আমার বাবা (তারেক-উল আলম) গত বছর কেনাডা বেড়াতে এসেছিলেন। কেনাডা থেকে দেশে ফিরে একটা বই লিখেছেন – ‘কানাডায় ৭০ দিন’। আজ পড়ুন এর ১৯ তম পর্বঃ
কানাডার আবহাওয়া
কানাডার লোকেরা রসিকতা করে বলে, ‘এখানকার তিন ডব্লিউকে বিশ্বাস করোনা’। কারা এই তিন ডব্লিউ ? এরা হলো কানাডার মেয়ে মানুষ (Woman), কাজ (Work) এবং আবহাওয়া (Weather)। প্রথম দু’টি রসিকতার সত্যতা কতদূর জানিনে তবে তৃতীয়টির সত্যতা বিছুটা উপলদ্ধি করেছি।
প্রতিদিন ভোরে ঘন্টাখানেক প্রাতঃভ্রমন আমার অনেক দিনের অভ্যাস। এখানে এসে ও সেই অভ্যাস ত্যাগ করতে পারিনি। আর পারবোই বা কেমন করে ! এখানে প্রাতঃভ্রমনের যে চমৎকার পরিবেশ তা আমাদের দেশে কোথায় ! সুবিস্তৃত রাস্তার পাশেই পায়ে চলা পথ সমান্তরালে চলে গেছে। সারি সারি গাছ, চোখ জুড়ানো সবুজ ঘাসের মাঠ, বাগান, পরিষ্কার ঝকঝকে পথঘাট যেখানে একটা কাগজের টুকরো পর্যন্ত পরে থাকে না। কোন রকম ময়লা বা ধূলোবালি নেই।
কেবল ফ্রেশ অক্সিজেন বুকে টেনে নেয়া !
কিছু দূর পরপর গাছের নিচে বেঞ্চপাতা বিশ্রাম নেয়ার জন্যে। এতো সব চিত্তবিনোদক সুযোগ সুবিধা শুধু ভ্রমন পিপাসুদের জন্যে, পথচারিদের জন্যে। ভুলক্রমে কখনো আপনি রাস্তা পার হতে গেলে সমস্ত গাড়ি থেমে যাবে আপনার জন্যে যতোক্ষনে না আপনি ওপারে পৌঁছাবেন। যাত্রীর জন্যে, বয়স্কদের জন্যে এবং শিশুদের জন্যে সর্বাধিক নিরাপত্তা অন্য সব কিছুর আগে। কারণ, পথে এরা সবচেয়ে বেশি নিরীহ, সবচেয়ে অসহায়।
অসহায়কে সহায়তা করা এদের ধর্ম, এদের মানবতা বোধ। তাই এখানে পথ চলা একান্ত নিরাপদ। বিশেষ করে আমাদের মতো বয়স্কদের।
যাই হোক, যা বলতে চেয়েছিলাম--ভোর ছ’টা বাজতেই প্রতিদিনের অভ্যাস মতো আমি প্রাতঃভ্রমনে বের হই। বেরুবার পূর্বে প্রতিদিন বৌমা এসে আমার হাতে একটি ছাতা ধরিয়ে দেয়।
প্রথম দিন জিজ্ঞেস করতে বললো, ‘আব্বা, এখানকার বিধঃযবৎ এ বিশ্বাস নেই। আপনি এটা সাথে রাখুন’। আধা ঘন্টা হাঁটলাম বড় রাস্তার পাশ দিয়ে ফুটপাত ধরে। হঠাৎ দেখি ঠান্ডা বাতাস শুরু হয়েছে এবং আকাশ অন্ধকার হয়ে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। আপনাকে সুযোগই দিলো না অন্য কোথাও আশ্রয় নেয়ার।
ভাগ্যিস, বৌ-মার দেয়া ছাতাখানা সাথেই ছিলো।
