-এই সাদিব, কি করছিস ঘরের ভেতর শুয়ে শুয়ে? ওদিকে তোকে যে আমরা সবাই খুঁজে খুঁজে হয়রান!
-কেন রে? কি হয়েছে?
-কি হয়েছে, বুঝ না, না? আজ না আমাদের মিশনে যাওয়ার কথা?
-কিসের মিশন?
-কেন, আমরা যে ইসলাম বিরোধীদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছি! তাই তো আজ সবাই মিলে নোয়াপাড়া যাচ্ছি ওখানকার খ্রিস্টান কলোনিটা পুড়িয়ে দিতে।
-ও মা! কেন? ঐ নিরীহ সংখ্যালঘুরা আবার কি করল?
-তুই জানিস না বুঝি যে শালার খ্রিস্টান ইহুদিরা আমাদের মহানবী (সাঃ)-কে হেয় করেছে, ইসলামের অবমাননা করেছে! যাইহোক, সবই তো তুই জানিস। এতদিন ধরে পেপার পত্রিকাতে নিউজ তো কম বেরল না এ ব্যাপারে। এখন আর ঢং করিস না ঘরে বসে। তাড়াতাড়ি চল আমার সাথে!
-নারে বেলাল।
আমি যাব না।
-ছিঃ ছিঃ এসব কি বলছিস? ইসলামের হয়ে একটা কাজ করার সুযোগ পেয়েছি, সেটা এভাবে হেলায় হারাবি কেন?
-দ্যাখ, আমার কিন্তু মনে হচ্ছে তোরা যা করছিস তা ঠিক হচ্ছে না।
-তার মানে কি? তোর মতে অমুসলিমরা আমাদের নিয়ে যা করছে, তা ঠিক? তুই তো একেবারে কাফের হয়ে গেলি রে সাদিব!
-দ্যাখ ভাই! আমাকে ভুল বুঝিস না। স্যাম বাসিল নামের লোকটা যা করেছে, তা আমারও মনোজগতে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছে। আমিও মন থেকে মেনে নিতে পারছি না ইসলামের এই চরম অবমাননা।
-তাহলে? তাহলে আর তোর যেতে বাঁধা কোথায়?
-বাঁধা যে আমার বিবেক! বিবেকের কাছে প্রশ্ন করে যে তোদের কাজে যোগ দিতে সাড়া পাচ্ছি না মন থেকে।
-হায় রে! তোর এ কেমন বিবেক! ইসলামের হয়ে কাজেও সে তোকে বাধা দিচ্ছে! আসলে তোর মনে শয়তান ভর করে ছেড়ে রে সাদিব।
-সে তুই আমায় যা খুশি বল বেলাল। কিন্তু আমি তোদের সাথে তোদের এই তথাকথিত জেহাদে অংশ নিতে পারব না।
-কেন? কেন সেটা বল আমায়!
-কারণ তুই ভেবে দ্যাখ।
সেই সুদূর আমেরিকায় বসে কিছু বেপথে চলে যাওয়া ইহুদি আর কপটিক খ্রিষ্টান মিলে ইনোসেন্স অফ মুস...
-নাম নিস নে, নাম নিস নে। ওতে আমাদের পাপ হবে!
-আচ্ছা বেশ! কিন্তু কিছু বেপথে যাওয়া মানুষ মিলে একটা ফিল্ম বানাল। কিন্তু তার জন্যে তো আমরা তাদের গোটা শ্রেণি, জাত বা জাতিকে দোষারোপ করতে পারি না। ওরা যে ধর্মের, সে ধর্মেও তো ভিন্ন ধর্ম বা ধর্মালম্বিদের আঘাত করার কথা উল্লেখ নেই। তাই ওরা যা করছে, তাতে ওরা শুধু অন্যের ধর্মের নয়, নিজেদের ধর্মকেও অপমান করছে।
-তাহলে তুই এখন কি বলতে চাস?
