আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কানাডায় ৭০ দিন - ৫ম পর্ব

আমার বাবা (তারেক-উল আলম) গত বছর কেনাডা বেড়াতে এসেছিলেন। কেনাডা থেকে দেশে ফিরে একটা বই লিখেছেন – ‘কানাডায় ৭০ দিন’। আজ পড়ুন এর ৫ম পর্বঃ সমাবর্তন আজ ১৫ জুন, ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অন্টারিও-র ২৯৭তম সমাবর্তন। বেলা ৩.৩০ মিনিটে ইউনিভার্সিটির অ্যালুমনাই হলে অনুষ্ঠিত হবে সমাবর্তন অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানে যোগদানের আমন্ত্রনে সুদূর বাংলাদেশ থেকে আমাদের এখানে আগমন।

আমাদের বড় ছেলে শুভ এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাষ্টার্স অব ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড সায়েন্স ডিগ্রি অর্জন করে ২০১১ সালের জানুয়ারীতে। আজ সমাবর্তন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের সম্মাননা দেয়া হবে। এই দুর্লভ মুহূর্তটিতে সশরীরে উপস্থিত থেকে স্বচক্ষে উপভোগ করার জন্যে আমরা উপস্থিত হয়েছি ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির অ্যালুমনাই হল প্রাঙ্গনে। অনুষ্ঠান শুরু হতে এখনো ঘন্টা খানেক বাকি। আমরা বাংলাদেশের ছাত্র অভিভাবক মিলে মোট ১০/১২ জন একত্র হয়েছি এখানে।

অভিভাবকদের মধ্যে আমরা স্বামী-স্ত্রী আর রাজশাহীর এক মাতা--এই তিন জন। এরই মধ্যে প্রার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাবর্তনের বিশেষ পোষাক--মুকুট (বিশেষ ক্যাপ) এবং গাউন পরিধান করে এসেছে। অপূর্ব সুন্দর লাগছে তাদের। বিকেল ৬টা পর্যন্ত এই ড্রেস তারা নিজেদের কাছে রাখতে পারবে। এরপর জমা দিয়ে দিতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নিকট।

গ্র্যাজুয়েটদের জন্যে সমাবর্তন একটি আনন্দময় উপলক্ষ। তাদের মেধা ও পরিশ্রমের স্বীকৃতির অনুষ্ঠান। অনেকদিন তারা সুখে দুঃখে আনন্দ বেদনায় এক সাথে থেকেছে। শিক্ষা গ্রহণ করেছে। কতো স্মৃতি, কতো ঘটনা ! আজ তারা একত্র হয়েছে সমাবর্তনে।

এর পর কে কোথায় চলে যাবে, কে কোথায় হারিয়ে যাবে একে অপর থেকে ! অনেকের জীবনে হয়তো এটাই শেষ দেখা ! তাই এই আনন্দময় দুর্লভ মুহূর্তটি ধরে রাখতে সচেষ্ট শিক্ষার্থীরা। সমাবর্তনের বিশেষ পোষাকটি পরিধান করে নানান দৃষ্টিনন্দন স্পট থেকে তারা ছবি তুলছে একে অন্যের সাথে, নানান ভঙ্গিমায়। এই আনন্দঘন মুহূর্তটি ক্যামেরায় ধারণ করে স্মরণীয় করে রাখতে সচেষ্ট সকলেই। আজ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ডিগ্রি প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের মিলনমেলা ! ফটো সেশন পর্ব শেষে আমরা অনুষ্ঠানে প্রবেশের জন্যে অ্যালুমনাই হলের সামনে লাইনে দাঁড়ালাম। প্রার্থীরা চলে গেলো তাদের নির্ধারিত স্থানে।

সেখান থেকে ড্রেস আপ হয়ে কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মোতাবেক স্টেজে প্রবেশ করবে এবং সার্টিফিকেট গ্রহণ করবে তারই রিহার্সালে। আমরা হলে ঢুকে আমাদের জন্যে নির্ধারিত আসনে গিয়ে বসলাম। বিশাল এক হল রুম। বিশাল গ্যালারি। সম্মুখে মস্ত বড় স্টেজ।

