আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একটি বালিশের আত্মকাহিনী

একট বালিশের আত্মকাহিনী।

আমার নাম বালিশ। আমার জন্ম টুকু মিয়ার দোকানের বারান্দায়। টুকু মিয়া যখন পরম আদরে আমার খোলের মধ্যে নরম নরম তুলা ভরে দিচ্ছিল তখন আমি প্রথম পৃথিবীর আলো দেখলাম। টুকু মিয়া পাগলা কিসিমের মানুষ ছিল।

আমাকে বানিয়ে যখন দোকানের সেলফে সাজিয়ে রাখছিল তখন আমাকে বলছিল, 'বুঝলা বাপ তোমারে আমি এই যে বানাইলাম, এরপর কত মানুষ তোমার গায়ে মাথা রেখে আরাম করবে। কত সুখের ঘুম দিবে। তুমি কিন্তু কাওরে হতাশ করবা না। আমার সুনাম রাখবা। '

সেই দিন থেকে আমি আমার মানুষের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।

কবে সেই মনের মানুষ আসবে। যার সুখের জন্য আমি নিজেকে উৎসর্গ করব।

আমাকে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হল না। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সদ্য ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া এক ছাত্র আমাকে কিনতে এল। তাকে দেখেই আমার পছন্দ হল।

কি সুন্দর মাথা। ঝাঁকড়া চুল। আহা এই মাথা আমার বুকে ঠায় দিতে পারলে না জানি কত ভাল লাগবে।

অবশেষে বহু মুলামুলি করে টুকু মিয়ার কাছ থেকে আমাকে কিনে নিল ছেলেটি। সেটি ছিল আমার জীবনের সব থেকে খুশির দিন।

অবশেষে আমি মানুষের আরামের কাজে লাগতে পারছি ভেবে আমার কি যে খুশি লাগছিল। ছেলেটি যখন আমাকে বগলদাবা করে রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল তখন গর্বে আমার বুক ফুলে উঠছিল। আশেপাশে সবাইকে ডেকে আমার খুশির খবর দিতে ইচ্ছে করছিল।

ছেলেটি আমার জন্য সুন্দর ফুলের ছাপা দেওয়া একটা কভার কিনে দিয়েছিল। আহা কি সুন্দর ডিজাইন।

কভার পেয়ে আমি আমার মামা বিছানাকে ডেকে বললাম, 'দেখ হে বিছানা মামা তোমার চেয়ে আমার ডিজাইন কত সুন্দর। '

আমার ঠায় হল ঝকঝকে পরিস্কার এক বিছানায়। বিছানা মামার সাথে আমার খুব খাতির হয়ে গেল। আমি দিন রাত তার সাথে গুটুর গুটুর করে গল্প করে কাটিয়ে দিতাম।

দিন যায় মাস যায়, আমি আমার মালিককে প্রত্যেক রাতে আরামের ঘুম দিতে লাগলাম।

আহা কত শত স্মৃতি যে জমা আছে সেই সব রাতের। কোন কোন রাতে আমার মালিক আমাকে বুকের সাথে চেপে ধরে তার প্রিয়তমার সাথে আলাপ করত। আহা কি রোমান্টিক সেই সব দিন ছিল।

একদিন হঠাৎ করেই দেখলাম আমার মালিকের চোখ মুখ থমথম করছে। ফোনে প্রিয়তমার সাথে সে কি ঝগড়া।

ঝগড়ায় আকাশ বাতাস কাপতে লাগলো। ঝগড়ার প্রথম ঝাপটা গেল বিছানা মামার উপর দিয়ে। রাগের চোটে আমার মালিক বিছানায় নির্বিচারে কিল মারতে লাগল। আহা বেচারা কত ক্যাঁচক্যাঁচ করে আর্তনাদতটাই না করল। তবুও মাফ পেল না।



তার পর হঠাৎ করেই রাগ এসে পড়ল আমার উপর। হাতের কাছে আমাকে পেতেই ভয়ে আমার ভিতর ছ্যাত করে উঠল। তারপর শুরু হল তান্ডব। কোথায় গেল আমার কভার, কোথায় গেল আমার তুলা। আমি জ্ঞান হারালাম।



যখন জ্ঞান ফিরে পেলাম তখন অনেক রাত। আমাকে কভার দিয়ে ঢেকে ফেলা হয়েছে। তবুও বুঝতে পারলাম ভিতরে ভিতরে কতটা জখম আমি। হঠাৎ করেই অনুভব করলাম আমার গায়ে কোত্থেকে ফোঁটা ফোঁটা গরম পানি পড়ছে। অবাক হলে লক্ষ্য করলাম আমার মালিক আমার উপর মাথা রেখে নিশ্বব্দে কাঁদছে।

দেখে আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। মালিকের জন্য আমারো কেমন যেন কষ্ট হতে লাগল।

বিছানা মামার কাছে শুনলাম আমার মালিকের গার্লফ্রেন্ডের সাথে ব্রেকাপ হয়ে গিয়েছে। ব্রেকাপ জিনিশটা কি আমি ঠিক মত না বুঝলেও বুঝলাম এটা খুব কষ্টের ব্যাপার।