-আমি স্রেফ এ-ই বলতে চাই যে, ফিল্মটা যারা বানিয়েছে, তারা অবশ্যই ধিক্কারপ্রার্থী। কিন্তু তাই বলে আমরা আমাদের নিজ দেশের কিছু সংখ্যালঘুর প্রাণ নিয়ে কেন ছিনিমিনি খেলব? তারা তো কোন অন্যায় করে নি। তারাও তো আমাদের মতই মানুষ। তাদেরও বাঁচার অধিকার আছে। সেই অধিকারকে যদি সম্মানই করতে না পারি, তবে আমরা কিসের মুসলমান? তারপরে আরও দ্যাখ, লিবিয়ায় মার্কিন দূতাবাসে হামলা চালিয়ে রাষ্ট্রদূত ক্রিস্টোফার স্টিভেন্সকে এই যে হত্যা করা, তা কি ঠিক হল? ঐ ভদ্রলোক কি দোষ করেছিল? আমেরিকান হওয়া বা জাতে খ্রিস্টান হওয়াই কি তার অপরাধ? তারপর পাকিস্তানেও তো একটা মানুষ মরল এই সহিংস বিক্ষোভেরই জের ধরে।
আমাদের পবিত্র কোরআনে কিন্তু আল্লাহ ইরশাদ করেছেন যাতে আমরা অন্য ধর্ম ও দেশের মানুষকে মানুষ হিসেবে তাদের প্রাপ্য সম্মান দেই। তাহলে আজ কেন অসহায়, নির্দোষ কিছু মানুষের বাঁচার অধিকার হরণ করব জেহাদের নামে?
-তার মানে আমরা কি করব বল? তোর মত হাত গুটিয়ে বসে থাকবো? বিছানায় হাত-পা মেলে দিয়ে টানটান হয়ে শুয়ে থাকবো?
-অবশ্যই না। এরকম অবস্থায় আমাদের জিহাদ করতে হবে।
-তাহলে যে একটু আগে তুই-ই জিহাদের নামে এতকিছু বললি?
-নারে। আমি জিহাদের বিরুদ্ধে কিছু বলি নি।
তোরা যা করতে যাচ্ছিস, তা তো আদতে জিহাদ নয়।
-তাহলে সেটা কি? আর জিহাদই বা কি?
-তোরা যা করতে চাচ্ছিলি, তা হল হুজুগে গা ভাসিয়ে বেধর্মিদেরই অনুকরণ করা। তারাই কেবল পুর্বাপর বিচার না করে কাজ করে। কিন্তু আমরা সত্যের ধর্মের পূজারি। আমাদেরও ধর্ম রক্ষায় নামতে হবে।
জিহাদও করতে হবে। কিন্তু তার আগে যে আমাদের জিহাদের প্রকৃত সংজ্ঞা জানতে হবে।
-তাই তো জানতে চাচ্ছি, তোর কাছে জিহাদ মানে কি?
-আমি তো আমার কাছে জিহাদ মানে কি তা তোকে বলছি না। কোরআনে আল্লাহ যা বলেছেন এ সম্পর্কে, তাই বলছি। ইসলামের পরিভাষায় জিহাদ হল আল্লাহর দিনকে বিজয়ী করার জন্য সকল প্রতিকূল শক্তির বিরুদ্ধে দৈহিক, মানসিক, আর্থিক ও জ্ঞানবুদ্ধি দিয়ে প্রচেষ্টা চালান।
সুতরাং অহেতুক সহিংসতার নাম জিহাদ হতে পারে না, যেমনটা তোরা করতে যাচ্ছিলি। কোন পার্থিব উদ্দেশ্যও জিহাদ হতে পারে না।
-তার মানে কি? তোর কি মনে হয় আমরা পার্থিব উদ্দেশে এ কাজ করছি?
