জীবনে প্রাণ আসুক। প্রতিটা মুহূর্তকে আমরা সুন্দর করে তুলি।
বাতাসের জোঁক
জাহেদ মোতালেব
আমি না, গাড়ি...
সে কথা শেষ করে না। ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে হ্যান্ডেল দ্রুত ঘুরিয়ে নেয়।
রিকশার চাকা রাহেনার বাম উরু ছুঁয়ে গেছে।
নরম ও ভেজা চোখ তুলে তাকায় সে। ছেলেটা তাদের বাসার অদূরে থাকে। চেনে সে।
রিকশাওয়ালার মুখে বিব্রত হাসি। কিছু বলবে এমন ভাব।
যেন এটা অনিচ্ছাকৃত। সে খুবই দুঃখিত।
মেয়েটা চলে গেলে তার পেছন দিকে তাকিয়ে বিজয়ীর হাসি হাসে। চাকা দিয়ে উরু ছোঁয়া সঞ্চারিত হয় হাতে।
রাহেনা বাঁক নিয়ে সামান্য এগিয়েছে।
সে রিকশা নিয়ে এগিয়ে যায়। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় গায়Ñআসি আসি বলে জোছনা আমায় ফাঁকি দিয়াছে...
তার গোঁফের ফাঁকে হাসির রেখা। রিকশার গতি কমিয়ে এগোয়। ডাস্টবিনের পাশে কড়ই গাছের ছায়ায় থামে। সিটের উপর পা তুলে বসে বিড়ি ধরায়।
ধোঁয়া বড় মাছিগুলোর মতো ওড়ে। ফু দিলে তা ঘূর্ণি হয়। আরেকটা ফু দিয়ে ধোঁয়াগুলো কানা বক্করের ভালো চোখটির ভেতর ঢুকিয়ে দিতে চায়। তাকে উদাস ও শূন্য মনে হচ্ছে।
এই রিকশা যাবি?
কোনানে?
নিউ মার্কেট।
জোরে পেডেল মারে। এতে শক্তির ক্ষয় কম। একদিন চালাতে চালাতে আবিষ্কার করেছিল। পুনরায় ফুর্তিতে ফিরে আসে। গতিই তার ফুর্তি।
রাস্তার ওপাশে পাহাড়ে ডুমুর গাছের পাতা নড়ছে। এক বিকেলের কথা মনে পড়ে। জিইসির মোড় থেকেই ভাড়াটা নিয়েছিল। মেয়েটার বয়স কম। ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক।
বিকেলের রোদ গরিবুল্লাহ শাহ’র মাজারের পাশের পাহাড়ের উপর দিয়ে এসে মেয়েটির ঠোঁটে পড়েছে। হর্নের শব্দে পেছনে তাকাতে গিয়ে সে এক ঝলক দেখেছে।
অবাক হয়। মোষের মতো শরীরটা ঘামে। ইচ্ছে হয় পেছনে তাকাতে।
পাহাড়ে গরুর ঘাস খাওয়া দেখে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। পেছনে গদির উপর একটা পুতুল বসে আছেÑখুলশীর দিকে যেতে যেতে পুলকে সে নড়ে চড়ে। লুঙ্গি ঢেকে ঢুকে দেয়। বস্তির মর্জিনার গালি মনে পড়েÑমাগীর পোলা, ট্যারা চুক্ষে কি দেহস? একবার রাস্তার কলে গোসল করার সময় তার দিকে তাকালে এ কথা বলেছিল।
পেডেল উল্টো দিকে মেরে সে চলে যায় ধানক্ষেতে।
আইলের ঘাসে একটা চিনে জোঁক। জোঁক হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে বুকে ঢোকে, মগজে ঢোকে। কুছুকুছু করে রক্ত খায়। সময় বদলে যায়।