বৃষ্টি অবশ্য পাঁচ সাত মিনিটের বেশি স্থায়ী ছিলো না। কিন্তু এখানে তো রাস্তার পাশে কোন আশ্রয়স্থল নেই। এমন কোন বাড়ি বা আশপাশে দোকানপাট নেই যেখানে গিয়ে আপনি কিছুক্ষনের জন্যে আশ্রয় নেবেন। অবশ্য মাঝে মাঝে কাঁচের ঘেরা যাত্রী ছাউনি যেখানে বাস এসে থামে।
কিন্তু তাও যথেষ্ট দূরে দূরে। অতএব এহেন অবস্থায় ছাতাই মাথা বাঁচানো একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়।
এখানকার আকাশ এই ঝকঝকে পরিষ্কার এই অন্ধকার। এই ঠান্ডা বাতাস- এই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। আপনাকে নোটিশ দিয়ে আসবে না আবার বেশিক্ষন থাকবেওনা।
কখনো হঠাৎ হঠাৎ ঠান্ডা বাতাস শুরু হয়ে যায়। হালকা গরম কাপড় তাই সাথে না রাখলেই নয়।
এখানকার আবহাওয়ার উপর তাই আপনি সব সময় বিশ্বাস রখতে পারবেন না। আপনাকে প্রস্তুতি নিয়েই বেরুতে হবে।
নিঃসঙ্গ পথচলা
গত ক’দিন ধরে কানাডায় প্রচন্ড গরম।
কে বলবে শীতের দেশে এতো গরম ! লন্ডনে ঝকঝকে আকাশ, উত্তপ্ত রোদ। তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড হলেও মনে হচ্ছে ৪৫ ডিগ্রি। অনেকটা গ্রীষ্মের বাংলাদেশের মতো তবে অতো অস্বস্তিকর নয়। এখানে বাতাসের র্আদ্রতা কম বলে ঘাম হয় না। শেষ রাতের এক পশলা বৃষ্টিতে তাপমাত্রা ২২ ডিগ্রির কাছাকাছি চলে এসেছে।
আজকের আবহাওয়া তাই অত্যন্ত আরামের এবং স্বস্তির।
আজ একা ঘুরতে বের হলাম। উদ্দেশ্য পথঘাট চেনা। এখানে প্রায়ই পথঘাটে খেই হারিয়ে ফেলি। সব বাড়ি, রাস্তা, গলি একই রকম মনে হয়।
শুভ ছাড়া দূরে কোথাও যাইনি। তাই আজ লন্ডন শহরের ম্যাপ নিয়ে বের হলাম। আজ একা একা ঘুরবো।
প্ল্যাটস লেন পার হয়ে চেরিহিল গার্ডেনের ফুটপাত দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। বিশাল এলাকা জুড়ে বাগান।
বাগানের মধ্যেই বড় বড় অট্টালিকা। কোনটা ছ’তলা ফ্ল্যাট বাড়ি আবার কোনটা বা বিশ তলা। সুন্দর নিরিবিলি সুনশান পরিবেশ। কোন সাড়া শব্দ নেই অথচ বাড়িগুলোতে শত শত মানুষের বাস। বাসিন্দারা অবসর প্রাপ্ত ব্যক্তি।
হয় স্বামী-স্ত্রী নয়তো একা। পুত্র কন্যারা থাকে অন্যত্র নিজ নিজ সংসার নিয়ে। এখানে একান্নবর্তী পরিবার নেই। এমনকি বাবা মার সাথেও থাকেনা কেউ। তাই বৃদ্ধরা একা, অসহায় ! অসহায় ? না, তা নয়, সরকার আছে তাদের জন্যে।
সরকার দেখা শোনা করে তাদের। প্রচুর অবসর ভাতা দেয়, অনেক টাকার পেনশন। চমৎকার ফ্ল্যাট বাড়ি তাদের জন্যে। তাদের জন্যে ডাক্তার, নার্স সব ফ্রি। তাদের দেখা শোনার জন্যে, খাওয়ানোর জন্যে, সেবা যতেœর এমনকি গোসল করানোর জন্যে প্রয়োজনে রয়েছে শিক্ষিত অ্যাটেনডেন্ট, সেবাদানকারি নার্স।
