজের জগতেই থাকে, কারও চোখের দিকে সরাসরি তাকায় না, অনেক বেশি জেদ ওর।
হঠাত্ই চঞ্চল হয়ে ওঠে, হঠাত্ আক্রমণাত্মক হয়ে যায়। টেলিভিশনে পছন্দের কোনো বিজ্ঞাপন দেখলে অন্যকিছু নয়; বরং বিজ্ঞাপনের চরিত্রের অঙ্গভঙ্গি অনুকরণের চেষ্টা করে শিশির।
শিশিরের এ লক্ষণগুলো ঠিক কোনো স্বাভাবিক শিশুর লক্ষণ নয়। জন্ম-পরবর্তী এক বছরেরও বেশি সময় যেকোনো প্রতিবন্ধকতা ছাড়া বেড়ে উঠলেও এরপর শিশিরের আচরণে যে সমস্যাগুলো ফুটে উঠেছে তা আদতে একজন ‘অটিস্টিক’ শিশুর বৈশিষ্ট্য।
কী করে বুঝবেন শিশুটি অটিস্টিক কি না
অটিজমে আক্রান্ত শিশুর অন্য কোনো শারীরিক অসংগতি থাকে না বললেই চলে।
ফলে অনেক বাবা-মা শুরুর দিকে বুঝতে পারেন না যে তাঁর সন্তান অটিজমে আক্রান্ত। তাই জন্মের পর থেকে বেড়ে ওঠা পর্যন্ত নানাভাবে শিশুকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। বিশেষ কিছু লক্ষণ থাকলে শিশুকে চিকিত্সকের কাছে নিয়ে নিশ্চিত হতে হবে শিশু অটিজমে আক্রান্ত কি না। এই লক্ষণগুলো জানিয়েছেন ইনস্টিটিউট অব নিউরো-ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রিসার্চের সিনিয়র অকুপেশনাল থেরাপিস্ট ও লার্নিং ডিজঅ্যাবিলিটি কনসালট্যান্ট উম্মে সায়কা নীলা—
১. মা-বাবা বা অন্য কারও সঙ্গে দৃষ্টিসংযোগ (আই কন্টাক্ট) না করা।
২. নাম ধরে ডাকলে সাড়া না দেওয়া।
৩. পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ করা। যেকোনো একটি বিষয়ে বা একই খেলায় মগ্ন হয়ে থাকা।
৪. দুই বছর বয়স পর্যন্ত দু-একটিও অর্থবোধক শব্দ না বলতে পারা।
৫. অতি চঞ্চলতা, আক্রমণাত্মক বা আত্মঘাতী আচরণ করা।
৬. শব্দ, গন্ধ, বর্ণের প্রতি অতি সংবেদনশীল ও স্পর্শকাতর হওয়া।
অবশ্য দেড়-দুই বছর পর্যন্ত এগুলো একেবারেই প্রাথমিক সমস্যা। এর সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক নানা সমস্যাও দেখা যেতে পারে। যেমন—শারীরিক ভারসাম্যহীনতা, নিদ্রাহীনতা, ভয়ভীতি, খিঁচুনি প্রভৃতি।
সবার আগে পারিবারিক সচেতনতা
শিশুর এ সমস্যাগুলো একসময় খুব বেশি আমলে নেওয়া হতো না। অনেক পরিবারেই এ ধরনের শিশুকে ‘বোকা’ বা ‘হাবাগোবা’ হিসেবে চিহ্নিত করা হতো।
একটি সচ্ছল, শিক্ষিত পরিবারে জন্মানো শিশুর বেড়ে ওঠার সময়টা পরিবারের সদস্যরা সচেতনভাবে তার শারীরিক কিংবা মানসিক সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে পারেন বা খেয়াল করেন। কিন্তু একটি কম সচ্ছল ও অনগ্রসর পরিবারে কিংবা গ্রামে বেড়ে ওঠা শিশুর ক্ষেত্রে তেমনটা নাও হতে পারে।
অটিজম সম্পর্কে তাই সচেতনতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শহর, গ্রাম, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র—সবার সচেতনতাই অটিস্টিক শিশুকে সুন্দর ও অনেকটাই স্বাভাবিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত করতে পারে।
একটি শিশু অটিস্টিক হলে পরিবারের সবার সমান অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাকে যতটুকু সম্ভব সুস্থ রাখার চেষ্টা করতে হবে।
অটিস্টিক শিশু শিশিরের মা সায়মা জাহান (ছদ্মনাম) বলেন, ‘শিশির অটিজম রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে নতুন জীবন শুরু হয়েছে আমাদের। আমার নতুন জীবন আমাকে শিখিয়েছে কীভাবে দুঃখের মধ্যেও হাসতে হয়, কীভাবে বিষাদের মধ্যেও কল্যাণ আবিষ্কারের চেষ্টা করতে হয়। আমার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই শিশিরের জন্য নিবেদিত। ’
