আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একটি সিগন্যাল ও আমার আমি

যা বিশ্বাস করি না, তা লিখতে-বলতে চাই না, পারবোও না। কিন্তু যা বিশ্বাস করি, তা মুখ চেপে ধরলেও বলবো, কলম কেড়ে নিলেও লিখবো, মারলেও বলবো, কাটলেও বলবো, রক্তাক্ত করলেও বলবো। আমার রক্ত বরং ঝরিয়েই দাও, ওদের প্রতিটি বিন্দুর চিৎকার আরও প্রবল শূনতে পাবে। ছেলেটির কোনো স্বপ্ন ছিলনা। কী জানি, ছিল হয়ত!তবে ওর চোখ দুটোতে কখনো স্বপ্নের আলোকচ্ছটা দেখিনি আমি।

যে'কটা মুহূর্ত দেখছি, শীর্ণ আর কৃষ্ণবর্ণ ছেলেটিকে, শুধু ক্ষুধা আর অভাবে নিমজ্জিত কিছু কষ্ট দেখেছি। যার বহি:প্রকাশ কখনো বিষন্ন ছিলনা, ছিল স্মিত এক হাসি। আমি বেশিদিন নই ঢাকায়, পড়াশোনা করেছি দেশের বাহিরেই। এখন চাকরি করছি, ঢাকায়। নিজের দেশে ফিরে আসবার জন্যে চলে আসা।

.... তা আমি যেই হই। বাসে, ট্রেনে, গাড়িতে অথবা রিক্সায়, দুপাশে চোখ ভরে তাকিয়ে থাকাটাই আমার স্বভাব। আমি দেখতে থাকি, মানুষ, তাদের কাজ, গাছপালা... সব, সবকিছু। প্রতিদিন নিজে গাড়ি করে অফিস যাই আমি। সকাল ৮.৩০, আমি নিয়মিত একটি সিগন্যাল এ আটকে পড়ি।

এখন অভ্যাস হয়ে গেছে মাঝে-মাঝে ওখানে মিনিট পনের থেমে থাকার, কখনো বা বেশি। তিনমাস আগের সোমবার সকালটাও আলাদা কিছু ছিলনা, খুব হালকা আওয়াজে প্রিয় একটি গান বাজছিল গাড়িতে, "মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না....। " গুনগুন আমিও গাচ্ছিলাম, বেসুরো। হঠাৎ ঠক-ঠক শব্দে চমকে উঠলাম, বেশ বিরক্তও হলাম। কাঁচ নামিয়ে একটি নিষ্পাপ মুখ দেখলাম, যেন কাঁদছে, একটি ছেলে।

কিছু টকটকে গোলাপ উপরে তুলে বলল," স্যার, ফুল নিবেন, ফুল? তাজা রইছে, নিবেন?" না লাগবেনা বলে জানালা নামাচ্ছিলাম, ছেলেটি জানালাটা ধরে বলেই চলছিল, "নেন না স্যার, দুটা টাকা পাইলে খাইতে পারতাম, নেন না....স্যার...স্যার..." খেঁকিয়ে উঠলাম,"না রে বাবা, জ্বালাস না তো!" হাল ছেড়ে দিয়ে, মাথা নিচু করে ছেলেটা দৌড় দিল। নি:শব্দে আমি জানালার কাঁচ উঠিয়ে দিলাম, সিগন্যাল সবুজ হয়েছে। পৌঁছে গেলাম, আমার নিয়ত জেলে, আমার কর্মস্থল। কর্মব্যস্ত প্রতিটি দিনে কোনকিছু ভাবার অবকাশ পাইনা কোনদিনই, আজও পেলাম না। দিনশেষে সেই ঘরে ফেরা।

