আমি একাই পৃথিবী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম http://www.facebook.com/kalponikvalo প্রিয় পাঠক, কিছু কিছু গল্প থাকে যে গল্পে মূল গল্পের চেয়ে গল্পের ভূমিকাটাই বড় হয়। আর কোন কারনে গল্পটি যদি হয় ব্যক্তিগত কোন ভৌতিক অভিজ্ঞতার গল্প তাহলে সেখানে ভুমিকার অবস্থা হয় অনেকটা 'বার হাত কাঁকুরের তের হাত বিচির' মত অবস্থা। এই গল্পেও অনেকটা সেই রকম হয়েছে। তাই পাঠকদের একটু ধৈর্য সহকারে পড়ার অনুরোধ করছি।
তবে কেউ চাইলে এই ভূমিকাটুকু বাদ দিয়ে মূল গল্পে যেতে পারেন। সেই ক্ষেত্রে একটু নিচের দিকে এখনই চলে যেতে হবে।
আমার নানার বাবা মোহাম্মদ ইদ্রিস মিয়া ছিলেন নোয়াখালীর পুলিশ সুপার। তার চাকরী জীবনের একটা দীর্ঘ সময় তিনি চট্রগ্রামে কাটিয়েছিলেন। একবার এক কুখ্যাত ডাকাতকে ধরার কারনে তৎকালীন ইংরেজ সরকার তাকে কিছু নগদ অর্থ প্রদান করে।
এই টাকা দিয়ে তিনি একটি জমি কিনেন। আমার নানা চট্রগ্রাম মেডিকেলে ভর্তি হবার পর নানার বাবা সেখানে একটি বাড়ি বানান।
ডাক্তারী পাশ করার পর আমার নানা সরকারী ডাক্তার হিসেবে কুমিল্লাতে যোগদান করেন। নানার বাবা তার পৈত্রিক ভিটা ফেলে চট্রগ্রামে থাকার ব্যাপারে রাজি ছিলেন না। তাই বাড়িটি এক হিন্দু ব্যবসায়ীর কাছে ভাড়া দিয়ে দেয়া হয়।
এইভাবেই চলছিল। নয় মাস যুদ্ধের পর বাংলাদেশ তখন মাত্র স্বাধীন হয়েছে। যুদ্ধ শেষে অনেকের অনেক সম্পত্তি বেদখল হয়ে যাচ্ছিল। যুদ্ধের এই কয় মাস চট্রগ্রামের বাড়ির কোন খবর নানারা নিতে পারেন নি। তাই নানার বাবা নানাকে চট্রগ্রামে পাঠালেন, বাড়ির অবস্থা দেখার জন্য।
এসে দেখলেন, পুরো বাড়ি ঘাস লতাপাতায় ছেয়ে গিয়েছে। ম্যাসাকার অবস্থা। বাড়ি তালাবদ্ধ। আশে পাশে খোঁজ নিয়ে নানা জানলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে সেই হিন্দু ব্যবসায়ী ভারতে পালিয়ে যান। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বাড়িটি খালীই পড়েছিল।
এরপর নানা লোকজন ডেকে বাড়িঘর পরিষ্কার করার কাজে হাত দেন। বাড়ির ভিতরটা পরিষ্কার করার সময় শ্রমিকরা নানা রকম অদ্ভুত জিনিস পায়। যেমন, নানারকম কাপড়ের মূর্তি, ছোট কিছু মাথার খুলি, লালচে রং এর কিছু কাপড়, নানারকম সুগন্ধী আর একটা রুমের মেঝেতে কিছু নকশা করা আলপনা। ব্যাপারতা ঠিক স্বাভাবিক মনে না হওয়ায় নানা একটু খোঁজ খবর লাগালেন। কিন্তু তেমন কোন খবর পেলেন না।
