আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একজন "মেরিটলেস" ছেলের গল্প

আমার অনেক স্বপ্ন...আমি বাস করি স্বপ্নের মাঝে...রঙ্গিন রঙ্গিন সব স্বপ্ন... সকাল ১০ টা বেজে ৩০ মিনিটঃ তানজিম এখনও বেঘোরে ঘুনুচ্ছে। তার কর্মজীবী বাবা-মা ইতিমধ্যে বাসা থেকে বের হয়ে গিয়েছে। যাওয়ার আগে তার মা বলে গিয়েছে, ''কিচেনে টেবিলের উপর পরোটা আর ডিম ভাজি রাখা আছে। নবাবের ঘুম ভাঙলে খেয়ে নিয়ো। রাতেও কিছু খাও নি! বাসায় তো আর ৫-৬ জন দাসী নেই যে মুখে তুলে খাইয়ে দিবে!” তানজিম মায়ের এ ধরনের আচরনের সঙ্গে ঠিক পরিচিত নয়।

একরাশ খারাপ লাগা মনের মধ্যে পুষে রেখে মা বাসা থেকে বের হতেই উঠে পরল। আসলে সে অনেক আগেই ঘুম থেকে উঠেছে। সত্যি কথা হচ্ছে যে, সে রাতে আসলে ঘুমাই নাই! সারা রাতই তার নির্ঘুম কেটেছে! বিছানা থেকে উঠতেই প্রচন্ড চায়ের পিপাসা লাগল তার। চা খাওয়াটা তার এক ধরনের নেশা! মামার টং দোকানে বসে তার বন্ধুরা সমানে বেন্সন এন্ড হেসেজ আর মার্লবরু টানলেও সে সিগারেট খায় না। কিন্তু তার চা খাওয়ার নেশাটা সিগারেটখোর বন্ধুদেরও মাঝে মধ্যে লজ্জ্বায় ফেলে দেয়! ওরা একটা সিগারেট শেষ না করতেই যে তার ২ কাপ চা খাওয়া শেষ! অন্যান্য সময়ের মত এবারও তার মা নাস্তার সাথে অবশ্যই চা বানিয়ে রেখে যাবে- এ প্রত্যাশা নিয়ে সে কিচেনে গেলো।

কিন্তু গভীর হতাশায় লক্ষ্য করল যে ফ্লাস্কে কোনো চা নেই! কি আর করা! নিজেই গরম পানি বসিয়ে চা বানিয়ে ফেলল। নিজের প্রিয় মগে চা নিয়ে রোমের বারান্দায় এসে বস ল। সকালের চমৎকার রোদে তার মন এক অদ্ভুত ভাল লাগায় ভরে গেল। কিন্তু, চায়ের মগে এক চুমুক দিতেই তার ভাল লাগা মুহূর্তের মধ্যেই মিলিয়ে গেল! বুঝতে পারল যে চা বানানো তার কর্ম নহে! মগের সম্পূর্ণ চা বেসিনে ফেলে দিয়ে বালিশের নিচ থেকে সেল টা নিয়ে বারান্দার চেয়ারে এসে বসল সে। রাস্তায় স্কুল পালানো কিছু ছেলের জমাট একটা আড্ডা দেখল সে।

সেল থেকে নিরবের নাম্বারটা ডায়াল করল সে। কিন্তু আজব ব্যাপার! ওর নাম্বার তো সেভ করা তাহলে contact name show করল না কেন! পরক্ষনেই নিজের ভুল বুঝতে পেরে কল যাবার আগেই লাইনটা কেটে দিল তানজিম। কাল রাতে নিরবের নাম্বার তো নিজের হাতেই সেল থেকে ডিলিট করে দিয়েছে সে! নিরব ছিল তান জিমের সবচেয়ে ভাল বন্ধু। হ্যাঁ! ছিল কিন্তু আজ আর নেই! কাল রাতেই ওর সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেছে সে কিন্তু এর জন্য তার মনে একটুও আফসোস নেই! নিরব আর তানজিমের পরিচয় খুব বেশি দিনের নয়। মফস্বলের স্কুল থেকে এস.এস.সি পাশ করার পর ভাল রেজাল্টের কারণে ২জনই ঢাকার একটি স্বনামধন্য কলেজে ভর্তি হয়।

