কাল আমার গায়ে হলুদ, আমার শ্বেত সুন্দরী যে আমায় ছেড়ে চলে গেল তার জন্য খুব তো কোনকিছু আটকে থাকল না। এইতো মাত্র এক মাস হয়েছে এর মধ্যেই আমাদের বাড়ির সবকিছু প্রায় স্বাভাবিক।
ব্যতিক্রমের মধ্যে এতটুকুই দেখছি, বাবার মুখটা এখনও থমথমে। রোজ সকালে বাইরে যাওয়ার আগে বাবা একবার করে আমার ঘরে ঢোকে,বাড়তি একটু আদর করে যায়। বাবা কখনও দিদুকে না বলে বাইরে যেত না।
বুঝি না, সেই অভ্যাসেই বাবা রোজ এখানে আসে, নাকি আমি পর হয়ে যাচ্ছি ভেবে মমতার বাঁধনটা আর একটু শক্ত করে দিতে চায়!
কখনও ভাবতে পারতাম না দিদু ছাড়া আমরা কিভাবে চলব; সমস্ত সংসারের সবার মাথার উপরে দিদু ছিল ছায়া-বৃক্ষের মত। মন যতদূর স্মৃতি খুঁজে পায় খাওয়া, গোসল, খেলা, গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়া, প্রথম অক্ষর চেনা,ভীরু ভীরু দোলায়িত মনে স্কুলের আঙ্গিনায় পা রাখা যেখানেই দৃষ্টি যায় সেই শুভ্র বসনা মমতাময়ীর ছবি। একুশের বই মেলা, বৈশাখী মেলা এসব যায়গায় বাবা মায়ের আপত্তি থাকলেও দিদু আমায় ঠিক নিয়ে যেত।
স্কুল-কলেজে যখন পড়তাম আমার তেমন কোন বন্ধু ছিলনা,আর বন্ধুর অভাবটাও দিদুর কারণে আমি কখনও বোধ করিনি। আমার এমন কিছু ছিলনা যা আমি দিদুর সাথে শেয়ার করতে পারতাম না।
বন্ধু যদি তাকেই বলে যাদের দুই দেহ এক প্রাণ তাহলে আমার দিদু ছিল আমার একমাত্র এবং সত্যিকারের বন্ধু।
দিদুর আদরে, যত্নে ভালোবাসায় কখন কিভাবে যে জীবনের বড় বড় পরীক্ষা গুলো এমন সফল ভাবে পার করে এসেছি বুঝতেই পারিনি;দিদুর সান্নিধ্য এমনি স্বাস্থ্যকর ছিল।
দিদুর যে এক প্রচণ্ড স্বপ্ন ভাঙ্গা কষ্ট ছিল এবং দিদু তা খুব সুন্দর ভাবে, সযত্নে আড়াল করে রাখত বুঝতাম, খুব জানতে ইচ্ছে করত কিন্তু কিছুতেই দিদু বলত না। একদিন খুব করে ধরলাম, দিদু মিষ্টি হেসে বলল কষ্ট তো সবারি আছে দিদি ভাই, আমার কষ্ট সমুদ্রের মত, আমার সুখ পৃথিবী ব্যপী, আমার ঐশ্বর্য অপরিমেয়, আল্লা আমায় যা কিছুই দিয়েছে সবি মুক্তহস্তে দিয়েছে রে। কিন্তু দিদিভাই আমার কথা আমি তোকে বলব না, আমার ডায়েরিতে সব লেখা আছে,আমার মরার পরে তুই দেখে নিস, ওটা তোর জন্যই রইল।
দিদুর ডায়েরি টা আমার কাছেই আছে, কিন্তু ওটা পড়ার মত করে মন কে এখন ও তৈরি করতে পারি নাই।
দিদুর শরীরে আমি কখন ও রং এর ছোঁয়া দেখিনি, যা পরত সবি সাদা। দিদু নিরাভরণ থাকা পছন্দ করতনা। দিদুর হাতে, কানে, গলায় যে গয়নাটুকু ছিল তাও সাদা সোনার উপরে সাদা পাথর বসানো, বাবা ইংল্যান্ড থেকে ব্যারিস্টার হয়ে ফিরে আসার সময় এনে দিয়েছিল। সাদার যে এত মাধুর্য,এত সৌন্দর্য, আমার দিদুকে যে না দেখেছে, তার হয়তো সেটা জানাই হয় নাই।
আমিই দিদুর নাম দিয়েছিলাম শ্বেত সুন্দরী।
একবার খুব করে বললাম, দিদু তোমায় তো কখনও রঙ্গিন কিছু পরতে দেখি নি, একটা লাল শাড়ি পর না। দিদু সদ্য প্রেমে পড়া কিশোরীর হাসি হেসে বলল, হ্যাঁ রাকা লাল শাড়ি পরব তোর বিয়ের দিনে। তবে হ্যাঁ একটা শর্ত আছে, তোর বরকে বলিস একই রকম দুইটা শাড়ি কিনতে। শাড়ি দুটো যেন হয় অসাধারণ,একটা পরে তুই যাবি স্বামীর সাথে বাসরঘরে আর অন্যটা পরে আমি ঢুকব আমার স্মৃতির বাসরে।
মনে থাকবে তো?
