"প্রিয়জন চলে গেলে মানুষই ব্যথিত হয়, আকাশ নির্বিকার, আকাশ কখনও নয়। তোমরা মানুষ, তাই সহজেই দুঃখ পাও, হে ঈশ্বর, আমাকে আকাশ করে দাও। " ১.
রাত ১১ টা বেজে গেছে অনেক আগেই। এখন মনে হয় ঘড়ির কাটা ১২ টা ছুই ছুই করছে। হাতের ঘড়িটা বের হবার সময় ভুলে রেখে এসেছে অভি।
ভুল হওয়ারই কথা। চোখের সামনে বাবা-মায়ের এমন আচরণ দেখে নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি সে। রাগে বাবা-মায়ের সামনেই কাঁচের একখানা গ্লাস ভেঙ্গে ঘর থকে বেড়িয়ে এসেছে সে। বের হওয়ার সময় তার আদুরে ছোট্ট বোনটির ভয়ে সংকুচিত হওয়া কাঁদো কাঁদো মুখ দেখে এসেছে। খুব খারাপ লাগছে তার।
অভি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বি.বি.এ ৩য় বর্ষে পড়ে। যদিও তার বাবা তাকে এইখানে না পড়ে ভাল কোন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে বলেছিল। কিন্তু সে তা করেনি। অবশ্য তার একটা ভিন্ন কারণও আছে।
অভির বাবা আজিজুর রহমান সাহেব সরকারী উচ্চপদস্থ ১ম শ্রেণীর কর্মকতা।
অঢেল টাকা পয়সা থাকার কথা না থাকলেও তার বাবার কিন্তু অঢেল টাকা। তার মা ফারজানা রহমান শিক্ষিতা একজন মহিলা। তিনি সমাজসেবক। নারী অধিকার বাস্তবায়ন কমিটির সুযোগ্য নেত্রী। বাবা-মায়ের ব্যস্ততার কারণে ছোটবেলা থেকেই বাবা-মায়ের সঙ্গ সে কখনই পায়নি।
মাঝে মাঝে মনে হয় রাস্তার পাশে বস্তিতে জন্ম নেওয়া শিশুটিও তার চেয়ে অনেক বেশী সুখী। আর কিছু সে না পেলেও বাবা-মায়ের আদর আর ভালবাসায় বড় হতে পারছে।
২.
রাস্তার কোণায় চার চাকার উপর বসানো দোকান দেখে অভির সিগারেট খেতে ইচ্ছা হল। একা একা হেঁটে চলার একমাত্র সঙ্গী তো পাওয়া গেল। ভাগ্যিস মানিব্যাগটা সঙ্গে এনেছে।
দোকান থেকে একটা বেনসন নিয়ে টানতে টানতে হেঁটে চলছে সে। রাতের শহর বড়ই অদ্ভুত। অতি দরিদ্র মানুষগুলোর জীবন-যাপন দেখলে নিজেকে অনেক সুখী মনে হয় আবার মুহূর্তেই মনে হয় চার দেওয়ালের মাঝের লুকানো সুখ মানুষ যদি দেখত আর দেখে না বলেই সবাই সেই সুখের লোভ করে। হাঁটতে হাঁটতে বড় রাস্তায় নিয়ন লাইটের আলোয় নিজের রঙ যেন হঠাৎবদলে গেল। মনে হল অন্য এক জগতে প্রবেশ করেছে সে।
কিছুদূর যেতেই আবছা আলোয় শাড়ি পরা এক যুবতী মেয়েকে দেখতে পেল সে। প্রথমে মনে হল এত রাতে একটা মেয়ে একা রাস্তায় দাড়িয়ে আছে কেন?পরক্ষণেই ভুল ভাঙ্গল তার,বুঝতে পারল এরা যে অন্ধকার রাতের রাত জাগা মেয়ে। আর একটু কাছে যেতেই মেয়েটা অভির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইল। অনেকটা আগ্রহের সাথেই অভি মেয়েটার কাছে গেল । তাতে মনে হয় মেয়েটা খুশিই হল।
কাছে যেতেই সে বুঝল মেয়েটা দেখতে ততটা খারাপ না। রাতের এই হলদেটে আলো তাকে অন্যরকম একটা সৌন্দর্য দান করেছে যেন। মেয়েটা কিছু বলার আগেই অভি বলল-”তোমার নাম কি?” মেয়েটা বলল-”স্যার,নাম দিয়া কি করবেন? কামের কথা কন। সময় নাই। ” অভি বুঝল সে কি বোঝাতে চাইছে।
সে জিজ্ঞাসা করল ”কত দিতে হবে তোমাকে? মেয়েটি বলল “স্যার ১০০ টাকা দিলেই হইবো। ”শুনে অভি অবাক হল। মাত্র ১০০ টা টাকার জন্য মানুষ কি না করতে পারে? অভি বলল-”আমি তোমাকে ৫০০ টাকা দিব তবে তুমি যা ভাবছ তার জন্য নয়। এমনিই দিব। আমার সাথে বসে কথা বলার জন্য।
”সে এই মুহূর্তে খুব একা,তার কথা বলার একজন সঙ্গী দরকার এখন। মেয়েটির তামাটে মুখে খুশির উজ্জ্বল দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ল যেন। ল্যাম্পপোষ্টের নীচেই বসে পড়ল দুজন। অভি মেয়েটির অদ্যপ্রান্ত জানতে চাইলো। মেয়েটি তার দঃখের কথা বলতে লাগল।