ঘাস মরে যায়। সে রোকেয়াকে খোঁজে। তার হলুদ শাড়িটা বাতাসে উড়ছে। ঘ্রাণ নিতে গিয়ে তার নাক হলুদ প্রজাপতি হয়ে যায়। প্রজাপতিটা উড়ে উড়ে রোকেয়াকে ধরতে চায়।
কিন্তু খুঁজে পায় না। ‘শালা জিয়ার চেলা, তোর বিপদ আছে মেলা। ’ কানা বক্করের চোখে জোঁক ঢুকিয়ে দিতে চায়।
এখন প্রজাপতিটা গন্ধ শোঁকে। ঈদে দেওয়া আতরের চেয়েও বেশি সুগন্ধ।
কিছুক্ষণ পর তা পিঁপড়ার মতো কুটকুট কামড়ায়। সে আকাশ দেখে। রিকশা চলে ধীরে। পেছনে ট্রাকের হর্ন। তার নিঃশ্বাস দীর্ঘতর।
ঘামে গেঞ্জি জবজবে।
পার্স খুলে মেয়েটি টাকা দেয়।
আফা, দুইডা ট্যাহা দ্যান না।
কেন? দশ টাকা দরদাম করেই তো উঠেছি।
কষ্ট করে আইছি, দুইডা ট্যাহা... দৃষ্টি থাকে লাল ঠোঁটে।
মেয়েটি কী যেন বলতে চাইল। নেভার মাইন্ড ধরনে কাঁধ ঝাঁকিয়ে দুই টাকার দোয়েল পাখি দেয়।
সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার হেঁটে যাওয়া দেখে। ক্রিং ক্রিং বেল বাজায়।
বাম পাশে খাড়া।
যাত্রীটি বলল।
আরেকটু হলেই বাসের তলে ঢুকে যাচ্ছিল। সুতো ছিঁড়তে দেরি হয়। দ্বিতীয়বারে শুনে থতমত খেয়ে দাঁড় করায়। যাত্রী নেমে পানের দোকানে যায়।
পান মুখে দিয়ে ঠোঁটে ঝুলায় সিগারেট।
তার মন ধোঁয়ার মতো দোলে। ধোঁয়া থেকে বেরিয়ে আসে প্রজাপতি। প্রজাপতি দেখে, হলুদ শাড়ি পরে রোকেয়া ফড়িং ধরতে চেষ্টা করছে। ফড়িংটা উড়ে জলাশয়ের পানা ফুলে বসে থাকে।
পানমুখে যাত্রী জিজ্ঞেস করে, এ্যাই, তোর নাম কিরে?
সে বিরস মুখে বলে, কামাল।
কোথায় থাকস?
টেসটাইলের পাশের বস্তি।
তার চোখে-মুখে বিরক্তি। ফুর্তি অনেক আগেই উড়ে গেছে। ‘হালা, কোনাই থাহি তা দিয়া তোর কাম কি।
’ মনে মনে গজরায়।
লোকটি পান চিবাতে চিবাতে বিদ্যুৎ চলে যায়। আপনমনে বলে, শালার কারেন্ট। তারপর পানের পিক ফেলে। থু ঢুকে যায় কামালের মগজে।
হেঁটে যাওয়া মেয়েটিকে খারাপভাবে দেখে।
যাত্রী ভাবে, মার্কেট থেকে হেঁটে যাব। পকেটে হাত দিয়ে জানতে চায়, হাজারী গলি গেলে তাকে আর কয় টাকা দিতে হবে। আট টাকা বললে যাত্রী চলে যায়।
দশ টাকা হাতে নিয়ে কপালের ঘাম মোছে সে।
দুপুর থেকে পঞ্চান্ন টাকা আয় করেছে। রিকশার ঝাঁকের ভেতর গদিতে বসে বিড়ি টানে। টান পড়ে তার স্মৃতিতেও। একটা আম গাছ মটমট করে ভেঙে পড়তে থাকে। কাক হয়ে কোনো ডাস্টবিনে বসবে! নিউ মার্কেটের পাশে রিকশায় হেলান দিয়ে মেয়েটির ঠোঁট ও পা নাড়ানো দেখে।
