আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কানাডায় ৭০ দিন - ১০ম পর্ব

আমার বাবা (তারেক-উল আলম) গত বছর কেনাডা বেড়াতে এসেছিলেন। কেনাডা থেকে দেশে ফিরে একটা বই লিখেছেন – ‘কানাডায় ৭০ দিন’। আজ পড়ুন এর ১০ম পর্বঃ ডেট্রয়েট নদীর তীরে কানাডার অন্টারিও প্রদেশের সর্ব দক্ষিণ প্রান্তের শহর উইন্ডসর। আর আমেরিকার উত্তরের লেক রাজ্য মিশিগান। এই মিশিগান রাজ্যের বৃহত্তম শহর ডেট্রয়েট।

এটা আমেরিকার অন্যতম বৃহৎ গাড়ি উৎপাদনকারি নগরীও বটে। ডেট্ট্রয়েট নগরী এবং উইন্ডসর শহরকে যে নদী দিয়ে আলাদা করা হয়েছে তার নাম ডেট্টয়েট রিভার। উইন্ডসর আর ডেট্টয়েট নগরীকে আবার সংযুক্ত করেছে অ্যামবেসেডর ব্রীজ। নদীর নিচে টানেল পথেও সংযোগ আছে। টানেল পথে দুই দেশের বিভিন্ন শহরের মধ্যে বাস, ট্রাক, ট্রাম, ট্রেন প্রভৃতি ভারী যান চলাচল করে।

ব্রীজ পার হয়ে ওপারে যেতে গাড়িতে দুই মিনিট আর হেঁটে ৮/১০ মিনিট। অনেকে চা- কফি খেতে এপার ওপার হয়। পৃথিবীর দুই ধনী দেশের দুই বিখ্যাত শহর। আমরা ডেট্টয়েট নদীর এপারের কানাডিয়ান শহর উইন্ডসরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছি। ভিসা থাকলে ওপার থেকেও ঘুরে আসা যেতো।

২৫ জুন, বেলা ১১টায় আমরা বাসা থেকে রওনা হলাম রেন্ট-এ-কার থেকে ৭ সিটের লেটেস্ট গাড়ি নিয়ে। পেছনের সিটে আমি, লতা এবং লুসি। মাঝের দুই সিটের একটিতে ধ্র“ব তার স্ট্রলারের কার সিট নিয়ে এবং অন্যটিতে শুভ। সামনের সিটে স্টিয়ারিং ধরে বরন এবং যথারীতি তার স্ত্রী শাওন পাশের সিটে। আমরা অক্সফোর্ড স্ট্রীট দিয়ে পশ্চিম দিকে যাত্রা শুরু করি।

আমাদের লক্ষ্য দক্ষিণের উইন্ডসর শহর। পূর্বেই সিদ্ধান্ত নেয়া ছিলো আমরা হাইওয়ে দিয়ে যাবো না, কান্ট্রি রোড দিয়ে যাবো অর্থাৎ গ্রামের পথ দিয়ে। কান্ট্রি রোড দিয়ে গেলে সময় এক ঘন্টা বেশি লাগে তবুও যেতে হবে। কারণ, সাথে ছোট্ট শিশু ধ্র“ব। কান্ট্রি রোডে গাড়ি চলে কম, ধীরে ধীরে চালানো যায়।

কিন্তু হাইওয়েতে ১০০ কিলোমিটারের কমে নয়। আমাদের গাড়ি সহসাই শহর ছেড়ে গ্রামের পথ ধরলো। এখানকার গ্রাম আমাদের দেশের গ্রামের মতো নয়। গ্রামের রাস্তা আমাদের শহরের রাস্তার চেয়েও সুন্দর। প্রস্থে ৩০-৩৫ ফুট।

রাস্তার পাশে আরো ৮/১০ ফুট পাথর কুচি বিছানো, গাড়ি হঠাৎ ব্রেক করলে বা গতি সম্পূর্ণ গাড়ি হঠাৎ রাস্তা থেকে নেমে গেলে যাতে গতি শ্লথ হয়ে যায়। রাস্তার দুই দিকে সমতল ভূমি। দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের ক্ষেত মাইলের পর মাইল চলে গেছে। জমিতে গম ও ভূট্টার ক্ষেত। আমাদের যেমন ধান এখানে তেমনি গম।

