আমার বাবা (তারেক-উল আলম) গত বছর কেনাডা বেড়াতে এসেছিলেন। কেনাডা থেকে দেশে ফিরে একটা বই লিখেছেন – ‘কানাডায় ৭০ দিন’। আজ পড়ুন এর দ্বিতীয় পর্বঃ
বিমান বন্দর থেকে লন্ডন
কানাডা সময় বিকেল ৪.৩০ (কানাডা- বাংলাদেশ সময় পার্থক্য গ্রীষ্মে ১০ ঘন্টা, শীতে ১১ ঘন্টা)। আমাদের বড় ছেলে শুভ, তার খালা ডলি এবং ডলির মেয়ে মিতুল একসঙ্গে ওয়েটিং রুমে ঢুকে আমাদের জড়িয়ে ধরলো। আনন্দে আবেগে শুভর দু’চোখে পানি।
ডলির চোখ ও ছলছল করছে। তাদের ধারণা ছিলো প্লেন আরো আধাঘন্টা পরে আসবে। অবশ্য প্লেন নির্দিষ্ট সময়ের কিছু পূর্বেই ল্যান্ড করেছে। ওরাই মালপত্র নিয়ে বাইরে এলো। কাইয়ূম (আমার ভায়রা ভাই- ডলির স্বামী) গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছিলো, নেমে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
স্বাগতম জানালো আমাদের ! আমাদের পেয়ে সবাই উচ্ছ্বসিত, আনন্দে আত্মহারা ! কিন্তু গাড়ি এখানে বেশিক্ষণ রাখা যাবেনা, জরিমানা করে দেবে পুলিশ। মালামাল দ্রুত গাড়িতে উঠিয়ে নিলো শুভ আর কাইয়ূম। গাড়ি আমাদের নিয়ে রওনা দিলো আমাদের মূল গন্তব্য লন্ডন শহর অভিমুখে। মিতুল থেকে গেলো। সে ব্রেমটন শহরে ফিরে যাবে নিজেদের বাসায় যেখানে তার ছোটভাই ফারহান তার অপেক্ষায়।
এখনো ১১ তারিখ ! সেই ঢাকা থেকে ১১ তারিখ ভোর ৫.৩০ মিনিটে (ঢাকার সময়) আমরা রওনা হয়েছি আর এখন বিকাল ৪.৩০ মিনিট (কানাডা সময়)। দিন যেনো আর শেষ হয়না ! পূর্ব পশ্চিমের দিবা রাত্রির এ ঐক্য শুধু জেট বিমানের কারণেই। জেট একনাগাড়ে ছুটেছে সূর্যের পেছনে ! আমরা পৃথিবীর অপর প্রান্তে পৌঁছে গেছি। সূর্যের সাথে জেট বিমানের অসম খেলার এখানেই সমাপ্তি ! দিন শেষ হতে এখনো চার ঘন্টা বাকি। এখানে সন্ধ্যা হবে ঘড়ির কাঁটা ন’টায়।
তাহলে কতো ঘন্টায় একটা দিন !
কাইয়ূম তার নতুন নিশান পেট্টল নিয়ে ছুটছে লন্ডনের পথে। লন্ডন এখান থেকে দুই ঘন্টার পথ। সুন্দর প্রশস্ত রাস্তা, ঝকঝকে পরিস্কার। সামান্যতম ধূলাবালি নেই। ওয়ানওয়ে রোড।
পাশাপাশি ৫-৬টি গাড়ি একসঙ্গে ছুটতে পারে। ডিভাইডারের বামপাশ দিয়ে বিপরীত দিক থেকেও একইভাবে গাড়ি আসছে। ফ্লাইওভার বা ওভার পাশ দিয়ে রাস্তা ঘুরে যাচ্ছে এদিক ওদিক। চমৎকার সুন্দর পথদৃশ্য !
