স্বপ্ন দেখি দেশকে এগিয়ে নেয়ার, আমার বিশ্বাস আমি পারব। একটি স্বপ্নের এমন করুণ মৃত্যু?(ঘটনাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীকে কেন্দ্র করে
অন্তু একটি স্বপ্নের নাম। আর তার স্বপ্ন ছিল নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনাবিদ হয়ে এই শহরের /নগরের সামগ্রিক নাগরিক সমস্যাগুলোর সমাধান করা। হয়তো মনে মনে সে অসংখ্য স্বপ্নের জাল বুনে ছিল, তৈরি করেছিল অসংখ্য নকশা যাতে করে কিছুটা হলেও আমার, আপনার ,আমাদের নাগরিক সমস্যাগুলো দূর করা যায়। আর এই নকশাগুলো বাস্তবায়ন করার জন্য প্রয়োজনছিলো তার নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনাবিদ হওয়া ।
সেই স্বপ্নকে পুঁজি করে হাজার হাজার শিক্ষার্থীদের সাথে প্রতিযোগিতা করে ২০০৮-৯ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয়েছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগে। অনেক আশা ও উৎসাহ নিয়ে ভর্তি হলেও প্রথম সেমিস্টারের পর থেকেই শুরু হয় তার হতাশার গল্প। যেই গল্পটার সমাপ্তি নির্মম ও হৃদয়বিদারক ।
বিভাগের শিক্ষার্থীদের মতে, অন্তুর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক দুইটা পরীক্ষাতেই জিপিএ ৫ ছিল। সে ২০১০ সালে প্রথম বর্ষ ২য় সেমিস্টার পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে একটি কোর্সে বহিষ্কৃত হয়।
সেই সময় তাকে জানানো হয় তাকে পরবর্তিতে শুধুমাত্র ঐ কোর্সে পরীক্ষা দিতে হবে । কিন্তু , ২য় বর্ষ ১ম সেমিস্টার পরীক্ষার আগে জানানো হয় যে তাকে পুনরায় পূর্বের সেমিস্টারের সকল পরীক্ষা দিতে হবে। কারন , তার একটি পরীক্ষা বাতিলের পরিবর্তে সবগুলো পরীক্ষা ই বাতিল করা হয়েছে। এইজন্য তার শিক্ষাজীবন একবছর পিছিয়ে পড়ে । পরবর্তিতে সে তার জুনিয়রদের সাথে শিক্ষাজীবন পরিচালনা করতে থাকে।
কিন্তু পরবর্তী বছর সে দুটি বিষয়ে উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হয় এবং বাকি কোর্সগুলোতে তার মোট জিপিএ ছিল ২ এর নিচে । বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুসারে তাকে আবারো একবছর পিছিয়ে পরতে হয়। অর্থাৎ তাকে তার দুই বছরের জুনিয়র শিক্ষার্থীদের সাথে ক্লাস শুরু করতে হবে। অন্যদিকে , তার বাকি দুইটা বিষয় আবার দুইবছর জুনিয়রদের সাথে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করতে হত, কিন্তু তার শ্রেণী পরীক্ষাগুলোর নম্বর এতো কম ছিল যে, ঐ কোর্সগুলোতে পাশ করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ছিল। যদি সে এইবারও পরীক্ষায় খারাপ করতো তবে তিনবার ফেল করার কারণে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মনুসারে , বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হতো ।
তাই সে যখন বুঝলো যে তার স্বপ্ন আর পূরণ হওয়ার নয় এবং আবার ফেল করার লজ্জা সে সইতে পারবে না, তখন সে সবচেয়ে নির্মম ও করুণ পথটাই বেছে নিল , সেটা হচ্ছে নিজেকে হত্যা। আত্মহত্যা করার জন্যও সে তার সবচেয়ে প্রিয় একটা জায়গা বেছে নিলো । সে নগর ও পরিকল্পনাবিদ হওয়ার পর যে জায়গাটাতে আসতো ,ঠিক সেই জায়গাটা । ঢাকার বাংলামোটরে অবস্থিত বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অফ প্ল্যানারস(BIP)। বিভাগের শিক্ষার্থীদের মতে সে এই বিল্ডিঙয়ের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে(তারিখ ২৫-১১-২০১২)।
সে ইচ্ছা করেই BIPতে আত্মহত্যা সংঘটিত করে কিছু প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে যায়, আমার কাছে, আপনার কাছে, এই শিক্ষাব্যাবস্থার কাছে, এর সাথে জড়িত সকলের কাছে। সেই প্রশ্নগুলো আমার কাছেও এসেছে , আমাকে ব্যাপক নাড়া দিয়ে গেছে। আমি জানি , এই প্রশ্নগুলো আপনাকেও স্পর্শ করবে।
প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে , সে কি আত্মহত্যা করেছিলো নাকি সেখানে তাকে কেউ হত্যা করেছে? বিভাগের সকল শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মতে , ফয়সাল করিম অন্তুর মত শান্তশিষ্ট, ভদ্র ছেলে কখনও কোনো শত্রুতাবশত কারও দ্বারা খুন হতে পারেনা। এমনকি তার হলের শিক্ষার্থীরাও তার সম্পর্কে একই কথা বলবে।
তার মানে সে আত্মহত্যা করেছে, তা না হলে সে ঐ BIP যেত না।
দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, এতো স্বপ্ন নিয়ে ভর্তি হয়েও সে কেন বহিষ্কৃত হলো আর বারবার ফেল করলো?
