লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ। নেতার মৃত্যুশয্যা
মোহাম্মদ ইসহাক খান
তিনি এখন ডিপ কোমায়, জ্ঞান নেই। আদৌ জ্ঞান ফিরবে কীনা কেউ বলতে পারছে না।
তাঁর নাকে-মুখে নল লাগানো। একটি ব্যয়বহুল হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের অপরিসর কক্ষে তিনি শুয়ে আছেন। কয়েকটি স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে তাঁর হার্টবিট, রক্তচাপ, পালস সবকিছু। সার্বক্ষণিক নজর রাখছেন দুজন ডাক্তার এবং দুজন নার্স। তাঁরা কেউই আশাবাদী নন যে এই অবস্থা থেকে মানুষটি ফিরে আসবেন, কিন্তু তবুও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁরা চেষ্টা চালিয়ে যাবেন।
বলা তো যায় না, যখন কোন আশাই থাকে না, যখন সব বাতি নিভে যায়, তখনও তো এক-আধবার দপ করে জ্বলে ওঠে।
কেবিনটির ভেতরে এই অবস্থা, বাইরের চিত্রটি কেমন?
আইসিইউএর ভেতরে কাউকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। যাঁরা তাঁকে দেখতে চান, তাঁদেরকে বাইরে থেকে উঁকি দিয়ে দেখতে হবে। তাঁর স্ত্রীর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিলো, তিনি এখন মলিন মুখে হাসপাতালের একটি স্টিলের বেঞ্চে বসে আছেন। তাঁর এক ছেলে সারাদিন ধরে হাসপাতালের বারান্দায় পায়চারি করছে, আর মেয়ে আমেরিকা থেকে দেশে আসার জন্য প্লেনে চড়েছে।
বাবার শেষ সময়ে না হয় একটু পাশে থাকবে। সময়মত পৌঁছতে পারলেই হয়।
ডাক্তারদের ভাবগতিক সুবিধের নয়। তাঁদের মুখে হাসি নেই, বিষণ্ণ চোখে তাঁরা যেন অপেক্ষা করছেন ব্যাপারটি শেষ হয়ে যাবার জন্য। অবশ্য তিনি এখনো "ক্লিনিক্যালি ডেড" হলেও পুরোপুরি মৃত নন, কাজেই যতক্ষণ না তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে মৃত ঘোষণা করা হচ্ছে, ততক্ষণ তাঁর পরিচর্যা চালিয়ে যেতে হবে, এবং হাসপাতালের তহবিলে দৈনিক টাকা জমা হতে থাকবে।
পয়সাওয়ালা রোগী পেলে এই সুবিধেটা হয়। তাছাড়া এই হাসপাতাল এমনিতেই "বড় হাসপাতাল", এখানে গরীব মানুষ ঢোকার সাহস পায় না। এখানে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন শিল্পপতি, রাজনৈতিক নেতা, সচিব, আমলা এঁরা।
তিনি একজন নেতা। একনামে সবাই তাঁকে চিনত।
যেমন ছিল তাঁর খ্যাতি, তেমন ছিল তাঁর প্রভাব। তাঁর একটি কথায় দেশে বড় বড় পরিবর্তন ঘটে যেত। তিনি যেটা বলতেন, সেটাই সই ছিল। দোর্দণ্ড প্রতাপশালী এই নেতা দেশের এই প্রান্ত থেকে সেই প্রান্ত দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। দিয়েছেন অসংখ্য বক্তৃতা, করেছেন গণসংযোগ, ইলেকশনের সময় ভিখিরি সেজে সাধারণ মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়েছেন।
টিভি টক শো তে সত্যি কথা যেমন বলেছেন, পরিস্থিতির প্রয়োজনে অনেক মিথ্যেও বলতে হয়েছে। রাজনীতি মানেই তো মিথ্যা।
তাঁর ব্যাংকের তহবিলে টাকার আসল অংক তিনি নিজেও জানেন না, অন্যরা তো দূরের কথা। তিনি যে এলাকায় যেতেন, সে এলাকায় চব্বিশ ঘণ্টা লোডশেডিং হতো না, শুধু তাঁর সুবিধের জন্য। তাঁর জন্য মানুষ (সত্যি বলতে সমর্থকেরা) রাস্তায় নামত, তাঁকে করা আঘাত নিজের শরীরে নিয়ে নিত, তাঁর জন্য গাড়ি ভাংচুর করতো, টায়ারে আগুন দিত, তাঁর জন্য বানাত তোরণ, তাঁকে পরাত ফুলের মালা।
তাঁর বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে তাদেরকে মাটিতে পুঁতে ফেলার সংকল্প করতো। তাঁকে জেলে পুরলে নিঃশর্ত মুক্তি দাবী করতো।
পিল পিল করে সমর্থকেরা এবং নিজ দলের লোকজন এসে তাঁকে বাইরে থেকে এক নজর দেখে চলে যাচ্ছে। কেউ কেউ চোখের পানি মোছার ভান করছে। আর কে জানে, বিরোধী শিবিরে হয়তো খানিকটা আনন্দের ঢেউ লেগেছে।
ব্যাপক ব্যস্ততার কারণে তিনি নিজের দিকে তাকানোর অবসর পান নি। যখন পেয়েছেন, তখন শরীরের কলকব্জাগুলো কাজকর্ম বন্ধ করে দিতে শুরু করেছে। এখন তিনি অন্য ভুবনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন। পৃথিবীর বাতাসে তিনি দীর্ঘ পঁয়ষট্টি বছর শ্বাস নিয়েছেন, করেছেন কত না কাজ। বলেছেন কত কথা।
মানুষটি এখন অসহায়ের মতো অনড় হয়ে পড়ে আছেন হাসপাতালের বিছানায়। শরীরে কোন স্পন্দনের চিহ্ন নেই। চামড়া ফ্যাকাসে সাদা হয়ে গেছে। তাঁর বন্ধ দু'চোখের মাঝখানে যে মস্তিষ্ক, সেটাতে এখনো ধিক ধিক করে চিন্তা চলছে, মাত্র তো দুটো দিন কাটালাম। এখনই চলে যেতে হবে? সময় এত কম নিয়ে এসেছিলাম?
