রামুতে বৌদ্ধ অধিবাসীদের ওপর হামলার ঘটনায় বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পূর্বপরিকল্পিত এ হামলা কি শুধুই স্থানীয় বিচ্ছিন্ন ঘটনা, নাকি এর পেছনে কোনো চক্রান্ত রয়েছে?
ভারত উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস সাম্প্রদায়িক। এখানে বারংবার বহিরাগতরা এসে ক্ষমতা দখল করেছে এবং সে অনুযায়ী নিজ ধর্মের লোকজনকে রাষ্ট্রক্ষমতার স্বাদ দিয়েছে। মোগলরা পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন ইসলামের, ভারত দখলের জন্য তাঁরা সামনে এনেছেন ইসলাম প্রচারের মতো ধর্মীয় কারণকেই। সেখানে আবার সম্রাট আকবর যখন দ্বীন-ই-ইলাহী নামের অসাম্প্রদায়িক এক ধর্ম প্রচার করে ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করার একটি চেষ্টা করেন, তাঁর পরই আবার ধর্মীয় দোহাই দিয়েই ক্ষমতায় বসার সুযোগ পান কট্টর ইসলামী শাসনে বিশ্বাসী আওরঙ্গজেব।
রাষ্ট্রের সঙ্গে আসলে ধর্মের নয়, বাণিজ্যের সম্পর্ক- এ কথাকে আপ্তবাক্য ধরে ইউরোপীয়রা সহজেই ভারতে ঢুকে পড়তে পেরেছে এবং এ অঞ্চলের ধর্মীয় রাজনীতি বুঝে নিতে তাদের সময় লাগেনি একটুও। আর তাই ধর্মীয় বিভাজনে ভারত উপমহাদেশকে বিভক্ত রেখে তারা নিজেদের আখের গুছিয়ে নিয়েছে ঠিকমতোই। ব্রিটিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে এ উপমহাদেশে সবচেয়ে বড় বাধা ছিল জনসাধারণের ধর্মীয় বিভাজন। ব্রিটিশ সরকার সেই বিভাজন রক্ষা করতে সচেষ্ট থেকেছে সব সময় এবং শেষ পর্যন্ত বিষয়টিকে এমন অবিশ্বাস আর তিক্ততার দিকে নিয়ে যেতে পেরেছে, যেখানে একটি ভূখণ্ডকে ধর্মের ভিত্তিতেই ভাগ করে তৈরি করে দেওয়া হয়েছে দুটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র। ধর্মের ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে থাকা রাষ্ট্র যে আসলে অস্তিত্বের জন্য খুবই দুর্বল একটি বিষয়, তার বড় প্রমাণ পূর্ব আর পশ্চিম পাকিস্তানের বিভাজনের মধ্য দিয়ে মাত্র দুই যুগের মধ্যেই বাংলাদেশের উদ্ভব।
বাঙালির ইতিহাসে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বড় কলঙ্করেখা মাত্র দুটি, দুটিই সেই ব্রিটিশ যুগের। একটি কলকাতার দাঙ্গা আর দ্বিতীয়টি নোয়াখালীর দাঙ্গা। এর বাইরে বাঙালি ভূখণ্ডে সংঘবদ্ধ ধর্মীয় দাঙ্গার তাণ্ডব দেখা যায় না। বিচ্ছিন্ন ঘটনার অনেক উদাহরণ সত্ত্বেও এ কথা বলা যায়, বাঙালি, বিশেষ করে বাংলাদেশের বাঙালিরা ধর্মীয় সহাবস্থানে ভারতের অন্যান্য জাতিসত্তার তুলনায় অনেক বেশি সভ্যতার পরিচয় দিয়েছে।
স্বাধীন বাংলাদেশ, বাঙালির অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের জন্ম
রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অসাম্প্রদায়িকতা চর্চার সুযোগ তৈরি হয় ১৯৭১ সালের পর।
এর মূল কারণ বাংলাদেশের বাঙালি এর আগের ২৪ বছর ধর্মীয় রাজনীতির অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসতে সর্বশক্তি দিয়ে লড়াই করেছে। নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে যখন রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধ হয়ে পড়েন, বাঙালির চিরায়ত ভাষা আর সংস্কৃতি যখন আক্রান্ত হয়ে পড়ে ধর্মীয় রাষ্ট্রের দোহাই দিয়ে, তখন এ অঞ্চলে বাঙালিরা নিজের অস্তিত্বের প্রয়োজনেই বাংলা ভাষা আর সংস্কৃতিকে বেশি করে আঁকড়ে ধরতে গেছেন এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন। এর ফলে ১৯৭০-এর নির্বাচন কিংবা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ একটি অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের জন্মকে অপরিহার্য করে তুলেছিল। একই ধারাবাহিকতায় স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ লিখেই প্রথম সংবিধান প্রচলিত হয়। তবে ১৯৭৫-এর পট পরিবর্তনের পর অগণতান্ত্রিক সরকারগুলো আবারও সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দিতে থাকে।