পরীক্ষায় নকল করার তিনটা কারণ থাকতে পারে, প্রথম হচ্ছে, কোনো শিক্ষার্থী যখন সারা বছর শিক্ষাবহির্ভূত কর্মকান্ডে জড়িত থাকে যেমন, অপরাজনৈতিক কর্মকান্ড, এছাড়াও আরও অনেক কিছু থাকতে পারে। কিন্তু বিভাগের শিক্ষার্থীদের মতে সে এইরকম কোন কিছুতে জরিত ছিল না।
দ্বিতিয় কারণ হচ্ছে, যেকোনো অবস্থায় বা যেকোনো উপায়ে পরীক্ষায় ভালো করা, যেটা আমি অনেক বিভাগেই খেয়াল করেছি। কিন্তু , অন্তুর প্রথম সেমিস্টারে অন্তুর সেইরকম কোনো অবস্থানই ছিল না।
এমনকি শিক্ষার্থীদের মতে এই রকম কোনো ইচ্ছাও তার ছিলনা। তার মানে দাঁড়ায় এই কারনেও সে নকল করেনি।
তৃতীয় কারণ হচ্ছে, চেষ্টাকরেও এই মুখস্থ নির্ভর পড়ালেখার সাথে মানাতে না পেড়ে , এই ব্যাবস্থায় শিক্ষাকে গ্রহন করতে না পেড়ে শেষ উপায় হিসেবে নকল করা। আমার মতে, অন্তু এই কারনেই নকল করে। কারণ তাকে প্ল্যানার হতেই হবে।
তৃতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, সে পরেও পরীক্ষা য় ভালো করতে পারতো, সেটা কেন পারলো না?
সে অবশ্যই ভালো করতে পারতো যদি , তাকে সেই রকম সাহায্য বিভাগ থেকে করা হতো। সেই রকম কিছুই তাকে করা হয়নি, হয়েছে বরং উল্টোটা। তার নকল করার কারণ জানতে না চেয়ে তাকে মারত্মকভাবে সকলের সামনে অপমান করা হয়েছে। তার সমস্যাগুলো অনুধাবন করার চেষ্টা না করে তাকে অপমান করা হয়েছে, এমনকি যখন সে সবকিছু ভূলে পরের সেমিস্টারের পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত ঠিক তখন তাকে জানানো হলো যে , সে এই সেমিস্টারে ফেল। কেন, এই সিদ্ধান্তটা কি পরীক্ষার ঠিক পরপর নেয়া যেত না? তাকে কি একটা সুযোগও দেয়া যেত না?
এখন হয়তো আপনারা প্রশ্ন করবেন , পরের বছর কেন পারলো না?
হয়তো , এতো সব অমানবিক আচরণ সে মেনে নিতে পারেনি, সে হয়তো পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়েছিলো ।
আরেকটা কারণও হতে পারে , হয়তো জুনিয়রদের সাথে সে কনোভাবেই মানিয়ে নিতে পারছিলো না, হয়তো শিক্ষক বা জুনিয়রদের কাছথেকে এমন কোনো আচরন সে পেয়েছে, যা তার আত্মসম্মানে চরমভাবে আঘাত করেছে। এইখানে একটা বিষয় পানির মত স্পষ্ট যে, সে শিক্ষকদের কাছ থেকে সহযোগীতা দূরের কথা ন্যূনতম সাহানুভুতিও পায় নি।
তারপরেও হয়তো আপনাদের প্রশ্ন, আত্মহত্যা কি করতেই হত, আর কোনো উপায় কি ছিল না?
আমি বলব ছিল না, কারণ মানুষ তখনি আত্মহত্যা করে যখন দেখে যে তার স্বপ্ন আর কখনও বাস্তবায়িত হবে না, এমনকি তার পরেও কিছু খড়কুটা ধরে বেচে থাকার চেষ্টা করে। সকলের তীব্র অসহযোগীতা , হীনশিক্ষাব্যাবস্থা ও তার পারিপার্শ্বিকতা তার সেই সম্বলটুকুও কেড়ে নিয়েছিলো কারণ বহিষ্কার তার জন্য অপেক্ষা করছিল। এই জন্যই তাকে আত্মহত্যা করতে হয়েছে, সে চেয়েছিল এভাবে যেন আর কোনো অন্তুর স্বপ্নভঙ্গ না হয়।
আর এই প্রশ্নটার উত্তর পেতে একবার নিজেকে অন্তুর অবস্থানে দাড় করান তাহালেই বুঝতে পারবেন আসলেই আর কোনো উপায় ছিল কিনা।
এখন আপনাদের কাছে আমার প্রশ্ন, এটা কি আত্মহত্যা নাকি সার্বিক শিক্ষাব্যাবস্থা তার সামনে এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছিল যাতে সে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয় অর্থাৎ তাকে হত্যা করা হয়েছে? উত্তর দিন ?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।