নানার এক খালাত ভাই ছিল জামাল নানা, যিনি চট্রগ্রামেই থাকতেন। তিনি সব কিছু দেখে বললেন, এই বাড়িতে তন্ত্রমন্ত্র বা ডাকিনী বিদ্যা চর্চা হতো। সব শুনে আমার নানা কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন। বাড়ি পরিষ্কার করার জন্য যে সব শ্রমিকদের আনা হয়েছিল, কোন শ্রমিক এই সব জিনিস ধরতে রাজি ছিল না। শেষ মেষ বাধ্য হয়ে আমার নানা আর তার সেই ভাই মিলে সব অদ্ভুত জিনিসগুলো দূরে নিয়ে মাটি চাপা দিয়ে দেন।
তারপর আরো লোকজন ডেকে পুরো বাড়ি রংটং করে একে বারে ঝকঝকে করে ফেলেন। একজন কেয়ারটেকার আর জামাল নানাকে বাড়ি পাহারা দেয়ার দায়িত্ব দিয়ে তিনি নোয়াখালী ফিরে আসেন।
আমার নানি তখন গর্ভবতী। আমার মেজখালা তখন আমার নানীর পেটে। নানীর শরীর বেশি ভালো ছিল না, আমার নানা চেয়েছিলেন নানিকে চট্রগ্রামে কিছুদিন এনে রাখবেন।
তাই দুই দিনের মাথায় আমার নানা, নানি, আমার মা, বড় মামা ও নানির এক বোনকে নিয়ে চট্রগ্রামে চলে এলেন। এসে দেখলেন বাড়িতে কেউ নেই। কিছুক্ষন ডাকাডাকি এবং খোঁজাখুঁজির পর পাশের বাড়ি থেকে জামাল নানাকে পাওয়া গেল। তার চোখের নিচে কালি, মাথার চুল উস্কুখুস্ক হয়ে আছে। ঘটনা কি জানতে চাইলে, জামাল নানা যা বললেন তা অনেকটা এই রকম ছিল যে, রাতে তারা ঘুমাচ্ছিল, হঠাৎ কেন যেন তার ঘুমটা ভেঙ্গে যায়।
চোখ মেলতেই তিনি কেমন যেন একটা বোটকা গন্ধ পান। মাথা ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকাতেই হারিকেনের মিটিমিটি আলোয় তিনি দেখলেন দরজার সামনে মানুষের মত্ দেখতে কালো রোমশ, বিভৎস মুখমন্ডলের একটা বিচিত্র প্রানী দাঁড়িয়ে আছে। এ দেখে তিনি ভয়ে সাথে সাথে চিৎকার দেন। চিৎকার শুনে মাটিতে শুয়ে থাকা কেয়ারটেকার লাফ দিয়ে ঘুম থেকে উঠে পড়ে। কেয়ারটেকারকে ব্যাপারটা খুলে বলেন।
কেয়ারটেকার ছিল মোটামুটি সাহসী। সে বাইরে হারিকেন নিয়ে কিছুক্ষন হাকাহাকি করলো। তারপর ফিরে এসে ব্যাপারটাকে স্বপ্ন বলে ব্যাখ্যা দিয়ে জামাল নানাকে ঘুমিয়ে পড়তে বলে সে ঘুমিয়ে পড়ল।
সকাল বেলা ঘুম কেয়ারটেকারের হৈচৈ এ জামাল নানার ঘুম ভাঙ্গে। তিনি ঘটনা কি জানতে চাইলে কেয়ারটেকার বলে কে যেন বাড়ির পিছনে একটা মরা কুকুরের লাশ ফেলে গিয়েছে।
জামাল চাচা কুকুরের লাশটা দেখলেন প্রায় অনেকটা পচে গন্ধ বের হচ্ছে। রাতের ঘটনার কথা মনে করে তারা দুইজনেই কিছুটা ভয় পেলেন। কিন্তু তারা কেউই মুখে কিছু বললেন না। শেষে কেয়ারটেকার আর তিনি মিলে কুকুরের অর্ধপচা লাশটিকে বাড়ির পেছনে মাটি চাপা দেন।
সেই রাতে তারা রাতের খাবার খেয়ে রুমে আর রুমের বারান্দায় হারিকেন জ্বালিয়ে শোয়ার ব্যবস্থা করেছিল।
সারাদিন কাজ করে তারা দুইজনের মোটামুটি ক্লান্ত ছিল। তাই বিছানায় যাওয়া মাত্রই তারা ঘুমিয়ে পড়েন। প্রায় আনুমানিক প্রায় শেষ রাতের দিকে আবারো কোন কারনে জামাল নানার ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘুম ভেঙ্গে দেখেন কেয়ারটেকার সাহেবও জেগে গিয়েছেন। ঘর ভর্তি কেমন যেন একটা প্রচন্ড বোটকা গন্ধ।