বৃদ্ধদের আবাসনের কাছেই রয়েছে চেরিহিল মল। আছে খাবারের দোকান, ওষুধের দোকান, বইপত্রের দোকান, পোস্ট অফিস, ব্যাংক ইত্যাদি। ‘মেট্রো শপিং মল’ তাদের জন্যেই। সব কিছুই তাদের হাতের নাগালের মধ্যে। কিন্তু তবুও তারা দুঃখী, তারা অসহায়।
কারণ তাদের আপনজন, তাদের সন্তানেরা তাদের সাথে থাকেনা-- নাতি নাতনিদের কাছে পায়না। বৃদ্ধ বাবা-মা যেনো তাদের বোঝা ! তাইতো তারা অসহায়, তারা দুঃখী।
এদিক থেকে আমরা অনেক ভাগ্যবান। আমাদের সামাজিক বন্ধন, ধর্মীয় অনুশাসন, স্নেহ মমতা ভালবাসা এবং পরস্পর নির্ভরতা আমাদের দৃঢ বন্ধনে আবদ্ধ রেখেছে। বৃদ্ধ বয়সে সন্তানেরা আমাদের কাছে থাকে, আমাদের সেবা যতœ করে।
সামাজিক মর্যাদায় তারা হয় গৌরবান্বিত। বাবা- মা একদিন তাদের জন্যে, তাদের সুখের জন্যে জীবনের সব কিছু উৎসর্গ করেছে। এখন তারা হয়েছে বৃদ্ধ, হয়েছে অসহায় শিশুর মতো। সন্তানের স্নেহ মমতা ভালোবাসা ছাড়া তাদের আর কিছুই চাওয়া পাওয়ার নেই। তাই সন্তানেরা তাদের সাথে থাকে, কাছে রাখে।
তারা তাদের দায় এড়ায় না। পশ্চিমা বিশ্ব থেকে এই একটি জায়গায় আমরা এগিয়ে।
বৃদ্ধদের জন্যে এখানে রয়েছে চেরিহিল মল। সকালে বিকেলে তারা হাঁটতে হাঁটতে টিমর্হটন অথবা অন্য কোন খাবারের দোকানে গিয়ে বসে, খায়, আড্ডা দেয়। মেট্রো থেকে প্রয়োজনীয় কেনাকাটা সারে।
যে কোন দোকানে, যে কোন চিত্ত বিনোদন কেন্দ্রে, সিনেমা থিয়েটারে, খাবারের দোকানে তাদের জন্যে ১০ শতাংশ ছাড়, এটা আইন করা। এককালে তারা দেশকে দিয়েছে এখন দেশ তাদের দেবে।
চেরিহিল গার্ডেনের মাঝ দিয়ে রাস্তা চলে গেছে। রাস্তার দুই পাশ দিয়ে চলে গেছে পায়ে চলা পথ। ঘাসে ঢাকা সবুজ বাগান।
বড় বড় গাছ রাস্তার পাশে অথবা বাগানে। কিছু দূর পরপর বেঞ্চপাতা যাতে পথচারীরা বিশ্রাম নিতে পারে। চারদিকে ফুলের বাগান- অতি যতেœ গড়া। মাঝে মধ্যে বড় বড় ফ্ল্যাট বাড়ি। বাড়ি যতো বড় তার পাঁচ গুণ বেশি খোলা জায়গা গাড়ি রাখার জন্যে, গাড়ি পার্কিংয়ের জন্যে।
শুধু বাড়িতে নয় প্রতিটি মলে, প্রতিটি মার্কেটে এই ব্যবস্থা। পার্কিং ছাড়া গাড়ি রাখার, গাড়ি ঘোরানোর কোন উপায় নেই। আইনের প্রতি সবাই সচেতন। নিয়মের বাইরে কেউ নেই। সব কিছুই সিষ্টেমের মধ্যে চলে।