স্টেজের পেছনাংশে বাদকদল অতি মিহি কোমল সুরে সংগীতের সুর মূর্চ্ছনা তুলেছে। আমরা স্টেজের কাছাকাছি জায়গায় আসন নিলাম। উদ্দেশ্য কাছ থেকে অনুষ্ঠান দেখা। শিক্ষার্থীদের বসার জন্যে রয়েছে হলের মধ্যে নির্ধারিত স্থান। হলের মাঝখানে গ্র্যাজুয়েট, তাদের পেছনে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট এবং পি এইচডি প্রাপ্তরা।

বাংলাদেশের গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রির কেউ নেই। পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ৬ জন এবং পিএইচডির ২ জন। এদেশে আন্ডার গ্র্যাজুয়েশনের জন্যে বিদেশীদের কোন বৃত্তির ব্যবস্থা নেই। ২/৪ জন বিদেশী যারা নিজ খরচে এখানে পড়তে আসে তারা ধনীর দুলাল। প্রচুর ডলার ব্যয়ে তারা এখানে পড়া লেখা করে।

এদেশে টিউশন ফি অনেক। থাকা খাওয়া এবং টিউশন ফিসহ কমপক্ষে দুই হাজার কানাডিয়ান ডলার খরচ হয় মাসে। এদেশে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীর ৮০ শতাংশই কানাডিয়ান। বাকিরা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের। কানাডিয়ানরা বেশির ভাগই সরকারি লোন নিয়ে লেখাপড়া করে।

পোস্ট গ্র্যাজুয়েট এবং পিএইচডির বিদেশী ছাত্ররা সরকারি বৃত্তি, প্রতিষ্ঠানের বা কোম্পানীর বৃত্তি অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তি নিয়ে এসেছে। এরা নিজ নিজ দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্র অথবা শিক্ষক। তারা উচ্চ শিক্ষার বৃত্তি নিয়ে এখানে এসেছে। তারা পরিশ্রম করেছে, কমিটমেন্ট রেখেছে। আজ তাদের পরিশ্রম এবং মেধার স্বীকৃতির অনুষ্ঠান।

তারা তাদের মেধার স্বীকৃতির সার্টিফিকেট নেবে আজ। এই মহান অনুষ্ঠানে আজ জ্ঞানীগুনী, সুধীজন, অভিভাবক এবং ডিগ্রিপ্রাপ্ত ছাত্র-ছাত্রীদের মহামিলন ঘটেছে। সন্তানের শিক্ষার এবং মেধার স্বীকৃতির এই মহান অনুষ্ঠানে গর্বিত পিতা মাতার সরব উপস্থিতি কি যে আনন্দের তা ভাষায় প্রকাশের নয় ! এই গর্ব, এই আনন্দানুভূতি আমাদের জীবনের একটি শ্রেষ্ঠ অধ্যায়ের সুখানুভূতি ! হল পূর্ণ দর্শক অভিভাবক। অতিথিরা গ্যালারির বাম দিকে এবং পেছনের আসনসমূহে বসেছেন। প্রার্থীরা ডানে মাঝের আসনসমূহে।

আজকের সমাবর্তনের মূল আকর্ষণ ডিগ্রি প্রাপ্তরা স্টেজের বামদিকের দরজা দিয়ে হলে প্রবেশ করতে শুরু করেছে। সবাই দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে তাদের অভিনন্দন জানালো। প্রথমে গ্র্যাজুয়েট সংখ্যায় ৩০০/৪০০, তারপর পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ৪০-৫০ জন এবং সবশেষে পিএইচডি ১০-১২ জনের মতো। প্রার্থীরা তাদের নির্দিষ্ট আসনে গিয়ে বসলো। আজ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির প্রকৌশল বিভাগের ডিগ্রিপ্রাপ্তদের সম্মাননা ও সার্টিফিকেট প্রদান অনুষ্ঠান।