কিছুদিনের মধ্যেই তাদের মধ্যে দারুণ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে। মা-বাবাকে ছেড়ে এতো দূরে পড়তে আসা ২টি ছেলের জন্য তা ছিল বিরাট পাওনা! কলেজ়ে ভালো ছাত্র হিসেবে শিক্ষক মহলে তানজিমের সুনাম ছিল আর ভাল ছেলে হিসেবে শিক্ষার্থী মহলেও সে অনেক জনপ্রিয় ছিল! আর নিরব ছিল তার ঠিক উল্টোটা! সকল টার্ম পরীক্ষাতেই একটা না একটাতে ফেল করতই সে! নিজের চেষ্টাই হোক বা পাশের বেঞ্চের ছেলের সহায়তাই হোক সেও তানজিমের মত এইচ.এস.সি. তে গোল্ডেন এ+ পেতে সমর্থ্য হয়। ২জনেরই ইচ্ছে ছিল মেডিকেলে পড়বে তাই ভর্তি হয়ে গেল মেডিকেল কোচিংএ। এ পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল কিন্তু সকল ঝামেলার সূত্রপাত হল মেডিকেল এডমিশান টেষ্টের রেজাল্ট দেওয়ার পর থেকে। নিরব চ্যান্স পেলেও তানজিম পেল না! গত পরশু দুপুরে রেজাল্ট পাওয়ার পর থেকেই একের পর এক ফোনে বিরক্ত তানজিম সেলটা অফ করতে বাধ্য হয়।

বিকেলের দিকে নিরবকে ফোন দেয় কিন্তু ১০-১২ বার ফোন দেয়ার পরও সে ফোন রিসিভ করে নি! তানজিম মেসেজ দিয়ে বলল যে,'' dost, amar toh hoy nai! Mathay kisu duktesena. Tor hoiche? Free hoye phn dis” রাত ১১টা পর্যন্ত নিরবের নাম্বার থেকে কোনো রিপ্লে আসেনি তানজিমের কাছে। সে ভাবল হয়তো নিরবেরও চ্যান্স হয়নি তাই মন খারাপ বিধায় ফোন দিতেসেনা। রাত ১১টা ১৫ মিনিটে নিরবের নাম্বার থেকে ফোন পেয়ে হতাশার মাঝে হাবুডুবু খাওয়া তানজিম যেনো একটু আনন্দিত হল। কারণ, নিরবের সঙ্গে কথা বললে হয়তো তার মনটা অনেক হালকা হবে। কিন্তু, তান জিম ফোন রিসিভ করতেই নিরব এক নাগাড়ে বলে গেল, “কিরে তুই নাকি চ্যান্স পাছ নাই? এই প্রশ্নে চ্যান্স শুধু গাধারাই পায় না।

তোর ফোন রিসিভ করতে পারি নাই cz তখন নিশিতাকে নিয়ে একটু বি.এফ.সি তে গেসিলাম। আমি চ্যান্স পাইসি তাই ওর খুশি দেখে কে! দোস্ত রাখি , খালামনি ফোন দিছে। বুঝসই তো চ্যান্স পাইছি, সবাই একের উপর এক ফোন দিতেছে! পরে কথা হবে। বাই। ” কিছুটা হতাশ তানজিম খুব বেশি মন খারাপ করল না।

সে মোবাইল দিয়ে ফেসবুকে ডুকে অন্য বন্ধুদের খবর জানতে লাগল। ফ্রেন্ড লিস্টে থাকা আত্বীয় স্বজন অনেকেই ফেবুতে মেসেজ দিয়ে তার রেজাল্ট জানতে চাইল। তার মনটা আরো খারাপ হয়ে গেলো। অনলাইনে নিরবকে দেখতে পেয়ে নক করল কিন্তু কোনো রিপ্লে পেলো না সে! সব কষ্ট বুকে চেপে রেখে তার অন্যতম পছন্দের একজন কবি আবুল হাসানের একটি কবিতা স্ট্যাটাস হিসেবে দিলঃ "ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেপ সমস্ত কাগজ ! আমি বাজে ছেলে, আমি লাষ্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না ! ………………………………. আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ ! সচ্চরিত্র ফুল আমি যত বাগানের মোড়ে লিখতে যাই, দেখি কলম খুলে পড়ে যায় বিষ পিঁপড়ে, বিষের পুতুল ! আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি!" সাথে সাথে নিরবের কমেন্ট, "ar koto atlami korbi? Du-D te admit hoia ja naile pore aam - chala 2 Tai jaibo " সঙ্গে সঙ্গেই নিরবকে ব্লক দিয়ে নিজের ফেবু একাউন্টটা ডি-এক্টিভেট করে দিল সে। বারান্দায় বসে গতকালের ঘটনা গুলো ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ তানজিমের মনে পরে গেলো নিরব আর নিশিতার মধ্যে সম্পর্ক গড়ে দেবার সেই সময়কার কথা।