এখন বেলা ১১টা, চেরিহিল গার্ডেনের ফুটপাত ধরে হাঁটছি। আকাশ পরিষ্কার। বেলা বাড়ছে, রোদের তাপ বাড়ছে। পৌর কর্পোরেশেনের লোকজন রাস্তা পরিষ্কার করছে। রাস্তার পাশে এবং বাগানে ঘাস কাটছে মেশিনে।
রাস্তার পাশেই গার্বেজ--ময়লা ফেলার বক্স। একটা সিগারেটের ক্ষুদ্র অংশও কেউ রাস্তায় ফেলে না, ঐ গার্ভেজেই ফেলে। অভ্যাস হয়ে গেছে সবার। পৌর কর্পোরেশনের লোকজন প্রতিদিন ঐ ময়লা নিয়ে যায়,রি- সাইক্লংি এ পাঠিয়ে দেয়। তাই পুরো শহরই থাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ঝকঝকে।
একটা গাছের নিচে বসলাম। তাকিয়ে দেখি নাম নাজানা প্রকান্ড এক বৃক্ষ। বয়স মনে হয় শত বছরের কম নয়। চারদিকে ছাতার মতো মেলে ধরেছে ডালপাতা। সূর্যের প্রচন্ড তাপ থেকে আগলে রাখছে বিশ্্রাম প্রার্থীদের ।
এখানে প্রচুর বড় বড় গাছ, বেশির ভাগই ম্যাপল, ওক, পাইন ইত্যাদি। এক্সমাসট্রির সূূূঁচালো সবুজ পাতা গ্রীষ্মেও খুব সুন্দর, শীতে তুষার কনার শুভ্রতা নিয়ে থাকে ধ্যানমগ্ন। অন্যান্য সব গাছের পাতা শীতে ঝরে যায়। পৃথিবীর উৎপাদিত মোট বনজ সম্পদের দশ শতাংশ উৎপাদিত হয় কানাডায়। বনভূমির প্রতি এদের অনেক যতœ, অনেক মমতা।
রাস্তার ধারে দু’টি বিল্ডিংয়ে রঙ এর কাজ চলছে। বিশ তলার ফ্ল্যাট বাড়ি। সাইন বোর্ডে সাবধান বানী ঃ Be cautious–works on progress অর্থাৎ সাবধান কাজ চলছে ! যথেষ্ট জায়গা নিয়ে নিরাপত্তা বেস্টন। ি দুই তিনটি বিশাল ক্রেন যেগুলো ৩০ তলার উপর পর্যন্ত যায়। ১৬-১৭ তলায় বিল্ডিংয়ের গায়ে বারান্দার মতো তৈরি করা পাইপ ও রড দিয়ে।
ঝুলানো বারান্দায় ২/৪ জন রঙ মিস্ত্রী রঙ করছে এবং অন্য একজন পরিষ্কার করছে। ক্রেনচালক ক্রেনে কর্মী এবং মালামাল ওঠানামা করাচ্ছে। ব্যাস, এই ক’জন লোক দিয়েই রঙ করার কাজ চলছে। কোন হই চই নেই। চেঁচামেচি নেই--নীরবে নিঃশব্দে বিল্ডিংয়ে রঙের কাজ চলছে।
উঠে দাঁড়ালাম, চেরিহিল গার্ডেন পার হয়ে অক্সফোর্ড রোড ধরে পশ্চিম দিকে হাঁটা শুরু করলাম। রাস্তার ডান দিকের ফুটপাত ধরে হাঁটছি। রাস্তার দুই পাশে বড় বড় ফ্ল্যাট বাড়ি, অফিস এবং গাড়ি পার্কিং। মাঝে মাঝে গভীর বনভূমি। সব কিছুই বৈচিত্রময় ! রাস্তা কোথাও উঁচু আবার কোথাও বা নীচু।
মাঝে মাঝে ছোট ছোট ডোবা। ডোবার পানিতে পাতি হাঁসের বিচরণ। কোথাও বা দুই একটি বক এক পায়ে দাঁড়িয়ে গভীর ধ্যান মগ্ন শিকারের প্রত্যাশায় !