উঁচু উঁচু হাইরাইজ বিল্ডিং মনে হয় আকাশ ছুঁবে। উঁচু সব দালান যেমন আছে তেমনি আছে একতলা দো’তলা আবাসিক ভবন।
একই রকম দেখতে সব। ছবির মতো সুন্দর সব কিছু।
দেখতে দেখতে আমরা হাইওয়েতে এসে পড়েছি। গাড়ি ১২০ কিলোমিটার বেগে ছুটছে। পেছনের সিটে শুভ তার মা খালাকে নিয়ে গল্পে মশগুল।
অনেক দিন পর দেখাতো ! তাই একে অন্যকে উজাড় করে দিচ্ছে গল্পে, কথায় ! অনেক দিনের জমানো কথা। দেশের খবর, স্বজনদের খবর, দেশের আর্থ সামাজিক সব খবরের মধ্যেই আছে তারা। মাঝে মাঝে খারাপ সংবাদে বিষন্নতা আবার প্রসঙ্গ পাল্টে অন্য খবরে আনন্দে আত্মহারা ! আমরা অর্থাৎ সামনের সিটের আরোহীরা ও মাঝে মাঝে আলোচনায় অংশ নিচ্ছি।
গাড়ি হাইওয়েতে ছুটছে। ২০০ ফুট চওড়া রাস্তা।
মাঝে ডিভাইডার। গাড়ি ছুটছে শতে শতে কিন্তু নীরবে। কোন হর্নের শব্দ নেই। রাস্তায় গাড়ি থেমে থাকার বিরক্তিকর দৃশ্য নেই। কোন পার্কিং নেই-- শুধু ছুটে চলা !
রাস্তার দু’পাশে সবুজ ভূমি মাইলের পর মাইল চলে গেছে।
যতো দূর দৃষ্টি য্য়া শুধু সবুজ আর সবুজ। কোথাও উঁচু পাহাড় আবার কোথাও সমতল ভূমি। সমতলে দিগন্ত বিস্তৃত শস্যক্ষেত, পাহাড়ে ঘন বনাঞ্চল। মাঝে মাঝে কৃষকের বাড়ি। বাড়ির সামনে ২/৪টি গাড়ি দন্ডায়মান।
পাকা রাস্তা বাড়ির উঠোন পর্যন্ত চলে গেছে। মাঝে মাঝে ছোট ছোট শহর। সাজানো গোছানো সুন্দর পরিপাটি !
চা-র তেষ্টা পেয়েছে ! অন্য কারণেও গাড়ি থেকে নামা প্রয়োজন। এদেশে যেখানে সেখানে প্রকৃতির ডাকে আপনি সাড়া দিতে পারবেন না। আপনাকে যেতে হবে নির্দিষ্ট জায়গায়।
সেই নির্দিষ্ট জায়গা হলো কফি হাউজ। সেই কফি হাউজে যাওয়ার জন্যে আমরা গ্রামের পথ ধরলাম। প্রায় ১৫-২০ কিলোমিটার ভেতরে চলে গেলাম আমরা। মিললো কফি শপ, নাম ‘টিমর্হটন’ । এই টিমর্হটন ই এখানকার বিখ্যাত কফি শপ।
শহর, গ্রাম বন্দর সর্বত্রই এই টিমর্হটন রয়েছে। এখানে চা- কফি, ডোনাট, বগেল, টমি বটিস, অনয়িন সুপ ইত্যাদি আপনি অর্ডার দেয়ার পর টাটকা বানিয়ে দেবে। এখানকার বিখ্যাত ‘কেপাচিনো’ কফি গরম বা ঠান্ডা দুই রকমেই পাওয়া যায়।
কফির অর্ডার দিয়ে আমরা একে একে বাথরুম অর্থাৎ ওয়াসরুমের কাজ সেরে এলাম। কি চমৎকার ওয়াসরুম! পরিস্কার পরিচ্ছন্ন।