সিঁড়ি বেয়ে উঠতে-উঠতে আনমনে কথা বলছিলাম নিজের সাথেই। নিজেকে বলছিলাম, আমি কতটা একা, কতটা অর্থহীন আমার জীবন। পরিবার থেকে সবসময় দূরে থেকেছি, এখনো তাই করছি....কেন? উত্তর জানা নেই আমার, আমি একা থাকি, সেচ্ছায়। তবে আমি একাকিত্ব বোধ করি, আর আমি এটা পছন্দ যে করি, তাও নয়। তবু আমি একা থাকি।

নিজেও জানিনা কেন। নিজের জটিল মনের কাছ থেকে কোনদিন উত্তর পাইনি। আজও পাবোনা জানি, অনর্থক প্রশ্নগুলো আমাকে পৌঁছে দিল ঘরের দরজার সামনে। কোনকিছু ঘটেনি যেন আজ, প্রতিটি দিনের মতই সবকিছু শূন্য। শুয়ে ছিলাম চোখ বন্ধ করে, আচমকা দুটি নিষ্পাপ চোখ দেখতে পেলাম, সেই ছেলেটির।

কেন অযথা খারাপ আচরণ করলাম? ওর তো দোষ নেই কোনো, এটাই ওর কাজ। আমরা সবাই তো ফেরি করে ফিরি। কেউ সামান্য ফুল, কেউ অন্যকিছু। আমি নিজেও যে কিছু অনুভুতির ফেরিওয়ালা........ ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, এলার্ম-ঘড়িটা হিংসেয় জ্বলছিল নিশ্চয়, এত গভীর ঘুমে হামলা দেয়ার নির্মমতা নয়তো কেন? উঠে প্রস্তুত হয়ে নিলাম দ্রুত, অফিস আছে। সেই সিগন্যাল, আবার আমি।

টোকা পরতেই হেসে ফেললাম, আমার জীবনে সবকিছুই এমন, গতবাধা, যা হবার, তাই হয়, অবিরাম। জানালা খুলে ছেলেটিকে দেখলাম, আমাকে দেখে চমকে উঠলো, চলে যাচ্ছিল ও। ডাক দিলাম ওকে, ঘুরে বলল, "ডাকসেন স্যর??" ---_হুমম, নাম কি তোমার? "নাম দিয়া কি করবেন স্যার? ফুল নিবেন??" একশ টাকা দিলাম ওর হাতে, বললাম "নামটা বলো এখন?" "আমারে ছক্কু কয়, ফুল কয়টা দিমু স্যর?" আমি বললাম, "আমার ফুল লাগবেনা। " "তয় কি টেকা ফিরত লইবেন?” আমি বললাম, "রাখো ঐটা, আচ্ছা তুমি এখন যাও। " এমন নির্মল আনন্দের হাসি আমি বোধয় বহুদিন দেখিনি, ওর চোখে-মুখে যেটা দেখেছি সেই মুহুর্তে।

একছুটে ভীড়ের মাঝে হারিয়ে গেল ছক্কু। ওর আনন্দ আমাকে স্পর্শ করছিল খুব। কেমন যেন একটা সুখের অনুভব নিয়ে দিনটি কাটালাম আমি, একটু আলাদা। আজ আমি আটকে পড়িনি সেখানে, একজন ছক্কুকে আমার মনে ছিলনা আদৌ। আমি আমার নিয়ত জীবনে ব্যস্ত হয়ে ছিলাম।

দুদিন পরে, জানালায় উত্তেজিত থপ-থপ, ছক্কু!! "কিরে, কেমন আছ তুমি?!" "আমি ভালো আছি স্যর, আপনে ভালো আছেন?" মাথা নেড়ে সায় দেই আমি, বলি, কি চাও? "কিছুনা স্যর, আপনের দেওয়া টেকা দিয়া মেলাদিন বাদে সেইদিন পেট ভইরা ভাত খাইছি, পত্তেকদিন চায়া খাই, হেইদিন কিন্না খাইসি। " বললাম, "থাক কই?" "ঐদিক। " কোনো দিকনির্দেশ পাইনা আমি, হেসে দশ টাকা দিলাম, যাবার সময় হলো। মাঝে মাঝেই দেখা হতো ওর সাথে, কখনো টাকা দিতাম কিছু, কখনো দিতাম না। একজন আরেকজনের কুশল বিনিময়ের একটা আজব সম্পর্ক ছিল আমাদের।

