আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রাজনীতি কি মানবিকতা হারাচ্ছে?

আল্লাহ মহান, যাহা বলিব সত্য বলিব। বাঙালির কিছু কিছু উৎসব থাকে মাস জুড়ে। ফেব্র“য়ারি এলে আমরা বই মেলায় যাই। ভীড় ঠেলে ধুলোবালির মধ্যে নতুন বইয়ের গন্ধ নেয়া এক অদ্ভুত বাঙালি বিলাস। ডিসেম্বর মাস জুড়ে বিজয়ের আনন্দ আমাদের আচ্ছন্ন রাখে।

নানা উৎসব আয়োজন আমাদের গ্লানিগুলোকে ধুয়ে-মুছে দেয়। এই মাসগুলো আমাদের ঐক্য গড়ে দেয়। সব ভুলে আমরা মনে করি, আমরা বাঙালি, এ আমাদের অহংকার। এই মাসগুলোতে আমরা আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগুলো মেলে ধরি। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বাম দল সবাই ফেব্র“য়ারি এবং ডিসেম্বর মাসে নানা রাজনৈতিক কর্মসূচির চেয়ে সাংস্কৃতিক কর্মসূচিকেই প্রাধান্য দেয়।

গভীর রাতে দল বেঁধে নারী-পুরুষ শহীদ মিনার কিংবা টিএসসি থেকে ঘরে ফেরে। আমাদের জীবনের জীর্ণতা, দীনতা আমরা ভুলে যাই। কিন্তু এবার ডিসেম্বর মাস এলো সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে। ২৯ নভেম্বর খালেদা জিয়া ঘোষণা দিলেন, ডিসেম্বর মাস জুড়ে তিনি কর্মসূচি দেবেন। বিজয় দিবস ছাড়াও ডিসেম্বর মাসের শুরুটা থাকে বাচ্চাদের পরীক্ষা।

পরীক্ষা শেষ করে বাচ্চারা কোথাও বেড়াতে যাবে, গ্রামের বাড়িতে গিয়ে পিঠাপুলির স্বাদ নেবে। একটু অবস্থাসম্পন্নরা কক্সবাজার, কুয়াকাটা, বিত্তশালীরা সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক বেরিয়ে আসবে। এমন পরিকল্পনার আনন্দেই শিশুরা বার্ষিক পরীক্ষা দিতে যায়। মনে পড়ে, আমি যখন এরকম ছোট ছিলাম তখন পরীক্ষা কেমন হবে, এর চেয়ে পরীক্ষার পর কী কী করব, সেই উত্তেজনাই ছিল বেশি। তখন একটা পরীক্ষা না হওয়ার চেয়ে কষ্টের আর কিছুই ছিল না।

জামায়াতের হরতালের কারণে একটি পরীক্ষা হলো না, বিএনপির অবরোধে দ্বিতীয় পরীক্ষা অনিশ্চিত হয়ে গেল, আবার আজকের হরতালে তৃতীয় পরীক্ষা পেছাবে। ছোট ছেলেমেয়েদের উপর যে কী প্রচণ্ড মানসিক চাপ তা কি আমাদের নেতা-নেত্রীরা একটু ভেবে দেখবেন। এই বাচ্চারা বাতিল হওয়া তিনটি পরীক্ষা (আবার হরতাল হলে আরো পরীক্ষা হয়তো পেছাবে) দিতে দিতে নতুন বছর এসে যাবে। হয়তো বেড়ানো বাতিল হবে, হয়তো তাদের আনন্দ পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। মন খারাপ করে ছেলেটি বা মেয়েটি কংক্রিটের শহরের জানালায় দাঁড়িয়ে থাকবে।

বেশি আবেগী শিশুরা হয়তো কাঁদবে। এই মন খারাপ কিংবা এই কান্নার কি কোনো মূল্য আছে আমাদের রাজনীতিবিদদের? অভিভাবকরা মনখারাপ করা বাচ্চাকে রাজনীতিবিদের দুষ্কর্মের ফিরিস্তি শোনাবে। বাবা-মা নেতা-নেত্রীদের গালাগাল করবে, কোমলমতি শিশুটি তা শুনবে। তার মনে গেঁথে যাবে ‘রাজনীতি’ বিষয়টা অত্যন্ত গর্হিত, খারাপ। রাজনীতি সম্পর্কে একটা বাজে ধারণা নিয়ে শিশুটি বড় হবে।

এই অনুভূতির কি কোনো মূল্য আছে আমাদের রাজনীতিবিদদের? ডিসেম্বর মাস শুধু বিজয়, কিংবা পরীক্ষার মাস নয়, এ মাস অভিবাসীদের মাস। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছেন আমাদের অভিবাসী ভাইবোনরা। এবছর এ পর্যন্ত ১৪ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছেন তারা। যাদের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি তরতাজা। যাদের পাঠানো টাকায় আমাদের নেতারা সফেদ পাঞ্জাবি গায়ে চড়িয়ে গলাবাজি করেন।