শীত প্রধান দেশ। প্রধান খাদ্য গম এবং গমের উৎপাদন প্রচুর। আমাদের সাথে পার্থক্য- আমাদের দেশে আইলে ঘেরা ছোট ছোট টুক্রো টুক্রো জমি। এখানে আইল বা বিভক্তি নেই জমিতে। এক কৃষকেরই হাজার হাজার একর জমি।

চাষ হয় সব যান্ত্রিক পদ্ধতিতে। মাঝে মাঝে কৃষকের খামার বাড়ি, সুন্দর ছিমছাম। প্রত্যেক বাড়িতে দুই চারটি গাড়ি, ট্রাক্টর এবং চাষাবাদের অন্যান্য যন্ত্রপাতি। প্রত্যেক বাড়ির উঠোন পর্যন্ত পাকা রাস্তা। শহরের বাড়ির চেয়েও সুন্দর।

কৃষকেরা এসব বাড়িতেই থাকে। কোন কৃষককে জমিতে দেখা যায়নি--না হাঁটতে না কাজ করতে। জমি কর্ষন, শস্যবোনা, ফসল কাটা, সব কিছু হয় মিশিনের সাহায্যে। রাস্তা ঘাটেও কোন মানুষজন দেখা যায়না। যা দেখা যায় তা গাড়ি, কেবল গাড়ি।

গ্রাম বলতে প্রায়ই ফসলের ক্ষেত। লোকজন বাড়ি ঘর খুবই কম। নির্জন নিরিবিলি। কয়েক মাইল পর পর দুই একটি বাড়ি চোখে পড়ে। গাড়ি দ্রুত ছুটছে।

ফসলের ক্ষেত দ্রুত সরে যাচ্ছে। দূর নিকটে ঘন বনাঞ্চল। সারি সারি বৃক্ষ রাজি। মনে হয় ছবি তোলার জন্যে এভাবে সাজানো ! সব কিছুই সাজানো গোছানো। কোথাও কোন ছন্দপতন নেই।

মাঝে মাঝে চোখে পড়ে উইন্ড মিল। সু-উচ্চ পিলারের মাথায় তিন ডানার প্রকান্ড পাখা। এক একটা ডানা ৩০-৩৫ ফুটের কম নয়। পিলারের উচ্চতা ৪৫-৫০ ফুট। পাখা ঘুরছে, বাতাসে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে।

মাইলের পর মাইল চলে গেছে এই উইন্ড মিল। এদেশে বিদ্যুতের কোন অভাব নেই। পৃথিবীর র্সবোবৃহৎ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র এদেশে রয়েছে। তারপরও তারা বিভিন্ন উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। বিদ্যুৎ শক্তি ছাড়া সব উৎপাদন কর্মকান্ডই অচল।

তাই বিদ্যুৎ এদের ‘সেকেন্ড গড’ ! পথে ছোট ছোট কয়েকটি শহর চোখে পড়লো। চাথাম নামক শহরে গাড়ি থেকে নেমে আমরা ‘টিমর্হটন’ রেষ্টুরেন্টে গেলাম। ওখান থেকে হাল্কা কিছু খাবার এবং গরম কফি নিয়ে গাড়িতে ফিরলাম। চাথাম শহরটি বেশ সুন্দর, ছিম্ছাম। দেখতে দেখতে আমরা উইন্ডসর শহরে এসে পড়েছি।

মিলন স্ট্রীটে রানার বাসায় যখন আমরা পৌঁছলাম তখন বেলা ২টা। রানার স্ত্রী ঝুমা আমাদের সাদর অভ্যর্থনা জানালো। তাড়াতাড়ি আমাদের জন্যে সরবত (জুস) নিয়ে এলো। আমরা ওয়াসরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এলাম। এখনই আমাদের আবার ছুটতে হবে ৪০-৫০ মাইল দূরে অন্য আরেক শহর--বিলিরিভার শহরে।

