আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অভিসার : গল্প

গল্পের রাজত্বে বসবাস করছি আপাতত A Girl never pursues a man; but then, a mousetrap never pursues a mouse. - রনি বার্কার (১৯২৯-২০০৫), ব্রিটিশ অভিনেতা, লেখক এবং ব্যবসায়ী ১. ‘পিয়া বাসন্তী রে কাহে তু সাতায়ে আ যা....’ এটা অঞ্জনের বড় প্রিয় গান। এই গানটা যখন সিডিতে বাজে তখন গাড়ির ভেতরটা মুহূর্তে বদলে যায়। এমনিতে অঞ্জনের নতুন কেনা জি করোলার ভেতরে বসে এসি ছাড়লে বাইরের কিছুই টের পাওয়া যায় না। রাস্তায় যতো ট্রাফিক থাকুক, অন্য গাড়ির হৈ হুল্লুড় আর হর্ণের বাহাদূরী থাকুক অঞ্জনের গাড়ির ভেতরে তা পৌঁছায় না। ড্রাইভিংটা সে নিজেই করে।

নিজেকে বা গাড়িকে অন্য কারো হাতে দেয়ার পক্ষপাতি সে নয়। আর নিজে যেহেতু ড্রাইভিং করে তাই পুরো ব্যাপারটা সে আয়েশ করেই করার চেষ্টা করে। একমাস আগে নেয়া ২০১০-এর এই মডেলটার মধ্যে সব রকম আয়েশের সুবিধা এমনিতেই ছিলো, পাশাপাশি সিট কভার, পাপোশ, ডিভি প্লেয়ার, বোসের স্পিকার বাড়তি আয়োজন হিসাবে যোগ করে নিয়েছে সে। গাড়ি চালাতে চালাতে গান শোনা তার প্রিয় অভ্যাস। বাইরে যখন প্রবল গরম, ধূলা, ধোঁয়া আর শব্দদূষণ, তার গাড়ির ভেতরে তখন এসির শীতলতা আর সেমিক্লাসিকালের মুগ্ধতা।

এখন এই গানের সাথে সাথে সে হাত রাখে তনিমার হাতে। তনিমা’র শরীর থেকে শ্যানেল ফাইভের ঘ্রাণ এসে তার নাকে লাগে। গিয়ারটা বদল করতে গিয়ে অঞ্জন টের পায় আসলে তনিমার হাত নয়, তার এক হাত স্টিয়ারিংয়ে আরেক হাত গিয়ারে। আর যে ঘ্রাণটা এসে লাগছে তা তার গাড়ির ভেতরের এয়ারফ্রেশনারের। আসলে স্রেফ কল্পনায় সে তনিমার সঙ্গে লংড্রাইভে ভাসছিলো এতোক্ষণ।

এবং এখন সে বিশ্বরোডের জ্যামে বন্দী। তবে এই তো আর কয়েক মিনিট, ক্রসিংটা ছাড়লেই অঞ্জনের গাড়ি উড়াল দেবে উত্তরার পথে। ১৩ নম্বর সেক্টরে যাবে সে। সেখানে ৭ নম্বর রোডের একটি বাড়িতে তার জন্যে অপেক্ষা করছে তনিমা। একা।

আরমাত্র ১৫ বিশ মিনিটের মধ্যেই শুরু হবে অঞ্জন-তনিমা’র অভিসার, এক নতুন স্বপ্নের সূচনা। এই কয়েকটা মিনিটকেও এখন অনন্তকাল মনে হয় তার কাছে। সে মোবাইল বের করো। - কী করছো? - অপেক্ষা। -আমিও।

- আসছো না কেন? - ট্রাফিক জ্যাম। - কতদূর? - এই তো বিশ্বরোড পার হবো। - ঠিকানা মনে আছে তো? - চেষ্টা করলেও তো ভুলতে পারবো না। - দারোয়ানকে বলা আছে। গাড়ি সোজা ভেতরে ঢুকিয়ে দিও।

- ঠিক আছে, রাখি, সিগন্যাল ছাড়ছে। - সাবধানে এসো। - নো চিন্তা ডিয়ার, আই এম কামিং। - লাভ ইউ। - লাভ ইউ টু।

