আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অভিসার

ক্লান্ত চেহেরা নিয়ে আয়নার সামনে দাড়ালো মিতু । আয়না বলতে আরশী নয়; নিতান্তই বড় একটি আয়নার ভাঙ্গা অংশ । বড় যুদ্ধের জীবন তার । এখানে আয়নার সামনে দাড়ানোয় বিলাসিতা । আর আয়না কেনা তো অনেক দূরের গল্প ।

এই ভাঙ্গা টুকরাটুকু সেই কুড়িয়ে নিয়ে আসছে এক ডাস্টবিন থেকে । অনেক শখ তার আয়না দেখার । তাই সে মাঝে মাঝে এই আয়নায় মুখ রাখে । তার জন্য মা রূপী মানুষটার কম গাল খায় না । মাগী ছাড়া সে কথা কয় না ।

মাঝে মাঝে এই রুক্ষ চুল ধরে টানাটানি করতেও ছাড়ে না । সারাদিন এত পরিশ্রম করে তারপরেও মায়ের মন পায় না সে । সব সময় গালা গালির উপরে রাখে । কোনদিন কম কামাই করলে তার আর রক্ষা থাকে না । প্রায়ই মনে হয় এ তার নিজের মা নয় ।

অবুঝ মন বোঝে না এখানে মা একটি শব্দ মাত্র; মায়া, মমতা, আদর, স্নেহ অন্য সব অর্থহীন । তেজগাঁও রেললাইনের বস্তিতে থাকে মিতু । কতই আর বয়স তার ? তেরো চোদ্দ হবে মনে হয় । কিন্তু শরীরে বাড়ে নি ততটা । অনাহারে অর্ধহারের জীবনে তাকে সাত আট বছরের বালিকা মনে হয় ।

চোখগুলো বড় বড় আর মায়ায় ভরা । সারাদিন এটা ওটা কুড়ায় সে । এটাই তার কাজ । যা পায় পুরাটায় মায়ের হাতে তুলে দেয় । মাও কাওরান বাজারে সব্জি কুড়ায় ।

আর সেগুলো নিয়ে এসে বিক্রি করে এই ফ্লাইওভারের নিচের বাজারটা । মা মেয়ে সারাদিন যা রোজাগার করে তা দিয়ে কোনোভাবে চলে তাদের । গোস্ত তারা চোখে দেখে না । মাছ জোটে সে মাসে দুই একদিন । কিন্তু সেই মাছ মিতুর খেতে ইচ্ছে করে না ।

কেমন পচা পচা লাগে । এজন্যও মা বকাবকি করে, নবাবজাদার বেটি আইছে । মাছ খাইতে পারে না, পচা গন্ধ আবার কী রে ? মাছ মাছই, খাইলেই মিটে গেল । কিন্তু মিতু পারে না । শুধু মাছের বদলে একগাদা গাল খেয়ে বোবার মত চেয়ে থাকে ।

তবে আজকে আয়নার সামনে সে দাঁড়িয়ে এত কিছু ভাবছে না সে । তার আজ বড়ই খুশি খুশি লাগছে । মুখটা ভালো করে বারকয়েক দেখলো মিতু । অনেকটা ফর্সাই তো লাগে । তারপর লাজুক লাজুক দৃষ্টিতে নিজের বুকের দিকে তাকালো ।

এদিক ওদিক তাকিয়ে নিলো আবার । তারপর জামাটা খুলে ফেললো । হ্যাঁ, এবার বোঝা যাচ্ছে । খুব বেশি বড় নয় অন্য মেয়েদের মত । তবে ধরা যায় ।

খুব কষ্ট হলো মিতুর কেন অন্য মেয়েদের মত তার বুকটা বড় হলো না । তবে এই বুকেই হাত দিয়ে নতুন ডেরায় উঠা লোকটা তাকে আজ দশ টাকা দিয়েছে । বলেছে কাল দুপুরে ওর ডেরায় গেলে আরো টাকা দেবে । মিতুর চোখটা চক চক করে উঠলো । কাল যদি আমায় পঞ্চাশ টাকা দেয় তাহলে সে টাকাটা মাকে দেবে না ।

যেটা করবে সেটা হলো একটা বড় আইসক্রিম কিনে খাবে । ও কী যে স্বাদ সেই আইসক্রিমগুলো ! একদিন এক বড়লোকের মেয়ের হাত থেকে পড়ে গেয়েছিলো ওর সামনে । সেটা ও কুড়ে নিয়ে খেয়েছিলো । তারপর থেকেই তার চিন্তায় ছিলো সে ঐ আইসক্রিম একদিন কিনে খাবে । সেজন্য সে সেই আইসক্রিমটার প্যাকেটটাও যত্ন করে রেখে দিয়েছে ।

