আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শৈশবের হিলের চড় খাওয়া আর কৈশোরের প্রতিক্রিয়া।

দেশটা আমাদের। এর জন্য ভাল কিছু করতে হলে আমাদেরই করতে হবে। Mail:rabiul@gmail.com আমি বরাবরই ঠান্ডা স্বভাবের মানুষ। ঝামেলা সবসময়ই এড়িয়ে চলি। মারামারিকে প্রচন্ডরকম ভয় করি।

কোন কিছু নিয়ে রাগ করলেও বেশীক্ষণ সে রাগ থাকে না কিন্ত একটা ঘটনা নিয়ে আজো আমার ভিতরে মারাত্নক রাগ কাজ করে। আজো আমি কোনভাবেই ওই ঘটনাকে ভূলতে পারি না। সব স্পষ্টই মনে পড়ে আর মনে পড়লেই রাগ সামলানো কষ্টকর হয়ে পড়ে। ওই ঘটনাটাই আজ আপনাদের সাথে শেয়ার করব। ঘটনাটা ১৯৮৬ সালে আমার ২য় শেণীতে পড়াকালীন সময়ের।

আমরা থাকতাম মতিঝিল এ জি বি কলোনীতে। আমাদের পাশেই মতিঝিল বাংলাদেশ ব্যংক কলোনী। আমাদের খালাতো ভাইরা থাকতো সেখানে। ছোটকালে আমরা আমাদের কলোনী থেকে ঈদের সময়গুলোতে খালাতো ভাইদের সাথে ঈদের আনন্দ করতাম। প্রতি বছরই কোরবানীর ঈদ আসলে আমরা ঈদের পরের দিন গরুর রশি দিয়ে সিড়ির মুখে দোলনা বানিয়ে খেলতাম।

সে বছরও কোরবানীর ঈদের পরের দিন বিকেল বেলায় আমরা খালাতো ভাইদের বিল্ডিংয়ের সিড়ির নিচে গরুর রশি ঝুলিয়ে দোলনা বানিয়ে মহা সুখে দোল খাচ্ছিলাম। ব্যংক কলোনীর প্রতিটা সিড়ি অনেক চওড়া হওয়াতে সিড়ির মাঝে আমরা দোল খেলেও দোলনার যে কোন পাশ দিয়ে অনায়াসে দুইজন মানুষ ভিতরে যেতে কোন সমস্যা হতো না। খালা তো ভাই আর আমি মিলে দোল খাচ্ছি। একজন বসি আর একজন পিছন দিক দিয়ে ধাক্কা দেই। বিল্ডিংয়ের লোকজন আমাদের পাশ দিয়েই যাওয়া আসা করেন।

এই সময়ই তিন জন বড় মেয়ে আসে। তাদের একজনের নাম মিস মিলি(আসল নাম ব্যবহার করলাম না। আসল নামও অনেক পরে জ়েনে ছিলাম। তাদের বড় আপু বলতেও আমার আপত্তি আছে। )ঈদের পরের দিন হওয়াতে খুব সেজ়ে এসেছিলেন।

উনি তখন ১০ম শেনীতে পড়তেন। (সেটাও পরে হিসেব করে বের করেছি। )আমি তখন দোল খাচ্ছিলাম আর খালাতো ভাই আমাকে ধাক্কা দিচ্ছিল। খালাতো ভাই তখন ১ম শেণীতে পড়ত। উনি আমাদের এসেই বল্লেন ‘এই ছেলে দোলনা থামাও।

আমরা ভিতরে যাব’। আমি বল্লাম দোলনা কেন থামাবো। আপনারা বিল্ডিংয়ের ভিতরে যেতে চাইলে পাশ দিয়েই তো যেতে পারেন। । তাছাড়া উনারা এই বিল্ডিংয়েরও কেউ নন।

বিল্ডিংয়ের কেঊ হলে খালতো ভাইকে নাম ধরেই ডাকতো আর খালাতো ভাইও তাদের সাথে সাথেই চিনতে পারতো। উনারা বিল্ডিংয়ে এসেছিলেন উনাদের আর এক বান্ধবীর বাসায়। মিস মিলি আবারও বল্লেন দোলনা থামাতে। আরো বল্লেন উনারা ভেতরে যাবেন। যদি দোলনা না থামাই আর আমি যদি উনাদের কারো গায়ের সাথে লাগি তাহলে মারবেন।

