আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শিক্ষকতা থেকে সোনালী ব্যাংক পরিচালক হেনরীর নাটকীয় উত্থান এবং বিপুল অর্থ বৈভব!

বাস্তবতা নিয়ে কথা বলতে চাই। জান্নাত আরা হেনরী, পেশা জেলা শহরের একটি মধ্যমমানের হাইস্কুলে শিক্ষকতা। বছর চারেক আগেও তার জীবণ-যাপন ছিল খুবই সাদামাটা। চলাফেরা করতেন রিকশায়। মধ্যবিত্ত আর দশজনের মতোই স্বাভাবিক জীবন-যাপন ছিল তার।

কিন্তু মহাজোট সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পরই রাতারাতি পাল্টে যেতে থাকে তার অবস্থান। সিরাজগঞ্জ শহরের সবুজ কানন হাইস্কুলের শিক্ষক জান্নাত আরা হেনরীর কথা বলছিলাম। ২০০৯ সালে সোনালী ব্যাংকের অন্যতম পরিচালক নিযুক্ত হন। মালিক হন বিপুল পরিমাণ অর্থ-বিত্তের। গাড়ি-বাড়ি আর সামাজিক অবস্থানেরও রাতারাতি পরিবর্তন।

হেনরীর এ উত্থান সিরাজগঞ্জবাসীকে ফেলে দেয় এক ঘোরের মধ্যে। হেনরী বর্তমানে কেন্দ্রীয় মহিলা আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদিকা। জেলা আওয়ামী লীগের পরীক্ষিত নেতা মোতাহার হোসেন তালুকদারের পুত্রবধূ হিসেবে ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে সিরাজগঞ্জ-২ (সদর) আসন থেকে আওয়ামী লীগ থেকে খুব সহজে মনোনয়ন পান হেনরী। কিন্তু পরাজিত হন বিএনপির প্রার্থী রুমানা মাহমুদের কাছে। বলা হয় এ আসনের সাবেক সাংসদ ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের যথাযথ সমর্থন না পাওয়াতেই তাকে পরাজিত হতে হয়।

সংসদ নির্বাচনে পরাজিত হলেও মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাকে সোনালী ব্যাংকের পরিচালক করা হয়। আর এ পুরস্কারপ্রাপ্তির মধ্য দিয়েই শুরু হয় তার নতুন পথচলা। গত সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনকে দেয়া হলফনামায় স্কুল শিক্ষিকা জান্নাত আরা হেনরী তার মাসিক আয় ১০ হাজার টাকা উল্লেখ করেছিলেন। হলফনামা অনুযায়ী তাদের স্বামী-স্ত্রীর কাছে মোট নগদ সাড়ে ৪ লাখ টাকা ছিল। স্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ দেখিয়েছিলেন ৪ বিঘার কিছু কম।

যার মূল্য ৬ লাখ টাকারও কম। বর্তমানে বাড়ি গাড়ি আর বিপুল ধন-সম্পদের মালিক হেনরী। চার বছরের ব্যবধানে পাল্টে গেছে হেনরীর অবস্থান। অভিযোগ রয়েছে, সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পদে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে ঋণপ্রদান, চাকরি বাণিজ্য, কর্মকর্তাদের পদোন্নতি ও বদলি, ঋনমওকুফ, শাখা খোলাসহ বিভিন্ন তদবির বাণিজ্য করেন হেনরী। গত সাড়ে তিন বছরে হেনরী প্রায় শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।

এসব কাজের লিয়াজো করার জন্য একজন প্রতিনিধিও তার নিয়োগ করা ছিলো। সোনালী ব্যাংকের ঊর্ধতন একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বড় অংকের ঋণ পেতে হেনরীর দ্বারস্থ হয়েছেন অনেকে। তার সুপারিশে সোনালী ব্যাংক থেকে অনেকেই মোটা অংকের ঋণ পেয়েছেন। বিনিময়ে একটা পার্সেন্টও তিনি পেতেন। সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে থাকার পর বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, জান্নাত আরা হেনরী রাজধানীর রূপনগর আবাসিক এলাকায় 'রজনীগন্ধা' নামের বাড়িতে ফ্ল্যাট কিনেছেন। ঢাকার উত্তরায় ৫ কাঠার প্লট কিনেছেন। ২০১১ সালের আগস্ট মাসে প্রায় কোটি টাকা মূল্যে একটি টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার (ঢাকা মেট্রো ঘ-১১-১৭৫৫) জিপ ও একটি সাদা রংয়ের প্রাইভেটকার (নম্বর ঢাকা মেট্রো-ঘ-২৭-৩৬০০) কিনেছেন। দুটি গাড়ি তিনি নিজে ব্যবহার করলেও একটি নিজ নামে মালিকানা রয়েছে। সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার গজারিয়া নামক স্থানে ৭ বিঘা জমি (প্রতিশতক বিশ হাজার টাকা মূল্যে) শশুর শাশুরির নামে সখিনা-মোতাহার ফ্লাওয়ার মিলের কাজ শুরু করেছেন।