গত দুই সপ্তাহ ধরে ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির বিভিন্ন বিভাগের সমাবর্তন অনুষ্ঠান চলছে। প্রতি বছর সামার এবং স্প্রিং এ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি অর্জনকারী শিক্ষার্থীদের সমাবর্তন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মত অনেক বছর পর একসঙ্গে সমাবর্তন হয়না-- প্রতিবছরই হয়। গ্যালারির সম্মুখে বিশাল স্টেজ। স্টেজের উপর ৬/৭টি চেয়ার।

সামনের ছোট টেবিলটি ফুল দিয়ে সাজানো। চেয়ারের পেছনে অর্কেস্ট্রার তোলা মৃদু মধুর সুরের মূর্চ্ছনা ! ঘড়ির কাঁটায় ঠিক ৩.৩০ মিনিটে কানাডার জাতীয় সংগীত ‘ও কানাডা’ সুরের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান পর্ব শুরু হয়। প্রধান অতিথি, মূল বক্তা, উপাচার্য সবাই স্টেজে নিজ নিজ আসন গ্রহণ করেন। অনুষ্ঠানের পরিচালক মাইকে অনুষ্ঠান শুরুর ঘোষণা দিয়ে অতিথিদের পরিচয় করিয়ে দেন। এবারে ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির ‘প্রফেসর অব দ্য ইয়ার’ একজন ভারতীয়।

প্রফেসর সাহেব তাঁর সুদীর্ঘ জ্ঞানগর্ব বক্তব্য প্রদান করেন। তাঁকে মাল্য দান করে সসম্মানে আসনে বসানো হয়। একে একে ছাত্র পরিচালক, উপাচার্য এবং প্রধান বক্তার বক্তব্য দিয়ে বক্তব্য পর্ব শেষ হয়। আজকের অনুষ্ঠানে আমাদের অত্যন্ত আনন্দের এবং গর্বের বিষয় হলো ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য একজন বাংলাদেশি। নাম তাঁর অমিত চাকমা।

উজ্জ্বল গৌর বর্ণের দীর্ঘদেহী সৌম্যশান্ত ব্যক্তিত্ব। উচ্চতায় সাড়ে ছয় ফুট। রাঙ্গামাটির ছেলে। চার বছর মেয়াদে তিনি এখানকার উপাচার্য। দুই বছর শেষ হয়েছে।

আরো দুই বছর তিনি উপাচার্য থাকবেন। লন্ডনে বাংলাদেশিদের মধ্যে সবচেয়ে উচ্চ পদে এবং সব চেয়ে সম্মানের অবস্থান তাঁর ! তাঁর মনোমুগ্ধকর সংক্ষিপ্ত বক্তব্য বেশ ভালো লাগলো। আজকের অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের সার্টিফিকেট প্রদান অনুষ্ঠান শুরু হলো ডক্টরেট প্রাপ্তদের মাধ্যমে। বাংলাদেশের দুইজন এবার প্রকৌশলে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তাঁরা সার্টিফিকেট গ্রহণ করলেন সভাপতির কাছ থেকে।

হাততালি দিয়ে তাঁদের অভিনন্দন জানালাম। এরপর এলো ইঞ্জিনিয়ারিং এ পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি অর্জনকারীদের। অধীর আগ্রহ এবং উৎকন্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছি শুভ কখন আসে। উৎকন্ঠা শেষ হয়না ! অবশেষে শুভকে সত্যি সত্যি দেখলাম স্টেজে উঠতে। আনন্দে এবং গর্বে বুকটা ভরে গেলো ! নিজের অজান্তেই দাঁড়িয়ে পড়লাম।