দুঃখের কথা শুনতে কার না খারাপ লাগে? অভিরও লাগছিল। তার বাবা তার মাকে ছেড়ে অন্য এক মহিলাকে বিয়ে করে চলে গেছে। তারা ৫ ভাই বোনকে রেখে গেছে তার মায়ের কাছে। সে গার্মেন্টসে কাজ করে ৩ হাজার টাকা পায়। তাতে কিছুই হয় না।
তাই শেষ পর্যন্ত এ কাজেই নামতে হল। ”তোমার এইসব করতে খারাপ লাগে না?” অভি জানতে চাইল। “আমাদের আবার খারাপ স্যার? সমাজে দুই জাতের মানুষগোর মইধ্যে কোন খারাপ লাগন কাজ করে না। এক হইল বড়লোকগো কারণ তাগো অনেক টাকা আর এক হইল আমাগো মত গরীব মানুষগো কারণ আমাগো ভালা খারাপের কোন মূল্য সমাজে নাই। ” কথা বলতে বলতে অভি দেখল দূর খেকে একটা গাড়ি ছুটে আসছে।
কিছুক্ষণ পর গাড়িটি তাদের সামনে এসেই দাড়ালো। দুইটা লোক গাড়ি থেকে নেমেই অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে লাগল। একজন বলে উঠল-”রাতে রাস্তায় বেলাল্লাপনা কর? চল গাড়িতে ওঠ। থানায় চল, বের করতাছি তোদের বেলাল্লাপনা। ”
3.
সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তার টেবিলে বসতেই আজিজ সাহেবের মোবাইলে ফোন এল অপরিচিত এক নম্বার থেকে।
হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে শুধু বলেই গেল আর আজিজ সাহেব শুধু শুনেই গেলেন কিছুই বললেন না। ফোন রাখার পর মনে হল তিনি অগ্নিমূর্তি ধারণ করেছেন। ফোনটা পকেটে রেখে তিনি নাস্তা না করে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেলেন।
৪.
অভি তার বাবা মায়ের সামনে মাথা নিচু করে বসে আছে। তার বাবা মা দুজনেই তার উপর ক্ষিপ্ত।
অবশেষে তার বাবা বলতে লাগল-”খুব বড় হয়ে গেছিস না? তোর কিসের অভাব? ছোটবেলা থেকে পাসনি এমন কিছু আছে? সমাজে তোর মা আর আমার একটা স্ট্যাটাস আছে। তুই আমাদের মান সম্মান সব ধূলোয় মিশিয়ে দিলি? তোর বাবা যে আমি এইটা বলতেই তো আমার লজ্জা লাগতাসে এখন”
অনেতক্ষন অভি চুপ করে ছিল। তারপর বলতে লাগল-”কিসের সম্মানের কথা বলছ বাবা? যেই সম্মান শুধু মাত্র তোমার টাকার জন্য। সমাজে ভাল,দামী এলাকায় বসবাসের কারণে। তুমি আজ বলছ আমার কারণে তোমার মান সম্মান গেছে? তুমি কি কখনো চিন্তা করেছ তুমি যখন দূর্নীতির দায়ে সাসপেন্ড হয়েছ,পত্রিকায় তোমাকে নিয়ে লিখা হয়েছে তখন আমাকে মানুষ কত ঘৃণার চোখে দেখেছে।
আমার নিজেকে অপরাধী না হয়েও অপরাধী মনে হয়েছে। বন্ধুদের আড্ডায় তোমায় যখন ঘুষখোর বলে তখন আমার সম্মানের কথা কি তোমার একবারও মনে ছিল না?আমার পরিচয় দিতে তোমার আজ লজ্জা লাগছে আর আমি যে এত বছর তোমার কলংঙ্কিত পরিচয় বহন করে চলছি। তবু তুমি যে অমার বাবা। আর মা? তিনি নারী অধিকার বাস্তবায়ন করেন অথচ ঘরের কাজের মেয়েটিকে নির্যাতন করতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেন না। এই নিয়ে মাতামাতিতে তো আমার সম্মান কমে না,বরং আমার পরিচিতি বারে।
বাবা মায়ের ভালবাসা কি জিনিস তা কখনো পাইনি। তোমরা শুধু টাকাই চিনেছ। এমনই যদি হবে তবে আমায় পৃথিবীতে এনেছিলে কেন?”
আজিজ সাহেব আর তার স্ত্রী মাথা নিচু করে বসে রইলেন।
*( বিশৃঙ্খল ভাবনার শৃঙ্খল বহিঃপ্রকাশের চেষ্টা মাত্র। যেভাবে চিন্তা করেছিলাম ঠিক সেভাবে প্রতিফলন ঘটাতে পারিনি।
সংক্ষিপ্ত করার জন্য অনেক চিন্তা বাদ দিতে হল। )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।