আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তৃতীয় মাত্রায় শাওন

আমি পেশায় সংবাদকর্মী। এর পাশাপাশি পড়াশুনাও করি। আর ফেসবুকে বসি, আরও অনেক কিছু করি। সব এখন মনেও নেই। গত মঙ্গলবার মধ্যরাতে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ‘চ্যানেল আই’- এর নিয়মিত টক শো ‘তৃতীয় মাত্রা’য় অংশ নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন।

এতে উঠে এসেছে হুমায়ূন আহমেদের সাথে তার সম্পর্ক, শেষ দিনগুলোর কথা। একই সাথে তিনি বলেছেন দাফন নিয়ে সৃষ্ঠ জটিলতা ও দুই পরিবারের টানাপোড়নের কথা। তৃতীয় মাত্রায় সঞ্চালনা করেন জিল্লুর রহমান। অনুষ্ঠানের শুরুতেই মেহের আফরোজ শাওনকে জিজ্ঞাসা করা হয়Ñ কেমন আছেন? এ কেমন আছেনকে সঞ্চালক দুই ভাগে ভাগ করে দেন। এক ভাগে ছিলো যখন বিয়ে করেছিলেন আর তিনি মারা যাওয়ার পর।

এর জবাবে শাওন বলেন, ‘এখন আমি ভালো নেই। ভালো থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত। যদি সেই সময়কার কথা বলেন, তাহলে বলবো, সেই সময়েও খুব একটা ভালো ছিলাম না। কারণ, তখন চারিদিকে নানা ধরনের প্রশ্ন। যারা প্রশ্ন করছেন, তারা নিজেদেরই নানাভাবে উত্তর বানিয়ে দিচ্ছেন।

তারপরও তখন আমি এখানকার চেয়ে অনেক ভালো ছিলাম। কারণ, ভালো থাকার মত তখন আমার কাছে চমৎকার মনের ও শক্ত মানসিকতার একজন মানুষ ছিলেন। সেই জন্য তখনকার পরিস্থিতির তুলনায় এখন ভালো নেই। তখন ভালেঅ ছিলাম, এখন কিছুটা ভালো থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সন্তানদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যতটুকু ভালো থাকা যায়, তারা ততটুকু ভালো আছে।

ছোটটির (নিনিত) বয়স দুই হলো। ও এখনো বাবা না থাকার কষ্ট বুঝতে পারে না। সে এখনো সেলফোন হাতে নিয়ে বাবার সাথে কথা বলে। বলে “হ্যালো বাবা”। এই দুটো কথাই বলে।

কারণ এর চেয়ে বেশি সে বলতে পারে না। বাবার ছবি দেখে আদর করে, চুমু খায়। আর আমার বড় ছেলে (নিষাদ) এর বয়স এখন সাড়ে পাঁচ বছর। ওর জগতটা একটু ভিন্ন ধরনের। ও চাপা সম্ভাবের, বাবার মতো।

সবার সাথে ও মনের কথা শেয়ার বরে না। সব কথা প্রকাশও করে না। বিশেষ করে আমার সাথে ও কোন কথা শেয়ার করে না। ওর নানির কাছে কিছু বলে, আমার বোনেদের কাছে কিছু বলে। কাজের বুয়াদের কাছে বলে।

হয়তো ভাবে, আমি কষ্ট পাবো। সেই জন্যই কিছু বলে না। মাঝেমাঝে বলে, আমার বাবা আকাশের তারা হয়ে গেছে। হয়তো কেউ ওকে বুঝিয়ে যে, মারা গেলে মানুষ আকাশের তারা হয়ে যায়। একদিন ও আমাকে বলে, নুহাশ পল্লীর আকাশে যে তারাগুলো আছে।

