আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কানাডায় ৭০ দিন - ১৪ তম র্পব

আমার বাবা (তারেক-উল আলম) গত বছর কেনাডা বেড়াতে এসেছিলেন। কেনাডা থেকে দেশে ফিরে একটা বই লিখেছেন – ‘কানাডায় ৭০ দিন’। আজ পড়ুন এর ১৪ তম পর্বঃ অরেন্ডা কোর্ট ব্রেমটন শহর বৃহত্তর টরন্টোর একটি অংশ। এই ব্রেমটন শহরের বিখ্যাত অরেন্ডা রোডের পাশেই ‘অরেন্ডা কোর্ট’। কয়েকটি ছোট বড় বিল্ডিং নিয়ে অরেন্ডা কোর্ট।

এখানে রয়েছে ২৫০টি অ্যাপার্টমেন্ট, গাড়ি পার্কিং এবং বেশ বড় জায়গা নিয়ে ১টি শিশু পার্ক। এই অরেন্ডা কোর্টের র্সাবকি ব্যবস্থাপনায় রয়েছে আতাউল কাইয়ূম- আমার ভায়রা ভাই, ডলির স্বামী। ডলি’র অফসি টরন্টোয়। কোম্পানি প্রদত্ত এই অরেন্ডা কোর্টের ১টি অ্যাপার্টমেন্টে থাকে ডলি- কাইয়ূম, সাথে কন্যা মিতুল এবং ছেলে ফারহান। নায়াগ্রা ফলস থেকে ডলি আমাদের এনে ওঠালো এই অরেন্ডা কোর্টের অ্যাপার্টমেন্টে।

বিকেলে কাইয়ূমের সাথে গলোম শহরের এক মুসলিম দোকানে। আমাদের সালাম দিয়ে অভ্যর্থনা জানালেন কাবুল খান। তিনিই দোকানের মালিক। আফগানিস্তানের নাগরিক। এখানে শাক-সবজি, তরিতরকারি, মাছ-মাংস থেকে শুরু করে সব ধরণের প্যাকেট জাত খাবার, শুকনো ফলমূল, চাল-ডাল, রুটি, মাখন ইত্যাদি এবং ‘হালাল মাংস’ বিক্রি হয়।

এই হালাল মাংস কেনার জন্যেই আমাদের এখানে আগমন। আমরা মুরগির হালাল মাংস নিলাম। বড় বড় মুরগির রান। এক একটি রানের ওজন ১/২ পাউন্ড। ১ ডজন মুরগির রান নেয়া হলো বার-বি-কিউ করার জন্যে।

মশলা মাখা মাংস। এদেশে সব কিছুই মোটামুটি তৈরি করাই থাকে, শুধু প্রসেস করে খাওয়া। নান রুটিও পরটা নেয়া হলো। আর নেয়া হলো কাঁচা শাক-সবজি এবং কিছু ফলমূল। বারবি-কিউ করার চুলা বসানো হলো বাড়ির লনে।

সন্ধ্যার পর মিতুল বার-বি-কিউ করার প্রসেস সম্পন্ন করে ওভেন অন করলো এবং চুলার শিকের উপর মাংস ঝলসানো শুরু করলো। মিতুল বার-বি-কিউ করায় বেশ অভ্যস্ত মনে হলো। জিজ্ঞেস করতে বললো, হোস্টেলে বান্ধবীদের সাথে অনেক করেছে। রান্নার মাঝে কাউয়ূম এলো। তিনিও রান্নায় ওস্তাদ পাঁচক ! তিনি সবজি বার-বি- কিউ করলেন।

বার-বি-কিউ আসলে তেমন কোন রান্না নয়, মাছ-মাংস বা অন্য কিছু প্রয়োজনীয় মসলা মিশিয়ে আগুনে ঝলসিয়ে পুড়িয়ে খাওয়া। ইতিমধ্যে ডলি তার কাজ শেষে বাসায় ফিরেছে। একটু পরেই ফিরলো সুশান তার ছেলেকে নিয়ে। সুশান ডলির ফিলিস্তিনি বান্ধবী। থাকেন আল-আইন।

ডলির বাসায় বেড়াতে এসেছেন। থাকবেন মাস খানেক। ফি বছরই আসেন, থাকেন ডলির বাসায়। রাতে সবাই একত্রে বসে পরম তৃপ্তি নিয়ে পোড়া মাংস-পরটা খেলাম। অনেক রাত অবদি চললো আড্ডা ! তারেকদের একান্নর্বতী পরিবার ৫ জুলাই, রাতে বন্ধু তারেকের বাসায় আমাদের নিমন্ত্রন।

