লিমনের প্রধান অপরাধ, সে বেঁচে আছে। যদি সে একেবারে মরে যেত, তাহলে হয়তো আমরা সবাই বেঁচে যেতাম। আমাদের যারা সরকারি বাহিনী, তাদের জীবিত লিমনের অভিযোগ মোকাবিলা করতে হতো না। আমাদের যাঁরা গণমাধ্যমকর্মী, তাঁদের একটানা লিমনের জীবনের ওপর দিয়ে চলা নিরাপত্তা-ঝড়ের কাহিনি বলে যাওয়ার কষ্ট করতে হতো না। আমাদের যাঁরা মানবাধিকারকর্মী, তাঁদের যাত্রার বিবেকের মতো লিমন-নাটকের দৃশ্যে দৃশ্যে হাজির হয়ে অক্ষমতার কাঁদুনি গাইতে হতো না।
পা হারানো লিমন, নাগরিক সমাজের প্রতিবাদ, মানবতাবাদী বন্ধন, আইনের রক্ষণভাগ সবাইকে আজ এক কাতারে দাঁড়িয়ে অসম লড়াই চালাতে হতো না রাষ্ট্রের সঙ্গে। মৃত লিমন প্রতিবাদ করত না, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দাবি করত না সে নিরপরাধ। যেমন দাবি করার সামর্থ্য নেই সম্প্রতি থানা হেফাজতে মৃত্যুবরণকারী নারায়ণগঞ্জের শামীম আর মিরপুরের হূদয়ের। মরে গিয়ে তারা সবাইকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেছে। ফিরে এসে তারা বলবে না, ‘আমি এমনি মরিনি, আমাকে হত্যা করা হয়েছে।
’
এ রকম অনেক লিমন ক্রসফায়ারে মরে গেছে; তেমন হইচই হয়নি। আত্মীয়স্বজনেরা যতই দাবি করুক, নিহত মানুষটি সন্ত্রাসী ছিল না, সে দাবি ধোপে টেকেনি। কারণ, ধোপারা ছিল অনেক শক্তিশালী। বিপরীতে তাদের স্বজনেরা ছিল দুর্বল এবং মৃত মানুষ আত্মপক্ষ সমর্থনে সম্পূর্ণ অক্ষম। এ ধোপের বিষয়টি খোলাসা হওয়া দরকার।
যে ধোপা কাপড় যত জোরের সঙ্গে কাচে, তার কাছে কাপড় নষ্ট হয় বেশি। বেশি পুরোনো বা পাতলা কাপড় তার হাতে ছিঁড়ে যাওয়ারই কথা। যেখানে ধোপা হয় রাষ্ট্র স্বয়ং, সেখানে দুর্বল মানবসন্তানদের পক্ষে তাদের কঠিন হাতের কাচাকাচির পরও অক্ষত থাকা কীভাবে সম্ভব? এ অবস্থায় রাষ্ট্রের কাছে অপ্রিয় ‘সত্য’কে সত্য বলে প্রতিষ্ঠা করা খুবই কঠিন। এবং যেখানে নিহত ব্যক্তিটি সাক্ষ্য দিতে আসতে পারবে না, সেখানে আর চ্যালেঞ্জ করে কে?