টয়লেট পেপার, বেসিন, পানি, লিকুইড সাবান সব কিছুই আছে। আপনি শুধু ব্যবহার বিধি জানলেই চলে। প্লেনে তো আর এতো আরামে বাথরুম হয়নি ! সময় না হয় একটু লাগলই ! টিমর্হটন থেকে আমি এক কাপ গরম কেপাচিনো নিয়ে বসলাম। শুভর মা ও খালা ক্রীম কপি এবং শুভ ও কাইয়ুম আইস কফি নিলো। ১৫-২০ মিনিট কাটলো আমাদের কফিশপে।
আমরা গাড়িতে এসে বসলাম। গাড়ি ছুটে চললো লন্ডন শহর অভিমুখে। গাড়ির গতি ১২০ কিঃ মিঃ ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ডলি কাইয়ূমকে সতর্ক করে দিচ্ছে গতি বেগ কন্ট্রোলে রাখার। গাড়ির গতি ১২০ কিঃ মিঃ ছাড়ালেই পুলিশ ধরবে ! রাস্তায় কোন পুলিশ দেখা যায়না বটে কিন্তু প্রতিটি গাড়ির প্রতি ট্রাফিক পুলিশের সজাগ দৃষ্টি।
রাস্তায় কোন অনিয়ম হলে অথবা কোন দুর্ঘটনা ঘটলে সাথে সাথে পুলিশ এসে যাবে আপনি খবর দেয়ার পূর্বেই। অপরাধ অনুযায়ী জরিমানার টিকেট ধরিয়ে দেবে। বীমাবিহীন কোন গাড়ি রাস্তায় চলতে পারবেনা। দুর্ঘটনায় কোন গাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হলে বীমা কোম্পানী টাকা দিয়ে দেবে।
এদেশে গাড়ি কিনতে আমাদের দেশের মতো ২০০%-৩০০% টেক্স দিতে হয়না কিন্তু প্রতি মাসে ১৫০-২০০ ডলার বীমা কোম্পানীকে দিতে হয়।
বীমা কোম্পানীই ঐ গাড়ির নির্দিষ্ট টেক্স সরকারকে দিয়ে দেবে। তাই এখানে গাড়ি কিনতে এক সঙ্গে অনেক টাকার প্রয়োজন পড়ে না। অল্প টাকায় গাড়ি কেনার সামর্থ প্রায় সবাই রাখে। কিন্তু গাড়ি চালানোর লাইসেন্স সহজে মিলবে না। আপনাকে প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেই তবে লাইসেন্স নিতে হবে।
লাইসেন্সধারী ড্রাইভিং শিক্ষক প্রতি ঘন্টায় ৩০ ডলার নিয়ে কমপক্ষে আপনাকে ২০-৩০ ঘন্টা গাড়ি চালানো শেখাবে। রাস্তা ঘাটের নিয়মকানুন শেখাবে, ট্রাফিক আইন শেখাবে। এর পূর্বেই আপনাকে আরেকটি পরীক্ষা অর্থাৎ থিউরিটিক্যাল পরীক্ষা পাশ করতে হবে। অতএব এখানে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া সহজ ব্যাপার নয়। আমাদের দেশের মতো টাকা খরচ করলেই ড্রাইভিং লাইসেন্স মিলবেনা।
তাই এখানে ভুল ভ্রান্তি কম, অ্যাকসিডেন্ট কম। সবাই ট্রাফিক আইন মেনে চলে। হাইওয়েতে কোন ট্রাফিক জ্যাম নেই। সব কিছুই সিস্টেমের মধ্যে চলে, শৃংখলার মধ্যে চলে। জীবন এখানে অনেক সুন্দর !