বিচিত্র ভঙ্গিতে পান খাচ্ছে। যেন ডাকছে ফিসফিসিয়ে। তার হৃদপিণ্ডটা হঠাৎ লাফিয়ে রাস্তায় পড়ে। মৃতের মতো অপলক চোখে সে রাস্তার দিকেই তাকিয়ে থাকে।
কয়েক মুহূর্ত পর মেয়েটির পায়ের দিকে তাকায়।
ডান পায়ের বুড়ো আঙুল সোডিয়াম আলোয় ফেকাসে। তাকে ডাকছে, আয়, আয়। রোকেয়া যে রাতে গলায় শাড়ি পেঁচিয়েছিল সেই রাতের চাঁদটি তার মগজে ঢোকে। তাকে এলোমেলো করে দিয়ে ডাকে, আয় আয় আমার ঘরে আয়।
ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদের আলোয় দেখা বিহ্বল চোখগুলো মনে পড়ে।
সেই চোখে রহস্যময় হাসি ছিল। হাসির মানুষটা যদি ফিরে আসত! ভাবতে ভাবতে তার চোখে কুয়াশা জমে। চোখগুলো ভিজে উঠেছে।
গুটি গুটি পায়ে মেয়েটির পাশে দাঁড়ায়। বুক কাঁপে।
রাস্তার উল্টোদিকের দোকান আর আকাশের দিকে তাকায়। ফিসফিস করে, কত?
মেয়েটি মিটিমিটি হাসে। পকেটে ট্যাহা আছেনি?
ওই চোখ দুটা যদি ছুঁতে পারতাম! রোকেয়া মনে হয় তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটার মুখের দিকে তাকাতে পারে না।
‘চলো, আইজ...’ মেয়েটি রিকশায় ওঠে আর সে উদ্যমে চালায়।
গুনগুন করে। সুখ কল্পনায় ভরে ওঠে। পেডেল মারার অনুভূতি টের পাচ্ছে না। গতি বাড়ে। মেয়েটি খিলখিল হাসে।
ডায়রিয়া রোগী যেভাবে পায়খানার দিকে দৌড়ায় সেভাবে দৌড়ায় সে। দৌড়ে পৌঁছে একটি ঘরে। ঘরময় আঁধার। সব আঁধার পান করে তার চোখ দেখতে চায়। পারে না।
হলুদ শাড়ির খসখস শব্দ শুনতে চেষ্টা করে। পারে না। শাড়িটা যে নিম গাছে বাঁধা। শাড়ির প্রান্তে বাঁধা রোকেয়ার গলা। ঝুলে ঝুলে ঘুমাচ্ছে!
তারও ঘুম আসে।
পানিতে বরই পাতা দিয়ে কয়েকজন লোক তার ঘুমকে সিদ্ধ করে। তখন আলো ডুবে যায়। অন্ধকার থেকে কটকটে গোলাপি রঙের মতো হাসির শব্দ আসে। সেই হাসিতে লুকিয়ে আছে হাহাকার। ভেতরে একটা পুরনো রিকশা চলে।
সে রিকশাটার প্যাসেঞ্জার হতে চায়। নিম গাছের ডালে, পাতায় ঠোঁট বুলিয়ে দিতে চায়। মনে হয় তার পেছনে নিম গাছের গন্ধ। সে জোরে নিঃশ্বাস টানে।
রিকশা থামে।
পায়ের কাছে গু। পাশের ঝুপড়ির রোগা মা প্লাস্টিকের বদনা দিয়ে ছেলেটির নির্মাঙ্গে পানি ঢালছে। এই স্রোত দরজার পাশে ক্লান্ত কুকুরটির কাছে এসে থেমে যায়।
সে গোঁফে হাত বুলায়। মেয়েটির পা গুয়ে পড়েছে।
বিশ্রী গালি দেয়। ঘরে ঢোকার পর ঝড়ো আবেগে মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে সে। মুখ ঝামটা মেরে মেয়েটি বলে, হু, রসের নাগর হইছস?