তার মধ্যে কোনটা আমার বাবা? আমি বাবার সাথে কথা বলবো। প্রথমদিকে যখন নিউইয়র্ক থেকে আমার দেশের কথা চিন্তা করছি। হুমায়ূন আহমেদেকে নিয়ে। দুঃখিত এখনো আমি লাশ বা মরদেহ শব্দটি বলতে পারবো না। ওকে নিয়ে যখন আমরা ফিরে আসছি।

তখনো আমার বড় ছেলে বলছিলো, আমরা বাংলাদেশে যাচ্ছি, বাবা যাবে না। ওর ধারণা ছিলো বাবা ইংরেজি জানে না। ওর বাবাও বাচ্চাদের সামনে বোকা সেজে থাকতো। ইংরেজি জানি এ কথা বলতো। সে জন্য ও বলে উঠে, বাবা তো ইংরেজি জানে না।

বাবার যদি পানি খেতে ইচ্ছা করে। তাহলে কার কাছে চাবে। বাবাকে কি আমরা হাসপাতালে রেখে যাচ্ছি। তাহলে বাবা বাসায় এসে আমাদেরকে খুঁজবে না। ওর প্রশ্নের কোন উত্তর আমি নেই মুহুর্তে খুঁজে পাই নি।

আমি শুধু এটকু বলেছি, তোমার বাবার স্পেসে চলে গেছে। কারণ ওর বাবা ওর সাথে স্পেস নিয়ে অনেক গল্প করতো। ও তখন আমাকে জিজ্ঞাসা করে, স্পেসে কি আরো বড় হাসপাতাল আছে। যেখানে ডাক্তাররা বাবাকে ব্যাথা দেবে না। তখন আমিও বললাম, স্পেসের কোন বড় এক হাসপাতালে তোমার বাবা গেছে।

আসলে পুরোপুরি উপলব্ধি করার মতো অবস্থায় এখনো ও আসে নি। অন্য সন্তানরা কেমন আছেনÑ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসলে ওদের ভালো থাকার তো কথা না। কারণ, ওদের বাবা নেই। এ সময় গুলতেকিন খান কেমন আছে, তা তিনি জানেন কি নাÑ জানতে চাইলে তিনি এড়িয়ে যান। আপনি কোন পরিচয়ে এগিয়ে যেতে চানÑ এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আসলে একটি পরিচয়েই কি পরিচিত হতে হবে।

হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী একজন স্থাপতিÑ দুইটি পরিচয়ই কিন্তু একটি মানুষের। হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী একজন সঙ্গীতশিল্পী। আমি জানি না, ভবিষ্যতে আমি কতদিন পর গান গাইতে পারবো। আদৌ পারবো কিনা, অভিনয় করতে আদৌ পারবো কিনা। কখনো ইচ্ছা হবে কি না, তাও জানি না।

কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী এই পরিচয় আমার সারাজীবন থাকবে। এই পরিচয়টা আমার হৃদয়ের কাছের পরিচয়, অহংকারের পরিচয়। আমি হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী। যেভাবে তার পাশে ছিলাম, সেভাবেই থাকবো বাকিটা জীবন। ’ ক্যান্সার ধরা পড়ার প্রসঙ্গে বলেন, ‘হুমায়ূন আহমেদ ডাক্তারের কাছে যেতে ভয় পেতেন।

তিনি নিজের জন্যও পছন্দ করতেন না। তেমনি আমার শাশুরী (হুমায়ূন আহমেদের মা) যতবার অসুস্থ হয়েছে, সে সময়ও তাকে অনেক জোড়াজুড়ি করে হাসাপাতালে নিয়ে যাওয়া হতো। বিকেলে যেতেন দশ মিনিট থেকে চলে আসতেন। হাসপাতালের পরিবেশ, অসুখ অসুখ গন্ধ তার খুব অপছন্দের ছিলো। এমনকি আনন্দময় মুহুর্ত, যখন আমার বাচ্চা হয়েছে।

