লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ। আমজনতা
মোহাম্মদ ইসহাক খান
রফিক সাহেব রোজকারের মতো অতি মনোযোগের সাথে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। তাঁর শ্যালক ফজলু এসে পাশের সোফায় বসা মাত্রই তাঁর উৎসাহ চলকে উঠলো।
আরে, শালাবাবু যে, এসো এসো। তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। দেখো, আজকের কাগজে কত ইন্টারেস্টিং খবর আছে।
তিনি মহা উৎসাহে পড়তে শুরু করলেন। ফজলু বাধা দেবার সুযোগ পেলো না, অগত্যা বিরক্ত মুখে চায়ের কাপে চুমুক দিলো।
এই শুরু করেছে দুলাভাই!
রফিক সাহেবের অন্যতম প্রধান কাজ হচ্ছে রোজ সকালে খবরের কাগজ পড়া আর দুনিয়ার তাবৎ খবর সম্পর্কে তাঁর শালাবাবুকে আলাদা করে ওয়াকিবহাল করে তোলা। আজকাল আরেকজনকে খবরের কাগজ পড়ে শোনানোর ব্যাপারটা আর নেই, কিন্তু রফিক সাহেব আজও তাঁর বাসায় এই ঐতিহ্যটি বজায় রেখেছেন। ফজলু মোটেই পছন্দ করে না খবরের "ধারাবর্ণনা" শুনতে, কিন্তু দুলাভাই এমন বিপুল উদ্দীপনার সাথে পড়তে শুরু করেন যে তাঁকে থামানোর কোন পথ সে খুঁজে পায় না।
রফিক সাহেব যে বিশেষ ক্যাটাগরির কোন খবরে উৎসাহ রাখেন তা নয়, তিনি দেশে প্রতিদিন যেসব ঘটছে, সেগুলোই উচ্চস্বরে শ্যালককে পড়ে শোনান। রাজনীতি (ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া), অর্থনীতি (বিশ্ববাজারে মন্দাভাব), শেয়ার বাজারে ধস, ব্যাটিং বিপর্যয়, পারিবারিক কলহের খবর, কিছুই তিনি বাদ দেন না।
এই দ্যাখো, কী লিখেছে। প্রথম পক্ষের স্ত্রীকে পিটিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন স্বামী ... ...
আর এটা দ্যাখো, সম্পত্তি নিয়ে কলহের জের ধরে ভাইয়ের হাতে ভাই খুন ... ...
আর এটা তো খবরের বাড়া, যৌতুকের দাবীতে পাষণ্ড স্বামী পুড়িয়ে মারল স্ত্রীকে। এই কাজে তাকে সহায়তা করে নিহত গৃহবধূ কুলসুমের শাশুড়ি এবং ননদ। হাত বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় ... ...
এবার একটা ডিজিটাল খবর দেখো, হে হে, ফেসবুকে পরিচয় থেকে প্রণয়, শেষে ভুয়া পরিচয়ধারী প্রতারক তরুণের কাছে নিজেকে সঁপে দিলো তরুণী এবং মানসম্ভ্রম সব হারিয়ে সে এখন বিচারের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছে। সেই তরুণ হাওয়া হয়ে গেছে, পুলিশ তাকে খুঁজে পাচ্ছে না ... ...
কু-প্রস্তাবে সাড়া না দেয়াতে কিশোরীর মুখ এসিডে ঝলসে দিলো বখাটে তরুণ ... ...
ফজলু দুয়েকবার ভগ্নীপতিকে থামাতে চেষ্টা করলো, শ্যালকের সামনে সব খবর পড়ার যোগ্য নয়; কিন্তু রফিক সাহেব এসবের ধার ধারেন না, তিনি একেবারে শেষ পাতার খবরটি পড়লেন, "পূর্বশত্রুতার জের ধরে রাতের অন্ধকারে কৃষকের বাগানের সব গাছ কেটে নিয়ে গেলো দুর্বৃত্তরা, গরীব চাষী আবুল মিয়ার মাথায় হাত ... ...", অবশেষে থামলেন তিনি।
হ্যাঁ, এবার বলো, কী যেন বলতে চাইছিলে? সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে শ্যালককে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
কী বলবো? আপনি তো আমার কথাই শুনছেন না।
আরে, তুমি বুঝতে পারছ দেশের কী অবস্থা? প্রতিদিন পেপার খুললেই কত মজার মজার খবর উপস্থিত। দেশ রসাতলে যাচ্ছে, তাই না, হা হা হা।
ফজলু অবাক হয়।
আপনি বেছে বেছে সব খারাপ খবর পড়লেন, আমাকেও শোনালেন। আবার মনে হচ্ছে দেশ রসাতলে যাওয়াতে আপনি খুব খুশি? এইসব দুঃসংবাদ পড়ে আপনার তো মন খারাপ করার কথা।
এবার রফিক সাহেব একটু অবাক হবার ভঙ্গি করেন, ভ্রূ নাচান। মন খারাপ করবো কেন? আরে তোমাদের মতো নিউ জেনারেশন এসব খবরে মন খারাপ করে। আমরা আমজনতা, "ম্যাঙ্গো পাবলিক"।
অনেক ঘাটের পানি খেয়েছি না? এসব খবর অনেক আগে থেকে পড়ে আসছি শালাবাবু। মন খারাপ করলে আমাদের চলবে? তোমার মতো বয়সে কোন দুঃসংবাদ শুনলে কিংবা পড়লে আমার খুব খারাপ লাগতো, কিন্তু এখন আর লাগে না। আমাদের আর কী-ই বা করার আছে, বল? যদি পুরো পেপার পড়, তাহলে তো তোমাকে সারাদিন মন খারাপ করে থাকতে হবে। তার চেয়ে এগুলোকে ইন্টারেস্টিং খবর হিসেবেই নিই না, ক্ষতি কী? অভ্যেস করে নাও শালাবাবু, একসময় দেখা যাবে ঠিকই তুমিও অভ্যস্ত হয়ে গেছ।
ফজলু আবার বিরক্ত মুখে চায়ের কাপে চুমুক দেয়।
সে খেয়াল করে না, তার ভগ্নীপতির মুখে অনেক দিন আগের দুঃখবোধের ছাপটা খানিকক্ষণের জন্য হলেও ফিরে এসেছে।
হঠাৎ যেন মহা গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনে পড়ে গেছে এই ভঙ্গি করে রফিক সাহেব আবার পেপারটা টেনে নেন, আরে, একটা মজার খবরই তো বাদ দিয়ে গেছি। এই দ্যাখো, কাকের মাংস কাকে খায় না, কিন্তু মানুষে খায়, একটি রাজনৈতিক দলের দুটো গ্রুপের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ইট পাটকেল ছোঁড়াছুঁড়ি, আরে, ছবিও দিয়েছে দেখছি। সাংবাদিকগুলোর রসবোধ আছে, এক ছোকরার হাতের পিস্তলটা আবার গোল করে লাল দাগ দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, হা হা হা ... ...
ফজলু মনে মনে ভাবে, খবরের কাগজে একটা কলাম বরাদ্দ দিলে কেমন হয়, যে কলামের নাম হবে, "ভাল খবর। " সেই কলামে থাকবে শুধুই আনন্দময়, মন হালকা করে দেয়া খবরগুলো।
দুলাভাই তো সব খবরই ইন্টারেস্টিং হিসেবে নেন, আনন্দ পান, তখন ফজলু নিজেও আনন্দ পাবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।