জ্যাম থেকে মুক্তি পাওয়া গেলো। এয়ারপোর্ট রোডে পরেই সে একটানে একশতে স্পিড তুলে দেয়, ক্রমে একশ দশ। গাড়িটা একটুও কাঁপে না, কোন গুঞ্জন নেই গাড়িতে, মনে মনে সে তৃপ্ত হয়। একেবেকে একটার পর একটা গাড়িকে পেছনে ফেলে সে এগিয়ে চলে বিজয়ি ভঙ্গিতে। জসিমউদ্দিন এসে আবার জ্যামে পড়ে।

উত্তরার এক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের কল্যাণে এই জ্যাম। অঞ্জনের মেজাজটাই বিগড়ে যায়। সে গানটা বন্ধ করে। মিররে নিজের চেহারাটা দেখে। ব্যাক ব্রাশ ঠিক আছে, ক্লিন সেভ, জলপাই রঙা পোলো শার্ট, ভালই লাগছে নিজেকে।

এখন তনিমার পছন্দ হলেই হয়। সে আবার তনিমাকে ফোন দেয়। - কী হলো? - আবার জ্যামে পড়েছি, জসিমউদ্দিনে। - ওই স্কুলটা ছুটি হয়েছে নিশ্চই। - হ্যাঁ, রাগ লাগছে।

- রাগ করো না প্লিজ, কয়েক মিনিটেই ছাড়া পেয়ে যাবে। - তুমি নীল শাড়ি পড়েছো তো? - আসলেই দেখতে পাবে। - আসবো কী করে, এতো জ্যাম! - একটু ধৈর্য ধরো। সবুরে মেওয়া ফলে। - মেওয়া ফলবে তো? - এসেই দেখো কী মেওয়া খাওয়াই।

কেমন একটা শিহরণ খেলে যায় অঞ্জনের শরীরে। আরও পনের বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় প্রথম যেদিন নিশাকে চুমু খেয়েছিলো ঠিক এমনই শিহরণ লেগেছিলো। নিশাকে আর বিয়ে করা হয়নি তার। বিয়ে হয়েছিলো সুস্মিতার সাথে। সুস্মিতাকে বিয়ে করা অবশ্যই ভুল হয়েছে তার।

এক কথায় সুস্মিতা বড় বেশি পুরুষালি। মেয়েলি কোন আবদার, অভিমান, আহ্লাদি, ন্যাকামি, ঢংÑই নেই তার মধ্যে। নিজেকে সমপর্ণ নয়, প্রকাশেই তার আনন্দ। সারাদিন পর অঞ্জন যখন ঘরে ফেরে তখন স্ত্রী নামের কোন মুখ দরজা খোলে না, কেননা, সুস্মিতা তখনও তার টিভি চ্যানেলে মেকআপ নেয়া নিয়ে ব্যস্ত। আটটার কি নয়টার সংবাদ পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে সে।

আর ক্লান্ত বিরক্ত অঞ্জন স্রেফ স্বপ্ন দেখে, কেউ একজন একদিন ঘরে ফিরলে এক গ্লাস ঠাণ্ডা লেবুর শরবত হাতে তুলে দেবে, দরজা খুলে দিয়ে শুধু বলবে, ‘এ কি এ তো ঘেশে গেছো তুমি!’ হা, স্বপ্ন! - কী হলো, চুপ কেন? - না, ভাবছি। - গাড়ি চালাতে চালাতে এতো কিছু ভেবো না মিস্টার ভাবুক, পরে না একটা দূর্ঘটনা হয়। - কী হবে দূর্ঘটনা হলে? - যাও, যতো সব বাজে কথা! কী ভাবছিলে? - সুস্মিতার কথা। - ও। - রাগ করলে? - রাগ করবো কেন? বউয়ের কথা তো ভাবতেই পারো।

দেখো অঞ্জন, তোমাকে এখনও বলছি, তোমার মধ্যে বিন্দু মাত্র দ্বিধা থাকলেও এসো না। এখই জসিমউদ্দিন রোড থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে ফেলো। - তোমার মধ্যে কোন দ্বিধা নেই? - না। - কেন? - কারণটা তুমি জানো। - তবু তোমার মুখে শুনতে চাই।