মনের মধ্যে একধরনের পুলক খেলে গেল । চোখ বন্ধ করে ভাবলো কী মজাই না হবে ! এই সময় হঠাৎ করে চুলে টান খেয়ে মিতু চমকে উঠলো । আর সঙ্গে সঙ্গে মায়ের বাজখাই গলা শোনা গেল, মাগীর ঘরে বসে বসে উপ চর্চা হচ্ছে ? মাগীকে কোন নাঙ নিতে আসপি । পেটে ভাত নাই, নাঙ্গের জন্য সাজা হচ্ছে । তারপরেই গাল ঠাস করে একটা থাপড় দিয়ে বলে উঠলো, ন্যাংটা হয়ে ডং করা হচ্ছে ।

আজ কি মাগীর ভাত খাওয়া লাগবে না ? গিলতে বসে তো কম গেলে না । পারলে এক হাড়ি একাই খায় । কামের বেলায় নাই । আজ যদি মাগীকে না শুকাইছি তো ......? মিতু তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়ে । একবার মনে হয়েছিলো দশটাকাটা মায়ের মুখের উপড় ছুড়ে মারে ।

কিন্তু পরেই মনে হলো লাভ কী ? গাল তো কমবে না । বরং চুল ধরে আর একটা টান দিয়ে বলবে, কই পেলি ? ওর চেয়ে এখানে ওখানে ঘুরে ফিরে রাতে যেয়ে টাকাটা মায়ের হাতে দিলেই মিটে যাবে । হাটতে হাটতে অনেকটা দূরে চলে এসেছে মিতু । এখানে মায়ের আর চিল্লানি শোনা যাবে । শুধু রেল চলে যাবে ঝিক ঝিক করতে করতে ।

সে সময়টা ওর ভালোই লাগে । নানা রকমের মানুষ দেখা যায় । ওর ও মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় রেলগাড়িতে চড়ে এখানে ওখানে ঘুরতে যায় । কিন্তু ভয়ে পারে না । কোথায় যাবে সে ।

যদি হারিয়ে যায় ? তাহলে ... ? পা ছড়িয়ে রেলের উপড় বসে পড়লো মিতু । এখানে ওকে বিরক্ত করার কেউ নাই । আর একবার আইসক্রিমের কথা মনে হলো । চোখটা আবারো চক চক করে উঠলো । কাল খুব মজা করে সে আইসক্রিমটা খাবে ।

অবশ্য কেনার পর তাকে গোপন একটা জায়গায় চলে যেতে হবে না হলে তার বয়সী কারো সাথে দেখা হয়ে গেলে না দিয়ে খেতে পারবে না সে । আরো একটা সমস্যা আছে । মা জেনে যাওয়ার ভয় । ভয় কথাটা মনে হতেই আর একটা ভয় এসে তার মনে ধাক্কা দিলো । কাল লোকটা দুপুরে ডেরায় যেতে বললো কেন ? কী করবে সে ? বুকে হাত দেয়ার বেশি কিছু করবে না তো ? বেশি কিছুর কথা মনে হতেই মুখটা আর একবার লজ্জায় ভরে উঠল ।

যদিও আশে পাশে কেউ নাই তবুও নিজের কাছেই কেমন লজ্জা লাগতে লাগলো ওর । ভয়টা অবশ্য বেশিক্ষণ থাকলো না । দুটা ঘটনার কথা মনে পড়লো ওর । তখন সে অনেক ছোট । একরাতে মায়ের আহ উহ শব্দ শুনে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিলো ।

মা মা বলে ডেকে উঠেছিলো, মা কী হয়েছে তোমার ? মা উল্টা রেগে উঠেছিলো, মাগী ঘুমা । বলে দুম দুম করে কিল বসিয়ে দিয়েছিলো পিটের উপরে । চোখ খোলার সাহস পায় নি সে । তারপরেও বসেছিলো মায়ের গায়ের উপরে একটা অন্য মানুষ আছে । সেদিন সে বুঝতে পারে নি ।

কেন মা তাকে মেরেছিলো । কিন্তু এখন বোঝে । আর এই তো কয়দিন আগে আবারো দেখেছিলো একই ঘটনা । অবশ্য এবার আর মায়ের নয় । পাশের ডেরায় থাকা এক ভাবীর ।