দেখতে দেখতে অনেক দূর এসে পড়েছি। সামনে ওয়ান্ডারল্যান্ড- অক্সফোর্ড রোডের ইন্টার সেকশন। এবার আমাকে বাম দিকে ‘লন্ডন মলে’ যেতে হবে।
একশ ফুট রাস্তা পার হতে হবে। চৌ- রাস্তার মোড়ে সাদা সিগন্যালের জন্যে অপেক্ষা--অবশেষে রাস্তা পার হয়ে এপারে এলাম।
লন্ডন মল- বেশ বড় মার্কেট। কয়েকটি বড় বড় দোকান নিয়ে এই ‘মল’। মার্কেটে ঢোকার বামপাশে বড় রাস্তার ওপর বিখ্যাত ‘ম্যাকডোনাল্ড’-- খাবারের দোকান।
ম্যাকডোনাল্ড সাধারণত কোন মলের মধ্যে থাকে না। কারণ, ‘ম্যাকডোনাল্ড’ নিজেই একট্ িমল। অনেক বড় পরিসর নিয়ে এর অবস্থান। এরা সব ধরণের ফাস্টফুড তৈরি করে এবং অতি সুলভে বিক্রি করে। এদের খাবারের সুনাম বিশ্বব্যাপী।
যাই হোক, মলের সব চেয়ে বড় দোকানটিতে ঢুকলাম। নাম ‘সিয়ার্স আউট লেট’। মাংস এবং শাকসবজি ছাড়া অন্যসব জিনিষপত্র এখানে পাওয়া যায়। বিশেষ করে পুরুষ এবং মহিলাদের পোশাক। এদের মূল দোকানের নাম ‘সিয়ার্স’-বিশ্বখ্যাত দোকান।
সিয়ার্সের ‘সেলে’ দেয়া জিনিষপত্র বিক্রি হয় সিয়ার্স ‘আউটলেটে’। দুই এক মাসের মধ্যে মূল দোকানের বিক্রি না হওয়া মালামাল পাঠিয়ে দেয়া হয় এসব আউটলেটে । পুরো আমেরিকা এবং কানাডা জুড়ে রয়েছে এদের বিক্রয় কেন্দ্র। মালিক আমেরিকান। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অর্ডার দিয়ে এরা পণ্য উৎপাদন করায়।
শতশত কোটি ডলারের পণ্য। কমশ্রম মূল্যের দেশে এরা পণ্য উৎপাদন করায়। কোন থার্ডপার্টির মাধ্যমে বিক্রি করেনা। এদের ‘লোগো’ যুক্ত পণ্য সিয়ার্স ছাড়া অন্য কোন কোম্পানী বিক্রি করতে পারবে না। কম মূল্যে অর্থাৎ ‘ মূল্য ছাড়ে’ পণ্য আউটলেট শাখাসমুহের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়।
তারপরও তাদের শত শত কোটি ডলার প্রফিট। এক একটা দোকান এতো বড় যে এর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত প্রায় দেখা যায় না। নানা ধরণের পণ্যে দোকান ভরা। দোকানের বাইরে বারান্দায় ও ‘সেল’ লিখে প্রচুর পণ্য রেখে দেয়া, আপনি পছ্ন্দ করে নিতে পারেন।
প্রায় ঘন্টা দুই কাটালাম দোকানে।
বাংলাদেশে প্রস্তুত প্রচুর রেডিমেট পোশাক দেখা গেলো দোকানে। এসব পোষাক বাংলাদেশে প্রস্তুত হলেও বাংলাদেশের বাজারে কখনো বিক্রি হয় না। কারণ, সিয়ার্স ছাড়া তাদের উৎপাদিত পণ্য অন্য কেউ বিক্রি করতে পারে না। অত্যন্ত উন্নতমানের ডিজাইন, কাটিং, সেলাই। ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ দেখে গর্ব হয়।
‘সেল’ থেকে কিছু বাংলাদেশে তৈরি পোশাক কিনলাম। কিন্তু টাকার হিসাবে মূল্য অনেক !