- কারণ আমি তোমাকে ভালবাসি। তাই তোমাকে নিয়ে আমার কোন দ্বিধা নেই। সত্যিই তো ভালবাসলে আর দ্বিধা কিসের? অঞ্জন একটু লজ্জাই পায়। মেয়ে হয়েও তনিমার মনে কোন দ্বিধা নেই, তবে তার মনে কেন এতো দ্বিধা! সে কি তবে তনিমাকে নিঃস্বার্থ ভালবাসতে পারেনি? কিন্তু ভাল যদি না-ই বাসবে তাহলে কেন এই ছুটে চলা! ক’দিনেরই বা পরিচয় তনিমার সাথে? এখনও মাস পুরা হয়নি ফেসবুকের মাধ্যমে তনিমার সঙ্গে পরিচয়। তারপর মোবাইলে আলাপ।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন Ñ কথা আর কথা। এরমধ্যেই তনিমার আদ্যোপান্ত জেনে গেছে অঞ্জন, অঞ্জনের সব কিছুও জানা হয়ে গেছে তনিমার। তনিমার স্বামী থাকে ইতালিতে, সেখানেই তার তিনটা দোকান আছে। তনিমা এখানে উত্তরার ফ্লাটে অসুস্থ শ্বাশুড়িকে নিয়ে পড়ে আছে দু’বছর হলো। স্বামী কোন এক বিচিত্র কারণে তাকে ইতালীতে নিতে চায় না, তনিমা বলে, ‘নিশ্চয় ইতালিতে ওর কেউ আছে, কিংবা কে জানে, সে সব কিছু নয়, বুড়ো মাকে দেখার একটা পারমানেন্ট দাসী পেয়ে ও নিশ্চিন্তে আছে।

হয়তো ওর মা’র দেখাশোনার জন্যেই আমাকে বিয়ে করেছে। ’ আজ বুড়ি বাসায় নেই, ছোট মেয়ের বাড়িতে গেছে গতকাল রাতে। এই সুযোগেই তাকে বাসায় ডেকেছে তনিমা। ‘ওই প্লাস্টিক বামে যা’- হেলপারের কথায় হুশ ফেরে অঞ্জনের। জ্যাম ছেড়ে দিয়েছে।

সে মোবাইলটা রেখে গাড়ি টান দেয়। তিন মিনিটেই রবীন্দ্রস্মরণী পার হয়। রবীন্দ্রস্মরণী থেকে ভেতরে ঢুকে ১৩ নম্বর সেক্টরে চলে আসে, অবলীলায় ৭ নম্বর রোডটাও খুঁজে নেয় সে। রোডের মাথায় জিজ্ঞেস করতেই দোকানদার ‘সোনার হরিণ’ নামের বাড়িটা দেখিয়ে দেয়। গাড়ি গেটে আসতেই অঞ্জনের বুকটা কেমন ধুকপুক করে ওঠে।

এখনও কোথায় যেন তার ভেতরে একটা দ্বিধা কাজ করছে। সুস্মিতা যদি জানতে পারে Ñ কেমন এক ভয়ের অনুভূতি তার গলার কাছে আটকে যায়! কিন্তু এই গেট থেকে কি সে ফেরত যাবে? নিজের অজান্তেই সে হর্ন দেয়। গেট খুলে যায়। দারোয়ান কায়দা করে সালাম দেয়। এগিয়ে এসে গাড়ির দরজা খুলে দেয়।

- স্যার দুইতলায় চইলা যান। দোতলার প্রতিটি সিঁড়িতে অঞ্জন থেমে থেমে ওঠে। সে জানে, এই সিঁড়ির শেষ মাথাতেই তার জন্যে অপেক্ষা করছে ভিন্ন এক সুখ, অন্য এক জীবন। গাড়ির শব্দেই দরজা খুলে দাঁড়িয়েছিলো তনিমা। সে একটু নার্ভাস হাসি দেয়।

- এসো, ভেতরে এসো। অঞ্জন শরীরের সবটা ভার সোফায় এলিয়ে দেয়। হঠাৎ করে তার নিজের শরীরটাকে খুব ভারী আর অচেনা মনে হয়। তার ইচ্ছে করছে এক্ষুণি ছুটে গিয়ে তনিমাকে জড়িয়ে ধরে, কিন্তু হারামী দ্বিধাটা তাকে সহজ হতে দেয় না। তনিমা কিন্তু খুব সহজেই পাশে এসে বসে।