আমি বল্লাম দোলনা থামাবো না। আর আপনাদের গায়ের সাথে কোন ভাবেই লাগবেনা। আপনারা পাশ দিয়ে ভেতরে যান। আচ্ছা ঠিক আছে বলে মুখটাকে শক্ত করে উনি সিড়ির মাঝ বরাবরই এগিয়ে আসলেন মানে সরাসরিই আমার দিকে এগিয়ে এলেন। আমার খালাতো ভাই আমাকে পিছন দিক থেকে ধাক্কা দেয়াতে আমিও সামনের দিকেই যাচ্ছি।

ঊনিও আমার দিকে হঠাত এগিয়ে আসাতে সেকেন্ডেই আমার সাথে উনার ধাক্কা লেগে গেল। সামলানোর কোন উপায়ই ছিলনা। আমিতো সাথে সাথে বোকার মত দোলনা থেকে নেমে দাড়িয়ে গেলাম। একটু ভয় পেয়ে গেলাম। উনি তখন বল্লেন এখন ধাক্কা লাগলো কেমনে?ধাক্কা দিলে কেন?উনি তখন পায়ের হিলের সেন্ডেল খুলে আমাকে গালে প্রচন্ড একটা চড় বসিয়ে দিলেন।

চটাস!!!!!আমারতো পুরো মাথা ঘুরে উঠল। কানের ভিতর আওয়াজটা তখন খালি প্রতিধনিত হচ্ছিল। লজ্জায় আর অপমানে বিশ্রী অবস্থা। মেয়েটা অনেক বড় হওয়াতে শক্তিতেও পারব না। লজ্জায় কাদতেও পারছি না।

হিলের চড় যে এত ব্যথা সেটা আগে জানতাম না। উনিও তখন আরো কি কি বলে ঊনার বান্ধবীরাসহ হেটে সিড়ির ভিতরে চলে গেলেন। শুধু দেখলাম আমার লাল হয়ে যাওয়া মুখ দেখে উনার বান্ধবীরা হেসে দিল। আমাকে আর কি কি বল্লেন আমার আর কিছুই খেয়াল ছিলনা। আমি বোকার মত মেয়েটার দিকে চেয়ে রইলাম।

চেহারায় বিন্দুমাত্র মমতা নেই। উনারা চলে যাওয়ার পর আর খালার বাসায় গেলাম না। যদিও খালাতো ভাইরা ওই বিল্ডিংয়েরই এক তলায় থাকতো। সিড়ির এক বারে পাশেই উনাদের বাসা কিন্তু খালাকে কি বিচার দেব উল্টো দেখা যাবে মান ইজ্জত আরো যাবে। কালাতো ভাইকে বল্লাম মেয়ে তাকে চিনে কিনা।

খালাতো ভাই বল্ল চিনে। তাদের কয়েক বিল্ডিংয়ের পরেই ওদের বাসা। সোজা বাসায় চলে গেলাম। আম্মাকে পেয়ে দারুন কান্না শুরু করলাম। আম্মা ঘটনা শুনতে চাইলেও বলতে পারছিলাম না।

কান্না একটু থামিয়ে আম্মাকে ঘটনা বল্লাম। আম্মা প্রথমে উল্টা আমাকে দোষ দেয়া শুরু করলেন। কেন আমি রাস্তা পেরিয়ে ব্যংক কলোনী গেলাম। গিয়েছি যখন দোষটা আমারই। ভাল হয়েছে মেরেছে ইত্যাদী অনেক বকা দেয়া সুরু করলেন।

কিন্তু আমি কান্না থামিয়ে এবার রেগে গেলে আম্মা বল্ল তুই কি মেয়ে কে চিনিস। কোথায় থাকে জানিস?বল্লাম না চিনিনা। তবে খালাতো ভাই চিনে। তারপর আম্মাকে বল্লাম আমার সাথে এখনি চল। ওই মেয়েকে মারবো।

তখন সন্ধ্যা বেলা। আম্মা বল্ল এখন যাওয়া যাবে না,কাল সকালে যাব। আমারতো এই কথা শুনে রাগ আরো বেড়ে গেল। রাগে বিছানা বালিশ সব এলোমেলো করে ছুড়ে ফেল্লাম। ঘরের কাচের গ্লাস টেবিলের উপর যা পেলাম তাই আছড়িয়ে ভাংলাম।