তারেক আমার অনেক দিনের বন্ধু। ঢাকার বাসাবোতে মুক্তি যুদ্ধের সময় এক সাথে থেকেছি। আমার শ্বশুর বাড়ির খুব কাছের মানুষ। তার বাবা স্বাধীনতা পূর্ব ভারতের বিশিষ্ট সাংবাদিক এবং কবি নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মরহুম মোহাম্মদ ওয়ালি উল্লাহ, সন্দ্বীপে যিনি ‘অলিগান্ধী’ নামে সুপরিচিত। ব্রেমটন থেকে বিকেল ৫টায় টরন্টোর ম্যান স্ট্রীটে অবস্থিত তারেকদের নিজস্ব বাসায় আমরা পৌঁছলাম।

ডলি-কাইয়ূম পূর্বে বেশ ক’বার এসেছে তাই বাসা ধরতে কোন অসুবিধা হয়নি। ড্যানফোর্থ স্ট্রীট বা বাংলা টাউন এলাকার নিকটেই ম্যান স্ট্রীট। ভিক্টোরিয়া পার্ক, ড্যানফোর্থ স্ট্রীট বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকা। রাস্তার দুই পাশে বাংলাদেশি দোকানপাট। বাংলা সাইন বোর্ড দেখে হঠাৎ মনে হতে পারে আপনি বুঝি ঢাকার কোন এক এলাকায়।

বাংলাদেশ থেকে এতো দূরে হঠাৎ বাংলাদেশি শহর, বাঙালি লোকজন, বাঙালি কালচার- আপনি ভিমরি খেয়ে পড়বেন ! দেখে খুব গর্ববোধ হলো। ভালো লাগলো। দীর্ঘ ৩৮ বছর পর তারেকের সাথে এই প্রথম দেখা। কথা ভুলে গেলাম, জড়িয়ে ধরলাম ! একে অন্যের দিকে চেয়ে থাকলাম অনেকক্ষন ! ‘ কতো বছর পর’-- উভয়ের প্রশ্ন ! হাসলাম একে অন্যের দিকে তাকিয়ে। আমরা নষ্টালজিয়ায় চলে গেলাম।

অতীতের কতো ঘটনা, কতো স্মৃতি দু’ জনের মনে উঁকি ঝুঁকি দিতে থাকলো ! চোখে চোখে তাকিয়ে হয়তো না বলা কিছু প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেলো ! ভিতরে গিয়ে বসলাম। ছিমছাম গোছানো ড্রয়িংরুম। কার্পেট মোড়ানো ঘর। দুই যমজ ভাই- শান্তি ও কান্তি। শান্তিই তারেক।

বাসার সবাই চলে এলো ড্রইং রুমে। তারেকের বউ মুন্নী আর কান্তির বউ মিমি, এরা ও বাসাবোর মেয়ে। তারেকের দুই মেয়ে, কান্তির এক ছেলে। সবাই হাই স্কুল লেভেলে পড়ে। দুই ভাইয়ের খুব মিল।

এখনো এক সাথে থাকে। পরিচয়ের পালা শেষে গল্পের আসর বসে গেলো। তারেকের বউ মুন্নী খুবই গাপ্পিক, একাই একশ ! পুরনো দিনের গপ্প, বর্তমানের কথা, কথার পিঠে কথা- কথার যেনো শেষ নেই ! কে কাকে শোনাবে, কার আগে কে বলবে-- আবেগ তাড়িত সবাই। বহু বছর পর দেখা তো ! বাড়ির পেছনে বাগান দেখাতে নিয়ে গেলো তারেক। তারেকের নিজ হাতে তৈরি বাগান।

আপেল গাছে আপেল ধরেছে, কমলা গাছে এখনো ফলন আসেনি। নানা পদের সবজি পদিনা পাতা থেকে শুরু করে লাউ, কুমড়ো, মরিচ, লেবু ইত্যাদি গাছ, স্বযতেœ লালিত। খাওয়ার টেবিলে ডাক পড়লো। নানা রকমের ভাজি-ভর্তা, শাক-সবজি, মাছ-মাংস প্রভৃতি খাঁটি বাংলাদেশি খাবার। ওদিকে সেদ্ধ বাঁশমতি চাল।