মুঠোর মধ্যে হাতটা নেয়। - কী খোকাবাবু, নার্ভাস লাগছে? - নাহ্! - এখানে বসবে, না ভেতরে যাবে? অঞ্জন কিছু বলে না। তনিমাই তাকে ছোট বাচ্চার মতো হাতে ধরে বেডরুমে নিয়ে যায়। চারিদিকে ভারী সোনালী পর্দা, বেডকভারটাও সোনালী। কিন্তু ঘরে কোন আলো জ্বালা নেই।

দিনের বেলায়ও একটা আবছায়া ভাব। ঘরটার সাজসজ্জায় আভিজাত্য, জৌলুস আর গাম্ভীর্য এনে দিয়েছে টার্কিশ কার্পেট আর কোণায় রাখা ইতালিয়ান মার্বেলের নগ্ন নারী মূর্তিটি। - আলো জ্বালবো? - না, থাক। - নাও, জুসটুকু খাও। - কি এটা? - ব্লাডি মেরি নয়, তরমুজের জুস, খাও শরীরটা ঠাণ্ডা হবে।

আরাম করে বিছানায় বসো, আমি আসছি। - তুমি কোথায় যাচ্ছো? - আসছি বাবা। তনিমা বের হয়ে যেতেই অঞ্জন বুঝতে পারে, সে বোকার মতো আচরণ করছে, নিশ্চয়ই তাকে খুব নার্ভাস আর কেলাস দেখাচ্ছে। সে নিজেকে বকা দেয়, এ সব কী হচ্ছে অঞ্জন মিয়া! তুমি তো ইন্টারমিডিয়েটে পড়া কচি খোকা নও, এতো ভয় কিসের! এই হাতের কাছের নারীটি কিছুক্ষণের মধ্যেই তোমার হবে। এতে তো তোমার কোন দোষ নেই? তুমি তো তাকে খুঁজে বের করোনি, সে-ই তোমাকে ফেসবুকে ফ্রেণ্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলো, বলেছিলো, আপনার নামটা সুন্দর? মানে কি এই নামের? তুমি বলেছিলে, ‘অঞ্জন’ মানে কাজল, কালো।

আমি তো কালো তাই এমন নাম... - বাসা চিনতে অসুবিধা হয়নি তো? - না, একদম না। তনিমা একদম গা ঘেষে বসে। -কি? - সুন্দর! তুমি ছবির চেয়েও সুন্দর! - সত্যি! - একদম সত্যি! তনিমা এবার অঞ্জনের বুকে মুখ ঘষে। হঠাৎ আবেগে তার গলা জড়িয়ে আসে। অঞ্জনকে জড়িয়ে ধরে সে।

- কেন, তোমার সাথে আমার আরো আগে পরিচয় হলো না? এ প্রশ্নের কোন উত্তর অঞ্জনের কাছে নেই। সে একটু অসহায় বোধ করে। তনিমা তার মাথাটা বুকের মধ্যে টেনে নেয়। তনিমার বুকে কী মিষ্টি ঘ্রাণ! অঞ্জন দিশেহারা হয়ে যায়। সে ক্রমশ তনিমার বুকের ভাঁজে নাক ডুবিয়ে দেয়।

গরম নিশ্বাসের হাওয়া লাগে তনিমার বুকে। বিশাল পদ্মকুড়ির মতো বুক জোড়া ফুটে উঠতে থাকে, ঘ্রাণ বিলুতে থাকে। দুঁঠোট দিয়ে তনিমাকে চেপে ধরে অঞ্জন। এক অবারিতে চুম্বনে ছিঁড়ে দিতে চায় সব দ্বিধা। তনিমার জিভের স্বাদ এখন অঞ্জনের ঠোঁটের ভেতরে।

দুজোড়া ঠোঁট, হাত, পা আর দুটো শরীর ক্রমশ এক হতে থাকে। একে অপরকে টানতে টানতে, কাছে আসতে আসতে, এক চূড়ান্তবিন্দুতে মিলে যায় তারা। তারা যেন দুটো বাচ্চা, যেন দুটো চিপসের প্যাকেট ছিঁড়ে এক গ্রাসে সবটুকু চিপস খেয়ে নিতে চায় যতো দ্রুত সম্ভব। রাস্তার পাশের গাড়ির হর্ন, পাশের বাড়ির বেড়ালের ডাক, ফেরিঅলার হাক, কিছুই আর তাদের স্পর্শ করে না। তনিমা আর অঞ্জন তখন নিজেদের খুঁড়ে আরও ভেতরে যাওয়ার জন্যে তৈরি।