একজন অটিস্টিক শিশুকে দিনের পর দিন ধৈর্য ধরে চিকিত্সার মাধ্যমে মোটামুটি একটি পর্যায়ে নিয়ে আসা সম্ভব বলে মনে করেন অকুপেশনাল থেরাপিস্ট ও লার্নিং ডিজঅ্যাবিলিটি কনসালট্যান্ট উম্মে সায়কা নীলা। তিনি বলেন, ‘এক বা দুই বছর চিকিত্সা দেওয়ার পর থেমে গেলে তা শিশুর জন্য ফলপ্রসূ নয়।
এ ধরনের শিশুরা নিজের কাজগুলো নিজে করতে পারে না, সে ক্ষেত্রে শিশুর সেন্সরি স্টিমুলেশন (চারপাশের পরিবেশ দেখে, শব্দ শুনে এবং কারও সঙ্গে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার উদ্দীপনা) বাড়াতে হবে। দিনের পর দিন চিকিত্সকের পরামর্শ অনুযায়ী শিশুর সেন্সরি স্টিমুলেশন বাড়ানোর জন্য পরিবারকে কাজ করে যেতে হবে। এটা একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। এ ক্ষেত্রে পরিবারের সবাইকে ধৈর্য ধারণ করতে হবে। ’
সামাজিক সচেতনতা
অনেক অভিভাবক আছেন যাঁরা অটিস্টিক শিশুকে বাইরে বেড়াতে নিয়ে যেতে চান না সামাজিক প্রতিক্রিয়ার কারণে, লোক-লজ্জায় ভয়ে।
উম্মে সায়কা নীলা বলেন, একটা অটিস্টিক শিশুর জন্য সমাজের মধ্যে অবস্থান করাটা জরুরি। কিন্তু সমাজের মানুষের মধ্যে এ বিষয়টি নিয়ে নানা ধরনের নেতিবাচক মনোভাব কাজ করে, যেটা ঠিক নয়। মনে রাখতে হবে যেকোনো শিশুই অটিজমে আক্রান্ত হতে পারে। তাই সমাজের সব স্তরেই সচেতনতা প্রয়োজন।
রাষ্ট্রীয় সচেতনতা
সামাজিক সচেতনতা তখনই পরিপূর্ণভাবে তৈরি করা যায় যখন রাষ্ট্র সেই বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টাভিত্তিক সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের (সিডিসি) এক জরিপে দেখা গেছে, দেশটিতে প্রতি ৬৮ জনে একজন শিশুর অটিজম রয়েছে। দুই বছর আগেও এই হার আরও কম ছিল, ৮৮ জনে একজন। আমাদের দেশেও অটিস্টিক শিশুর সংখ্যা কম নয়। কিন্তু এখনো এ বিষয়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কোনো জরিপ হয়নি। অটিস্টিক শিশুদের নিয়ে কাজ করে এমন সংগঠনগুলো বেশির ভাগই শহরকেন্দ্রিক।
অথচ গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও অটিজমে আক্রান্ত শিশু রয়েছে। তাদের জন্য বিশেষায়িত স্কুল নেই, সঠিক দিকনির্দেশনা ও সচেতনতার অভাবে তারা সমাজের বোঝারূপে বেড়ে উঠছে। তাই রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে এই সমস্যা নিরসনে। এ প্রসঙ্গে উম্মে সায়কা নীলা বলেন, একটি অটিস্টিক শিশু যখন ছোট থাকে, তখন তাকে যতটা সহজে দেখাশোনা করা যায়, শিশুটি বড় হলে কাজটা তত সহজ নয়। তা ছাড়া মা-বাবা তো আর সারাজীবন থাকবেন না, তখন তাদের কী হবে? তাদের পড়াশোনা ও কর্মসংস্থানের কী হবে? সে বিষয়ে অনেক মা বাবাকেই উদ্বিগ্ন হতে দেখা যায়।
তাই এ বিষয়ে রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ এবং সামাজিক উদ্যোগ একান্ত কাম্য।
একটি শিশু কেন অটিজমে আক্রান্ত হয়, এখনো তার কোনো সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। তবে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, মনোবিকাশের প্রতিবন্ধকতা, মস্তিষ্কের অস্বাভাবিক জৈব রাসায়নিক কার্যকলাপ, বংশগতির অস্বাভাবিকতা, এমনকি বিভিন্ন টিকা প্রয়োগের কারণেও এটা হতে পারে। তবে এখনো সুনির্দিষ্টভাবে বিষয়টি জানা যায়নি। অটিজমের স্পষ্ট কারণ জানা গেলে হয়তো এর নিরাময় সম্পর্কেও আরও ভালোভাবে জানা যাবে।
তাই এ সমস্যা নিরসনে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। অটিস্টিক শিশু বেড়ে উঠুক আপনার-আমার সবার ভালোবাসায়।
প্রতিবন্ধী শিশুদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা হবে: শেখ হাসিনা
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।