তখনো তিনি দশ মিনিট থেকে চলে এসেছেন। কিন্তু, তাকে অনেক জোর করে চেকআপ করানো হতো। ২০১১ সালে রোজার সময়কার বিভিন্ন জায়গায় লেখা দেওয়ার ব্যস্ততা শেষে আমরা সিঙ্গাপুরে যাই। এটা শুধু বেড়ানো ছিলো না, সেখানে আমার মায়ের অপারেশান হচ্ছিলো। তিনি নিজে থেকে মা’র চিকিৎসার সময় আমাকে পাশে রাখার জন্য, অপারেশানের আগের দিন সিঙ্গাপুরে নিয়ে যান।

সিঙ্গাপুরে যাওয়ার কথা শুনে আমি ওর চিকিৎসার কাগজপত্র নিয়ে যাই। কারণ, ২০০২ সালে ওখানে ওর বাইপাস সার্জারী হয়েছিল। ওকে বারবারই চেকআপের জন্য বাধ্য করেছিলাম। রুটিন চেকআপের জন্যই এটা করা হয়েছিলো। এখানে রক্ত পরীক্ষা করার পর ডাক্তাররা সিটি স্ক্যান করতে বলেন।

সেখানে তারা টিউমার দেখতে পান। সেখান থেকে কোলন টেস্ট করার পর তার ক্যান্সার ধরা পড়ে। সে ক্যান্সার ছিলো চতুর্থ পর্যায়ের। ’ লিভার অপারেশান নিয়ে নানা কথার জবাবে তিনি বলেন, ‘হুমায়ূন আহমেদ খুবই জীবনবাদী মানুষ ছিলেন। তারপরও তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত শুনে ভয় পেয়েছিলেন।

তবে তা ছিলো ক্ষনিকের। এরপর বিশ্বের সেরা ক্যান্সার হাসপাতালে তার চিকিৎসা শুরু হয়। সেখানে ডাক্তাররা কেমেপাথেরাপী দেওয়ার কথা বলেন, কিন্তু সার্জারী করার কথা তিনি নাকচ করে দেন। প্রাইভেট হাসপাতালে এক একটি কেমো দিতে প্রায় ১৭ হাজার ডলার লাগতো। যা আমাদের জন্য কষ্টসাধ্য ছিলো।

পাঁচটি কেমোর পর আমরা ডাক্তারের পরামর্শে সরকারি হাসপাতালে যাই। সে সময় বেলভ্যু হাসপাতালে হুমায়ূন আহমেদকে স্থানান্তর করা হয়। হুমায়ূন আহমেদ একটা মিরাকলের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আমরাও করছিলাম। কারণ, ১২টি কেমোর পর আর কেমো দেওয়া যায় না।

এরপর ওরাল কেমো দিতে হয়। যা দিয়ে ছয় মাসের বেশি বাঁচা সম্ভব না। এটা নিয়ে আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। এ ক্যান্সারে শতকরা সাত শতাংশ লোক বাঁচে। আমরা চাইছিলাম, এই সাত জনের একজন কি হুমায়ূন আহমেদ হতে পারে না।

দাফন নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার প্রসঙ্গে শাওন বলেন, ‘আট বছরের সংসারে আমি তার মুখে ২০ থেকে ২৫ বার কবরের বিষয়ে কথা শুনেছি। এর প্রত্যেকবারই তিনি নুহাশ পল্লীতে কবর দেওয়ার কথা বলেছিলেন। তিনি তার আত্মজীবনী “আমি” বইয়ের ১৮৪ পৃষ্ঠায় নুহাশ পল্লীতে কবর ও এর এপিটাফে কি লেখা থাকবে তা উল্লেখ করে গেছেন। নুহাশ পল্লীতে গিয়ে তিনি আমাকে ও আরো অনেককে লিচু তলা দেখিয়ে ওখানে কবর দেওয়ার কথা বলে গেছেন। ’ তিনি আরো বলেন, ‘লিভার সার্জারীর আগের রাতে তিনি আমাকে বলেছিলেন, আমি মারা গেলে আমাকে নিয়ে অনেক টানাটানি হবে।