সেখানে বিলিরিভার লেকের পাড়ে উইন্ডসরের বাঙালিরা বনভোজনের আয়োজন করেছে। সেখানে লাঞ্চ এবং লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করার নিমন্ত্রণ আমাদের। রানা পূর্বেই আমাদের জন্যে এই ব্যবস্থা করে রেখেছিলো। কিছুক্ষণ পর রানা আমাদের নিয়ে বিলিরিভার লেকের দিকে ছুটলো! শুভরা বরনের গাড়িতে। রানার গাড়িতে আমি আর রানার ফ্যামিলি।

রানার ফ্যামিলি বলতে রানার স্ত্রী ইসরাত জাহান ঝুমা, দুই কন্যা ফারজা সাড়ে পাঁচ, আর ফারিয়া সাড়ে তিন বছর। চমৎকার মিষ্টি কন্যারতœ দু’টি। রানা শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে উইন্ডসর বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার প্রকৌশলে স্নাতকোত্তরে অধ্যয়নরত, স্ত্রী ঝুমা সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এ গ্র্যাজুয়েট। রানার বাড়ি সিলেট জেলায়। চটপটে স্পষ্টভাষী একজন সু-বক্তা।

ছাত্রাবস্থায় ঝুমার সাথে পরিচয়। সেই পরিচয় প্রণয়ে ও পরিণয়ে সমাপ্তি ! রানা শুভর বন্ধু, ঝুমা ছাত্রী। বিলিরিভার লেক বেলা ৩ টায় আমরা বিলিরিভার শহরে এসে পৌঁছলাম। এখানে বিলিরিভার লেকের পাড়ে আমাদের পিকনিকের আয়োজন। নদীর নামেই শহর, নদীর নামেই লেক--নাম বিলিরিভার।

কি চমৎকার ! অপূর্ব সুন্দর লেক। লেকের পাড়ে বাগান। সামনে তিন দিক দিয়ে লেক এমনভাবে বাগানটিকে ঘিরে রেখেছে দেখে মনে হয় একটা বদ্বীপ ! বিচে প্রচুর নর-নারী, শিশু এবং কিশোর। সুইমিং ড্রেসে তারা বিচে ঘুরে বেড়াচ্ছে, লেকে নেমে জলকলেি করছে। লেকে স্পীড বোট নিয়ে দুরন্ত বেগে ছুটছে কেউ কেউ।

সামনে, ডানে, বাঁয়ে লেকের পানি থৈ থৈ করছে। এমন এক স্পটে পিকনিকের আয়োজন। কি অপূর্ব মনোমুগ্ধকর দৃশ্য ! এমন দৃশ্য কল্পনাকেও হারমানায়, স্বপ্নকেও ছাড়িয়ে যায় ! ম্যাপল গাছের নিচে টেবিল সাজানো এবং বেঞ্চ পাতা। টেবিলের উপর খানা প্রস্তুত। অনেকে খাওয়া শেষ করেছেন, কেউ কেউ খাচ্ছেন।

আমরা শেষ পর্যায়ে এসেছি। আমাদের জন্য পর্যাপ্ত খানা রাখা আছে। মাঠের মধ্যেই চুলা, ওখানে মুরগি বার-বি-কিউ অর্থাৎ ঝলসানো হচ্ছে। গরম গরম মুরগির মাংস তুলে নিলাম ওয়ান টাইম ইয়ুজ প্লেটে। পোলাও বাসা থেকেই রান্না করে আনা।

তন্দুরী ছিলো, গরু ও খাসীর মাংস ছিলো, ছিলো সালাদ। অপূর্ব পরিবেশনা, অপূর্ব স্বাদ! এমন স্বাদের ঝলসানো মুরগি ! এমন সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশে এমন মজাদার খানা জীবনে ভোলার নয় ! এখানকার বাঙালি সমাজ ভীষণ আন্তরিক। নতুন মেহমান পেলে বিশেষ করে আমাদের মতো বয়স্করা যখন বাংলাদেশ থেকে আসে মনে করে তাদের বাবা- মাই বুঝি এসেছে ! সম্মানে, ভক্তিতে ভালোবাসায় আমাদের প্রাণ ভরিয়ে দেয় ! ভুলক্রমে ‘আপনি’ শব্দ মুখ দিয়ে বেরুলেই অভিমানে গাল ফুলায়। বিষন্ন মুখে বলে, ‘আমি আপনার ছেলের মতো, আমাকে তুমি বলবেন’। লজ্জায় বিব্রত হতে হয় ! লেকের পাড়ে এলাম।