হ্যাঁ, কেউ শুনতে পাচ্ছে না, কেউ দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু তিনি ভেবে চলেছেন।
তাঁর মস্তিষ্ক এখনো কাজ করা বন্ধ করে দেয় নি। শীঘ্রই দেবে। আর সেটার নামই মৃত্যু। মস্তিষ্কের বিশ্রাম মানেই মৃত্যু।
তিনি ভাবতেন, তিনি অনেক ক্ষমতাশীল।
একটা আত্মশ্লাঘা অনুভব করতেন। নিজের অজান্তেই ঠোঁটের কোণে হাসি খেলে যেত তাঁর, চেয়ে দেখো সবাই, আমি কীভাবে সদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছি। যা খুশি তাই করতে পারছি। আমার মতো ক্ষমতাশালী কে আছে?
কিন্তু হাসপাতালের এই অপরিসর বিছানা তাঁর সব আত্মবিশ্বাস যেন কেড়ে নিয়েছে। অনড় হয়ে শুয়ে থেকে তাঁর মনে হচ্ছে, তিনি আসলে খুব দুর্বল, অসহায়।
তাঁর যেন কখনোই কোন ক্ষমতা ছিল না। চায়ের চামচের এক চামচ ক্ষমতাও না।
তাঁর শ্রবণেন্দ্রিয় এখনো কাজ করছে। শুধু কাজ করছে না, যেন অনেকগুণ ভাল কাজ করছে। চোখ বন্ধ রেখেই তিনি শুনতে পাচ্ছেন বাইরে মানুষের হাঁটাচলার শব্দ।
শুনতে পাচ্ছেন স্ত্রীর হৃদস্পন্দনের শব্দ। শুনতে পাচ্ছেন মেয়ে যে প্লেনে চড়ে রওনা দিয়েছে তার শব্দ। হাসপাতালের বারান্দায় পায়চারি-রত পুত্রের হাঁটার শব্দ, তার উদ্বেগের শব্দ। উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, ভয়, হতাশা, সব যেন শব্দের রূপ নিয়ে এসেছে। তিনি অবাক হয়ে শুনছেন।
কান পেতে রয়েছেন। মৃত্যু যখন সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন সব ইন্দ্রিয়ই কি অত্যধিক শক্তিশালী হয়ে যায়? দেয়ালে হেঁটে চলেছে একটা পিঁপড়ে, এত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আইসিইউয়ের কক্ষে পিঁপড়ে কিংবা মাছি আসার কথা নয়, কিন্তু কীভাবে যেন চলে এসেছে। তিনি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেন পিঁপড়েটির হাঁটার শব্দ। সহসা তাঁর কাছে মনে হচ্ছে, এই পৃথিবী অত্যন্ত শব্দময়। কে জানে, হয়তো এটা একটা বিভ্রম।
মৃত্যুকালে বাস্তব আর বিভ্রমের মধ্যে পার্থক্য করা কঠিন হয়ে যায়।
কেউ কি জানে, দুটি চোখ ছাড়াও মানুষের আরও একটা চোখ থাকে? সেই চোখ দিয়ে মানুষ চোখ না খুলেও দেখতে পায়? হ্যাঁ, তিনি দেখতে পাচ্ছেন। দু'চোখ মুদে রেখেও তিনি দেখতে পাচ্ছেন স্ত্রী-পুত্রের উদ্বিগ্ন মুখ, দেখতে পাচ্ছেন ডাক্তার আর নার্সদের ব্যস্তসমস্ত ছোটাছুটি। কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে, এরা তাঁর কেউ নয়। সবাইকে অচেনা লাগছে।
একজন অচেনা লোক এসে তাঁর সামনে দাঁড়ালো। ধীর, মসৃণ অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলল, সময় হয়েছে। আগে কখনো একে দেখেন নি তিনি।
কিন্তু তাঁর কাছে মনে হল, এই লোকটি যেন তাঁর অনেক দিনের চেনা। তিনি যেন বিভোর হয়ে এই লোকটির জন্যই অপেক্ষা করছিলেন।
লোকটির দেহ দ্যুতিময়, একটা কোমল আলো ছড়াচ্ছে।
অচেনা লোকটি তাঁর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। সেই সাথে বলল, এখানে আপনার "মেয়াদ" শেষ হয়েছে। এখন আপনাকে আরেকটি নির্ধারিত স্থানে যেতে হবে। সেখানে আপনার হিসেব হবে।