সদানন্দপুর এলাকায় তার পৈত্রিক বাড়িতে পিতা আব্দুল হামিদের মালিকানায় হেনরীর সহযোগিতায় একটি পাঁচতলা বাণিজ্যক ভবনের নির্মাণ কাজ চলছে। এরইমধ্যে মূল অবকাঠামোর কাজ শেষ হয়েছে। বর্তমানে তার সিরাজগঞ্জে তার শশুরবাড়িতে থাকার জন্য সবকিছু অত্যাধুনিক ভাবে সুসজ্জিত করেছেন। এ ছাড়াও ঢাকার উত্তরায় পাঁচকাঠার একটি প্লট ক্রয় করেছেন তিনি। একটি সূত্রে জানা যায়, ঢাকা-সিরাজগঞ্জ রুটে ২টি অত্যাধুনিক বাস রয়েছে তার।

ডেসটিনিতে প্রায় এক কোটি টাকার শেয়ারসহ বিভিন্ন কোম্পানির প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকার শেয়ার রয়েছে হেনরীর। জান্নাত আরা তালুকদারের বাড়ি সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার কড্ডার মোড়ে। তার বাবা ছিলেন একজন স্কুলশিক্ষক। শামীম তালুকদার লাবুর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। জানা গেছে হেনরীর স্বামী লাবুর ঠিকাদারির লাইসেন্স থাকলেও তিনি বর্তমানে ঠিকাদারি ব্যবসা করছেন না।

বিভিন্ন তদবিরের কাজ করছেন বলে জানা গেছে। হেনরীর স্বামী এবং মেয়ে মুনতাহা হৃদয়ীর অ্যাকাউন্টেও বিপুল পরিমাণ টাকা থাকার অভিযোগ রয়েছে। হেনরীর জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদের তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। চলতি বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতি দমন কমিশন সমন্বিত জেলা কার্যালয় পাবনার উপ-পরিচালক মো. আবদুল করিম সিরাজগঞ্জের সোনালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক ও রূপালী ব্যাংকের প্রধান শাখার ম্যানেজারদের বরাবর একটি পত্র পাঠান (স্মারক নং-দুদক/সজেক/পাবনা/২০৪)। পত্রে জান্নাত আরা তালুকদার হেনরী, স্বামী শামীম তালুকদার লাবু, মেয়ে মুনতাহা হৃদয়ীর নামে এই ৬টি ব্যাংক শাখায় কোনো প্রকার হিসাব পরিচালিত হয়ে থাকলে তা দুর্নীতি দমন কমিশন, সমন্বিত জেলা কার্যালয় পাবনা বরাবর পাঠানোর জন্য বলা হয়েছে।

দুদক প্রধান কার্যালয় ২৩ জানুয়ারি এক নোটিশে তাদের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ তদন্ত করে রেকর্ডপত্রসহ তা গত ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১২-এর মধ্যে পাঠনোর জন্য অনুরোধ জানানো হয়। রেকর্ডপত্রে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদের তথ্য পায় দুদক। দুর্নীতি দমন কমিশন সমন্বিত জেলা কার্যালয় পাবনার উপ-পরিচালক মো. আব্দুল করিম বলেন, ''দুর্নীতি দমন কমিশন প্রধান কার্যালয় সব নথিপত্র তলব করায় গত ৩০ জুলাই প্রধান কার্যালয় ঢাকায় হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি বিষয়টি এখন প্রধান কার্যালয় থেকে অনুসন্ধান করবে। '' এদিকে দুদক প্রধান কার্যালয়ের ঊর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'হেনরীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত চলমান।

নির্বাচন কমিশনের হলফনামার তথ্যানুযায়ী হেনরী সংসদ নির্বাচনের আগে যে তথ্য দিয়েছেন তার সঙ্গে দুদকের অনুসন্ধানে পাওয়া বর্তমান সম্পদের বিশাল ব্যবধান দেখছে দুদক। চার বছর সময়ের মধ্যে কীভাবে বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছেন হেনরী তা এখন খতিয়ে দেখছে। ' হেনরীর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগের বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ''আমি একজন স্কুল শিক্ষক। অবৈধ কোনো সম্পদ নেই। কোনো অভিযোগও নেই।

'' 'তাহলে দুদক তদন্ত করছে কেন? দুদকতো অভিযোগের ভিত্তিতেই তদন্ত করে' এর উত্তরে তিনি বলেন, 'তাহলে দুদক থেকে শুনে নিন। আমাকে জিজ্ঞাস করছেন কেন? দুদক করছে এখনওতো কোনো রিপোর্ট দেয়নি। যে বিষয়টি তদন্তাধীন সে বিষয়ে কোনো কথা বলবো না। ' 'বেশিরভাগ সময় ঢাকায় থাকলেও সবুজ কানন স্কুলের শিক্ষকের পদ কীভাবে ধরে রাখছেন?' এ প্রশ্নের উত্তরের হেনরী কিছুক্ষণ নিরব থেকে মুঠোফোনের লাইন কেটে দেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মফস্বলের একজন স্কুল শিক্ষিকাকে সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য করায় বিতর্কের মুখে পড়ে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।

জানা গেছে, রাজনৈতিক তদবিরের কারণে সিরাজগঞ্জের সবুজ কানন স্কুলের শিক্ষক হেনরীকে রাষ্ট্রায়ত্ব সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বানানো হয়। আর রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে হেনরী মহাজোট সরকারের আমলে কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন। চলতি মাসে তার মেয়াদ শেষ হয়। হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে দুদক অন্য পরিচালকদের সঙ্গে তাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। আওয়ামী লীগ ঘরানার কেউ এর জবাব দেবেন কি? জানতে হলে পড়তে হবে।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.