তারা দুইজন ঘরের দরজা খুলে বারান্দায় এসে একটা ভয়াবহ জিনিস দেখলন। সারা বারিন্দা জুড়ে কিসের যেন নাড়ি ভূড়ি ছড়ান। এই দেখে তিনি সেখানে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যান। ঘুম ভেঙে তিনি নিজেকে পাশের বাড়িতে আবিষ্কার করেন।
এই সব কথা শুনে আমার নানা কিছুটা বিরক্ত হলেন।
হাজার হোক ডাক্তার মানুষ, ভূতপ্রেত জাতীয় জিনিসে বিশ্বাস করতে কেমন যেন তার গায়ে লাগে। তিনি ব্যাপাটা মোটেই পাত্তা দিতে চাইলেন না। তিনি জামাল চাচাকে বললেন, এতদিন এই বাড়িতে কেউ ছিল না, একা একা থাকার ফলে হ্যালুসিনেশন হয়েছে। জামাল চাচা কোন ভাবেই তার কথা মানতে চাইলেন না। পরে বাধ্য হয়ে নানা হুজুর ডাকলেন।
হুজুরকে দিয়ে বাড়ি বন্ধ করালেন। হুজুর যাওয়ার সময় বলে গেল, এই বাড়িতে খারাপ জ্বীনের আসর আছে। তিনি সাময়িক হয়ত একটা ব্যবস্থা করতে পারবেন। কিন্তু এটার সমাধান করা তার কাজ নয়। তিনি একজনকে চিনেন, যিনি এই কাজ করতে পারবেন।
সব কিছু শুনে আমার নানী এবং অন্যান্যরাও নানাকে অনুরোধ করল সেই বড় হুজুরকে খবর দিতে। সবার চাপে বাধ্য হয়ে নানা সেই বড় হুজুরের জন্য খবর পাঠালেন।
বাড়ি এখন মোটামুটী সরব। অনেক মানুষ আসছে নানার সাথে দেখা করতে। আমার আম্মারা বাড়ির সামনে খালি জায়গায় খেলা ধুলা করছে।
মোটামুটি স্বাভাবিক পরিস্থিতি। এর মধ্যে সেই হুজুর খবর নিয়ে এল, বড় যেই হুজুরের সন্ধানে তিনি গিয়েছিলেন, তিনি কোন একটি বিশেষ কাজে কুমিল্লা গিয়েছেন। কয়েকদিনের মধ্যেই ফিরবেন। নানীর অনুরোধে নানা হুজুরকে কিছুদিন এই বাড়িতে থাকার অনুরোধ করলেন।
যাই হোক এই ভাবেই চলছিল।
এক সময় আমার নানীর ডেলীভারির টাইম হলো। নোয়াখালী থেকে আমার নানার বাবা আর মা চট্রগ্রাম এলেন। আমার মেজ খালা জন্ম নিলেন। নতুন বাচ্চাকে দেখতে বাড়িতে অনেক মানুষ।
একদিন সন্ধ্যায় পরিবারের সবাই মিলে বারান্দায় গল্প করছিল।
পাশের রুমেই খাটে মধ্যে আমার আম্মা আর বাচ্চা মেজ খালা ঘুমিয়ে আছে। হঠাৎ আমার আম্মু বারান্দায় এসে বলে, বাবু কই? এই প্রশ্নে সবাই লাফিয়ে উঠে। গিয়ে দেখে খাটের মধ্যে বাবু মানে আমার মেঝখালা নেই। আমার নানী তো কান্না কাটি শুরু করলেন। সবাই মিলে সব রুম বাড়ির আশে পাশে খোঁজা শেষ করল।
কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। আতংকে শোকে পুরো পরিবারটি একেবারে নিস্তব্দ হয়ে গেল। এমন সময়, হঠাৎ খাটের নিচ থেকে বাচ্চা মানে আমার মেঝ খালার কান্নার শব্দ শুনতে পাওয়া গেল। তাড়াতাড়ি করে খাটের নিচ থেকে মেঝ খালাকে বের করে আনা হলো।