লেক বলবো নাকি নদী বলবো বুঝতে পারলাম না। নাম Belle river । আবার বলা হচ্ছে Belle river lake। এদেশে কোনটা নদী আর কোনটা লেক বোঝা বড় মুশকিল। পার্কের বামদিকে নদী গিয়ে মিশেছে লেকে।

পার্কটা আবার অনেকাংশে ঢুকে গেছে লেকের পেটে ! আমরা পিকনিক স্পট থেকে লেকের পাড় দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। অপূর্ব সুন্দর লেক-নদী ! খালি গায়ে সুইমিং ড্রেসে শিশুরা হই চই করে বিচে ছুটছে, লেকে ঝাঁপাচ্ছে। প্রায় ৪০ ফুট উঁচু ব্রীজ থেকে যুবক- কিশোর নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। নদীটা লেকের মুখেই। ব্রীজ থেকে নদী লেকে ঢুকে লেকের মধ্যে নিজকে বিলীন করে দিয়েছে।

বিনোদনকারী নারী, যুবতীদের পরনে ছোট্ট একটি পেন্টি আর বক্ষে সামান্য একটু আবরন। দেখতে খুব লজ্জা লাগছিলো ! আমাদের এই পরিবেশের সাথে আদৌ পরিচয় নেই যে ! আশি শতাংশ বিনোদনকারীই তরুন-তরুনী এবং কম বয়সী নারী। তারা আনন্দ করতে এসেছে। কে কি দেখছে, কে কি বলছে সে দিকে তাদের ভ্র“ক্ষেপ নেই। এদেশে পোষাকে-পরিচ্ছদে, চলনে বলনে, ধর্মে কর্মে অর্থাৎ কারো কোন ব্যক্তিগত বিষয়ে কেউ কখনো মাথা ঘামায় না।

লেকে সাঁতার কাটছে কেউ কেউ, আবার স্পীড বোট নিয়ে অথবা দ্রুততর স্পীড বোটের পেছনে নিজেকে শক্ত করে বেঁধে অথবা স্পীড বোটের সাথে বাঁধা শক্ত দড়ি বা ফিতা ধরে (অবশ্যই লাইফ জ্যাকেট পরেছে) স্পীড বোট চালিয়ে দিয়েছে কেউ। মাঝ লেকে চলে গেছে স্পীড় বোট রোমান্টিক আনন্দ পিপাসুকে নিয়ে। ফুল স্পীডের বোট কখনো পানির কয়েক ফুট উপরে উঠে যাচ্ছে আর দড়িতে বাঁধা লোকটি ওলট পালট খাচ্ছে ঠিক বড়শিতে ধরা মাছের মতো ! দুঃসাহসী শ্বাসরুদ্ধকর অ্যাডভেঞ্চার থ্রিলার ! ভয়ে অন্তরাত্মা শুকিয়ে যায় আমাদের ! কিন্তু তাদের কাছে এটা খেলা ! জীবন বাজি রেখে তারা খেলে, আনন্দে হারিয়ে যায়--মরণ এই আনন্দের কাছে তুচ্ছ ! এরা জীবন উপভোগ করে। এরা অ্যাডভেঞ্চার ভালোবাসে। সুইমিং কস্টিয়ুমে যুবতী নারীর দল আমাদের আগে আগে চলেছে।

পেছনেও আছে কিন্তু পেছনে ঘুরে দেখা অশোভন। পাশে এক যুগল গভীর আলিঙ্গনে পরস্পরকে ভালোবাসায় জড়িয়ে রেখেছে ! কারো কোন কৌতুহল নেই এসবে। কানে কানে বলি, কাছেই আমার স্ত্রী এবং পুত্রবধু হাঁটছে। তাই একটু তেরছা দৃষ্টিতে অন্যের দৃষ্টি এড়িয়ে উপভোগ করতে হচ্ছে এতো সব আনন্দময় দৃশ্যপটের ! হাজার হাজার গাংচিল লেকপাড়ে বসে আছে নিশ্চিন্তে, নির্ভাবনায়। এখানে পাখি মানুষকে ভয় পায়না।