কামালের মনটা স্রোতের মতো হয়ে যায়। এসেছে কাপড় খুলতে। জোছনা মাখা মুখ, হলুদ শাড়ি, শাড়িতে হাঁসের রেখাগুলো দেখে এখন ইচ্ছে করে কাপড় পরিয়ে দিতে।
নিজেকেও শরমের কাপড় পরাতে ইচ্ছে হয়।
ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু ঘটনা মাথা থেকে বেরিয়ে মেয়েটির মুখে প্রতিফলিত হয়। সেই মুখ তখন বর্ষার স্কুল মাঠ হয়ে যায়। সে ঢুকতে থাকে মেঘের ভেতর, জলের ভেতর। ধরতে চায় উড়ে যাওয়া শাড়িটি, পৌঁছতে চায় ভেজা মুখটির পাশে।
তাই জাম্বুরা দিয়ে বানানো বলটিতে জোরে কিক মারে। বল বৃষ্টিতে ওড়ে। বৃষ্টির শব্দে ক্রমশ মুছে যায় গোলবার। বলটি উড়ে এসে রাস্তায় পড়ে। রাস্তা তো ভাঙা।
ভাঙা রাস্তায় ঝাঁকি খেতে খেতে রিকশা চালায় সে।
নীরবতা সহ্য করতে পারছিল না। মেয়েটি কাদার ভেতর থেকে উঠে বলে, নাম কি?
কামাল মনে মনে চিৎকার করে, গো-ও-ও-ল।
কী হইছে?
সে জবাব দেয় না।
মেয়েটি জিজ্ঞেস করে, বাড়ি কোনাই?
নাই।
রিশকা তোমার?
না।
কার?
আমার বউয়ের?
বউ কোনাই?
কামাল মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হাসে। ওই তো।
সে মুখ বাঁকায়। বলে, আহারে! তোমার কে আছে?
তার গালি দিতে ইচ্ছে করে।
কিন্তু রসের সুরে বলে, তুমি।
খিলখিল হাসে মেয়েটি। তোমার ভেতরটা দেহি রসে টুসটুস। ও আমার রইস্যা বন্ধুরে।
রাত যখন বেড়েছে বাসায় চার-পাঁচজনের মাঝে কামাল শোয়া।
মাথার নিচে তেলচে বালিশ। টিনের চালের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
একটু আগে ট্রেন গেছে। এখন কোনো শব্দ নাই। বিকেলের মেয়েটির কথা ভাবে।
মাকে রেল গাড়িতে তুলে দিয়ে স্টেশন থেকে আসছিল। মা কাঁদে, মেয়ের মুখে হাত বুলিয়ে দেয়। মেয়ের চোখ ভেজা। বাসায় ফিরেছিল ওই চোখ নিয়ে। সে ভাবে, মেয়েটি তার হোক।
ভেজা মুখের মেয়েটিকে পাশে রেখে শিশুর কান্না শোনে। কান্না বের হতে চায় তার ভেতর থেকে। অনুচ্চ কণ্ঠে বলে, শালা কানা বক্কইরা, এ্যাকদিন না এ্যাকদিন তুর চোখটা থাকব না। তুই রোকেয়ারে মারছস।
ভাবে, সকাল ছয়টা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত রিকশা চালাবে।
দেখবে কেমন লাগে। মাথার ভেতর হেসে উঠে মেয়েটি। চূড়ান্ত তৃপ্তিতে পৌঁছতে সে আবার রিকশা চালাতে শুরু করে। চালায় ভেতরের রিকশাটি। পৌঁছে যায়, ধরবে কারো হাত।
তখনই হ্যান্ডেল ছেড়ে দেয় সবকিছু উপেক্ষা করার ভঙ্গিতে। ঝাঁকি খেয়ে চলে রিকশা।
(বাংলানিউজ২৪.কমে প্রকাশিত)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।