এই ঘটনার পর সবাই মোটামুটি মুষড়ে পড়ল।
আরো অনেক উল্টা পালটা ঘটনা ঘটতে লাগল। এমন সময়, সেই বড় হুজুর আমাদের সেই বাড়িতে এলেন। তিনি এসে বাড়ি বন্ধ করার ব্যবস্থা করলেন। বাড়ি পরিষ্কার করার সময় যে সব মূর্তি বাড়ির পেছনে মাটি চাপা দেয়া হয়েছিল সেগুলোকে মাটি থেকে তুলে ভেঙে ফেললেন এবং বাকি আরো কিছু জিনিসপত্রসহ তা আগুনে পুড়িয়ে ফেললেন। তারপর সেগুলো একটা বস্তায় করে কর্নফূলী নদীতে ফেলে দিলেন।
এরপর থেকে সেখানে আর তেমন কোন সমস্যা হয়নি।
পরবর্তীতে বাড়িটি চারতলা করা হয়। দ্বিতীয় তলা বাদ দিয়ে বাকি সব গুলো ফ্লোর ভাড়া দেয়া হয়। দ্বিতীয় তলায় আমার বড় মামা আর একজন বাবুর্চী কাম কেয়ারটেকার থাকত। বড় মামা এই বাড়িতে থেকে চট্রগ্রাম ইউনির্ভসিটিতে পড়াশুনা করেছেন।
পরর্বতী সময়ে আমাদের পরিবারের যারাই চট্রগ্রামে পড়াশুনা করতে গিয়েছেন তারা সেখানে থেকেছে। এক সময় বাড়িটি হয়ে উঠে আমাদের জন্য এক আনন্দশ্রম। কারন সেখানে শাসন করার জন্য তেমন কেউ ছিল না। আমরা সেখানে গেলে অফুরন্ত স্বাধীনতা উপভোগ করতাম।
_____________________________________________
এবার আসা যাক মূল গল্পে।
প্রায় সাত বা আট বছর আগে, একবার চট্রগামের বাড়িতে যাচ্ছি। প্রধান উদ্দেশ্য বান্দরবনের তাজিংডং এ যাওয়া। আমার বড় এক খালাত ভাই তখন চট্রগ্রাম মেডিকেলে পড়ত। তার নাম ছিল রাশেদ। তিনি আর তার কিছু বন্ধুরা সেই বাড়িতে থেকে পড়াশুনা করত।
পড়াশুনার পাশাপাশি তারা দুষ্টামীকে একটি শিল্পে পরিনত করেছিলেন। তাই তারা ছিল আমার আদর্শ। সেখানে আমার সমবয়সী কাজিন, সিনিয়র কাজিন এবং সবার বন্ধু বান্ধব মিলে ১৫ জনের একটা বিশাল দল ছিল। আমাদের এক কাজিন ছিল আইমান সে আবার ভূতপ্রেত ইত্যাদিকে ব্যাপক ভাবে বিশ্বাস করত। এক আড্ডায় সে প্ল্যানচ্যাটের ব্যাপারে বেশ ইন্টারেস্টিং কিছু তথ্য দেয়।
তার স্কুলের বন্ধুরা মিলে নাকি একবার প্ল্যানচ্যাট করে আত্মা ডেকেছিল। তার আত্মবিশ্বাসী বক্তব্যের কারনেই হোক আর নিষিদ্ধ কিছু করার উত্তেজনায় হোক আমরা রাজি হয়ে গেলাম এই প্ল্যানচ্যাট করার জন্য। এই উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে আমি আবার এই বাড়ির পূর্ব ইতিহাসের কথা না বলার লোভ সামলাতে পারলাম না। আমার এই গল্প উত্তেজনার মাপকাঠি একধাপ বাড়িয়ে দিল।
সেদিন রাতে আমরা প্ল্যানচ্যাট করব, সেদিন সকালে সবাইকে আইমান বললো কোন প্রকার মাছ মাংস সারাদিনে খাওয়া যাবে না।
এইগুলো খেলে নাকি প্ল্যানচ্যাটের সেশন ঠিকভাবে হয় না। তাই সবাই সব্জি আর ডিম যেন খায়। কি আর করা। আমরাও উত্তেজনার কারনে সবই করতে রাজি ছিলাম। বেশি উত্তেজিত ছিল আমার কাজিন এবং তাদের বন্ধুরা।