অফিস এ যাবার পথে, আমার পরিবার হয়ে দাঁড়ালো একসময়, ছোট্ট ওই হাসিমুখ ছেলেটি। একদিন আমাকে প্রশ্ন করে ও, "আপনের অনেক টেকা তাইনা স্যর?" আমি বলি, "ধুর না রে, আমি খুব সাধারণ মানুষ। " ও বলে, "তাইলে আমারে যে টেকা দেন, গাড়িত করি আসেন?" আমি কিছু বলিনা, হাসি শুধু। ও বলে, স্যার, "আপনে খুব ভালা মানুষ। " ওকে বিদায় করে আমি কাঁদি আপনমনে, নিজেকে বলি, যদি ছক্কুর কথা সত্য হত!! সবাই তো আমার থেকে দূরে চলে গেছে, বন্ধু, পরিবার।

হয়ত.....আমি ভালো হলে যেতনা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবি আমি,হয়ত.... ওরা নয়, আমি নিজেই নিজেকে খোলসে গুটিয়ে রেখেছিলাম.... হয়ত....এই হয়তগুলো আসলে অমিমাংসিত। কনক এর কলটা বেশ অনাকাংখিত ছিল। কলেজ জীবনের সবথেকে ভালো বন্ধু। অসৎ আমিও অস্বীকার করতে পারবনা, ওকে অনেক পছন্দ করতাম, ভালবাসতাম।

সেওত ভালবাসত আমাকে, প্রতিটা দিন আমরা নি:শব্দে বলে গেছি, একজন আরেকজনকে কতটা ভালবাসি। তবে ভালবাসি শব্দটার কমতি ছিল। যেদিন ওকে ফোনে বললাম, "আমি দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি কনক", ওর ফোঁপানোর শব্দটা অস্পষ্ট ছিলনা। বলতে চেয়েছিলাম আমি তখন। হঠাৎ ও বলে উঠলো, "আমার বিয়েতে থাকবিনা তাহলে তুই??" আমি হেসে বললাম, "তোর্ বিয়ে?! বলিসনি তো!! সুখী হ বন্ধু, অনেক সুভকামনা তোর্ জন্যে।

" কনক কি জানত, আমার চোখে তখন কিছু নিরব অশ্রু ছিল? শব্দের অনুপস্থিতি হয়ত জানতে দেয়নি ওকে, কোনদিনও। কথায়- কথায় একদিন ওকে বলেছিলাম, দেশ ছেড়ে চলে গেলে আর কখনো ফিরবনা। একা আর স্বাধীন একটা জীবন চাই আমার। ও বিষন্ন "হুমম" বলেছিল। তবে, এতটাও একা হতে চাইনি আমি কোনদিন।

তোমার ডিএ্যকটিভেটেড ফেসবুক একাউন্টটি কেউ একজন প্রতিনিয়ত খুঁজত, জানো? হঠাৎ করে এক সকালে ফোন করে বলল, "তুই ঢাকায় অথচ যোগাযোগ করিসনি কেন? আজ দেখা করবি?" এতদিন পর ওর কন্ঠটা অপার্থিব লাগছিল। পাঁচ বছর হবে হয়ত। জবাব খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ও বলল, "আজকেও তুই চুপ? বিয়ে করিসনি তুই, তাইনা? আমি শুনেছি সবই। " আমি হেসে বললাম, "তোর্ বাচ্চাকাচ্চা কয়টা?" "স্টুপিড, আমি বিয়ে করিনি!! গাধাটা আমাকে ছেড়ে যাচ্ছিলি, আমার রাগে গা জ্বলছিল, তাই ওই কথা বলেছি।