পোলাও বিরানী বা চায়নিজ না করে একেবারে খাঁটি বাঙালি খানা ! প্রতিটি আইটেম অপূর্ব স্বাদের তবে ঝালটা একটু বেশি। মুন্নী বললো, ‘সব আইটেম আমি নিজ হাতে করেছি দুলা ভাই, সব খাবেন’। আন্তরিকতা রান্নায়, আন্তরিকতা পরিবেশনে। বলে রাখা ভালো মুন্নী আমার শ্যালিকাদের বান্ধবী, তাই আমিও ওর দুলা ভাই ! ‘টাকি মাছের ভর্তাটা আরেকটু নেন, দেখেন বেগুন ভাজাটা .......’-মুন্নির আন্তরিক অনুরোধ। খানা যতো না স্বাদের তার চেয়ে বেশি আনন্দের, অকৃত্রিম আন্তরিক পরিবেশনায় ! রাত ন’টায় সবাই মিলে তারেকের বড় ভাই দুলালের পলমার এভেন্যুর বাসায় গেলাম তার মাকে দেখতে।

নব্বয়োর্ধ বয়স তাঁর। এখনো বেশ শক্ত ! শারীরিক অবস্থা খুবই ভালো তাঁর। আমাদের উপর অভিমান কেন আসার পূর্বে তাকে জানানো হলো না। তিনি নিজ হাতে রান্না করে আমাদের খাওয়াতেন। কথা দিয়ে এলাম একদিন এসে তাঁর হাতের রান্না খেয়ে যাবো।

দুলালের একান্নর্বতী পরিবার। মা, দুই সন্তান, তারা স্বামী-স্ত্রী এবং ভাই, ভাইয়রে স্ত্রী- সন্তান নিয়ে তার বড় সংসার। দুলাল নিজস্ব অর্থায়নে এই বাড়িটি ক্রয় করেছেন। দুলালের একান্ত আন্তরিকতায় এবং প্রচেষ্টায় ফ্যামিলির সব ভাই বোন কানাডায় এসে সেটেল হতে পেরেছে। আজ তারা সবাই কানাডার নাগরিক।

তারেক সিএন টাওয়ারে কাজ করে। আমাদের ৪ জনের জন্যে সি এন টাওয়ার পরিদর্শনের পাশ দিলো। আমাদের সিএন টাওয়ারে উঠতে, ঘুরতে বেড়াতে কোন পয়সা লাগবেনা ! সে এক মাসের ছুটি নিয়েছে। উদ্দেশ্য নিউইয়র্ক সহ যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমন। তার ক’ জন বন্ধু আসবে ইতালী থেকে।

তাদের নিয়ে আমেরিকা সফরে যাবে। আমাদের কথা দিলো পরশু আমাদের সাথে বেড়াবে। রাত অনেক হয়েছে। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা ব্রেমটনের পথে রওনা দিলাম। অপু -মনির নিমন্ত্রণে বেলায়েত হোসেন অপু এবং তার স্ত্রী মনি ডলির শ্বশুর বাড়ির আত্মীয়।

থাকেন টরন্টোয়। আজ দুপুরে তাদের বাসায় আমাদের নিমন্ত্রন। এখানে একটা রেওয়াজ দেশ থেকে কোন আত্মীয়, বন্ধু বা জানাশোনা কেউ এলে আপনাকে দেখতে আসবে, আপনাকে দাওয়াত দেবে। আপনার না করার উপায় নেই। না করলে মনঃক্ষুন্ন হবে, কষ্ট পাবে।

আজ না পারলে আপনাকে কাল যেতে হবে অর্থাৎ তার বাসায় একবেলা না খেয়ে আপনি নিস্তার পাবেন না। বাঙালি বিদেশে একান্ত আন্তরিক। একান্ত আপন। আর আপন আত্মীয় হলে তো কথাই নেই। এই জন্যে বিদেশে এরা খুব ভালো আছে।

কখনো একা বোধ করে না। এদের জন্যে আমাদের আশীর্বাদ এরা এভাবে ভালো থাকুক, আনন্দে থাকুক পরস্পরের সৌহার্দ্যে। বেলায়েত হোসেন যান্ত্রিক প্রকৌশলী। বাংলাদেশ সেনা বাহিনীতে মেজর পদের চাকুরী থেকে অবসর নিয়ে কিছুদিন মধ্যপ্রাচ্যে চাকুরী করেছেন। কানাডার ইমিগ্রেন্ট হয়ে এখন পুরো পরিবার নিয়ে টরন্টোতে আছেন।