কিন্তু জনতা পর্যায়ে এর তাৎক্ষণিক কোনো কুফল দেখা দেয়নি পশ্চিম পাকিস্তানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাঙালির লড়াইয়ের স্মৃতি তখনো টাটকা থাকার কারণেই। কিন্তু রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিভিন্ন সময়ে অমুসলিম জনগোষ্ঠীকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকত্বে নামিয়ে আনা হয়েছে। সংবিধানে বিসমিল্লাহ যোগ করেছেন জিয়াউর রহমান, তিনিই সংবিধান থেকে 'ধর্মনিরপেক্ষতা' বাদ দিয়ে 'আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস' যোগ করেছেন। আরো কয়েক ধাপ এগিয়েছেন পরবর্তী সামরিক সরকারের প্রধান কর্তা এরশাদ। তিনি বাংলাদেশকে ঘোষণা করেছেন ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে, রবিবারের বদলে শুক্রবারকে সাপ্তাহিক ছুটি ঘোষণা করেছেন এবং তাঁর শাসনের শেষ সময়ে নিজের বিরুদ্ধে যে জনরোষ, সেটিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ছুঁতো ধরে এ দেশে বড় আকারে সাম্প্রদায়িক হামলার ইতিহাস গড়েছেন।
সাম্প্রদায়িক হামলা ও রাজনীতি
সাদা চোখে দেখলে মনে হয়, সাম্প্রদায়িক হামলাগুলো সাধারণত দাঙ্গাবাজ মানুষের বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ। কিন্তু আসলে তা নয়। একটু ভাবলেই দেখা যাবে, এ দেশে যখনই শাসকগোষ্ঠী বিপদে পড়েছে, তখনই ধর্মীয় সংঘাতকে সামনে নিয়ে এসেছে জোরেশোরে। ইংরেজরা এই তুরুপের তাসটি বারবারই টেনে এনেছে গত শতাব্দীতে; যাতে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ এক হয়ে তাদের বিরুদ্ধে বড় কোনো আক্রমণ শানাতে না পারে। আমাদের স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী ২৪ বছরের ইতিহাসের দিকে খেয়াল করুন, প্রায় গোটা সময়টাই আমাদের কেটেছে পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক জান্তাদের অধীনে।
এই সামরিক জান্তারাই বারবার ধর্মের রাজনীতিকে সামনে টেনে নিজেদের রক্ষা করতে চেয়েছে। তাদের চোখে বঙ্গবন্ধু ও বাঙালির প্রগতিশীল সব নেতাই ছিলেন ভারত তথা 'হিন্দুদের দালাল'। ১৯৭১ সালে গণহত্যা চালানোর সময়ও তারা 'হিন্দু মনোভাবাপন্ন, নামে মাত্র মুসলমান'- এ কথা বলে নির্বিচারে বাঙালিদের হত্যা করেছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়েও এ দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মকে সামনে টেনে আনার পেছনে কাজ করেছেন দুই সামরিক শাসক জিয়া ও এরশাদ। এর কারণ ওই একই, জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে দিকভ্রান্ত করা।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, ইতিহাস আমাদের এই শিক্ষাই দিচ্ছে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের উদ্যোগের পেছনে যখনই রাষ্ট্রীয় পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ সমর্থন থাকে, তখনই বুঝে নিতে হবে যে রাষ্ট্র ও সরকার কোনো বড় বিষয় থেকে জনগণের দৃষ্টি সরিয়ে নিতে চাইছে।