খেলাম পিটুনি। রাগ গেলো আরো বেড়ে। মনটা চাইছিল দেয়ালে মাথা ঠুকি,কখনো মন চাইছিল চার তলা থেকেই লাফ দিয়ে পড়ি। আমাদের বাসার ফ্লাট ছিল চার তলাতে। এখন ভাবলে ভয় লাগে কি সব চিন্তা করছিলাম।

রাতে আব্বা ঘরের অবস্থা দেখে দিল বেত দিয়ে প্রচন্ড দিল মার। শরীররের আনেক জায়গায় কেটে গেল। রাগ আরো বেড়ে গেল। আমাদের বাসায় মুক্তিযুদ্ধের একটা মোটা অনেক ছবিযুক্ত বই ছিল। ছোটবেলায় খুব দেখতাম।

ওইটাতে একটা ছবি ছিল পাকিস্তানী সৈন্যরা একজন মুক্তি্যোদ্ধার পিঠে বেয়নেট দিয়ে কেটে লবণ মরিচ লাগিয়ে দিয়েছিল। জাদুঘরেও ছবিটা আছে। কাটা জায়গায় লবণ লাগালে নাকি খুব যন্ত্রণা হয় আব্বা তখন বলে ছিল। আমি এত মার খাওয়ার পরেও মা বাবা কারো মধ্যই মমতা না পেয়ে আম্মার সামনেই রান্না ঘরে যেয়ে লবণ নিয়ে খুব স্বভাবিকভাবে শরীরের কাটা জায়গায় লবণ লাগিয়ে দিলাম। আমার তখন কিছুই মনে হচ্ছিল না।

আম্মা আর সহ্য করতে পারেন নি। সাথে সাথে বাথরুমে নিয়ে সব ধুইয়ে আদর করা শুরু করলেন। কোলে নিলেন। আমি আদর পেয়ে কান্না সুরু করলাম। তখনি কাটা জায়গাগুলোতে প্রচন্ড জ্বলুনী টের পেলাম।

রাতে কাদতে কাদতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। পরের দিন প্রচন্ড জর আসলো শরীরে। তখন ডাঃ এত ছিল না। পীরজংগী মাজারে রেলের হাসপাতালের একজন ডাঃ বসতেন। ঈদের পরে হওয়াতে ঊনাকে চেম্বারে না পেয়ে আব্বা ঊনার বাসায় যেয়ে ডাঃ কে বাসায় নিয়ে আসলেন।

উনি সব ঘটনা শুনে ঔষধ দিয়ে চলে গেলেন। প্রচন্ড জ্বরে কয়েকদিন ঘোরের মধ্য ছিলাম। এর ভিতরে আমার খালা আসলেন বাসায় আমাকে দেখতে। খালাকে দেখে আরেক দফা কান্না। দীর্ঘ দুই বছর আর ব্যংক কলোনী যাওয়া হয়নি।

তারপর আবার আস্তে আস্তে মাঝে মাঝে যাওয়া শুরু করলাম। ঘটনা কোন ভাবেই ভূলতে পারি নাই। মাঝে মাঝে বিকেলে ওই মেয়েকে দেখতাম আর দেখলেই আমার মাথায় রাগ ঊঠে যেত। মনে হত তাকে কষে একটা হিলের চড় মারি। যদিও ওই মেয়ে ঘটনা ভূলে গেছে।

আমি শুধু ভাবতাম একদিন যদি একটা সুযোগ পেতাম। যতবারই ওই মেয়েকে দেখতাম ততবারই আমার এই সব মনে হত। যদিও আমার মা বাবা বা খালাতো ভাই কেঊই আমার মনের এই অবস্থার কথা বা ভাবনার কথা কখনো জানতো না। ছোটবেলা থেকেই বুঝতাম মেয়েরা আমাদের থেকে আলাদা কিছু কিন্তু আসলে পার্থক্য কই সেটা বুঝেছি এস এস সি দেয়ার পর। পড়ায় পড়েছি তারা আলাদা কিন্তু বুঝি নাই।

বুঝার চেষ্টাটাও করি নাই। তার কারণও ছিল। আমাদের বোন নেই। বাসায় টিভি ছিল না কোন কালে। সিনেমা দেখার তাই সুযোগ হয় নি।