- বাহ, ভালই তো জইমা উঠিছে অভিসার! ছিটকে দূরে সরে যায় অঞ্জন। বিশাল দেহী লোকটা একদম বিছানা ঘেষে দাঁড়ানো। মাথা জুড়ে টাক, লাল গেঞ্জি ফেটে বেরিয়ে আসছে ভূড়িটা। কিছু মানুষ আছে যাদের দেখলেই বোঝা যায় এরা ভাল মানুষ নয়, এ লোকটা তেমনি। কিন্তু তনিমার মধ্যে কোন বিকার নেই।

সে ধীরে সুস্থে নীল শাড়ির আচল গুটিয়ে নেয়। ব্লাউজের হুকগুলো একটা একটা করে লাগায়। অঞ্জনের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলে দেয়, কোথাও একটা ঝামেলা হয়ে গেছে! - হোয়াট ইজ দিস, হোয়াটস গোয়িং অন! - বিপদে পইড়লে খাস বাংলায় বাপ-মারে ডাকা উচিত, ইংরেজি ঝাড়লে কাম হবি না নে। - তনিমা, এই লোকটা কে? কী হচ্ছে এখানে! - বসেন অঞ্জন সাহেব, তড়পাইয়েন না। আমি আপনেরে সব ওয়াটারের মতো ক্লিয়ার কইরে বুঝায় দিতেছি।

এই যে আমার হাতের ভিডিও ক্যামেরাটা দেখতিছেন এরমইধ্যে আপনেদের এতোক্ষণের সিনেমাটা পুরাপুরি উইঠা গেছে। - এ সবের মানে কি? জানেন আমি কে? - জানি, জানি, সব না-জাইনা এইসব কাজ করা যায় না। আপনের চৌদ্দগুষ্ঠির খুঁজ খবর হাতে নিয়াই না আমরা ফিল্ডে নাইমিছি! - তনিমা, তুমি কিছু বলছো না, তারমানে, এই সবই কি ট্র্যাপ! তনিমা, ইউ ডোন্ট লাভ মি? তুমি আমাকে যা বলেছো... - তার সবই মিথ্যা। ওর কুন দোষ নাই। ওই হইলো গিয়া স্রেফ একখান টোপ।

আপনেরগোর মতো বড় বড় মাছ ধরতে এমন সুন্দর সুন্দর টোপ আমাগো লাগে। নিজেকে এতোটা বোকা, পরাজিত আর অসহায় কখনোই লাগেনি অঞ্জনের। তার থুতনিটা নত হয়ে গলায় গিয়ে ঠেকে। বিরাট এক দীর্ঘশ্বাস বুক ঠেলে বেরিয়ে আসে। - কিন্তু তনিমা, তুমি আমাকে বললে আমি এমনিতে যতো টাকা চাও দিতাম, আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম, ভালবাসতে শুরু করেছিলাম।

তনিমা কোন কথাই বলে না। একটু আগের উষ্ণ তনিমাকে এখন পাশে রাখে মার্বেলের মূর্তিটার মতোই নিথর আর শীতল মনে হয়। এক মহাজাগতিক উদাসীনতায় সে নিজের পায়ের রাঙা নখগুলোতে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে। - টেকা পয়সা কেমন নিয়া আসছেন সাথে? বড় লুকের বউয়ের সাথে ডেটিং মারতে আসছেন নিশ্চয়ই ভারী হয়া আসছেন। অঞ্জনের মনে পড়ে তাড়াহুড়া আর উত্তেজনায় তনিমার জন্যে কেনা গুচি’র পারফিউমটা গাড়িতেই রয়ে গেছে।

খুব শখ করে কিনেছিলো। কিন্তু এখন আর এ সব ভেবে লাভ কি! সে পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করে দেয়। - এখানে হাজার দশেক আছে। আশা করি ব্যাংকের কার্ড আর কাগজপত্রগুলো ফেরত দেবেন? - না, কার্ডগুলার সাথে পিন নাম্বারটাও দিয়া দেন, টাকা উঠায়া নিয়া আসি। অঞ্জন মিইয়ে যায়।

এতোটা ভরাডুবি সে কল্পনা করেনি। হঠাৎ দীর্ঘদেহি লোক বর্জ্রপাতের মতো হা হা হেসে ওঠে। - ডরাইছেন? না, ডরাইয়েন না। নগদ যা আছে, তা-ই নিমু। অইসব ক্রেডিট কার্ড, এটিএম বুথের ঝামেলায় যামু না।