কিন্তু তুমি আমাকে নুহাশ পল্লীতে কবর দিয়ো। কখনো ভাবি নি এ কথা রেকর্ড করে রেখে মানুষকে বিশ্বাস করাতে হবে। সেজন্যই রেকর্ড করে রাখি নি। আমি ও তার পরিবারের সকলেই জানেন তিনি নুহাশ পল্লীতে কত ভালোবাসতেন। তিনি নিজ মুখে যা বলেছেন, সে কথাই আমি রেখেছি।

যদি আমি তার সে কথা না রাখতাম, তাহলে আমি সারাজীবন উনার কাছে ছোট হয়ে থাকতাম। আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি তখন সবাইকে। আমি তাদেরকে অনুরোধ করেছি। ’ দাফন নিয়ে শাওন কোর্টে যেতে চেয়েছিলেনÑ মিডিয়াতে এমন কথা এসেছে। তিনি এ বিষয়ে বলেন, ‘আমি কখনো কোর্টে যাওয়ার কথা বলিনি।

মনের ভুলে বা আবেগতাড়িত হয়েও বলিনি। তাকে নিয়ে কোর্টে যাওয়ার ইচ্ছা আমার হতে পারে না। মিডিয়াতে অনেক ধরনের রিপোর্টিং হয়। আমি জানি না, কেন মিডিয়া এ ধরনের নিউজ করেছে। এটা ভুল।

যারা করেছেন, একটি প্রমান দেখান। কারণ, আমি এ কথা বলিনি। আমি সবার কাছে হাতজোড় করে সবার কাছে অনুরোধ করেছি। আমি আমার শাশুড়ীর পায়ে ধরে অনুরোধ করেছি। যে অনুরোধ করে, সে হুমকি দিতে পারে না।

সে কোর্টে যেতে পারে না। ’ শাওন এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেনÑ ‘আজ যারা এত কথা বলছেন, তারা এই দশ মাস কোথায় ছিলেন’। এ প্রসঙ্গটি তোলা হলে তিনি বলেন, ‘আমি হুমায়ূন আহমেদকে সুস্থ করার জন্য শেষ দশ মাস আমি যা করেছি, তার জন্য আমি কোন ধন্যবাদ চায়নি। কারণ, এটা আমার দায়িত্ব ছিলো। এর এটা করার পিছনে সাহস পেয়েছি, তার কারণ ছিলো হুমায়ূন আহমেদ।

সেখানে তার মৃত্যু, দুই দিনের ভ্রমন শেষে শারীরিক ও মানসিকভাবে খুব অসুস্থ হয়েছি। এরপর শহীদ মিনারে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদনে লাখো মানুষের ভিড়। সে সময় তার এক সন্তান মিডিয়ায় বলেন, তার বাবা নুহাশ পল্লীতে কবর দিতে মানা করেছেন। সে কথা শুনে আমি ঐ কথা বলেছিলাম। কারণ, সে কথা বলার জন্য ওর বাবা ওকে পাননি।

সন্তানদের অভিমানের অনেক কারন ছিলো, কিন্তু হুমায়ুনের কষ্ট ছিলো। সেই পয়েন্ট অব ভিউ থেকে ঐ কথা বলেছি। ’ আপনি বিজনেস ক্লাসের টিকিটে আসতে চেয়েছিলেন, কিন্তু কেন এই চাহিদাÑ এ প্রশ্নের উত্তরে শাওন বলেন, ‘আমি বা আমার সফরমঙ্গীরা কেউ বিজনেস ক্লাসের টিকিট চাই নি। কারন, তা বলার মতো পরিস্থিতি তখন ছিলো না। আমি হুমায়ূনের সাথে একই ফ্লাইটে আসতে চেয়েছি।