আবেগে উচ্ছ্বাসে উদ্বেলিত মন! ‘প্লিজ টেক ইউর সিট’ -- পেছন থেকে কে যেনো বলে উঠলো। ‘সরি’ বলে বসে পড়লাম। ফিরে এলাম বাস্তবে ! শুভ স্টেজে উঠে একটু মাথা নুয়ে হাঁটু গেড়ে বসে আচার্যের দুই হাঁটুতে দুই হাত রাখলো। আচার্য হাত দু’ টো নিয়ে একত্র করে কি যেনো বললো এবং পেছন থেকে অন্য একজন গিয়ে রজোলয়িা পরিয়ে দিলো। ব্যাস, স্বীকৃতি হয়ে গেলো ! এখন সে ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি- র একজন স্নাতকোত্তর সদস্য ! ওর মা আমার পাশেই বসা।

বললাম এই দুর্লভ মুহূর্তের ছবি নিতে। ওর মা ও স্বপ্নাবিষ্ট হয়ে পড়েছিলো ! হয়তো নিজকে হারিয়ে ফেলেছিলো স্বপ্নের রাজ্যে। চমকে ওঠে ক্যামেরা অন করলো ! আমরা কিছুক্ষণ পর আস্তে আস্তে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলাম। একটু পর শুভ এলো এবং আমাদের কদমবুচি করলো। হাতে তার সার্টিফিকেট।

আবেগে আনন্দাতিশয্যে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম ! দুই চোখ ভিজে গেলো আনন্দাশ্রুতে ! কণ্ঠ বুঁজে এলো, অনেকক্ষন মুখ দিয়ে কথা বেরুলো না ! শুভকে নিয়ে আমরা ছবি তুললাম। শুভ আমাদের ছবি তুললো। তার সমাবর্তন ড্রেস আমাদের পরিয়ে দিলো। ক্ষনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে নানাপ্রয়াস। অন্য বাংলাদেশি সেলিব্রেটিদের নিয়ে ছবি তুললাম।

ছেলের ড্রেস বাপের গায়ে টুপি মায়ের মাথায়, প্রাপ্ত ডিগ্রির সার্টিফিকেট হাতে-- যে যেভাবে পারছে ছবি তুলছে, আনন্দ করছে, আনন্দে ভাসছে ! দিনটিকে আনন্দময় এবং স্মরণীয় করে রাখতে যে যেভাবে পারছে নিজের মতো করে উপভোগ করছে। বিকাল ৬টা পর্যন্ত এই আনন্দধারা অব্যাহত থাকবে। আজকের এই আনন্দময় সুখ স্মৃতি আমাদের হৃদয়ে জাগরুক থাকবে, লালিত হবে আজীবন ! বনভোজন ঃ ইরিলেকের পাইনারি বিচ আজ ১৮ জুন, লন্ডন প্রবাসী বাংলাদেশিদের বনভোজন। স্থান ইরিলেকের পাইনারি বিচ। লন্ডন থেকে গাড়িতে এক ঘন্টার পথ।

যাওয়ার দায়িত্ব নিজের, খাওয়া এবং আনন্দ সবাই মিলে। সকাল ১০টায় শুভ আর বরণ (ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পি এইচডি গবেষক) রেন্ট এ কার থেকে গাড়ি নিয়ে এলো। ঝকঝকে আনকোরা নতুন গাড়ি যা মাত্র ২০১১ সালের এপ্রিলে বাজারে এসেছে। যাত্রী আমরা স্বামী-স্ত্রী এবং শুভ, অন্যদিকে বরণ ও তার স্ত্রী শাওন। লুসি বাসায় থাকল ধ্রুবকে নিয়ে।

আমরা রওনা হলাম ইরিলেকের পাইনারি বিচের উদ্দেশে। গাড়ি চালাচ্ছে বরন। পাশে বসে তার স্ত্রী শাওন জিপিএস এর নির্দেশনা নিয়ে বরনকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। শুভকে নিয়ে আমরা পেছনের সিটে। পথে আমরা থামলাম ‘শেয়ার উড ফরেস্ট মলে’।