ডিসেম্বরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লম্বা ছুটি হয়। এই সুযোগে মাটির টানে এক বড় অংশ অভিবাসীরা দেশে আসেন। কেউ পনেরো দিনের জন্য, কেউ একমাসের জন্য। তাকে ঘিরে তার পরিবারে এক উৎসব হয়। যে প্রবাসী আজ (১১ ডিসেম্বর) সকালে ঢাকায় নামবেন, বিমানবন্দরে নেমেই তিনি পড়বেন হরতালের মধ্যে।

তিনি তো জানেন না, ‘হরতাল কত ভয়াবহ, কত বীভৎস। নেমেই হয়তো তিনি তার প্রিয় মায়ের মুখ অথবা তার শিশু সন্তানের মুখটি দেখার জন্য ব্যাকুল হবেন। হরতালের ভ্র“কুটি উপেক্ষা করে তিনি যেকোনো একটা বাহন নিয়ে, তার গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হবেন। তার বাড়ি হতে পারে কুমিল্লা, ফেনী, কিংবা ঠাকুরগাঁও। বিমানবন্দর পেরিয়ে কিছুদূর যেতেই হরতালকারীরা তার গাড়ি আক্রমণ করল।

পুড়িয়ে দিল গাড়ি। লুটে নিল তার ব্যাগপত্র। যে ব্যাগে ছিল বহুদিন ধরে কষ্ট করে জমানো অর্থে প্রিয়জনের জন্য কেনা আপাত তুচ্ছ কিন্তু আবেগে অত্যন্ত মূল্যবান কিছু সম্পদ। হরতাল এই অভিবাসী মানুষটিকে যন্ত্রণা, কান্না আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়া কী দিল? এরকম ঘটনা কি ৪ ডিসেম্বরের হরতালে, ৯ ডিসেম্বরের অবরোধে ঘটেনি? বিএনপি কি গ্যারান্টি দিতে পারে, আজকের হরতালে এমন কিছু ঘটবে না? আমাদের রাজনীতি কি মানবিক বোধশূন্য হয়ে পড়ছে? বিরোধী দলের দাবি কী? নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার। হরতাল অবরোধ করলেই কি এই দাবি সরকার মেনে নেবে? এই সরকারের আয়ুষ্কাল এক বছরেও কম সময়।

আন্দোলন জমিয়ে একটা সরকার পতন অসম্ভব। ১৯৮২ সাল থেকে আন্দোলন করে একটি অবৈধ সরকার হটাতে লেগেছে ৮ বছর। ১৯৯০-এর পর নির্বাচনের ধারায় একটি নির্বাচিত সরকারকে এভাবে ফেলে দেয়া যে অলীক কল্পনা তা বিএনপির নেতারাও ভালো বোঝেন। আন্দোলনের চেয়ে গত একবছর তারা যেসব জনসংযোগমূলক কর্মসূচি করে আসছিলেন, সেটিকেই বরং মানুষ ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছিল। বিএনপি থেকেও বলা হয়েছিল, তারা হরতাল-অবরোধ এবং ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি দিতে চায় না।

এর মধ্যে হঠাৎ করে বেগম জিয়া ২৯ নভেম্বর এভাবে গর্জে উঠলেন কেন? গত কয়েকদিনের আন্দোলন দেখে মনে হচ্ছে, বিএনপির চেয়ে এই ধ্বংসাত্মক আন্দোলনে জামায়াতের উৎসাহ বেশি। অনেকেই বলেন, জামায়াতের চাপেই বিএনপিকে এমন কঠোর কর্মসূচি দিতে হচ্ছে। কারণ মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের রায়ের আগে একটা অরাজকতা ও আতঙ্ক সৃষ্টির নীলনকশা জামায়াত বহু আগে থেকেই করে রেখেছিল। যুদ্ধাপরাধী সাঈদী তো বলেই দিয়েছিলেন যে, তাকে গ্রেপ্তার করা এত সহজ নয় সারা দেশে আগুন জ্বলবে। জামায়াতের নীলনকশার ফাঁদে বিএনপি কি তাহলে পা দিয়েছে? বিএনপি একটি ব্যাপক দল।

সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে তাদের চলাফেরা। তাদের তো এই সময়ে হরতালের নেতিবাচক বিষয়গুলো দেখা উচিত ছিল। কিন্ত তা না দেখে তারা মানবতাবিরোধীদের বাঁচাতে মানবতাবিরোধী তৎপরতার পথে পা বাড়ালো। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্যই এটি একটি বড় আঘাত। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.