কারণ, হুমায়ূনের মরদেহ আসছিলো এমিরেটাস আর আমাদের টিকিট ছিলো জেট এয়ারওয়েজের। যেহেতু আমরা এক সাথে আসতে চেয়েছি, সেজন্যই আমাদের আসতে বিলম্ব হয়েছে। এছাড়া আর কোন কারণ ছিলো না। ’ হুমায়ূন আহমেদের সাথে তার প্রথম পরিচয় প্রসঙ্গে বলেন, ‘১৯৯১ সালে হুমায়ূন আহমেদের সাথে প্রথম পরিচয়। একটি ডকুফিল্মে অভিনয় করার সুবাদে।

তখন আমি নতুন কুঁড়িতে ও ক্লাস সিক্সে পড়ি। ’ হুমায়ূন আহমেদের মেঝো মেয়ে শীলা আহমেদ আপনার বান্ধবীÑ এ কথা কতটুকু সত্য?Ñ এর জবাবে তিনি বলেন, ‘শীলার সাথে আমার পরিচয় ১৯৯৬ সালে। একটি নাটকে কাজ করার সুবাধে। আমি ভিকারুননিসা আর শীলা হলিক্রসের ছাত্রী ছিলাম। শীলা আমার দুই বছরের জুনিয়র।

ও আমি এক সাথে অভিনয় করেছি। একসাথে কাজ করতে করতে ওর সাথে আমার সখ্যতা গড়ে উঠেছিলো। কিন্তু বান্ধবী বলতে যা বোঝায়, তা আমরা ছিলাম না। ’ হুমায়ূনের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলায় মানুষ এ সম্পর্ক মেনে নেবে কি নাÑ এ বিষয়ে ভাবতেন কি না?Ñ জবাবে শাওন বলেন, ‘এ বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করি নি। আমি ওকে একা দেখেছি।

একজন লেখক অনেক মজার কথা বলেন। সেই হুমায়ূন আহমেদের পিছনের মানুষকে দেখেছি। একজন দুঃখী ও রাগী হুমায়ূনকে দেখেছি। ওনার পাশে দাঁড়ানোর একজন মানুষের দরকার ছিলো। সে চিন্তা থেকেই তার সাথে আমার সম্পর্ক।

’ হুমায়ূন আহমেদের সংসার ভাঙ্গার পিছনে বা তার একা হয়ে যাওয়ার পেছনে আপনার হাত ছিলো কি নাÑ এ প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘ওে একা হওয়ার পিছনে আমার কোন হাত ছিলো না। তার জীবনের অনেক পর্যায় আছে। আমি একটি পর্যায় দেখেছি, অন্য পর্যায়গুলো দেখিনি। সত্যিই জানি না, কেন হুমায়ূন আহমেদের অবস্থান পরিবর্তন হয়েছে। আমি নিজেও তাকে সুখী সংসার করতে দেখেছি।

একা হওয়ার পেছনে শুধু প্রেম ছিলো না, কিন্তু এছাড়াও আরো কারণ আছে। আমি পরবর্তীতে জানতে চেয়েছি। কিন্তু, তিনি এসব বিষয় নিয়ে কোন কথা বলেন নি। বিয়ে নিয়ে কিছু সমস্যাা হয়েছে। ওর আগের সংসারের সবার সাথে হয়েছে।

তারপরও আমরা এতে অপরকে ভালোবেসেছি। হুমায়ূন আমৃত্যু আমাকে ভালোবাসতো। এটাই আমার সামনের দিনের পথচলার পাথেয়। ’ নিজের বাকি জীবন একা কিভাবে কাটাবেনÑ এ প্রশ্নের উত্তরে শাওন বলেন, ‘আমি একা আছি কে বললো। আমি তো একা নয়।