মেন্ডারিন রেস্তোরাঁ
মেন্ডারিন রেস্তোরাঁয় আজ আমাদের ম্যারাথন লাঞ্চ--১২০ আইটেমের চায়নীজ খানা। লাঞ্চের সময় বেলা ১১টা থেকে ৩টা।
মেন্ডারিন একটি বিশেষায়িত চায়নীজ রেস্তোরাঁ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চায়নীজ খাবারের এই রেষ্টুরেন্টটি রয়েছে।
‘মেন্ডারিন’ একটি চায়নীজ ভাষা। অধিকাংশ চায়নীজ এ ভাষায় কথা বলে। হয়তো তাই রেস্তোরাঁটির নাম রাখা হয়েছে ‘মেন্ডারিন’।
রেস্তোরাঁর দূরত্ব বাসা থেকে প্রায় ২০ কিমি দুপুর ১টায় রেস্তোরাঁয় পৌঁছে আমাদের চক্ষু কপালে ! ভেতরে ঢোকার জন্যে লম্বা লাইন। মনে হয় কোন সিনেমার টিকেটের জন্যে আমরা লাইনে দাঁড়িয়েছি।
টাকা পয়সা খরচ করে খাবো, তাও লাইন দিয়ে ! বিশ মিনিট লাইনে দাঁড়িয়ে কাউন্টারে পৌঁছলে আমাদের জানানো হলো খাবারের জন্যে ৪৫ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে এবং খাবার খেতে সময় দেয়া হবে মাত্র ৩০ মিনিট ! এমন শর্তে ইচ্ছে হলে খাবারের জন্যে অপেক্ষা করো নইলে চলে যাও! এমনিতেই মেজাজ তিরিক্ষি হয়েছিলো, এবার রক্ত মাথায় উঠে গেলো। রাগ করে শুভকে বললাম - খাবো না এখানে, চলো বাসায় ফিরে যাই। ‘চলে যাবে’? ওর অসহায় করুন আর্তি ! ওর চেহারা দেখে বড্ড মায়া হলো। বেচারা কতো আগ্রহ করে আমাদের নিয়ে এসেছে ১২০ আইটেমের চায়নীজ খাওয়াবে বলে। সাথে আবার শিশু ধ্র“ব, ওর মা-দাদিসহ।
বললাম, বুকিং দিয়ে ফেলো, যা হবার হবে। ‘আচ্ছা’-বলেই সে চার জনের জন্যে বুকিং দিয়ে দিলো। অতঃপর তার মুখে প্রশান্তির ছাপ!
টেবিল বুকিং দিয়ে আমরা ওয়েটিং রুমে বসতে গেলাম। সেখানে ও খালি নেই বসার জন্যে কোন জায়গা। মানুষ অধীর আগ্রহে দাঁড়িয়ে অথবা বসে খাবারের অপেক্ষায়।
আমরা কোন রকমে দাঁড়াবার জায়গা পেলাম। রিলিফের জন্যে ক্ষুধার্থ বুভুক্ষু মানুষের অপেক্ষা দেখেছি বাংলাদেশে কিন্তু পয়সা দিয়ে খাবারের জন্যে স্বচ্ছল মানুষের এমন বুভুক্ষু অপেক্ষা জীবনে এই প্রথম ! হঠাৎ এক দম্পতি আসন ছেড়ে উঠে গেলো। শুভ সাথে সাথে সিট দুটো দখলে নিয়ে আমাদের বসিয়ে দিলো।
এখানে খাবার খেতে আসা মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে এক নজর দেখলাম। সত্যিই ১২০ আইটেমের খাবার খাওয়ার মানুষই তো সব ! মোটা তাজা টকটকে নারী- পুরুষ।
কেউ পুরো ফ্যামিলি নিয়ে আবার কেউ বা বন্ধু বান্ধব নিয়ে। দেখেই বোঝা যায় এরা ভোজন রসিক মানুষ, খেতে পারে। কারো কারো ওজন আমাদের প্রায় দ্বিগুন। ভাগ্য ভালো আমাদের বেশিক্ষন অপেক্ষা করতে হলো না, মিনিট বিশ পরেই আমাদের ডাক এলো। আমরা তো মহাখুশি, অন্ততঃ এক ঘন্টা তো সময় পাওয়া গেলো ১২০ রকমের চায়নীজ খানা খেতে !