" আমতা আমতা করছিলাম আমি, হঠাৎ যেন শব্দ খুঁজে পেলাম, বললাম, "আমি তোকে ভালবাসি কনক!!" "গাধাটা, কতদিন লাগালি এই কথাটা বলতে!! হারিয়েই ফেলেছিলাম তোকে আমি! তবে আমার কিছু শর্ত আছে, তুই করে বলতে পারবানা, রোজ-রোজ ফুল দিবা, দু'মাসের মধ্যে বিয়ে করতে হবে, কেনাকাটা-ঘোরাঘুরি-ফুচকা আর ভালবাসা নিয়ে আমাকে কোনো অভিযোগ করার সুযোগ দেয়া চলবেনা। আর আজ বিকেলে দেখা করতে আসতে হবে। " আমি মনে মনে প্রমাদ গুনলাম, এসব হচ্ছেটা কি? যাহোক বিকেলে বেরিয়ে পরলাম, ওকে নিয়ে শহরের পাশে কথাও যাবার কথা হয়েছে। হঠাৎ মনে পড়ল ছক্কুর কথা, কোনদিন ফুল নেয়া হয়নি ওর কাছ থেকে, আজ সবগুলো কিনব। সিগন্যাল এ আমি আটকে ছিলাম, মিনিট বিশেক, না, ছক্কুর টোকা পরেনি সেদিন আমার গাড়ির কাঁচে।

আমি আগে বাড়লাম। কিছু গোলাপ কিনলাম কনক এর জন্যে। অসাধারণ একটা বিকেল ছিল ওটা। কনক, আমার সামনে দাঁড়িয়ে। শাড়িতে ওকে এত সুন্দর লাগছে কেন? আগের থেকে যেন আরো বেশি সুন্দর লাগছে ওকে, আমি হাঁ করে তাকিয়ে দেখছিলাম ওকে, কেন লালচে আলোটা ওর গালেই এসে পড়েছে? নিজের ভাগ্যকে বিশ্বাস হচ্ছিলনা আমার।

লজ্জা পেয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল ও, "এভাবে কেউ তাকায় নাকি, ধুত!" আমি নিজেতে ফিরে আসলাম। কথা হলো, অনেক অনেক কথা, ঠিক যেন পাঁচ বছর আগের সেই দিনগুলোতে আমরা, মাঝখানে অসীম অন্ধকার। কনককে সেদিন দেয়া ফুলগুলো আমার ভালোলাগেনি, ছক্কুর হাতেরগুলো অনেক বেশি সুন্দর হতো। ফুল কেনার আশায় আবার কোনো একদিন আমি অপেক্ষায় ছিলাম, সেই সিগন্যাল এ। সপ্তাহের পর সপ্তাহ ওকে না দেখে কষ্ট পেতাম।

ভাবতাম, আচমকা হয়ত আবার পড়বে টোকা। কিন্তু ছক্কু আর আসেনি। কোনদিন আর দেখিনি ওর নিষ্পাপ মুখ, ক'টা টাকা পেয়ে নির্মল মধু হাসি। কোনদিন আর সে জিজ্ঞাস করেনি, "স্যার, আপনে কেমন আছেন?" কনক আজ আমার বউ। আমরা অনেক ভালো আছি একসাথে।

তবে ওর একটাই অভিযোগ, আমি ওর জন্যে কোনদিন ফুল আনিনি আর। আমি উত্তরে বলি, "ভালো ফুল পাইনা যে....। " আমি ছক্কুর ফুলগুলো কিনতে চাই, ওকে অনেক খুঁজেছি, পাইনি কখনো। আপনাদের কেউ কি ওকে দেখছেন? ও দাঁড়াত ওই সিগন্যালটায়...উমমমম ....নাহ, থাক নাহয়, নাইবা বললাম। আপনারা ওকে চিনতে পারবেন না হয়ত।

এরকম ছক্কু যে সংখ্যায় অনেক। তবে আজও আমি ওর অপেক্ষা করে থাকি, ওই সিগন্যাল এ..................... ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.