সাম্প্রদায়িক হামলা ধীরে ধীরে আলোচনায় আসছে
আমরা যতই নিজেদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবে দাবি করি না কেন, এ কথা অস্বীকার করার জো নেই যে এ দেশে ব্যক্তি ও গোষ্ঠী পর্যায়ে সাম্প্রদায়িক মনমানসিকতার লোকজনের অভাব নেই। পরীক্ষার ফল, চাকরিতে নিয়োগ কিংবা পদোন্নতির অনেক ব্যাপারেই পরোক্ষভাবে সাম্প্রদায়িকতার ভূমিকা আছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। তবে গোষ্ঠীগতভাবে এক ধর্মের লোক কর্তৃক অন্য ধর্মের লোকের ওপর হামলার ঘটনা এ ভূখণ্ডে খুব বেশি নেই।
কিন্তু ইদানীং দেখা যাচ্ছে, এ রকম ঘটনা গত এক বছরে বেশ কয়েকটি ঘটে গেছে।
সর্বশেষ ঘটনাটি রামুর। রামুর ঘটনাটি বহুল আলোচিত হলেও আমরা যদি এক বছরের পরিসংখ্যান নিই, তাহলে দেখতে পাব যে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা উদ্বেগজনক। ঠিক এক বছর আগে চট্টগ্রামের পাথরঘাটা এলাকায় ভুয়া গুজব রটিয়ে একদল উগ্র মানুষ হিন্দুদের পূজামণ্ডপ আক্রমণ করে। আক্রমণের বিচারে এটি বড় ধরনের একটি আক্রমণ হলেও রহস্যজনকভাবে খবরটি মিডিয়ায় যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে আসেনি। কিন্তু মণ্ডপ ছড়িয়ে বসতবাড়িতে হামলার ঘটনাটি আলোচনায় এসেছে সাতক্ষীরার ক্ষেত্রে।
গত ২৬ মার্চ একটি মঞ্চনাটকে ইসলামকে অবমাননা করা হয়েছে- এ রকম অভিযোগ তুলে এক শ্রেণীর দাঙ্গাবাজ সাতক্ষীরার কালীগঞ্জে হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা করেছে। এই হামলায় বসতবাড়ি পুড়িয়ে নিঃস্ব করে দেওয়া হয়েছে হিন্দু ধর্মাবলম্বী অসংখ্য নাগরিককে। জুলাই মাসে হিন্দু বসতিতে হামলা হয়েছে বাগেরহাটের ফকিরহাটে। বড় আকারের আক্রমণ হয়েছে আগস্ট মাসেও, দিনাজপুরের হিলিতে এই আক্রমণে অনেক হিন্দু নাগরিকই তাঁদের সর্বস্ব খুইয়েছেন।
লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর হামলার কোনো জোরালো প্রতিক্রিয়া কখনোই গত কয়েক বছরে সরকারে উঁচু পর্যায় থেকে দেওয়া হয়নি।
কিন্তু রামুতে বৌদ্ধদের ওপর হামলার পর এবার সরকার বড় আকারের প্রতিক্রিয়া দেখাতে বাধ্য হচ্ছে। দায়িত্বশীল মন্ত্রীরা ইতিমধ্যেই রামু সফর করেছেন। এই লেখাটি যখন লিখছি, তখন প্রধানমন্ত্রীর রামু সফরে যাওয়ার কথাও শোনা যাচ্ছে।
এর কারণ কী? কারণ এবারই প্রথম আন্তর্জাতিকভাবে এই হামলার প্রতিক্রিয়া হয়েছে। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের দূতাবাস আক্রান্ত হয়েছে।
শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা এই আক্রমণ চালিয়েছে। থাইল্যান্ডে বিক্ষোভ হয়েছে এই হামলার প্রতিবাদে। বাংলাদেশের অন্যতম দাতা দেশ জাপানও রামুর বৌদ্ধদের ওপর হামলায় প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। সব মিলিয়ে সরকার চাপের মুখে পড়েছে- এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এই চাপ সাময়িক হলেও এর প্রতিক্রিয়া থাকবে সুদূরপ্রসারী।