-না তোরা তা করছিস না। কিন্তু তোরা যেসব ইসলামের নামে ভুয়া স্বার্থান্বেষী সংগঠনের অনুকরণ করছিস, তারা করছে। আর এভাবে কিন্তু তারা গোটা মুসলিম সম্প্রদায়েরই ক্ষতি করছে।
-যেমন?
-যেমন ধর কিছু সংগঠন জিহাদের আড়ালে জঙ্গিবাদী কার্যক্রম চালাচ্ছে। কেউবা ধর্মের নামে খোলা ওয়েবসাইট এ উগ্র মন্তব্য ছড়িয়ে দিয়ে সেই ওয়েবসাইটকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে প্রচুর অর্থ কামিয়ে নিচ্ছে।
-তোর বক্তব্য বুঝলাম। কিন্তু তাহলে আমরা মরিস সাদেক, টেরি জোনস, সালমান রুশদির, স্যাম বাসিলের মত লোকেদের রুখতে কি করব?
-অহিংস বিক্ষোভ আন্দোলন চালানই যায়। কিন্তু তা কেবল লোক দেখান হলে হবে না।
সেই প্রচেষ্টা যেন সফলকাম হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। তবে এও লক্ষ্য রাখতে হবে তার দরুন কোন নিরীহ মানুষের ওপর যেন অবিচার না হয়। তবে অহিংস আন্দোলনে কাজ না হলে দৈহিক শক্তিই প্রয়োগ করতে হবে, যার উল্লেখ আমরা ইতোপূর্বেও পেয়েছি মহানবীর জীবনে সংগঠিত উহূদ, বদর প্রভৃতি স্থানে হওয়া যুদ্ধে। আর আরেকটি কথা আমাদের বুঝতে হবে, বেধর্মিরা কেন এভাবে একের পর এক ইসলামকে, মহানবীকে আক্রমণ করে যাচ্ছে।
-কেন?
-কারণ তারা মুসলমানদের বিশ্বাসে আঘাত হানতে চায় যাতে মুসলমানরা সরল বিপ্লবী মনে এমনকিছু করে, যার প্রেক্ষিতে তারা পৃথিবীর কাছে ইসলামি রাষ্ট্রগুলোকে কোণঠাসা করে রাখতে পারে।
কিন্তু তাদেরকে আর আমাদের সরলতার সুযোগ নিতে দেওয়া যাবে না। এমন পরিস্থিতিতে বরং আমাদের এক হয়ে সত্যকে সংরক্ষণ ও পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাদেরকে বুঝিয়ে দিতে হবে যে মুসলমানদের এই ধর্মের ভিত্তি সরলতা নয়, সত্য।
-এইটা ভাল বলেছিস ভাই। আমি তোর কথা শুনে এখন নিজের ভুল বুঝতে পারলাম।
চল বাকি সবাইদেরকেও বোঝাই, এটাই ধ্রুব সত্য যে ইসলাম সত্যেরই ধর্ম, সরলতার নয়।
পুনশ্চঃ
# 'ইনোসেন্স অব মুসলিমস' চলচ্চিত্রের পরিচালক নিজেকে স্যাম বাসিল নামে পরিচয় দেয়। এটি তার ছদ্মনাম।
# দুজন মার্কিন নাগরিক নিজেদের ওয়েবসাইটে 'ইনোসেন্স অব মুসলিমস' ছবির প্রচারণা চালিয়েছিলো। তাদের একজন হলো খ্রিষ্টীয় চরমপন্থী যাজক টেরি জোনস এবং অন্যজন ওয়াশিংটনের আইনজীবী মরিস সাদেক (ইনি এক মিসরীয় বংশোদ্ভূত কপটিক খ্রিস্টান)।
# সালমান রুশদির হল ইসলাম বিরোধী ব্যাঙ্গার্থক বই 'দ্য স্যাটানিক ভার্সেস' এর রচয়িতা। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।