ডাইনিং রুমে গেলাম।
বিশাল রুমে অন্ততঃ দশটি টেবিল পাতা। প্রতি টেবিলে ৫/৭ টি চেয়ার। পাঁচ চেয়ারের এক টেবিলে এক চটপটে চায়নীজ ওয়েট্রেজ আমাদের নিয়ে বসালো। ধ্র“বকে অবশ্য চেয়ারে বসতে হলো না। সে তার নিজস্ব স্ট্রলারে বসে আমাদের রাক্ষুসে খাবার যজ্ঞ উপভোগ করবে !
আমাদের টেবিলটি চমৎকারভাবে সাজানো- গ্লাসে রুমালের ফুল, টেবিলে ধবধবে সাদা চাদর, প্লেট গ্লাস চামচ ইত্যাদি।
‘মেন্ডারিন’ নাম খোদিত চমৎকার টিসু রুমাল। ওয়েট্রেস ৪টি ঠান্ডা পানির বোতল টেবিলে রেখে গেলো। অন্য একটি বড় রুমে দুইটি বিশাল টেবিলে বড় বড় ডিসে ১২০ রকমের খাবার সাজানো। একটি টেবিলে জানা অজানা নানান আইটেম- সুপ, মাছ মাংস, রুটি ফ্রাই রাইচ ইত্যাদি এবং অন্য টেবিলে নানান ধরণের মিষ্টি, আইসক্রিম, ফ্রুটস, ছালাদ ইত্যাদি আরো কতো কি! শুধু মাছের আইটেমই ১৫-২০ রকমের, আর মাংস অন্ততঃ ২০ পদের। শামুক, ঝিনুক, সাপ, হাঙ্গর যে নেই তারই বা বিশ্বাস কি ! সমস্ত আইটেম খাওয়া কোন মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়।
প্রায় আইটেমই শুকনো- ফ্রাই। সেলফ সার্ভিস, নিজে গিয়ে নিয়ে আসতে হবে।
প্লেটে খাবার নিয়ে আমরা টেবিলে গিয়ে বসলাম। চিংড়ী, ফিস-ফিঙ্গার, ন্যুডুলস, ফ্রাই রাইচ, মুরগি, জাপানি ‘সুসি,’ চার পাঁচটি সুপ ছাড়া বাকি প্রায় সব আইটেমই আমাদের কাছে নতুন। আল্লাহর নাম নিয়ে বিছমিল্লাহ্ বলে আমরা খাওয়া শুরু করলাম।
আস্তে আস্তে আমরা প্রায় সমস্ত আইটেমই খেলাম ! আবার সবজি সালাদ এবং ফ্রুটস নিয়ে খেলাম। মিষ্টি দধিও খেলাম। খেতে খেতে ৩টা বেজে গেলা। কারো পেটে আর বিশেষ কোন জায়গা অবশিষ্ট থাকলো না !
পাশের টেবিলে গোটা ৭ জনের এক ফ্যামিলি। কোন ক্যারিবিয়ান ফ্যামিলি হবে।
খাবার পর একটি কেক কাটলো, ‘হ্যাপি র্বাথ ডে’ র গান হলো। ছবি তুললো ৭-৮ বছরের বাচ্চাটির। ওয়েট্রেজ ২-৪ জন বার্থডে গানের সাথে সুর মিলিয়ে শুভেচ্ছা জানালো। আমরা হাততালি দিয়ে শরিক হলাম মাত্র।
আমাদের ওঠার সময় হয়েছে।
বিল পরিশোধ করে ধন্যবাদ দিয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম মেন্ডারিন রেস্তোরাঁ থেকে।
(ক্রমশ) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।