আমি যতটা সম্ভব আমার মালিকের রাতে সুখের ঘুম দিতে চেষ্টা করতে লাগলাম।

কিন্তু সে সারারাত কিছুতেই ঘুমাতো না। সারা রাত আমার উপর এপাশ ওপাশ করতে থাকত। আহা মালিকের জন্য আমার খুব করুনা হতে লাগল।

প্রথমবারের মত যখন সে ১৫ দিনেও আমার কভার বদলে দিল না তখনো আমি মন খারাপ করলাম না। মনে মনে ভাবলাম, আহা বেচারা ব্রেকাপ করে খুব কষ্টে আছে তাই হয়ত আমার কথা ভুলে গিয়েছে।



কিন্তু তার পর মাস পেরিয়ে গেল। আমার কভার ময়লায়, চুলের তেলে চিটচিটে হয়ে গেল। তবুও আমার মালিক আমাকে পরিস্কার করল না। আমার দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল।

তবুও আমি সব সহ্য করে নিলাম।

মালিকের দিন খুব খারাপ যাচ্ছিল। মালিকের জন্য আমার কষ্ট হতে লাগল।

তারপর ঘটল সেই ঘটনা বা দুর্ঘটনা যা আমি কোন দিনও ভুলব না। রোজকার রাতের মত সেদিনো দুর্গন্ধে ভরা কভার নিয়ে মালিকের অপেক্ষা করছিলাম। মালিক সেদিন অনেক রাত করে ঘরে ফিরল।

ঘরে ফিরেই আমাকে মাথায় দিয়ে উসখুস করতে লাগল। হঠাৎ করেই আমাকে টেনে মাথা থেকে নিচে নামিয়ে নিল।

তারপর আমাকে কোলবালিশের মত.. ছি ছি আমি আপনাদের সেই কথা বলতে পারব না। এতটা খারাপ মানুষ কিভাবে হতে পারে?! ঘৃণায় আমার সারা গা জ্বলে পুরে যেতে লাগল।

সেই দিন থেকে আমার অবস্থা আরো শোচনীয় হতে লাগল।

একদিন এক নতুন কভার এসে আমার নোংরা কভারের উপর চাপিয়ে দেয়া হল। তার পর সেটাও একদিন ময়লা হয়ে গেল। তার উপর আরেকটা নতুন চাপিয়ে দেয়া হল।

আমার স্বাস্থ্য হল দেখার মত। যে মানুষই রুমে আশে আমাকে নিয়ে আরাম করতে চায়।

কিন্তু ভিতরে ভিতরে ততদিনে আমি শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম। মানুষকে সুখ দিতে দিতে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম।

সব থেকে কষ্ট পেলাম যেদিন, সেদিন আমি সত্যি সত্যি ভেবেছিলাম আত্মহনন করব। আমার মালিক আমার উপরের ময়লা কভারটা খুলে ফেললেন। ফেলে যখন তার এক বন্ধুকে ডেকে বললেন, 'দ্যাখ নিচের কভারটাই বেশি পরিস্কার মনে হচ্ছে না?'

রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছিল।



তারপর আরো অনেক দিন যেতে লাগল। জীর্ণ শীর্ণ আমি ধুঁকে ধুঁকে মালিকের সেবা করে যেতে লাগলাম। মালিক ও আমাকে প্রায় প্রায় মাঝরাতে ছিঁড়েখুঁড়ে ব্যাবহার করতে লাগল। আমি মরে গিয়েও বেঁচে ছিলাম আরো কিছুদিন।

একদিন হঠাৎ করেই মালিক আমাকে বগলদাবা করে বাহিরে নিয়ে গেলেন, আমার সব নোংরা কভার থেকে মুক্তি দিলেন।

রোদের আলোয় আমার গা জুড়িয়ে গেল। মালিকের উপর মনটা খুব ভাল হয়ে গেল। হয়ত এবার একটা পরিস্কার কভার মিলবে। কিছু তুলাও হয়ত মিলবে। মনটা খুশিতে নেচে উঠল।



কিন্তু একি! মালিক আমাকে যেন কোথায় নিয়ে চললেন। তার পর আমাকে ছুড়ে ফেললেন। আমি অবাক হয়ে নিজেকে আবিস্কার করলাম একটা পচা খাবারে ভর্তি ডাস্টবিনে। আমার গন্ধে বমি আসতে লাগল। আমি চিৎকার করে কাঁদলাম, কত সাহায্য চাইলাম।

কেউ আমার দিকে ফিরেও তাকাল না।

তারপর একদিন কোমল চেহারার একটা পিচ্চি মেয়ে আসল সারা গায়ে ধূলো মেখে। আমাকে ডাস্টবিন থেকে টেনে বের করল। আমাকে বাসায় নিয়ে গেল। তার মা খুব সুন্দর করে সুই সুতা দিয়ে আমাকে মেরামত করলেন।

তার পর কি সুন্দর একটা কাভার আমাকে পরিয়ে দিলেন। এত খুশি লেগেছিল আমার। খুশিতে কেঁদে ফেলেছিলাম।

তার পর থেকে সেখানেই আমি থাকতে লাগলাম। বুঝলাম কারো অবহেলায় আসলেই কিছু যায় আসে না।

কারো ভালবাসায় অনেক কিছু যায় আসে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.