দিদুর সে কথা আমি কখনও ভুলি নি। রাতুলের সাথে আমার যখন প্রথম সম্পর্ক হয় তখনি ওকে বলেছিলাম।
দিদুর কারণেই আমি কখনও খারাপ রেজাল্ট করার, খারাপ কিছু ভাবার, কোন অন্যায় করার কোন অবকাশ পাই নাই। দিদু কখনও শাসন করত না। কখনো কোন কিছুতে জোর করত না।
দিদু একদিন বলছিল, দেখ রাকা মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি কি জানিস? মানুষের নিজের জীবনটাই সে নিজে গড়তে পারে না; অন্য কেউ গড়ে দেয়, এমন কি তার নিজের নামটা পর্যন্ত তার নিজের দেয়া না। তোকে আমি এমনভাবে গড়তে চাই রাকা, যেন তোকে দেখে বুঝতে পারি , আমার স্বপ্নগুলো সত্যি হলে জীবন কেমন হত।
রাতুলের প্রতি আমার ভালোবাসার গভীরতা এক ধাপ বেড়ে গিয়েছিল মনে হয় এই জন্য যে ও ও দিদুকে আমার মতই পছন্দ করত, শ্রদ্ধা করত, হয়তো ভালোও বাসত।
আমাদের বিয়ের সব বাজারই হয়ে গিয়েছিল, শুধু শাড়িটার দায়িত্ব রাতুল নিজে নিয়েছিল।
দিদু যেদিন মারা গেল তার আগের রাতে দুজন মধ্যরাত পর্যন্ত জেগে ছিলাম।
দিদুর কোলের কাছে শুয়ে শুয়ে ভবিষ্যতের আলোচনা করছিলাম। আমাদের রুমে দুই কর্নারে দুটো খাট ছিল, একটায় আমার, আর অন্যটায় দিদুর বিছানা পাতা। আমি সব সময় দিদুর সাথেই ঘুমতাম। ওই দিন হটাত দিদু বলল, তোর বিছানায় যা রাকা, এখন থেকে এ ক’দিন তুই একা ঘুমাবি। আমি বললাম, কেন? দিদু বলল, একা থাকলে তোর মধ্যে শূন্যতার সৃষ্টি হবে, তখন রাতুল কে বেশী করে কাছে নিতে পারবি আর আমার ও একা থাকার অভ্যাস টা আবার হোক।
রাতে আমার ভাল ঘুম হল না।
সকালে ঘুম ভাঙ্গল রাতুলের ডাকে। বিস্মিত হয়ে জিগ্যেস করলাম তুমি এত সকালে! কি ব্যাপার? রাতুল বলল একটা জিনিস তোমাদের দেখানোর লোভ সামলাতে পারলাম না, কাল রাতেই হাতে পেয়েছি;তাই ভাবলাম তোমাদের সাথেই নাস্তা করব।
তা কি জিনিস দেখাও।
উহু আগে উঠে হাত-মুখ ধোও, দিদুকে ডাক তারপর।
দিদুর খাটে চোখ পড়তে দেখি দিদুও ঘুমোচ্ছে, আশ্চর্য হয়ে গেলাম দিদু তো কখনও এত বেলা ঘুমায় না। বুঝলাম আমার মত দিদুরও রাতে ভাল ঘুম হয় নাই। দু জনেই ডাকলাম, দিদুর কোন সাড়া নাই, কাছে গিয়ে দেখি দিদুই নাই।
বাবা বাচ্চা ছেলের ময় হাউ-মাউ করে কাঁদল,এক সপ্তা ধরে দিদুর বাপের বাড়ির শ্বশুর বাড়ির এলাকার সব কটা এতিমখানায় তিন বেলা খাবারের ব্যবস্থা করেছিল বাবা। গ্রামের অনেক লোক এসেছিল দিদুকে শেষবারের মত দেখতে, তাদের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা জানাতে।
আজ একটু আগে মা রাতুলের আনা প্যাকেট টা আমার হাতে দিয়ে গেল, খুলে দেখি আমার বিয়ের শাড়ি।
এমন শাড়ি আমি জীবনেও দেখি নি। তার কারুকার্য আর শৈল্পিক নিপুণতা আমি বর্ণনা করে বুঝাতে পারব না। বুঝলাম এ ডিজাইন রাতুলের নিজের সৃষ্টি, অর্ডার দিয়ে করিয়ে এনেছে। দেখতে দেখতে আমার চোখ আটকে গেল তার পাড়ে গিয়ে, খুব খেয়াল করে দেখলে বুঝা যাচ্ছে নাড়া-চাড়ায় ভেসে উঠছে, দুটো নব বধূর প্রতিবিম্ব; একটা বয়স্ক আর একটা নবীন।
মনে মনে বললাম, এই না হলে কি বন্ধু! বাসর ঘরেও দিদু আমার সাথে থাকবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।