তাই লিমন মারা না গিয়ে নিজেই চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। বেঁচে গিয়ে সে সবাইকে ফ্যাসাদে ফেলেছে।
অক্ষত লিমনের চেয়ে পা’হারা লিমন অনেক বেশি শক্তিশালী। তাই তার মোকাবিলায় রাষ্ট্রকে তার সব যন্ত্রপাতির সদ্ব্যবহার করতে হচ্ছে। রাষ্ট্র যে ভুল করে না, সেটা প্রমাণে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, প্রধানমন্ত্রীর অন্তত দুজন উপদেষ্টা, পুলিশ, র্যাব সবাই জোরের সঙ্গে দাবি করেছে, লিমন সন্ত্রাসীই ছিল (২৮ মে, প্রথম আলো)। সেখানেই তারা থামেনি, লিমনের ওপর গুলি জায়েজ করতে তারা প্রচার করেছে, কেবল লিমন নয়, তার বাবা-মা, ভাইবোন সবাই সন্ত্রাসী। লিমন যদি দরিদ্র রাখাল না হতো, তার পরিবার যদি ভদ্রসমাজের বাইরের না হতো, তাহলে হয়তো একটি পরিবারকে এত সহজে সন্ত্রাসী বলায় বাধা ঠেকত।
লিমনের বেলায় সেটা ঠেকেনি ওই শ্রেণীবিদ্বেষের কারণে। আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠানে যত ওপরে যাবেন, ততই সামাজিক পিরামিডের নিচের দিকে থাকা মানুষের প্রতি শ্রেণীবিদ্বেষের ঝাঁঝালো সংস্কৃতি দেখতে পাবেন। এ সংস্কৃতিতে গরিবমাত্রকেই অসম্মানিত ভাবা হয়। যাবতীয় সন্ত্রাস-রাহাজানি গরিব আর বস্তির যুবকেরাই করে; এমন ধারণা ওই পিরামিডের শীর্ষবাসীদের হাড়ের ভেতর মজ্জার মতো বাসা বেঁধে আছে।
এক লিমন-কাহিনি এভাবে রাষ্ট্রের খুনে স্বভাব ও গরিববিদ্বেষ সবকিছুকেই উন্মোচিত করে দিয়েছে।
তাই এ ‘সবকিছুকে’ অস্বীকার করে র্যাবকে প্রমাণ করতেই হবে, লিমন সন্ত্রাসী ছিল। দুটি মামলা করে র্যাবের এ প্রমাণের চেষ্টার মধ্যেই বিচারবহির্ভূত হত্যাচর্চার ফাঁকিটা ধরা পড়ে। ধরা যাক, র্যাবের মামলায় প্রমাণিত হলো, লিমন আসলেই সন্ত্রাসী ছিল। তাতেও কি কাউকে আইনের আওতার বাইরে সন্ত্রাসী কায়দায় গুলি করা যায়? কারও গুলি পায়ে লাগে, কারও গুলি লাগে বুকে; কিন্তু যেখানেই লাগুক, কথিত অপরাধীকে দেখামাত্র বা ধরে এনে নির্যাতন করে গুলি করে মেরে ফেলাটা কি বৈধ হয় তাতে? আমরা এর নাম দিয়েছি বিনা বিচারে হত্যা বা আরও কঠিন ভাষায় ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা’। কিন্তু বিচারেরও আগে থাকে আইন।
সে আইন প্রয়োগ করেন আদালত। পুলিশ বা র্যাবের যেটা করার কথা, সেটা হচ্ছে নিবৃত্তিমূলক বলপ্রয়োগ। অর্থাৎ, অপরাধ ঘটার আগে ঠেকানো বা অভিযুক্ত অপরাধীকে আটকানোর জন্য বলপ্রয়োগ। লিমনের বেলায় এর কোনোটাই হয়নি। তার বিরুদ্ধে কারও কোনো অভিযোগ ছিল না, গুলি খেয়ে পা হারানোর আগে তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা অস্তিত্বমান ছিল না।
লিমন ‘অপরাধী’ হলো আহত হওয়ার পর। মরে গেলে এ অভিযোগই রাষ্ট্রীয় দলিলের সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেত।
লিমনের ঘটনাটা হয়ে গেছে উনিশ শতকের ফ্রান্সের ড্রেইফাস মামলার মতো। ফরাসি সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন আলফ্রেড ড্রেইফাসের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়। এ অভিযোগে ১৮৯৪ সালে তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।
