স্টেশন পার হয়ে পূর্ণগতিতে ছুটতে শুরু করেছে ট্রেন। যাত্রীদের মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস, যথাসময়ে হয়তো পৌছানো যাবে নিজ গন্তব্যে। সারাদিনের কর্মক্লান্ত যাত্রীদের কেউ কেউ হয়তো একটু চোখ বন্ধ করার চেষ্টা করছেন। এমনই সময় কয়েকজন যাত্রীর চিৎকার.... আগুন! আগুন!! আগুন!!! কোথায় আগুন? কোন কম্পাটমেন্টে? সবারই জিজ্ঞাসা। পোড়া গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
এমন সময় আবারও চিৎকার, দ্রুত চেন টানেন, চেন টানেন.. টানা হলো চেইন, আস্তে আস্তে ট্রেন গেলো থেমে। দ্রুত পায়ে নিরাপত্তা কর্মীদের ছোটাছুটি।
.......না, এটা কোন নাটক বা সিনেমার গল্প নয়। একেবারে বাস্তব ঘটনা। সময়ঃ কোরবানীর ঈদের একদিন আগে, বৃহস্পতিবার রাত আনুমানিক আটটা।
স্থানঃ জয়দেবপুর স্টেশন পার হয়ে ঘুটঘুটে অন্ধকারে আচ্ছন্ন মৌচাক এলাকা। ঢাকা থেকে পার্বতীপুরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া পার্বতীপুর ঈদ স্পেশালে জ নম্বর কম্পার্টমেন্ট। কমলাপুর, বিমানবন্দর, জয়দেবপুর স্টেশন পার হওয়ার পরই এ ঘটনার সূত্রপাত। পেছনের ঘটনা আরও পেছনে.....
কোরবানীর ঈদে বাড়ি যাচ্ছি। চারদিকে সাজ সাজ রব।
সবাই জানে আমি ঢাকা ছাড়ছি ঈদ করতে, আর এলাকার বন্ধুরাও জানে এবার তাদের সাথেই ঈদ করতে যাচ্ছি। সবাই জানে কারণ- বছরে এই একটি বারই বাড়ি যাওয়া হয়। চাকরীর কারণে দুই ঈদে ছুটি হয় না। আর রোজার ঈদের চেয়ে কোরবানীর ঈদেই বন্ধুদের সমাগম বেশি, তাই কোরবানীর ঈদ বাড়ি যাওয়ার উপলক্ষ্য........
প্রথমেই ঠিক হয়, কিভাবে বাড়ি যাব, বাস নাকি ট্রেন? সড়কে মহাজট। ৫ঘন্টার জার্নি লাগছে ১০ঘন্টা বা আরও বেশি।
তাই সিদ্ধান্ত ট্রেনেই সই। এখন টিকিট কিনতে হবে? লাইন ধরে টিকিট পাওয়া যাবে না। আর এতক্ষণ লাইনে দাড়ানোর সুযোগও নেই। তাই রেলওয়ের সম্রাট সহকর্মী তৌহিদ ভাইয়ের স্মরণাপন্ন। অবশেষে টিকিট পাওয়া, যদিও তা ঈদ স্পেশাল পার্বতীপুর।
স্পেশাল ট্রেন শুনে মনে হলো- আরামদায়কই হবে আট ঘন্টার এই ট্রেন যাত্রা। (যদিও বাসে সময় লাগে ৫ঘন্টা)
২৫শে অক্টোবর বিকেল ৪টা ২৫মিনিটে কমলাপুর থেকে ট্রেন ছাড়বে। আগে-ভাগেই স্টেশনে উপস্থিত হয়েছি আর অন্য শত শত যাত্রীর মতো। জানা গেলো- এক ঘন্টা ট্রেন লেট। প্লার্টফর্মে ট্রেন এলো দেড় ঘন্টা পর।
শুরু হলো ট্রেনে ওঠা নিয়ে প্রতিযোগিতা।