কোন বাজে বন্ধুও ছিল না। আর আমি যে ব্যপারটা বুঝিনা সেটা তো কেঊ জানতো না ,কাঊকে কোন দিন জিজ্ঞাসাও করি নাই। আর এ কারণেই মেয়েটাকে মারার চিন্তা মাথায় ঘুরত। তখন আমি ১০ম শেণীতে পড়ি। রোজার ঈদের পরের দিন গেলাম দুপুর বেলায় গেলাম খালার বাসায়।

ঈদের পরের দিন হওয়াতে দুপুর বেলাটা ছিল একবারেই নির্জন। আমি সবে খালার বাসায় ঢুকে জুতো ঢুকে খালাকে সালাম করলাম। খালা বসতে বলে ভিতরে গেলেন। জানালা দিয়ে দেখি ওই মেয়েটা খালার বাসার সামনে দিয়ে কোথায়ও যাচ্ছে। আমার দিক থেকে সে পিছন ফেরা মানে তার পিছন দিকটা দেখা যাচ্ছে।

মাথায় হঠাত করে রাগ উঠে গেল। দেখি দুপুর বেলা এক বারেই নির্জন। দরজার কাছে খালার নতুন কেনা হিলের সেন্ডেল। হিলের নতুন সেন্ডেল নিয়েই খালাকে বল্লাম আসছি। বলেই খালি পায়েই দৌড় দিলাম।

দৌড়ের গতি বাড়িয়ে দিলাম। এক সময় মেয়েটার কাছে এসেই হালকা লাফ দিয়ে পিঠে প্রচন্ড শক্তি দিয়ে জোরে সেন্ডেল বসিয়ে দিলাম আর সাথে দিলাম প্রচন্ড এক ধাক্কা। মেয়েটা আউউউ!!!! বলে একটা চিৎকার দিল আর আমার ধাক্কার কারণে ব্যলেন্স হারিয়ে মেয়েটা পড়ে গেল। আমার পিছনে তাকানোর কোন সুযোগ ছিল না। আমি দৌড়ের গতি আরো বাড়িয়ে এক সময় ব্যংক কলোনী গেইট আর রাস্তা পেরিয়ে আমাদের কলোনীতে বাসায় এসে দৌড় থামালাম।

আমার চেহারা দেখার সুযোগ তার হয় নি। বুকের ভিতরে মনে হচ্ছিল ফেটে যাবে। বাসায় আম্মা হাতে সেন্ডেল দেখে জিজ্ঞাসা করলেন কার সেন্ডেল নিয়ে আমি বাসায় এসেছি। আর আমার জুতোই বা গেল কোথায় ?খালি পায়ে কেন?আমি পরে বলব বলে আর কোন কথা না বলে রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। অনেক দিন পর সান্তনা পেলাম।

আমার মনটা অনেক শান্ত হলো। ঘুমিয়ে পড়লাম। রাতে খালা বাসায় আসেন। আমি হঠাত দৌড় দেয়ায় খালা জানালা দিয়ে দেখলেন সেকেন্ডেই আমি মেয়েটাকে পিঠে সেন্ডেল দিয়ে মেরে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে হাওয়া। মেয়েটা নাকি পিঠে হাত দিয়ে অনেকক্ষণ বসে ছিল।

হাটুতেও ব্যথা পেয়েছিল। খালা আম্মাকে ঘটনা বলায় আম্মাও হতবাক। মেয়ের ছোট ভাই নাকি বড় মাস্তান টাইপের। আমাকে দরজা ধাক্কা দিয়ে তোলা হল। আমি পুরো ঘটনা বল্লাম।

৮ বছর পরেও আমার এইভাবে প্রতিক্রয়াতে দুইজনেই আসলে নির্বাক। যাই হোক আমি আর ব্যংক কলোনী যাইনি দীর্ঘ ৮ বছর। মেয়ের ছোট ভাইয়ের সাথেও পরিচয় আছে । আমার ৫ বছরের বড়। যদিও উনি জানেন না আমিই সেই।

এখন আর ব্যংক কলোনীতে উনারা থাকেন না। তবে মেয়ের ছোট ভাই মাঝে মঝে আমাদের কলোনীতে ঈদের সময় আড্ডা দিতে আসেন। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।