আশ্চর্য লাগলো একটা লোকও রাস্তার ধারে কাছে দেখলাম না, না দাঁড়িয়ে থাকতে না হেঁটে যেতে।
এখানে হেঁটে সময় নষ্ট করার মতো সময় কারো নেই। তাই সবাই ছুটছে, সবাই ছুটছে গাড়ি নিয়ে। গাড়ি ছাড়া এরা জীবন কল্পনাও করতে পারে না। নিত্য নতুন মডেলের ঝকঝকে গাড়ি এদের। গাড়ি কোম্পানীগুলো নুতন কোন মডেলের গাড়ি বের করলে সর্বাগ্রে পাঠিয়ে দেয় আমেরিকায় এবং কানাডায়।
পথে সে রকমই দেখলাম। গাড়ি কোম্পানীগুলোর অফিস বা বিক্রয় কেন্দ্রসমূহে শতশত নতুন মডেলের গাড়ি লাইন ধরে পড়ে রয়েছে। রাস্তায় দুই একটা পাবলিক বাস হঠাৎ চোখে পড়ে নইলে সবই কার, নিত্য নতুনকার। আর বৃহৎ বৃহৎ লরি, কন্টেইনার বহনকারি ট্রেইলর, ২৪ চাকা ৩২ চাকার কাভার্ডভ্যান। এসব কাভার্ডভ্যান সরাসরি আমেরিকা থেকে ও আসছে মালামাল নিয়ে।
গাড়ি চলছে পিঠে পিঠে, একের পর এক ! মনে হয় গাড়ির মিছিল। বিপরীত দিক থেকে ও ছুটে আসছে শতশত গাড়ি। একসঙ্গে এতোগাড়ি, গাড়ির মিছিল এই প্রথম দেখলাম। কোন গাড়ির গতিই ১০০ কিঃ মিঃ নিচে নয়। আবার এক গাড়ি অন্য গাড়ির জন্যে বাধাও নয়।
দেখতে দেখতে কিভাবে যেনো দুই ঘন্টা সময় পার হয়ে গেলো ! আমরা হাইওয়ে থেকে লন্ডন শহরে ঢুকে পড়লাম। বুঝতেই পারলাম না কিভাবে ২০০ কিঃ মিঃ পথ পার হয়ে এলাম এতো অল্প সময়ে। আসলে বিমানে দীর্ঘ সময় বসতে বসতে আমরা বোর হয়ে গিয়েছিলাম। আর গাড়িতে প্রাকৃতিক দৃশ্য, পথঘাট, আলো-বাতাস, সব কিছুই সুন্দর সব কিছুই আনন্দময়, সব কিছুই হাতের নাগালের মধ্যে। আলো বাতাস হাতে ছোঁয়া যাচ্ছে, প্রাণ ভরে বুকে টেনে নেয়া যাচ্ছে।
চট্টগ্রাম থেকে টরন্টো পর্যন্ত দীর্ঘ ভ্রমনের ক্লান্তি, অবসাদ সব যেন দূর হয়ে গেলো ! দেহমন নতুন করে সতেজ হলো !
আমরা লন্ডন শহরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে ডাউনটাউনে এসে পড়েছি। এখানে সব উঁচু উঁচু বিল্ডিং। প্রশস্ত সব রাস্তাঘাট, বিশাল বিশাল মল। এক একটা মলের সামনে শতশত গাড়ি পার্ক করা। এই প্রথম ফুটপাতে মানুষ দেখলাম ! মানুষ রাস্তা পার হচ্ছে সিগন্যাল দেখে।
কতো রকমের নারী পুরুষ ! স্বল্প বসনা নারী কাউকে তোয়াক্কা না করে ছুটছে নিজ গন্তব্যে !
আমরা অক্সফোর্ড স্ট্রীট দিয়ে যাচ্ছি। একটু পরেই প্ল্যাটস লেন। এই প্ল্যাটস লেনের ২৬১ নম্বর বাড়ির সম্মুখে এসে গাড়ি থামলো। ৫ তলার বিশাল ফ্ল্যাট বাড়ি। শুভর ফ্ল্যাট দো’তলায়।
সামনে গাড়ি পার্কিং। প্রচুর গাড়ি পার্কিং লটে। আমরা গাড়ি থেকে নেমে লিফট দিয়ে উপরে উঠলাম। দরজা খুলে আমাদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে বৌমা আর ধ্রুব ! ধ্রুব আমাদের নাতি-- ১মাস ৬ দিন বয়স ! আমাদের দিকে কেমন ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে ! দাদি ছোঁ মেরে নাতিকে বুকে জড়িয়ে নিলো--পরম যত্নে, পরম মমতায় !
(ক্রমশ) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।