মানুষের কাছাকাছি থাকে। শতশত স্পীড বোট একটা নির্দিষ্ট জায়গায় রাখা। মানুষ, পাখি, লেকের অপূর্ব দৃশ্য মন পাগল করে দেয়, মাতোয়ারা হয়ে যায় মানুষ। ক্যামেরা শুভর হাতে। মনোরম নয়নাভিরাম দৃশ্য ক্যামেরায় ধারণ করতে সে সর্বদা সচেষ্ট।

বলে রাখা ভালো, শুভ একজন ভালো ফটোগ্রাফার। এমন মোহনীয় স্থান ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছেনা। বারবার তাগাদা আসছে ফেরার। তাই বিকাল ৭টায় আমরা ফিরে চললাম উইন্ডসরের দিকে। এবার আমাদের গন্তব্য ডেট্টয়েট রিভার।

ডেট্টয়েট রিভার আমরা উইন্ডসর ফিরে যাচ্ছি। আমি রানার গাড়িতে, শুভরা বরনের সাথে। পথে সুন্দর ছোট্ট শহর-- তিকামস। চিরাচরিত সেই একই দৃশ্য--সুন্দর রাস্তাঘাট, সুদৃশ্য মার্কেট ইত্যাদি। সব শহর প্রায় একই ধাঁচের।

আমরা ঘন্টা খানেকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম উইন্ডসরে। রিভার সাইড রোড দিয়ে যাচ্ছি আমরা। কাছেই ডেট্টয়েট রিভার। বামপাশে নদীর ওপারে সু- উচ্চ প্রকান্ড প্রকান্ড দালান, মনে হয় একটার উপর অন্যটা ! রানা আঙ্গুল তুলে দেখাচ্ছে, ‘ঐ তো ডেট্ট্রয়েট শহর’। কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে থাকলাম।

চোখের সামনেই আমেরিকা! হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায় ! আমরা ডেট্টয়েট নদীর পাড়ে এসে পড়েছি। ১নং গাড়ি পার্কিংয়ে ঢুকলাম। পার্কিং পুরোটাই গাড়িতে ভরা, খালি নেই একটিও। আমাদের দু'টি গাড়ির একটিও পার্কিংয়ে রাখা গেলো না। মিনিট পনেরো অপেক্ষা করা হলো।

এর বেশি এক জায়গায় অপেক্ষা করার নিয়ম নেই, পুলিশ এসে টিকেট ধরিয়ে দেবে! ইতিমধ্যে গাড়ি থেকে অনেকেই নেমে গেছে। নদীর অপূর্ব দৃশ্য উপভোগ করছে। নদীর ওপারে ডেট্টয়েট শহরের সু-উচ্চ সুন্দর ভবনসমূহ দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। ডেট্টয়েট নদীর ওপারে ভ্রমনরত আমেরিকান মানুষজন দেখা যাচ্ছে। নদীতে জাহাজ, স্পীড বোট চলছে।

ক্যামেরায় ডেট্টয়েট শহরের ছবি তোলা হচ্ছে। তাগাদা আসছে পার্কিং ছেড়ে যাওয়ার। অগত্যায় আমরা পুনরায় গাড়িতে উঠলাম। ২য় পার্কিং অ্যামবেসেডর ব্রীজের পাশেই। এখানেও পার্কিং গাড়িতে পূর্ণ, গাড়ি রাখার অবশিষ্ট কোন জায়গা নেই।

যারা এসেছে তারা যাবার নামটি পর্যন্ত করছেনা। আসলে এখানে এলে কেউ সহজে উঠতে চায়না। সন্ধ্যার পূর্বে সূর্যাস্ত না দেখে কে বা যাবে ! ভাগ্যভালো, কেনজানি পরপর দু’টি গাড়ি বের হয়ে গেলো। আমাদের গাড়ি অপেক্ষায় ছিলো, ঢুকে পড়লো ! কানাডার সময় এখন বিকেল ৮টা। এখানে সূর্য অস্ত যায় ন’টায়।

সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে। মনে হয় সূর্যটা এখন আমেরিকার শিকাগো শহরের উপর। আমরা অপরূপ সুন্দর এক নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে। লন্ডনের ক্ষীণকায় টেমস নদীর সম্পূর্ণ বিপরীত। এ নদীর অনেক গভীরতা।