যদি এর ধারাবাহিকতায় আগামী কয়েক মাসের মধ্যে বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা আবারও আক্রান্ত হয়, সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে ইমেজ সংকটের মুখে পড়বে, সেটি উত্তরণে আপাতত কোনো সুযোগ থাকবে না। এমনিতেই দুর্নীতি নিয়ে গত বেশ কিছু বছর যাবৎ বাংলাদেশের ইমেজ তলানিতে এসে ঠেকেছে। টিআইবির দুর্নীতির ধারণাসূচকে বাংলাদেশ শীর্ষস্থানে অবস্থান করার যে দুর্নাম এককালে কুড়াতে হয়েছে, সেটি থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ তৈরি হওয়া মাত্র পদ্মা সেতুর দুর্নীতি নিয়ে সরকারের ইমেজ সংকট তৈরি হয়েছে। এ সময়ে এসে যদি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ধ্বংসের অভিযোগের আঙুল উঠে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে, তাহলে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যে কোথায় যাবে, সেটি বলাই বাহুল্য।
সাম্প্রদায়িক এই আক্রমণ কেন
ইতিমধ্যেই আমরা ওপরে বেশ কিছু উদাহরণ সামনে এনে দেখেছি যে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক আক্রমণের একটি নতুন ধারা ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে উঠছে।
কিন্তু রামুতে বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা কেন? হামলা শেষে গত এক সপ্তাহে এ কথা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে রামুতে যে আক্রমণ হয়েছে, তা পূর্বপরিকল্পিত। একটি বড় আকারের পরিকল্পনা করে শানিত এই আক্রমণ রোধে স্থানীয় প্রশাসন আসলেই কি ব্যর্থ হয়েছে, নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে চোখ বুজে ছিল- সে প্রশ্ন উঠেছে। তাহলে কি এই আক্রমণের পেছনে সরকারের মদদ রয়েছে? সাধারণত সরকার যখন জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে তখন এই ধরনের অঘটন ঘটিয়ে জনগণের চোখ ফিরিয়ে নেওয়ার কৌশল এই ভূখণ্ডে বহুল ব্যবহৃত। ১৯৯০ সালে এরশাদ এর সফল প্রয়োগ দেখিয়েছেন।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে আওয়ামী লীগ এখন চাপের মুখে আছে।
তাদের জনপ্রিয়তা যে আগের মতো নেই- সেটি সহজেই বোঝা যাচ্ছে। বেশ কয়েকটি বড় আকারের ব্যর্থতা তাদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আওয়ামী লীগ শিক্ষা, কৃষি ও বিদ্যুতে যে সফলতা অর্জন করেছে, সেই সাফল্যের খবর চাপা পড়ে গেছে শেয়ারবাজারে লুটপাট, হলমার্ক দুর্নীতি, পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তর এপিএসের গাড়িতে পাওয়া নিয়োগ-বাণিজ্যের টাকা কেলেঙ্কারি, ছাত্রলীগের মাস্তানি, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে অভিযোগ, সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটিত না হওয়া, ইলিয়াস আলী গুমের ঘটনার কোনো সমাধান না হওয়ার মতো অসংখ্য আলোচিত ব্যর্থতায়। এসব থেকে জনগণের চোখ ফেরানোর জন্য কি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ধ্বংসের সেই পুরনো ট্রামকার্ডটি খেলছে কেউ?
এ রকম হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ এ দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু ভোটারদের অনেকেই আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক হিসেবে মনে করেন।
এ কথার সত্যতা পাওয়া যায় ২০০১ সালের নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা থেকে। সে সময় বিএনপি-জামায়াত জোট নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়েছে অমুসলিম জনগোষ্ঠীই। সুতরাং আওয়ামী লীগ নিজের ভোটশক্তি রক্ষা করার জন্যই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার চেষ্টা করাটাই আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক। ধর্মীয় সংঘাতের কার্ড আওয়ামী লীগের খেলার কথা নয়।
তাহলে কাহিনী কোথায়?