স্ত্রী মনি উচ্চ শিক্ষিতা, সাদাসিদে মানুষ। স্বামী-স্ত্রী উভয়েই কাজ করেন টরন্টোয়। এক ছেলে, দুই মেয়ে। ছেলে টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে ব্যবসা প্রশাসনে। পার টাইম কাজ করে।

কন্যা বড়টি হাই স্কুল লেভেলে এবং ছোটটি বেবী ক্লাসে পড়ে। নিজস্ব বাড়িতে থাকে। বাড়ি টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি। বেশ সুখি একটি পরিবার। মিতুল বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়ার পথে আমাদের নামিয়ে দিয়ে গেলো।

ফেরার পথে নিয়ে যাবে। উল্লেখ্য, মিতুল টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রূপচর্চা এবং তক্- তত্ব বিষয়ে গ্র্যাজুয়েশন করছে। মনি একা হাতে অনেক কিছুই করেছে। আমাদের জন্যে সে আজ কাজে যায়নি। পোলাওর সাথে ইলিশ মাছ, মুরগির রোস্ট, গরুর মাংস, সবজি সব কিছুই ছিলো।

ছানা মিষ্টি, দই ইত্যাদি মিষ্টান্ন ও তৈরি করেছে বাসায়। অপু ও তাদের বড় ছেলে কাজে ছিলো। তাদের ছাড়াই আমরা ভুরি ভোজন সারলাম। ভুরি ভোজন শেষে মেয়েরা আড্ডায় বসলো আর সেই সুযোগে আমি একটু দিবা নিদ্রা ! বিকাল ৪টায় মিতুল ফিরলো ভার্সিটি থেকে। কিছুক্ষণ পরই বেলায়েত সাহেব এলেন অফিস থেকে।

ডাইনিং টেবিলে সবাই বসলাম চায়ের আড্ডায়। দেশ-বিদেশের নানান গল্প। গল্পে গল্পে কেটে গেলো সময়। মনির ছোট মেয়ের বান্ধবী লিজা। বয়স ৭-৮ বছর হবে।

বাবা মা কাজে গেছে মেয়েকে এখানে রেখে। অনর্গল কানাডিয়ান উচ্চারনে ইংরেজী বলে গেছে বান্ধবীর সাথে। অনেক কথাই তাদের বুঝতে পারলাম না কিন্তু তারা চুটিয়ে গল্প চালিয়ে গেলো। এখানে ৭-৮ বছরের বাঙালি শিশুরা ইংরেজীতে কথা বলে। তাদের পড়া শোনার মাধ্যম ইংরেজী।

স্কুলে তাদের ভাষা শেখায়, উচ্চারন শেখায়। আমাদের ভুল ইংরেজী উচ্চারন বাচ্চারা শুদ্ধ করে দেয়। অবাক হয়ে খেয়াল করলাম এই বাচ্চারা যখন আমাদের সাথে কথা বলে অথবা তাদের বাবা মার সাথে তখন ইংরেজী বলে না, বাংলাতেই বলে। সুন্দর আদর্শ শিক্ষা। চা পর্ব শেষে আমরা অপু- মনির কাছ থেকে বিদায় নিলাম।

ফেরার পথে আমরা অরফাজ রোডের মার্কেটে গেলাম । এখানে রাস্তার দুই পাশে বড় বড় দোকান। মার্কেটের সামনে সু-বৃহৎ গাড়ি পার্কিং। এখানকার বেশির ভাগ দোকানই মুল দোকানের ব্রাঞ্চ, দাম ছাড়ের দোকান। মূল দোকানে যে পন্যের মূল্য ১০ ডলার এখানে সেই একই পণ্য আপনি ৫ ডলারে পেয়ে যাবেন।

অনেক সময় আরো কমেও পেতে পারেন। প্রধান দোকানের অবিক্রীত অথবা পুরানো ডিজাইনের মালামাল এসব দোকানে পাঠিয়ে দেয় ‘সেলে’ বিক্রির জন্যে। তাই এখানে প্রচুর বেচাকেনা। সময় নিয়ে দেখে দেখে প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রী সাশ্রয়ী মূল্যে কিনতে আসে অনেকে বিশেষ করে গার্মেন্টসের কাপড় চোপড়, সার্ট- প্যান্ট, মহিলাদের নানার ধরণের পরিধেয় বস্ত্র। ডলি ও মিতুল এখানে কেনা কাটায় বেশ অভ্যস্ত মনে হলো।

কোন দোকানে কি পাওয়া যায় তা তাদের নখদর্পনে। আমরাও বেশ কিছু কেনা কাটা করলাম। (ক্রমশ) ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।