বড় বড় ঢেউ পাড়ে এসে আছড়ে পড়ছে। নদীর পাড় বড় বড় পাথরে বাঁধানো। আবার ঢেউয়ের আঘাতে পাথর যাতে পড়ে না যায় সেই জন্যে স্টীলের নেটের দেয়াল। কোন অবস্থাতেই পাড় ভাঙ্গার আশংকা নেই। পাড়ের কিছু অংশে মোটা শক্ত দেয়াল এবং দেয়ালের পাঁচ সাতফুট পর স্টীলের গ্রীল যাতে কেউ একেবারে কিনারে যেতে না পারে, নদীতে পড়ে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটাতে না পারে।

কোন দুর্বিপাকে কেও নদীতে পড়ে গেলে বা কোন অঘটন ঘটলে চেন টানলেই (নদীর পাড়ে বিপদজনক অংশে চেইন টানানো রয়েছে ) মুহূর্তে উদ্ধার কর্মী ছুটে আসবে। বিনা কারণে চেন টানলে ৩০০ ডলার জরিমানা। এখানে সাহায্যের জন্যে ছুটাছুটি, চিৎকার চেঁচামেচির প্রয়োজন নেই--আঙ্গুলের ডগায় সব কিছু ! আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখছি ডেট্রয়েট নদীর অপূর্ব নৈসর্গিক সৌন্দর্য ! উত্তরে হুরন লেক থেকে জলধারা ডেট্টয়েট নদী হয়ে দক্ষিণে ইরি লেকে গিয়ে মিশেছে। লেক ইরি এবং ডেট্টয়েট রিভার আমেরিকার নিউইয়র্ক এবং মিশিগান রাজ্য থেকে কানাডার অন্টারিও প্রদেশটিকে আলাদা করে রেখেছে। ওপারের লোকজন নদীর পাড়ে বসে এবং এপারে আমরা মুগ্ধতা নিয়ে ডেট্টয়েট নদীর অপূর্ব রূপসৌন্দর্য উপভোগ করছি।

নদীর ছোট ছোট ঢেউ ক্রমান্বয়ে ফুলে ফেঁপে বড় হয়ে তীরে এসে আছড়ে পড়া, নদীর স্বচ্ছ সবুজ নীল পানি--চোখ জুড়িয়ে দেয়, মন ভরিয়ে দেয় ! ওপারে ডেট্রয়েট নগরীর সু-উচ্চ ভবনসমূহ মনে হয় আকাশ ছুঁবে। লক্ষ কোটি বৈদ্যুতিক আলোর উজ্জ্বলতা ডেট্টয়েট নগরীকে আলোর এক স্বপ্নপুরি বানিয়ে রেখেছে। পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ গাড়ি প্রস্তুতকারি প্রতিষ্ঠান জেনারেল মটরস্ এর আকাশচুম্বী অফিস ভবনটি মনে হয় হাত দিয়ে ধরা যাবে ! অ্যামবেসেডর ব্রীজ উইন্ডসর আর ডেট্রয়েট নগরীর অন্যতম যোগাযোগ সূত্র। গাড়ি নিয়ে দুই মিনিটের পথ। নদীর অনেক উঁচু দিয়ে এই ব্রীজ, যাতে নিচ দিয়ে বড় বড় জাহাজ চলাচলের কোন বিঘœ না হয়।

আমরা ব্রীজের কাছে নদীর এপারে বসে। ক্যামেরা জুম করে ব্রীজের ছবি, নদীর কর্ম চঞ্চলতার ছবি, ওপারের দৃশ্যাবলী ধারণ করছে শুভ। পাহাড়ের ঢালুতে কানাডার ঐতিহ্য স্থাপনাসমূহ এবং জাতীয় প্রতীক খোদাই করা। হাতি, ভাল্লুক, সিংহ প্রভৃতি প্রাণীর বৃহৎ ভাস্কর্য পাথরে খোদাই করে স্থাপিত। দর্শনার্থী আবাল বৃদ্ধবনিতা এসব স্থাপত্যের শৈল্পিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ না হয়ে পারেনা।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। সূর্য গনগনে থালার মতো রক্তচক্ষু দেখিয়ে শেষ বারের মতো বিদায় নিচ্ছে অ্যামবেসেডর ব্রীজের উপর দিয়ে মিসিগান রাজ্যের শেষ প্রান্ত সীমায়। আমরা দিনের আলোয় শেষবারের মতো আরেকবার তাকয়িে দখেলাম মিসিগান রাজ্যের ডেট্টয়েট নগরী এবং ডেট্টয়েট নদীর অপূর্ব নয়ন জুড়ানো শোভা ! রানার বাসায় রাত্রিযাপন রিভার সাইড থেকে আমরা ফিরলাম মিলন স্ট্রীটে, রানার বাসায়। আজ রাত আমরা থাকবো এখানে। আজ আমরা ওদের মেহমান।