তাঁকে শয়তানের দ্বীপ বলে পরিচিত এক ফরাসি আন্দামানে চালান করা হয়। কিন্তু দুই বছর যেতে না যেতেই প্রকাশ হয়ে যায় যে, ওই অপরাধটা আসলে ড্রেইফাস করেননি, করেছেন অন্য এক সেনা অফিসার। তাহলেও ফরাসি সেনাবাহিনী এবং আদালত মিলে আসল অপরাধীকে খালাস করে ড্রেইফাসের ওপর বাড়তি অভিযোগ চাপায়। এ অবস্থায় প্রখ্যাত ফরাসি সাহিত্যিক এমিল জোলা এক ফরাসি সংবাদপত্রে ড্রেইফাসের পক্ষে খোলা চিঠি প্রকাশ করলে শোরগোল পড়ে যায়। এমিল জোলা সরকারের কাছে মামলাটি পুনঃ তদন্তের দাবি করেন।
প্রগতিশীল মহলেও তোড়জোড় শুরু হয়। ফরাসি জাতি বিভক্ত হয়ে যায় ড্রেইফাসের পক্ষে-বিপক্ষে। ঘটনাক্রমে ১৯০৬ সালে প্রমাণিত হয়, ড্রেইফাস সম্পূর্ণ নিরপরাধ। এ ঘটনার অভিঘাত হয় অনেক গভীর। রক্ষণশীলদের মিথ্যা ও অপরাধপনা এতই উন্মোচিত হয়ে গিয়েছিল যে, ড্রেইফাসের সূত্র ধরে ফ্রান্সে র্যাডিকেলরা ক্ষমতাসীন হয়।
সেই থেকে ড্রেইফাস মূল্যায়িত হন বৈষম্য ও হিংসার বিশ্বজনীন প্রতীক হিসেবে। লিমন এখন তেমন করে বিনা বিচারে হত্যা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে জীবনে প্রতীকে পরিণত হয়েছে।
আধুনিক রাষ্ট্র ও আইনব্যবস্থার গোড়ায় রয়েছে তিনটি অধিকার: জীবন, সম্পত্তি ও স্বাধীনতা। জীবনের অধিকার যেখানে হুমকিগ্রস্ত, সেখানে সম্পত্তি ও ব্যক্তিস্বাধীনতা বলে কিছু থাকে না। বিনা বিচারে হত্যা এবং সন্ত্রাসী হত্যা চলতে থাকলে প্রত্যেকের জীবনই হুমকিতে থাকবে।
আসলে সমাজের কয়েকজন বিনা বিচারে নিহত হলেই বাকিরা ভয় পেয়ে যায়। ভয়ের সংস্কৃতি তখন জেঁকে বসে। জীবন হারানোর ভয় যেখানে প্রধান ভয়, সেই দেশে জীবনও জিইয়ে না, আইনও টেকে না। জীবন ও ন্যায়ের স্বার্থেই তাই নাগরিকদের বিনা বিচারে হত্যা বা অবৈধ বলপ্রয়োগ বন্ধ হতে হবে। সংশপ্তক লিমনকে তাই জিততেই হবে।
লিমনের সঙ্গে যা ঘটে চলেছে, তা যে কারও সঙ্গেই ঘটতে পারে। যে কথিত সন্ত্রাসী মোরশেদ জমাদ্দারকে ধরার অভিযানে লিমনকে গুলি করা হয়, অদ্যাবধি তাঁকে ধরতে পারেনি র্যাব বা পুলিশ। যে ১৬ বছরের কিশোর গুলি খেয়ে আহত হয়ে পড়ে থেকেছে মাঠে, সে কীভাবে সরকারি বাহিনীর কাজে বাধা দিতে পারে? ফাঁকিটা সাধারণ মানুষ সহজেই বুঝতে পারে, কিন্তু বুঝতে পারেন না ক্ষমতাশালী ব্যক্তি ও পদাধিকারীরা। লিমনের বিরুদ্ধে যতই তাঁরা মিথ্যা রটিয়েছেন, ততই লিমন অর্জন করেছে জনসমর্থন। রাষ্ট্র তার সঙ্গে যত অন্যায় করেছে, ততই সে ন্যায়ের প্রতীক হয়েছে।
এভাবেই লিমন পরিণত হয়েছে আমাদের পঙ্গু মানবাধিকারের প্রতীকে। এক পা হারিয়ে লিমন অর্জন করেছে অদৃশ্য এক ন্যায়ের পা। আমাদের গরিববিদ্বেষী সংস্কৃতি, আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর বেআইনি কার্যকলাপ, আমাদের দরবারি মানবাধিকারের পরিহাসের বিরুদ্ধে লিমনের সেই অদৃশ্য পা ধিক্কার দিচ্ছে। সেই পা যাঁরা দেখতে পান না, তাঁদের মানবিকতাবোধ মৃত মাছের মতো অনুভূতিহীন ও দুর্গন্ধময়।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
farukwasif@yahoo.com।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।