টিকিটহীন এবং সিট নাম্বারহীন টিকিটধারীদের চাপ সামলে অনেক কষ্টে ট্রেনে উঠতে পারা। দরজার বদলে জানালা দিয়ে লাগেজ ঢুকিয়ে দিয়ে নিজেও কোনক্রমে ট্রেনে দরজা দিয়ে চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে গেলাম। অনেক টাকা দিয়ে টিকিট কিনেও অনেক ভদ্রলোক পরিবার পরিজন নিয়ে ট্রেনে উঠতে পারেননি। আমরা যারা কম ভদ্রলোক তারা চাপাচাপি করে উঠেছি।
আর যাদের কোন গত্যান্তর নেই তারা ট্রেনের ভেতরে উঠতে না পেরে উঠছিলেন ছাদে। এ ঘটনা শুরু কমলাপুরেই নয়, বিমানবন্দর, জয়দেবপুরেও দেখা গেছে।
আমাদের আসন তিনটি। যখন আসনের কাছে পৌছালাম তখন দেখলাম একটা আসন কেটে অন্যপাশে চলে গেছে আর প্রতিটি আসনেই আসনের অতিরিক্ত মানুষ ঠাসাঠাসি করে বসা। তাদের উঠিয়ে সিটে বসতে গিয়ে ঘেমে নেয়ে একাকার।
দেখলাম বসে আছে আসন সংখ্যার দেড়গুণ। দাড়ায়ে আছে বসে থাকা যাত্রীর দ্বিগুণ। আর ছাদে অবস্থান নিয়েছে ট্রেণের ভেতরের মানুষের কয়েকগুণ। তিল ঠাই ছিলনা ছাদেও। তারপরও মনে স্বস্তি.. বাড়ি যাচ্ছি.. বাবা-মার সাথে ঈদ করবো।
কিন্তু বিভ্রাট ঘটলো জয়দেবপুর স্টেশন পার হয়েই...। ট্রেনের নাম ঈদ স্পেশাল হলেও শোচনীয় অবস্থা ছিল কম্পাটমেন্টগুলোর। হয়তো কারখানাতে পড়ে ছিল, কোনক্রমে মেরামত আর রং করে স্পেশাল নাম দিয়ে নামিয়ে দেয়া হয়েছে যাত্রী পরিবহনে। (কাচা রং লেগে আমার মতো অনেকের জামা-কাপড় নষ্ট হয়েছে)। অতিরিক্ত যাত্রীর ওজনের কারণে ট্রেনের স্প্রিং-এর সাথে চাকার ঘষা খেতে শুরু করে।
আর সেখান থেকেই আসতে থাকে পোড়া গন্ধ. .. তখনই আগুণ আগুণ চিৎকার।
নিরাপত্তা কর্মীরা ছোটাছুটি করে সমস্যা চিহ্নিত করে। সমাধান হয় যাত্রী কমাতে হবে এ কম্পার্টমেন্টের। কিন্তু কে নেবে যাবে কম্পার্টমেন্ট থেকে? ছাদের যাত্রীদের সরে যেতে বলা হয়, কিন্তু কোথায় যাবে তারা রাতের বেলা. কেউ সরে না দুর্বল কম্পার্টমেন্টটি থেকে, যেতে থাকে সময়. কে যেন লাঠি দিয়ে আঘাত করার হুমকি দেয় সরে যাওয়ার জন্য। কিন্তু কে শোনে কার কথা।
নেমে না গেলে ট্রেন বসে থাকবে- এমন হুমকির পরও কেউ সরে না। হতাশ হয়ে সরে যায় নিরাপত্তা কর্মীরা। এভাবেই কেটে যায় দেড় ঘন্টা। একজন -দুজন করে সরে যেতে থাকে ছাদের যাত্রীরা। ভাড় কমে যাওয়ায় অবশেষে ছেড়ে দেয় ট্রেন।
তারপর ধীরে ধীরে আবার যাত্রা শুরু করে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। সেই ধীর যাত্রায় জয়পুরহাট পৌছাতে সময় লাগে সাড়ে বার ঘন্টা। যেখানে আট ঘন্টার বেশি লাগার কথা নয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।