কাহিনী অনেকখানিই গভীরে।
আমরা সাম্প্রতিক সময়ে বৃহত্তর চট্টগ্রামের ঘটনাগুলোকে একসঙ্গে রেখে দেখতে পারি। গত কয়েক মাসের মধ্যে একটি বড় ঘটনা আরো রোহিঙ্গার বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা। বাংলাদেশ এই চেষ্টা রুখে দিলে এক শ্রেণীর মানবাধিকার সংস্থা আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশকে চাপ দেওয়ার চেষ্টা করে। ইতিমধ্যেই এসব সংস্থা ও পশ্চিমা কয়েকটি দেশ বাংলাদেশের ওপর চাপ বাড়িয়ে চলেছে, যাতে রোহিঙ্গা শিবিরে মানবিক সহায়তার নামে তাদের প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়। কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করতে গেলে হঠাৎ করেই বেশ কিছু রোহিঙ্গা মহিলা তাদের বোরকার নিচ থেকে বিভিন্ন ধরনের প্ল্যাকার্ড ও পোস্টার বের করে প্রদর্শন করে।
এসব প্ল্যাকার্ড ও পোস্টার ছিল সুলিখিত ইংরেজিতে। এর পাশাপাশি গত এক মাসের মধ্যেই রাঙামাটিতে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাত হয়েছে। বর্তমানে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে এ অঞ্চলে। আর তৃতীয় ঘটনা হিসেবে এখন রামুতে আক্রান্ত হয়েছে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা। মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে একের পর এক ঘটে যাওয়া এসব ঘটনা থেকে বোঝা যাচ্ছে, চট্টগ্রামে একই সঙ্গে বেশ কয়েক ধরনের উত্তেজনা ছড়ানো শুরু হয়েছে।
এর প্রতিটি ঘটনাই যে পূর্বপরিকল্পিত, এ কথা তো দিবালোকের মতোই পরিষ্কার।
এর পাশাপাশি বৃহত্তর চট্টগ্রামের এ জেলাগুলোর অন্য খবরগুলোও খেয়াল করুন। মাত্র কিছুদিন আগেই সমুদ্রসীমা নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে দীর্ঘদিনের টানাপড়েনের সমাপ্তি ঘটেছে। সরকারি দল একে 'সমুদ্র জয়' বলে অভিহিত করেছে। এর ফলে বঙ্গোপসাগরের এ অঞ্চলে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে।
ধারণা করা হচ্ছে, এ অঞ্চলে বিপুল পরিমাণ খনিজ সম্পদ সমুদ্রের বুকে লুকিয়ে আছে। বাংলাদেশ সরকার এখন এখানকার ব্লকগুলো ইজারা দেওয়ার প্রক্রিয়ায় জোরেশোরে ব্যস্ত। আর এ ব্যস্ততা বিশ্বায়নের তেল-গ্যাসখেকো মোড়লদের এ অঞ্চলে যে আগ্রহী করে তুলেছে, সে কথা বলাই বাহুল্য।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খবর হচ্ছে, বঙ্গোপসাগরে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কথাবার্তাও আবার নতুন করে বলা শুরু হয়েছে। চীন এ বিষয়ে নিজেদের আগ্রহের কথা ব্যক্ত করার পর গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের সম্ভাবনা অনেকখানিই বেড়ে গেছে।
এর পাশাপাশি মিয়ানমারের পরিস্থিতিও দ্রুত পরিবর্তনশীল। সেখানে সু চিকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নিতে জান্তা সরকারের আপত্তি নেই, এ কথা ঘোষণা হয়েছে মাত্র। মিয়ানমার যদি গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় অংশ নিতে শুরু করে তাহলে তাদের ওপর থেকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিধিনিষেধও অনেকখানি শিথিল হয়ে পড়বে। সে ক্ষেত্রে মিয়ানমারও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ছে বঙ্গোপসাগরের তীরে। সব ঘটনা একসঙ্গে মিলিয়ে দেখলে দেখা যাচ্ছে, বৃহত্তর চট্টগ্রাম খুব দ্রুতই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে একটি লোভনীয় স্থান হয়ে উঠেছে।
প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে, তাহলে বৃহত্তর চট্টগ্রামে এসব দ্বন্দ্ব-সংঘাত কি তাহলে সাময়িক উত্তেজনা কিংবা স্থানীয় রাজনীতির চক্রান্ত মাত্র নয়? এর পেছনে কি তবে আন্তর্জাতিক বড় কোনো খেলোয়াড়ের ইন্ধন রয়েছে?