পাই পাই করে হিসেব। হিসেবে কোন ভুল হবে না, কোন অবিচার হবে না।
তিনি এক মুহূর্তের জন্য একটু উদ্বিগ্ন বোধ করলেন। হিসেব? কত ভুল করেছেন, কত পাপ করেছেন। তিনি নিজেই কি কম অবিচার করেছেন? সুযোগ পেয়ে, ক্ষমতা প্রকাশ করতে গিয়ে কত অনাচার তাঁর এই দুই হাত দিয়ে হয়েছে, তিনি নিজেই তো হিসাব রাখেন নি।
আর হিসাব রেখে কী হবে? এখন তো তিনি চূড়ান্ত হিসাব দেখতে পাবেন। বড় কঠিন সে হিসাব। এক সময় তাঁর সামনেই অনেকে মাথা নিচু করে দাঁড়াত, আজ তাঁর পালা। আজ তাঁকে নিচু হয়ে দাঁড়াতে হবে। শেষ সময়ে কি মানুষের শুধু কৃত ভুলগুলোর কথাই বেশি করে মনে পড়ে? কেন সুখস্মৃতিগুলো মনে পড়ে না? তিনি দুচোখ কুঁচকে ভাবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু কই, তাঁর কোন সুখের স্মৃতি, কোন আনন্দময় ঘটনা তো মনে পড়লো না।
তিনি বাধা দিলেন না, হাত বাড়িয়ে দিলেন অচেনা লোকটির দিকে। অন্য ভুবনে যাত্রা শুরু করলেন তিনি। রহস্যময়, অজানা এক পথে যাত্রা। অচেনা পথপ্রদর্শক। অজানা গন্তব্য।
তারপরেও তাঁর কেন যেন কোন ভয় লাগছে না। যেন এটা ঘটবেই, ঠেকানোর কোন উপায় নেই। আগে থেকে ঠিক করে রাখা অবশ্যম্ভাবী গন্তব্য, যাকে বলে নিয়তি। এটাকে কেউ এড়াতে পারে না। তাঁর মতো ক্ষমতাবান মানুষও না।
তিনি যতদিন পৃথিবীতে বিচরণ করেছেন, একবারের জন্যও মনে হয় নি যে একদিন থামতে হবে। সব কিছুর শেষ হবে। তিনি একা এসেছিলেন, একাই চলে যাচ্ছেন, কেউ তাঁর সাথে যাচ্ছে না। তাঁর মনে পড়লো, তাঁর সমর্থকেরা স্লোগানে বলেছিল, জীবনে মরণে আমরা নেতার সাথে আছি। হায় কপাল!
তিনি এসেছিলেন কোন পুঁজি ছাড়া, যাচ্ছেনও পুঁজি ছাড়া, কপর্দকশূন্য অবস্থায়।
তাঁর অ্যাকাউন্ট নাম্বার এখনো আছে, কিন্তু একটি পয়সাও সাথে নিতে পারছেন না। তিনি নিজের খালি দুই হাতের দিকে তাকিয়ে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আমি একজন প্রভাবশালী লোক ছিলাম, অথচ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছি দুই শুন্য হাতে, ঠিক যেমন একজন সাধারণ মানুষ যায়। সবার গন্তব্য কি একই? মানুষে মানুষে কি কোনই পার্থক্য নেই? আমার একটা স্ট্যাটাস আছে, সমাজে একটা আলাদা স্থান আছে, সেটা কি এরা জানে না?
তিনি যাত্রাপথের পাশে দেখলেন না কোন সমর্থক, দেখলেন না কোন তোরণ, পেলেন না কোন ফুলের মালা। কেউ এলো না তাঁকে ফিরিয়ে নিতে।
খালি পায়ে তিনি হেঁটে চললেন অজানার পথ বেয়ে।
স্ক্রিনের সবুজ রেখাগুলো সমান্তরাল হয়ে গেল। এখন আর হৃৎপিণ্ড নামক পাম্পিং মেশিনটি রক্ত পাম্প করছে না। রক্তচাপ শুন্য, পালস শুন্য, বিট শুন্য। সব শুন্য।
প্রথমে শুন্য ছিল, শেষে এসেও সবই শুন্য হয়ে গেল।
ডাক্তার এসে লাইফ সাপোর্ট খুলে নিলেন। আর চেষ্টা করে লাভ নেই। সব শেষ।
তাঁর স্ত্রী মুখে আঁচল চাপা দিয়ে নীরবে কাঁদলেন।
তাঁর পুত্র কাঁদল না, শুধু স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। মৃত্যু কোন কোলাহল পছন্দ করে না, সে নীরবতাপ্রিয়।
(১৯-২০ ডিসেম্বর, ২০১২)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।