আমরা আপনেগোর মতো না, যেইটে সামাল দিতে পারি না সেইটে করি না। তয়, আপনের করোলাটা রাইখা যান। - জ্বি! - জ্বি, গাড়িটা আমাগোর কাজে লাগবো। - দেখুন, আপনার টাকা যা লাগছে আমি দিচ্ছি, আমার এইচএসবিসির একাউন্ট থেকে এখনও লাখ দেড়েক উঠাতে পারবো, গাড়িটা দয়া করে রাখবেন না। - আপনের পরামর্শ চাইতেছে কোন হালায়? লোকটার উদ্ধত ভঙ্গি দেখে অঞ্জনের রাগ চড়ে যায়।

সেও বেশ চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, গাড়িটা আপনি হজম করতে পারবেন না। আমার সম্বন্ধি পুলিশের এসপি। কিছু বোঝার আগেই ঠাস করে একটা চড় পড়ে অঞ্জনের গালে। - শালা, বানচোত, আমারে ফাপড় দেস! তুই চাস তোর এই ভিডিওটা মার্কেটে ছাইড়া দেই নাকি তোর বউ সুস্মিতার কাছে পাঠায়া দেই... আমি কি হজম করতে পারমু তার চিন্তা করিস না, বরং নিজের হজম শক্তি নিয়া ভাব। যা, সোজা বাইর হয়া যা।

অপমানে, যন্ত্রণায়, ঘৃণায় অঞ্জনের চোখে পানি এসে যায়। তনিমার দিকে তাকায় সে। কিন্তু তনিমা যেন পাথরের মূর্তি, কিচ্ছু দেখছে না, কিচ্ছু শুনছে না। - তনিমা, আমি, আমি চলে যাবো... - যা না হিরো, আবার নাটক করোস ক্যা! সোজা ভাগ। ও খাড়া, মোবাইলটা দিয়া যা।

বাহবা, নকিয়া, এন সিরিজি! বেশ! প্রেমের রাজা পরকিয়া সেটের রাজা নকিয়া, যা ভাগ। মাথা নিচু করে অঞ্জন বেরিয়ে যেতে নেয়। লোকটা আবার পিছু ডাকে। - খাড়া, এই নে, দুইশ টাকা রাখ, ট্যাক্সি কইরা বাড়িত যা, তোরা তো আবার ফার্মের মুরগি গাড়ি ছাড়া চলতে পারোস না। ২. যখন ঘরে ফেরে তখন অঞ্জনের হাত-পা কাঁপছে, রাগে না ভয়ে তা বলা সম্ভব না।

পুরোটা রাস্তা সে ভেবেছে, সুস্মিতাকে কি বলবে। মনে মনে একটা গল্পের ছক কেটে ফেলেছে সে। অন্যদিন এ সময় সুস্মিতা বাসায় থাকে না, কিন্তু বাইরে থেকে বেডরুমের আলো দেখেই সে বুঝতে পারে সুস্মিতা বাসায় আছে। কলিং বেল শুনে সেই দরজা খুলে দেয়। তাকে দেখেই সুস্মিতা বুঝেছে কোথাও একটা গণ্ডগোল হয়েছে।

- কী ব্যাপার তোমার মোবাইল কোথায়? এতোবার ফোন দিচ্ছি কোন জবাব নেই! কী হলো কথা বলছো না কেন? - সুস্মিতা আমাকে ছিনতাইকারী ধরেছিলো। - কি? কোথায়? কোন জায়গায়? কিভাবে? দাঁড়া, আমি একখুনি ভাইজানকে খবর দিচ্ছি। - একটু দম নিতে দাও আগে। - আসো, ভেতরে আসো। - আমাকে একটু ঠাণ্ডা পানি দাও।

সুস্মিতা ঠাণ্ডা পানি আনতে আনতে অঞ্জন ঠাণ্ডা মাথায় গল্পটা আবার সাজিয়ে নেয়। এখন তাকে খুব নিঁখুত অভিনয় করে যেতে হবে। পানি হাতে দিতে দিতে সুস্মিতা জিজ্ঞেস করে, তোমাকে মারেটারেনি তো? - না, গাড়িটা নিয়ে গেছে। - গাড়ি নিয়ে গেছে! কী বলছো তুমি! নতুন কেনা গাড়ি! - হ্যাঁ। কিচ্ছু করার ছিলো না আমার।