সারাদিন যে যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিল। আমি আর আমার এক কাজিন তুহিন দুজন মিলে একটু ঘুরতে গেলাম। যাওয়ার সময় বাবুর্চীকে বলে দিলাম রাতে যেন সবজী খিচুড়ী করে আর সাথে ডিম।
একএক করে সবাই আমাদের ফ্লোরে চলে এলো। আইমান বারান্দার সাথে লাগোয়া একটা রুমে মুছে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে মাঝখানে একটা সার্কেল আঁকলো।
সবাইকে খাওয়া দাওয়ার করার পর পরিষ্কার কাপড় পড়ে এই সার্কেলে এসে বসতে বলল। আমরা তাড়াতাড়ি খেয়ে এসে সেই সার্কেলে বসলাম। মাঝখানে রাখা হলো বেশ কয়েকটি মোমবাতি।
ঠিক রাত ১২:৩০ মিনিটে আমাদের প্ল্যানচ্যাট শুরু হলো। সবাই একে অন্যের হাত ধরে সামনের দিকে এক পা বাড়াচ্ছি আবার পিছিয়ে যাচ্ছি।
অনেকটা নাচের ষ্টাইলে। আর মুখে ডাকছি, আয় আয় আয়। এই ভাবে প্রায় বেশ কিছুক্ষন হলো। একসাথে আয় আয় আয় বলার কারনেই হোক আর যেই কারনেই হোক রুমের পরিবেশটা বেশ ভারী হয়ে উঠল। কেমন যেন একটা অনুভুতি।
হঠাৎ দেখলাম, তুহিন যেন কেমন মাথা ঝুকিয়ে গোংগাচ্ছে। সবাই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে তুহিনকে ডাকতে লাগলাম। কিন্তু তুহিন তখনও গোংগাচ্ছে আর কি যেন বলছে। কথা কিছুই বুঝতে পারছি না। সবাই আমরা সার্কেলেই বসে আছি।
আইমানের চোখমুখ দেখলাম শুকিয়ে গিয়েছে। হঠাৎ তুহিনের মুখ দিনে ঘন সবুজ রং এর কিছু তরল বের হয়ে আসল। এবং সে কিছুটা উদ্ভ্রান্তের মত আচরন করতে শুরু করল। আইমান বললো, তুহিনের উপর নাকি আত্মা ভর করেছে। কিন্তু তুহিন এর হঠাৎ করে খিচুনীর মত শুরু হয়ার কারনে বড় ভাইয়া মানে রাশেদ ভাইয়া তাড়াতাড়ি উঠে লাইট জ্বালালেন।
লাইট জ্বালানো মাত্র তুহিনের শুরু হলো পাগলামী। মনে হল সবাইকে সহ্য করতে পারছে না। আইমানের দিকে একবার লাফও দিয়েছিল। আইমান তো ভয়ে প্রায় কেঁদেই ফেললো। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, আমার ভূল হয়েছে, আমাকে মাফ করে দিন।
আমার উচিত হয়নি আপনাকে ডেকে আনা। এই কথা শুনে তুহিন এর গোংগানী আরো বেড়ে যায়। আইমানকে উদ্দেশ্য করে হুমকি, গালাগালি শুরু করে। আমি সবাইকে বললাম, আসেন সবাই দোয়া দুরুদ পড়ি। দোয়াদুরুদ পড়লে এই সব জিনিস চলে যাবে।
সবাই মিলে যে যা পারে তা পড়া শুরু করল। তারপর হঠাৎ দেখি তুহিন শান্ত হয়ে বুকের উপর মাথা ঝুলিয়ে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ল। সবাই মিলে ওর চোখে পানি টানি দিয়ে এর জ্ঞান ফিরিয়ে আনল। ও চোখ মিটিমিটি করে বলল, কি হইসে। সবাই ওর দিকে চেয়ে আছে কেন ইত্যাদি ইত্যাদি।