সেদিন দুপুরবেলার দিকে খেতে এসে দেখে ঘরে লবণ নাই । ভাবীর কাছে চাবে বলে ডেরার কাছে এসে দেখে দরজা বন্ধ । ভেতরে কেউ আছে কি না তা দেখার জন্য পাশের ফুটো দিয়ে উকি মেরেই শিউরে উঠেছিলো সে । ভাবীর নিচে শুয়ে আছে আর ভাবীর শরীরের উপর একটা অচেনা মানুষ উঠানামা করছে । দেখার সঙ্গে সঙ্গে গায়ের মধ্যে কেমন রি রি করে উঠেছিলো ওর ।

তারপরেও বেড়ার ফাক দিয়ে আর একবার তাকিয়েছিলো । তখন দুইজনে কাপড় পড়ছিলো । লবণ আর চাওয়া হয় নি ভাবীর কাছে, নিজের কাছেই যেন লজ্জা লাগছিলো মিতুর । চলে এসেছিলো সে । কয়দিন পরে এই ঘটনা বলছিলো ওর চেয়ে একটা বড় ছেলেকে ।

ওদের সাথেই থাকতো । রাস্তায় রাস্তায় পপকর্ন বিক্রি করতো । একটু বড় হলেও বেশ পাকনা । এই বয়সেই সে বিড়ি খায় । বড়দের সাথে আড্ডা মারে ।

ওকে কেউ কিছু বলে না । ওর সাথে মিতুর একটু বেশি ভাব । কেমন একটা ভালো লাগা আছে ওর প্রতি । ওকে বলার পরে ও মোবাইলে রাখা ছবি দেখাইছিলো । মিতু একটু চোখ রেখেই বলেছিলো, ছি ! এসব মানুষ দেখে ? আমার কেমন ঘিন্না লাগছে ।

তারপর ছেলেটা একটু হেসে বলছিলো, আমার সাথে করবি এমন ? মিতু বলছিল, না, আমার ভয় করে । আজ মিতুর সেই ভয় কই গেলো ? আজকে মিতুর ভয় লাগছে না কেন । এই তো তিন চার মাস আগেও তার ভয় করতো । ঐ ছেলেটা তাকে আরো একটা কথা বলেছিলো, এই কাজ করলেই নাকি মেয়েদের বাচ্চা হয় । তাহলে ওর ও কি বাচ্চা হবে না কি ? কেমন ভয় ভয় করলো ।

আবার মনে হলো কই ভাবী ও মায়ের তো বাচ্চা হয় নি । আর ভাবতে পারলো না । ভাবতে ভালো লাগছে না আর । ইচ্ছেও করছে না । কাল যেতেই হবে ওকে ।

ওর আইসক্রিম খাওয়া চাই । অবশ্য ঐ ছেলেটা থাকলে ওকে জিজ্ঞাস করা যেত । কিন্তু ও নাই পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে । উঠে পড়লো মিতু । ডেরার সামনে এসে এদিক ওদিক তাকালো মিতু ।

কেউ নাই । দুপুর সময়ে কেউ থাকে না । কেমন খা খা করে সময়টা । একটু সময় নিয়ে ডেরার মধ্যে ঢুকে পড়লো সে । নতুন মানুষটার সাথে আরো একটা মানুষকে দেখে বুকটা ধ্বক করে উঠলো তার ।

একটা ভয়ের স্রোত নেমে গেলো শিড়দাড় বেয়ে । মধ্যরাত । মিতু ফেরে নি এ নিয়ে অনেক কথা বলার পর ক্লান্ত লোকগুলো চোখ বন্ধ করেছে । তবে দুজন মানুষের চোখে ঘুম নাই । ফিস ফিস করে কথা বলছে তারা, কি রে মরে গেল নাকি ? কি জানি কিছু বুঝতে পাচ্ছি না ।

রক্ত পড়া বন্ধ হইছে ? হুম, কিন্তু শরীর তো নড়ছে না । বুকে কান পেতে দেখতো উঠানামা করে কি না ? না তো । মরে বোধহয় গেছে । চল এক কাজ করি ফেলে দিয়ে আসি । তারপর যা হয় হবে ।

পুলিশ জেনে ঝামেলা করতে পারে । পুলিশের অনেক কাজ । কোথাকার কোন ফকিরন্নীর বেটি মরে আছে তা নিয়ে তাদের মাথা ঘামাবার সময় কই ? না চল এর চেয়ে একটা ভালো কাজ করা যায় । কী ? রেললাইনের উপর রেখে আসি । রেলগাড়ী গেলেই কেটে পড়ে থাকবে ।

তখন আর পুলিশ মাথা ঘামাবে না । হুম, ভালো বুদ্ধি । চল তাই করি । তিন টুকরা হয়ে যাওয়া মিতুর শরীরটার দিকে সবাই বিষ্ময় চোখে চেয়ে আছে । কারো মুখে কোন কথা নাই যেন বোবা হয়ে গেছে সবাই ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।