এখানে পাকিস্তানি দোকান--‘নেমত’। হালাল খাবারের দোকান ! পিকনিকের খাবার এখান থেকেই নেবে। পূর্বেই অর্ডার দেয়া ছিলো। অন্যরাও গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিলো এখানে। গাড়িতে খাবার ওঠানো হলো, পানির বোতল ওঠানো হলো।

অতঃপর ২৫-৩০টি গাড়ির বহর নিয়ে আমাদের যাত্রা। দ্রুতই আমরা শহর ছেড়ে হাইওয়েতে উঠলাম। কিছুক্ষনের মধ্যেই আমরা কান্ট্রি রোড ধরলাম। গ্রামের রাস্তা। গাড়ির স্পীড লিমিট করা।

রাস্তায় দিক নির্দেশনা বোর্ডে দেখানো আছে স্পীডের হিসাব। লিমিট ছাড়ালেই বিপদ। একটু পর পরই বাঁক। একটি বাঁক ঘুরতে গিয়েই আমাদের বহরের একটি গাড়ি তো রাস্তার পাশে খাদে পড়ে গেলো ! খাদ বলতে পাঁচ ছয় ফুট নিচে ভূট্টা ক্ষেত। গাড়িতে একটি শিশু ছিলো ! অবশ্য সবারই সিট বেল্ট বাঁধা ছিলো বলে রক্ষে ! ভাগ্য ভালো গাড়ি উল্টে যায়নি--নেমে গিয়েছিলো।

কারো তেমন কোন ক্ষতি হয়নি। শিশুটি অক্ষত ! সবার চেষ্টায় গাড়ি রাস্তায় ওঠানো হলো। গাড়ির টায়ার পরিবর্তন করা হলো। অবশেষে পুনরায় যাত্রা ! গাড়ি ছুটছে গ্রামের পথে। মাইলের পর মাইল শস্যক্ষেত, গম ভূট্টার ক্ষেত।

গম কাটার সময় হয়েছে। কোথাও কোথাও কাটতে দেখলাম-মেশিনের সাহায্যে। জমি কর্ষণ, শস্য বোনা, কাটা, শুকানো সব কিছুই মেশিনে হয়। কৃষকের খামার বাড়ির মধ্যেই বিরাট গোলা ঘর। প্রথমে বুঝতে পারিনি ওটা কি।

পরে জেনেছি শস্য রাখার ভান্ডার-- গোডাউন,আমাদের গ্রামের ভাষায় গোলা ঘর! এখানকার কৃষকেরা খুব ধনী। আধুনিক প্রযুক্তিতে তাদের চাষাবাদ। ব্যাংক তাদের জন্য উম্মুক্ত। সরকার তাদের সাহায্যে হাত বাড়িয়ে রেখেছে। হাজার হাজার একর জমি তাদের পত্তনি দিয়ে রেখেছে।

শুধু একটি শর্ত--উৎপাদন করো! এখন কানাডায় গ্রীষ্ম। চারদিকে সবুজ আর সবুজ। গ্রীষ্মে প্রকৃতি জেগে ওঠে সবুজে। যে দিকে তাকাবেন কেবল সবুজ, রাস্তার পাশে ঘাস থেকে দিগন্ত বিস্তৃত শস্যক্ষেত। সবুজ বনাঞ্চল দেখে দু’ চোখ জুড়িয়ে যায়।

পৃথিবীর মোট বনজ সম্পদের ১০ শতাংশ কানাডায় এবং তার মধ্যে ৬০ শতাংশই রয়েছে এই অন্টারিও প্রদেশেই ! সর্বত্রই গাছ আর বনরাজি। প্রকৃতি সব কিছুই সাজিয়েছে এখানে ! ছোট ছোট পাহাড়ের টিলা, দিগন্ত বিস্তৃত মালভূমি-- সবুজে ঢাকা। হাজার হাজার একর সমতল ভূমি ফসলে ভরা। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই সবুজের সৌন্দর্য বেশি দিন থাকেনা, মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্তই এর আয়ু ! এরপর আস্তে আস্তে এই সবুজ বিলীন হয়ে যাবে, বরফের চাদরে ঢেকে যাবে এই সবুজের সৌন্দর্য ! তখন পত্রহীন গাছের শাখা তুষার কনার শুভ্রতায় ভরে থাকবে। গ্রাম পথে সবুজের খেলা দেখতে দেখতে কখন যে আমরা ইরিলেকের পাইনারি বিচের টোল কাউন্টারে পৌঁছে গেছি বুঝতেই পারিনি।