ঘটনার পরিপ্রক্ষিতে আমাদের সবার অবস্থা ততক্ষনে কাহিল। সবাই যে যার মত গোল হয়ে সদ্য ঘটে যাওয়া ঘটনাটি বিশ্লেষন করছে। এক গ্রুপ গেল ছাদে সিগারেট টানতে। আর এক গ্রুপ অন্য রুমে গিয়ে টিভি ছাড়ল। আমিও টিভি রুমে গিয়ে বসলাম।
তুহিন বাথরুমে গেল। আইমান বেশ সাফল্যের একটা হাসি নিয়ে বারান্দায় সিগারেট খেতে গেল। আমি রাশেদ ভাই, রিপন ভাই বসে টিভি দেখছি। আইমান বারান্দায় সিগারেট খাচ্ছে আর তার বন্ধুদের সাথে ফোনে ঘটনার বর্ননা দিচ্ছে। হঠাৎ ঠাস করে একটা গ্লাস ভাংগার আওয়াজ আর আইমানের চিৎকার।
আমরা দৌড় দিয়ে বারান্দায় গেলাম। গিয়ে দেখি আইমানের সামনে একটা ভাংগা ইলেক্ট্রিক বাল্ব। কি হইসে জিজ্ঞেস করাতে শুধু ও কোন ভাবে বলল, তু-তু-তুহিন। আমরা তুহিনের খোঁজে পিছে তাকালাম। কিন্তু অন্ধকারে কিছুই দেখা গেল না।
সিঁড়ি ঘরে দিকে যেতেই দেখি, তুহিন চোখ লাল করে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে বাল্বব। রাশেদ ভাই তুহিন বলে ডাক দিতেই আবারো পায়ের কাছে বাল্ব এসে পড়ল। তারপর হঠাৎ দেখি পিছন দিয়েও বাল্বব পড়া শুরু হলো। নিচে হৈচৈ শুনে যারা ছাদে গিয়েছিল তারা নিচে নেমে আসল।
আসার সময় সিঁড়ি ঘরে তুহিনের সাথে দেখা। ওদের দেখা মাত্রই তুহিন ওদের দিকে বাল্ব ছুড়ে মারল। সাথে বিচিত্র মুখভংগী। আমি সবার মুখের দিকে চেয়ে দেখি মোটামুটি সবাই আতংকিত অবস্থায় আছে।
কিছুক্ষন পর তুহিনের কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে আমি দরজা খুলে ওকে খুঁজতে বের হলাম।
গিয়ে দেখি তুহিন সিঁড়ি ঘরে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পড়ে আছে। সবাই মিলে ধরাধরি করে ওকে ভিতরে নিয়ে আসলাম। কিছুক্ষন পর তুহিনের জ্ঞান ফিরল। সে কিছুই মনে করতে পারল না। তারও বেশ কিছুক্ষন পর আমরা সবাই কিছুটা আতংক নিয়ে ঘুমাতে গেলাম।
বলা বাহুল্য তুহিনের সাথে সেদিন রাতে কেউ ঘুমালো না।
এই ছিল আমার প্ল্যানচ্যাটের গল্প। এবার আসুন প্ল্যানচ্যাটের পিছনের গল্প শুনি।
প্রিয় পাঠক এই বার আপনাদের একটা সত্য কথা বলি, প্ল্যানচ্যাটের এই বিষয়টা মুলত আমারই প্ল্যান করা। আইমান আমাদের সবাইকে একটি গাঁজাখুরি প্ল্যানচ্যাটের গল্প বলে।
ও পড়ত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। সে আর তার বন্ধুরা মিলে ইন্টারনেট থেকে নাকি খুঁজে বের করেছে, যার উপর আত্মাভর করে সে নাকি সবুজ রং এর বমি করে। তার বানানো কথাবার্তা শুনে সবাই যেভাবে ভয় পাচ্ছিল তাতে আমার হাতপা নিশপিশ করছিল সবাইকে ভয় দেখানোর জন্য। মাথায় একটা সুন্দর প্ল্যান আসলো। এতে আমার ২ জনকে দরকার।