আমার সাথে দুই জন হুমায়ূন আছে। নিষাদ ও নিনিত। হুমায়ূন আহমেদের সাথে যে স্মৃতি আছে, তা লিখে বা বলে শেষ করতে পারবো না। তিনি আমাকে অসাম্ভাবিক ভালোবাসা দিয়েছেন। এই অসাম্ভাবিক ভালোবাসা নিয়ে এ জনম তো কম, আরো চার-পাঁচ জনম থাকা যায়।

আমার আর কোন কিছুর দরকার হবে না। ’ ‘হুমায়ূন আহমেদ চেয়ার থেকে পড়ে গিয়েছিলেন’- এমন একটা তথ্য মিডিয়াতে এসেছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ হুমায়ূন আহমেদ চেয়ার থেকে পড়ে গিয়েছিলেনÑ এ তথ্য ঠিক না। তিনি যে চেয়ারে বসে ছিলেন, সে চেয়ারের নিচের দিকে পা সরে যাওয়ার তিনি পড়ে যেতে গিয়েছিলেন। সে সময় আমিই তাকে ধরে ফেলি।

পরে আমি চিৎকার করে মাজহার ভাই আর আমার মাকে ডাক দেই। তাদের সহযোগীতায় আমি হুমায়ূনকে উঠাতে পারি। ’ কোন এক কেমোথেরাপীর সময় আপনি দুই ঘন্টার জন্য বাইরে গিয়েছিলেনÑ এ প্রসঙ্গে শাওন বলেন, ‘প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, আমি কেমোথেরাপীর সময় দুই ঘন্টা তার সাথে ছিলাম না। যারা ওখানে ছিলো তারা দেখেছে আমি চব্বিশ ঘন্টা হাসপাতালে ছিলাম। যখন আমি বিশ্রামে যেতাম, ছিলাম না, তখন মাজহারুল ইসলাম চব্বিশ ঘন্টা থাকতেন।

এছাড়া আমি দুই ঘন্টার জন্য কখনোই বাইরে যায় নি। এ ছাড়া আর কি বলবো, যদি বেলভ্যু হাসপাতালের সিসিটিভি ক্যামেরার দেখানো যেতো, তাহলে হয়তো প্রমান হতো। এটা পুরোটাই একটি অবাস্তব, অবান্তর কথা। ’ ক্যান্সার হাসপাতাল ও নুহাশ পল্লী নিয়ে পরিকল্পনা প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমি প্রথম থেকেই বলেছি, হুমায়ূন আহমেদ নুহাশ পল্লীকে ট্রাস্ট করতে চেয়েছিলেন। আমি শুরু থেকে এ কথা বলে আসছি।

কিন্তু আমার একার পক্ষে এটা সম্ভব না। আমি তার প্রত্যেক উত্তরাধিকারীর কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো, যদি তারা নুহাশ পল্লীকে ট্রাস্টি করতে দেন। আমি চাই হুমায়ূন যেভাবে নুহাশ পল্লীকে দেখতে চেয়েছিলেন, তেমন ভাবেই যেন তা থাকে। ’ এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, তিনি কখনো চেয়েছেন শান্তি নিকেতনের আদলে গড়ে তোলার কথা। আবার কখনো বলেছেন, এখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলবেন।

যেখানে প্রাকৃতিক পরিবেশে ক্লাস নেওয়া হবে। কোন বিল্ডিং করে ক্লাসরুম বানানো হবে না। আবার কখনো বলেছেন, এটা যেমন আছে তেমনিই থাক। ক্যান্সার হাসপাতাল করতে গিয়ে তিনি একবার ভেবেছিলেন, নুহাশ পল্লী বিক্রি করে দেবেন। তিনি চেয়েছিলেন, যেমন আছে তেমনভাবে থাকুক নুহাশ পল্লী।