ঘড়িতে বেলা ১২টা। পাইনারি বিচের টোল কাউন্টার পার হয়ে আমরা ভিতরে ঢুকলাম। রাস্তা সোজা চলে গেছে বনের ভিতর। রাস্তার দুই দিকেই গভীর বন। কিছু দূর যেতেই রাস্তা ২/৩ দিকে চলে গেছে ভাগ হয়ে।

চারদিকে ঘন অরন্য। নির্জন, নিরিবিলি। কেমন যেনো থমথমে ভাব, গা ছমছম করে অজানা আতংকে ! মাঝে মাঝে ছোট ছোট গাড়ি পার্কিং। ২/১টি গাড়ি পার্ক করা। পার্কিংয়ে গাড়ি রেখে সাইকেল নিয়ে কেউ কেউ বনের গভীরে ঢুকে যাচ্ছে।

আমরা কোন রাস্তা ধরে এগোবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। আমাদের ক্যাম্প কোন দিকে, কোন পথে তাও বোঝা যাচ্ছেনা। আমাদের সঙ্গী কোন গাড়ি বা লোকজন পথে দেখছিনে। আমরা গভীর অরন্যে। আমরা পথ হারিয়েছি ! অরণ্যের মধ্যে আমরা দিক হারিয়েছি ! কোন দিক নির্দেশনা ছাড়া গাড়ি চলছে।

জিপিএসের নেট ওয়ার্ক নেই এখানে। মোবাইল ফোনের নেট ওয়ার্কও নেই। আবার শুনলাম এসব জঙ্গলে নাকি ভাল্লুক থাকে ! ভাল্লুক খুব ভয়ংকর প্রাণী। ভয় এবং উদ্বেগ একটু একটু বাড়ছে। আবার সূর্যের আলো ঘন জঙ্গলের কারণে সরাসরি প্রবেশ না করায় মনে হয় সন্ধ্যা।

পথে কোন লোকজনের দেখা নেই। সব কিছু মিলিয়ে একটা অস্বস্তিকর অবস্থা। যে পথে এলাম আবার সেই পথ ধরলাম। ভেতরে ছোট ছোট এতো রাস্তা যে কোন পথে এসেছি আবার কোন পথে ফিরবো তা মাথায় ঢুকছেনা, সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত একটি গাড়ি পার্কিংয়ে গিয়ে আমরা সাহায্য প্রার্থনা করলাম।

গাড়ির ভদ্রলোকের সহায়তায় অবশেষে আমরা আমাদের জন্যে নির্ধারিত নয় নম্বর ক্যাম্পে পৌঁছতে পারলাম। স্বস্তিতে নিঃশ্বাস নিলাম ! দলের লোকজন অনেক পূর্বেই সেখানে উপস্থিত। অনেকেই নাস্তা করছে, কেউ কেউ নাস্তা সেরে বিচে গেছে। আমরা ওয়াসরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে কাপড় চেঞ্জ করে এলাম। হালকা নাস্তা সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম বিচের উদ্দেশে।

ইতিমধ্যে ক্যাম্পের প্রায় সবাই চলে গেছে বিচে। বিশাল লেক ! নাম ইরি। এপারে কানাডার অন্টারিও ওপারে আমেরিকার ক্লিবল্যান্ড। লেক না বলে এটাকে সাগর বলাই শ্রেয় ! পাইনারি বনের পাইনারি বিচ। বিচ খুব একটা বড় নয়।