আমি তুহিনকে বেছে নিলাম। কারন তুহিন গ্রামে থাকে। সবাই জানে তুহিনকে নাকি ছোট বেলায় ভুতে ধরেছিল। সেই থেকে তুহিনের নাকি কি সব সমস্যা আছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এমন কিছুই দেখিনি।
তাকে যখন বললাম, আইমানের পাকনামী আমার সহ্য হচ্ছে না, ওকে একটা শিক্ষা দিতে চাই তখন ও সাগ্রহেই রাজি হল। তারপর গেলাম বাড়ির কেয়ারটেকার মোস্তফা ভাই এর কাছে। কারন তাকেও আমার লাগবে। উনাকে সবখুলে বুঝিয়ে বললাম, সাথে আরো ৫০টাকা দিলাম, চা পান খাওয়ার জন্য। তিনি হেসে রাজি হয়ে গেলেন।
প্ল্যানচ্যাটের দিন বিকেলে আমি আর তুহিন বাইরে ঘুরতে গেলাম। বাইরে গিয়ে ওর সাথে সমস্ত প্ল্যানটা আলোচনা করলাম। কারন এই খানে প্রধান ভুমিকাই তার। ছেলে বুদ্ধিমান, একবারের সব বুঝে নিল। আসার সময় আইমানের সেই তথাকথিত সবুজ বমির ইফেক্ট আনার জন্য কিছু পালংশাক কিনে আনলাম।
তারপর এনে সেটা চুপি চুপি মোস্তফা ভাইকে দিয়ে আসলাম। বললাম কুচি কুচি করে কেটে হালকা সিদ্ধ করে যেন ব্লাইন্ডারের ব্লেন্ড করে নেয়। কিন্তু ব্লাইন্ডার না থাকায় তিনি মসলা পিষার পাটায় হাল্কা পিষে নিলেন। তার কাছ থেকে আমরা কিছু পূরানো লাইটও নিলাম। যেন পরর্বতীতে ব্যবহার করতে পারি
সবাই খাওয়া দাওয়া করার পর, তুহিন এক ফাঁকে ফ্রিজ থেকে সেই পেষ্ট করা পালংশাক বের করে মুখে ঢুকিয়ে দেয়।
তারপর সবাই যখন আয় আয় আয় করে ডাকছে তখনই সে সবুজ বমি হিসাবে এই পালংশাক বের করে দেয়। বলাবাহুল্য সে জিনিস সবুজ ছিল না। কালচে সবুজ টাইপের ছিল এবং সে যে অভিনয় করল, তাতে আমার ক্ষমতা থাকলে তাকে অস্কার দিতাম। তার অভিনয় গুনে আমার হবু ডাক্তার ভাইরা পর্যন্ত চরম নার্ভাস হয়ে যায়। অনেকে নাকি তার পার্লস খুঁজে পাচ্ছিলেন না।
অনেকে আবার ডাক্তারী বাদ দিয়ে বলেছিলেন কোন হুজুর আনার ব্যবস্থা করতে। সব মিলিয়ে তুহিনের অভিনয় গুনে ১৬জন মানুষকে আমি সেই মাপের ভয় দেখাতে সক্ষম হই। এই ব্যাপারটি এতদিন পর্যন্ত লুকানো ছিল। এই ঈদে গ্রামের বাড়িতে এক আড্ডায় তুহিন ব্যাপারটা ফাঁস করে দেয়। তারপর আমার উপর নাজিল হয় গজব।
আমার কাজিনরা এবং তাদের সেসব বন্ধুরা বাংলাদেশে ছিলেন তারা সবাই আমাকে ফোন দিয়ে গুষ্টি উদ্ধার করে। বিশেষ করে আইমান আমার সাথে সর্ম্পক ছিন্ন করার ঘোষনা দিয়েছে। তবে আশার কথা হচ্ছে ভাবিরা সবাই আমার এই রকম কাজে বাহাবা দিয়েছে এবং সার্পোট করেছে। তাই এখনো বেঁচে আছি। শুনতে পাচ্ছি সবাই এই মাসের ১৫ তারিখে ঢাকায় আসবে।
তারপর আমাকে নাকি সীল মারা হবে। আমি এই কথা শুনে একটু বিরসবদন করলাম। আর মনে মনে ভাবলাম এই রকম আনন্দের জন্য আমি আমি একশটা সীল খেতে রাজি। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।