এক ইউনিটের দোতলা বাড়ি। নিচে ড্রয়িং ডাইনিং রান্নাঘর, ওয়াসরুম, স্টোর ইত্যাদি। উপরে শোবার ঘর, বাথরুম, ড্রেসিং রুম ইত্যাদি। ছিমছাম পরিপাটি সবকিছু। রাতের রান্না আগেই সেরে রেখেছিলো ঝুমা, রানার স্ত্রী।

ওভেনে গরম করে আমাদের পরিবেশন করলো। সবাই ভ্রমনে ক্লান্ত। তাই আমরা খেয়ে তাড়াতাড়ি শুইয়ে পড়লাম। সকালে চা-নাস্তা সেরে আমরা বেড়িয়ে পড়লাম শহর দেখতে। শহরের প্রধান আকর্ষণ উইন্ডসর বিশ্ববিদ্যালয়।

উইন্ডসর বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতি বিশ্বব্যাপী। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ছাত্র-ছাত্রী এখানে আসে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণে। কানাডার মধ্যে ১৪তম স্থান। বাংলাদেশের বেশ কিছু শিক্ষার্থী রয়েছে এখানে। ক’বছর আগেও উইন্ডসর ছিলো কানাডার একটি বিখ্যাত শিল্প নগরী।

কিন্তু ২০০৭ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার ধাক্কা উইন্ডসরকে ছত্রখান করে দেয়। ডেট্টয়েটের বড় বড় গাড়ি উৎপাদনকারি কারখানার বিভিন্ন যন্ত্রাংশ তৈরি হতো এখানে। আমেরিকার অর্থনীতির সাথে, উৎপাদনের সাথে এখানকার উৎপাদন ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। ছোট বড় কারখানাগুলো প্রচুর শ্রমিকের কর্ম চঞ্চলতায় সবসময় সরগরম থাকতো। ডেট্টয়েটের গাড়ি উৎপাদন প্রচন্ডভাবে কমে যাওয়ায় এখানকার কারখানাগুলো ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়।

লিজিং কোম্পানী, ব্যাংকসহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহে ধস নামে। বন্ধ হয়ে যায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। স্থবির হয়ে পড়ে এখানকার অর্থনীতি। এখনো কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি উইন্ডসর। শহরটিকে ফাঁকা ফাঁকা মনে হলো।

অন্যান্য শহরের মতো তেমন যৌলুস নেই, কিছুটা হতশ্রী ভাব। গাড়ি ঘোড়ার ছোটাছুটি তেমন নজর কাড়তে পারলো না। শহরে ক’টি বাংলাদেশি দোকান রয়েছে। আমরা একটি বাংলাদেশি দোকান থেকে ইলিশ মাছ নিলাম আর নিলাম ক’টি দেশি মুরগি যা লন্ডনে পাওয়া যায়না। দোকানের মালিক সিলেটি।

আমাদের পেয়ে ভীষণ আনন্দিত। রানা-ঝুমা দুপুরে না খেয়ে আমাদের যেতে দেবে না। আমাদের জন্যে তারা স্পেশাল খিঁচুড়ী রান্না করেছে। বাচ্চা দু’টি আমাদের একান্ত আপন করে নিয়েছে এ সামান্য সময়ের মধ্যেই। মায়ার বন্ধনে জড়িয়ে ফেলেছে আমাদের! এই পরিবারটি থেকে বিদায় নিতে আমাদের কষ্ট হলো।

(ক্রমশ) ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।