আমাদরে পতেঙ্গা বিচের মতো অতো সুন্দরও নয়। বালুতে ভরা বিচ, ডেবে যায় পা, পতেঙ্গার মতো আরামে হাঁটা যায়না। আমাদের লোকজন বিচের বালুর উপর একটা সামিয়ানা খাটিয়েছে। মহিলারা বসে লেকের শোভা উপভোগ করছে। লেকে নামলাম, সাঁতার কাটলাম।

অনেকক্ষণ ঝাঁপাঝাঁপি করলাম। পানি খুব একটা পরিস্কার নয়। ছোট ছোট ঢেউ। খুব একটা মন ভোলানো নয়। শুভও নেমেছে লেকে।

সে সব সময় আমার কাছাকাছি থাকছে। কারণ সে সাঁতার জানেনা। ওয়েস্টার্ন ’ভার্সিটির ছাত্ররা লেকে নেমেছে। ২০/২২ জন মিলে ওয়াটার পলো খেলছে। বাঙালির স্বভাব সুলভ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য--হই হই হুল্লোর, চেঁচামেচি চিৎকার ! আনন্দ চিৎকারে, আবেগে উচ্ছ্বাসে বিচ এলাকা প্রকম্পিত ! ঘন্টা দুই আমরা পানিতে আনন্দ করলাম।

আমাদের মহিলা এবং পানি ভীতু পুরুষ পানিতে নামলো না ! অন্যদিকে এর বিপরীত দৃশ্য। কানাডিয়ান পুরুষ মহিলা, যুবক-যুবতী, শিশু কিশোর সুইমিং কস্টিয়ুম পরে দিব্যি লেকে ঝাঁপাচ্ছে, খেলছে, সাঁতরাচ্ছে-- আনন্দ করছে প্রাণ খুলে। বিচের বালুতে গড়াগড়ি খাচ্ছে কেউ কেউ, আবার লেকে ঝাঁপ ! আমরা দেখেই আনন্দ নিচ্ছি, তৃপ্তির ঢেকুর তুলছি ! কানে কানে বলি, এদেশে আনন্দরত মহিলাদের দিকে একটু আড় চোখেই তাকাতে হয়, সরাসরি নয় ! লেক থেকে আমরা ক্যাম্পে ফিরলাম। পিকনিকের জন্যে বিশেষভাবে নির্মিত এক তলা সেমিপাকা একটি ঘর, চারদিক খোলা, উপরে টিন- অনেকটা গোলাকৃতি। সামনে খোলা লন।

চারদিকে ঘন বন। জঙ্গল পরিস্কার করে এমন ঘন অরন্যের মধ্যে এমন সুন্দর পিকনিক স্পট ! কোলাহলমুক্ত জঙ্গলের মধ্যে এমন সুন্দর নিরিবিলি পরিবেশ ! পাশেই বিশাল লেক। বনভোজনের জন্যে এর চেয়ে সুন্দর আদর্শ স্থান আর কি হতে পারে ! ঘরের মধ্যে বেশ বড় বড় ক’টি ডাইনিং টেবিল। এক একটা টেবিল ঘিরে ১২টি চেয়ার সাজানো। ভেতরে শ’খানেক লোকের একত্রে বসে খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা।

এটা পাইনারি বিচের ৯নং টুরিস্ট ক্যাম্প। পাশে ওয়াসরুম এবং গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা। আমরা লাঞ্চ খেতে বসলাম। বাংলাদেশ থেকে আসা প্রায় ১০-১২ জন অভিভাবক উপস্থিত ছিলাম। আমরা বয়স্করা সব এক টেবিলে বসলাম।