কলেজের প্রথম দিকে বাজে ছাত্র হিসেবে নিরবকে ক্লাসের কোনো স্যারই তেমন দেখতে পারত না। একবার যখন নিরব ফিজিক্সে ৭৫ এর মধ্যে ১৪ পেলো তখন স্যার সবার সাম্নে তাকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছেতাই অপমান করেছিল। স্যার যখন নিরব কে বলেছিল, "ব্যাঙের পায়ে ধরে মাফ চাইতে পারলেই শুধু তোমাকে প্রমোশন দেওয়া হবে!" তখন কেবল তানজিম ছাড়া সবাই হেসে লুটিপুটি খাচ্ছিল। নিশিতাও কি হাসিনি সেদিন? সেও হেসেছিল বরঞ্চ অন্যান্য মেয়েদের চেয়ে সে একটু বেশিই হেসেছিল! পরবর্তীতে তানজিমের সাহচর্যে এবং নিজের প্রচেষ্টায় নিরব ঘুরে দাঁড়িয়েছিল ঠিকই। এর কয়েকদিন পরই নিশিতাকে ভাল লাগার বিষয়টি তানজিম কে জানাতেই তানজিম নিশিতার কাছে নিরবের ভাল লাগার বিষয়টি জানিয়েছিল।

নিশিতা প্রথমে না করলেও পরবর্তীতে ঠিকই নিরবের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছিল। তাদের সেই সম্পর্কের মধ্যস্ততা কারী হিসেবে কত ঝামেলাই না পোহাতে হয়েছিল তানজিমকে। স্যারদের চোখ রাঙ্গানী উপেক্ষা করেই সেদিন ও সাহায্য করেছিল নিরবকে। কিন্তু আজ নিরব কি প্রতিদান দিল তাকে! কথাটা ভাবতেই ২ চোখ দিয়ে পানি পরতে শুরু করল তার! কিন্তু তার যে কান্না করলে চলবে না । সমাজের চোখে আজ সে ২য় শ্রেণির নাগরিক! মা বাবার কাছে আজ সে বোঝা!প্রতিবেশীর কাছে মেরিটলেস ছেলে! নিরবের মতে সে আতেল-গাধা! এত সব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ সে সিদ্ধান্ত নিল কি দরকার এ জীবনের? বেঁচে থাকার যেখানে কোনো মানেই হয় না সেখানে কেনো পরাজিত সেনাপতির মত ডুকরে ডুকরে কেনো মরার মত বেঁচে থাকা? একবার সে ভেবেছিল যে ২য় বার পরীক্ষা দিয়ে চ্যান্স পেয়ে মানুষ রূপী নিরবের মত পশুদের বুঝিয়ে দেবে যে সেও পারে! কিন্তু একি শুনল সে! স্বাস্থ্য মন্ত্রী সাফ জানিয়ে দিয়েছে যে সামনের বার পরীক্ষা নিবে না! তাহলে কি তানজিমের মত ''মেরিটলেসরা" সবার অগোচরে একের পর এক হারিয়ে যাবে? তানজিম বারান্দায় বসে বসে দূর দিগন্তের পানে চেয়ে রইল।

এত কম বয়সেই সবার এত লাঞ্চনা-অপমান সইতে সইতে সে ক্লান্ত। খুনের দায়ে যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্ত আসামির মতই যেন তার জীবন! সে জানে না তার ভবিষ্যত কি, শুধু জানে সে ২য় শ্রেনির নাগরিক! সকালের নাস্তাটা গতকালের মত আজও কিচেনেই পরে রইল! বেলা বেড়ে যাচ্ছে কিন্তু তানজিমের কোনো ব্যাস্ততা নেই! ২য় শ্রেণির নাগরিক দের ব্যাস্ততা না থাকাটাই কি স্বাভাবিক নয়? ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.