- তুমি কিছু করতেও পারবে না, যা করার আমিই করবো, আগে বলো, কোথায় কিভাবে ঘটনাটা ঘটলো? - আমি একটু মিরপুরের দিকে গিয়েছিলাম, একটা মিটিং ছিলো। খুব পিপাসা লাগছিলো, একটা ডাব খেলাম। ডাবটা খেয়ে গাড়িতে ওঠার পরই দেখি কেমন যেন লাগছে। পরে বুঝেছি ডাবটায় কিছু একটা মেশানো ছিলো। স্টিয়ারিং হাত রাখতেই পেছন থেকে কেউ একজন পেটের কাছে ছুরি ধরে বললো, কোন আওয়াজ করবেন না, যেভাবে বলছি সেভাবে গাড়ি চালান।

পাশের সিটেও একজন ওঠে বসলো। - কি সর্বনাশ! তারপর? - তারপর ওদের কথা মতো নানা অলিগলি পেরিয়ে একটা নির্জন পুরনো বাড়ির সামনে এলাম। ওরা আমাকে মানিব্যাগ দিতে বললো। দিলাম। মোবাইল দিতে বললো, দিলাম।

তারপর গাড়ি থেকে নেমে যেতে বললো। - দিনে দুপুরে এমন ঘটনা! এটা কি মগের মুল্লুক হয়ে গেলো! দাঁড়াও এক্ষুণি ভাইজানকে ফোন করছি। - ওরা কিন্তু থানা-পুলিশ করতে মানা করেছে। বলেছে, প্রয়োজনে আমাকে বাসায় এসে গুলি করবে? - এতো সোজা! আমি ওদেরকে ধরিয়ে ছাড়বো। ভাইজান আছে কি করতে, ওদেরকে ধরতেই হবে! পুলিশ চাইলে ঠিকই ধরতে পারবে।

এটা অবশ্য অঞ্জন জানে, এদেশে পুলিশ চাইলে সব অপরাধীকেই ধরতে পারে। কিন্তু কাদের ধরবে পুলিশ, অঞ্জন তো স্রেফ একটা গল্প ফেদেছে। এই উল্টোপাল্টা গল্প তাকে বাঁচাবে। নইতে যে তার গোপন অভিসারের কাহিনীও বের হয়ে যাবে। তাই বিকালে সুস্মিতার বড় ভাই এলেও তাকে সব ভুল ইনফরমেশন দিয়েছি অঞ্জন।

সে নিশ্চিত যে তার দেয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে কাউকেই ধরা যাবে না। বরং ওদেরকে সে নিজেই ধরবে সিদ্ধান্ত নেয়। পরদিন সকালে অঞ্জন আবার সেই ‘সোনার হরিন’-এ গিয়ে হাজির হয়। কিন্তু আজ গেটে দেখা যায় অন্য দারোয়ান। - কি চাই? - এটা তনিমাদের বাসা না? - জ্বি না, এইটা সোনার হরিন, শুটিং হাউজ।

অঞ্জন ফ্যালফ্যাল করে দারোয়ানের দিকে তাকিয়ে থাকি। মুহূর্তেই সে বুঝতে পারে, এরা তার ধরাছোঁয়ার অনেক উর্দ্ধে। -কী অইলো ভাই? - না, কিছু না। আচ্ছা, কাল কি এখানে কেউ শুটিং করেছে? - আর কইয়েন না, কালকে ঝিলমিল ভিডিও নামে কারা নাকি ভাড়া নিছিলো, ভাড়ার টাকা না দিয়াই ফুটছে। কেন, আপনে তাগোরে চেনেন? - না, আমাকে আসলে তনিমা বলে একজন কাল আসতে বলেছিলো আমি আসতে পারিনি, তাই ভাবলাম আজ কথা বলে যাই।

- ম্যানেজারের সাথে কথা কইবেন? - না। দারোয়ানকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে অঞ্জন ফিরে যায়। ফেরার পথে বারবার মার্বেলের নারী মূর্তিটার কথা মনে পড়ে তার। কে জানে কোথায় যেন ঐ মূর্তিটার সাথে তনিমার একটা মিল আছে!  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।