অগণতান্ত্রিক শক্তির চক্রান্ত
ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্টের চক্রান্তের পেছনে অগণতান্ত্রিক শক্তির ভূমিকা থাকার আশঙ্কাই সবচেয়ে বেশি। বৃহত্তর চট্টগ্রামের দিকে ইঙ্গিত দিলেও সারা দেশেই ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্টের উদ্যোগ বেশ দৃষ্টিকটুভাবে আবির্ভূত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের আর তেমন একটা দেরি নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার না থাকলে প্রধান বিরোধী দল এই নির্বাচন শুধু বয়কটই করবে না, তারা তা প্রতিরোধেরও চেষ্টা করবে। ওয়ান-ইলেভেনের স্মৃতি এখনো আমাদের মনে জাগরূক।
তাই রাজনৈতিক এ সংঘাত থেকে কী ফলাফল হতে পারে, সে ব্যাপারে অভিজ্ঞ মহলের আশঙ্কাটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যেসব খলনায়ক পর্দার আড়ালে সব সময়ই বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে চলে, তাদের নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়নে ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে একটি সংঘাতমূলক দেশ দেখানো জরুরি হয়ে পড়ে। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে এটি এখন বেশি সম্ভব হবে না। বিএনপি গত চার বছরে প্রমাণ করেছে যে রাজপথে বড় আকারের সংঘাত পরিচালনায় দলটি সমর্থ নয়। তাহলে নেপথ্যের কুশীলবদের অন্য কোনো সংঘাতের দিকে নজর দিতে হবে।
সেই সংঘাত সহজেই তৈরি করা যাবে ধর্মীয় জিগির তুলে। কেন যেন মনে হচ্ছে, সেই ড্রেস রিহার্সালই শুরু হয়েছে গোটা দেশে। নইলে প্রতিটি সাম্প্রদায়িক হামলায় মাঠ প্রশাসনের নিদারুণ ব্যর্থতা এ রকম নগ্নভাবে চোখে পড়ত না।
রুখে দাঁড়াতে হবে এখনই
মানব সভ্যতার এই পর্যায়ে এসে, একবিংশ শতাব্দীতে একটি দেশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে ধর্মীয় কারণে উত্তেজনার সৃষ্টি হবে- এমনটি কাম্য হতে পারে না। বাংলার হিন্দু, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালি- এ রকম স্লোগান তুলে যে দেশ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সেই দেশে স্বাধীনতার ৪১ বছর পর সাম্প্রদায়িক হামলার ঘুঁটিখেলা চলবে- সেটি হতে দেওয়া যায় না।
বাংলাদেশের সব মানুষই বাংলাদেশের সমান সম্পদ। এই দেশকে এগিয়ে নিতে হলে আমাদের সবাইকেই হাতে হাত রেখে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একসঙ্গে কাজ করে যেতে হবে। আর আমাদের ঐক্য ধ্বংসের জন্য সব সময়ই কাজ করে যাবে অপশক্তি- সেটাও আমাদের মনে রাখতে হবে। আর এ জন্য চাই সম্প্রীতি। আর চাই সম্প্রীতি রক্ষার আইন।
এই দেশে ব্লাসফেমি আইন প্রণয়নের দাবি নিয়ে ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলো এগিয়ে এলেও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে রক্ষা করতে 'এন্টি রেসিস্ট ল' প্রণয়নের দাবি এখনো আমাদের প্রগতিশীল কোনো পক্ষ থেকেই তোলা হয়নি। অথচ বিশ্বের সভ্য দেশগুলোতে এ রকম আইন আছে। কোনো নাগরিককে তার ধর্ম, বর্ণ, নৃতাত্তি্বক জাতিসত্তার জন্য যাতে বঞ্চনা-লাঞ্ছনার শিকার হতে না হয়, সে জন্য এসব আইন কড়াকড়িভাবে মেনে চলা হয়। আমাদের দেশেও এ রকম আইন এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। ব্যক্তিজীবনে যাতে কোনো নাগরিক সাম্প্রদায়িকতা কিংবা বর্ণবাদের শিকার না হন, সেটি দেখার দায় রাষ্ট্রের।
রাষ্ট্রকে তার অস্তিত্বের জন্যই এই সাম্য রক্ষা করতে হবে। তা না হলে উত্তেজনা তৈরির সুযোগ রয়ে যাবেই, নাগরিকদের একটি অংশ সব সময় নিজেদের আক্রান্ত ও দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবেই ভেবে যাবে। আর এর ফল হবে খারাপ। এসব হিংসা-বিভেদের সুযোগ তৈরি করে রাষ্ট্রকে দুর্বল করে ফেলবে অপশক্তিরা, সেই সুযোগ তাদের নিতে দেওয়া যাবে না। বিশ্লেষণ করেছেন অনিক শাহরিয়ার ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।