স্বেচ্ছা সেবক এবং উদ্যোক্তা সবাই ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রী। তারাই ব্যবস্থাপনায়, তারাই পরিবেশনায়। এমন এক সুন্দর পরিবেশে আমরা লাঞ্চে মনোযোগ দিলাম। বনভোজনের অন্যতম আকর্ষণ প্রধান অতিথি যিনি লন্ডন প্রবাসী বাংলাদেশিদের অত্যন্ত সম্মানের এবং শ্রদ্ধার পাত্র, ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির সেরা ব্যক্তিত্ব--ডক্টর অমিত চাকমা। তিনি এবং তার স্ত্রী মিসেস মিনা চাকমা এই বনভোজনে আমাদের সাথে থেকে অনুষ্ঠানটিকে অত্যন্ত আনন্দময় এবং প্রাণবন্ত করে তোলেন।

আমরা বাংলাদেশে যা ভাবতে ও পারিনে ভিসির মতো উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিত্ব কিভাবে সাধারণ মানুষের সাথে একাকার করে দেয় নিজকে, কিভাবে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীর বন্ধু হয়ে যায়! উপাচার্য অমিত চাকমা একজন সাদাসিদে মানুষ। অতি সাধারণ চলনে বলনে কথনে। উচ্চতা সাড়ে ছয় ফুট ! বিনম্র ব্যক্তিত্ব। নিজেই এসেছেন গাড়ি চালিয়ে, সাথে স্ত্রী মিনা দেবী। বাড়ি বাংলাদেশের রাঙ্গামাটি।

মনে প্রাণে খাঁটি বাংলাদেশি। সর্বদা মুখে হাসিটি লেগেই থাকে। বাংলা কথা বলেন সবার সাথে। লক্ষ্য করেছি বাংলা বলার সময় একটি ইংরেজী শব্দ ও উচ্চারণ করেন না, কেউ ইংরেজী বললে তিনি বাংলায় উত্তর দেন। আমার সাথে, আমার স্ত্রীর সাথে কতো কথা, কতো গল্প।

অনেক কাছের মানুষ মনে হলো। তাঁর স্ত্রী আরো সহজ, আরো সরল। একদিনেই যেনো অনেক আপন হয়ে গেলেন আমাদের ! ড. অমিত চাকমা তাঁর জীবনের কিছু খন্ডাংশ শোনালেন। বাংলাদেশ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষে চলে যান আলজিরিয়ায়। ওখানে পড়াশোনা করেন।

সামারে ছুটিতে লন্ডনে গিয়ে হোটেলে কাজ করতেন। সবচেয়ে অপছন্দের কাজ, যেকাজ কেউ সহজে করতে চাইতো না সেই কাজটি তিনি নিজেই যেচে গ্রহণ করতেন--সেই বাথরুম পরিস্কারের কাজ ! সবার আগেই তিনি চলে যেতেন কর্মক্ষেত্রে, হোটেল পরিষ্কারের কাজে ! এভাবে তিনি নিজকে মেলে ধরতেন এবং সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে নিতেন। সব কাজই আনন্দ এবং আন্তরিকতার সাথে করতে হবে। সব কাজই ভালো, সব কাজই গুরুত্বপূর্ণ। অত্যন্ত গৌরব এবং অহংকার নিয়ে এসব কাহিনী শোনালেন।

অমায়িক নিরহংকার আমুদে মানুষ। অতি বড় মাপের অতি সাধারণ মানুষ। সাধারণের মধ্যে একটি অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ! বিকেলে খেলাধূলা হলো বাচ্চাদের, বাচ্চার মায়েদের এবং অতিথি মহিলাদের। মহিলাদের প্রতিযোগিতায় আমার স্ত্রী ২য় হয়ে একটি ক্রিস্টেলের ঘড়ি জিতে নিলো ! ভিসি অমিত চাকমা ছেলেদের এবং মিসেস মিনা চাকমা মেয়েদের মধ্যে পুরস্কার বিতরন করেন। অত্যন্ত আনন্দময় এবং হৃদ্যতাপূর্ণ একটি দিন যা স্মরণীয় হয়ে থাকবে বহুদিন।

আমরা বিকেল ৭টায় ইরি লেকের পাইনারি বিচ ত্যাগ করে লন্ডনের পথ ধরলাম। (ক্রমশ) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।