আসলে যদি সুন্দর কিছু একটা করা যায়, তা সবাই মিলেই করতে হবে। আমি ব্যাক্তিগতভাবে সবার কাছে সেই আবেদনই করবো। প্রায় দেড়ঘন্টাব্যাপী ঐ সাক্ষাতকারে শাওন বলেন, ‘নিউইয়র্কে দশ মাসের যুদ্ধে যারা আমাদেরকে সাহায্য করেছেন, সহযোগীতা করেছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। আমি তাদেরকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। বিশেষ করে বিশ্বজিৎ সাহা, রুমা সাহা, পূরবী সাহা, ঝান্ডু মন্ডল, স্বপ্না মন্ডল, আতাউর রহমান ও তার স্ত্রীকে ধন্যবাদ দিতে চাই।

এছাড়া আরো কিছু মানুষ, যেমনÑ একজন ছিলেন বাড়িভাড়া ঠিক করে দিতে, রান্নার লোক। ’ শাওন বলেন, ‘বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমি অনুপস্থিতি রয়েছি, কিছু অনুষ্ঠানে ছিলাম। গত আট বছর আমি হুমায়ূন আহমেদ ও তার মায়ের পাশের চেয়ারে বসতাম। এত অনুষ্ঠানে হচ্ছে, তাতে আমার আশা ছিলো আমার শাশুরীর পাশের চেয়ারে আমি বসবো। সেটা কোন কারনে হয়ে উঠেনি।

আমি এখনো তাকে জিজ্ঞাসা করিনি, হয়তো করবোÑ কেন আপনার পাশের চেয়ার আমার জন্য রাখেন নি। অন্তত আরেকটি চেয়ার তো আমার জন্য রাখতে পারতেন। গত আট বছর তো আমিই বসতাম। ’ এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, ‘হুমায়ূন আহমেদের ছোট ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল গত তিন জুলাই নিউইয়র্কে যান। এর আগের দিন হুমায়ূন আমাকে কাগজে লিখে শেষ কথা বলেন।

তিনি তার ছোটোভাইয়ের সাথে কথা বলতে পারেন নি। কিন্তু ছোটভাইকে দেখার ইচ্ছা তার সব সময়ই ছিলো। গত আটটি বছর তিনি তার জন্য অপেক্ষা করেছেন। আমি তাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি, তিনি তার ভাইয়ের শেষ মুহুর্তে দেখতে গিয়েছেন। তার ভাই অবশ্যই তা বুঝতে পেরেছেন।

কারণ, তার চেতনা তখনো ছিলো। ’ জাফর ইকবালকে ধন্যবাত জানিয়ে শাওন আরো বলেন, ‘ হুমায়ূন মারা যাওয়ার পর আমি বিষয়টি তখনো বুঝে উঠতে পারি নি। প্রায় পাঁচ থেকে সাত মিনিট আমি বুঝতে পারছিলাম না। আমি দেখছিলাম মনিটর বন্ধ করে দিচ্ছিলো। তখনো আমি সেই মিরাকলের অপেক্ষা করছিলাম।

তখন আমার একটা ঝাঁকির দরকার ছিলো। সেই ঝাঁকি দেন জাফর ইকবাল। ঠিক সেই সময় জাফর ইকবাল আমার হাত ধরে বলে উঠেন “শাওন, দাদাভাই আর নেই। আমার দাদাভাই আর নেই। সেই দাদাভাই, যে বাংলাদেশের মানুষকে এত দিয়েছিলেন, যা ছিলো প্রয়োজনের তুলনায় বেশি।

আমরাই দাদাভাইকে কিছু দিতে পারি নি। শাওন, তোমাকে ধন্যবাদ, দাদাভাইযের শেষ জীবনগুলোকে আনন্দময় করে দেওয়ার জন্য। ” সেই মুহুর্তে এটার দরকার ছিলো। বাস্তব জীবনে ফিরে আসতে, তার এই ঝাঁকির দরকার ছিলো। হুমায়ূন দেখে যেতে পারলেন, জাফর ইকবাল আমাকে ধন্যবাদ দিয়েছেন।

আমি তাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি, আমাকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনার জন্য। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।