প্রিয় অপরাজিতা,
আশা করি চমৎকার আছো। অনেকদিন হলো তোমার সঙ্গে যোগাযোগ নেই, ইচ্ছে করেই করা হয়ে ওঠেনা। এই উত্তরাধুনিক যুগের আধুনিক প্রযুক্তিগুলো মানুষকে 'এক' করতে যেয়ে 'অনেক' করে ফেলেছে। ঠিক যেমন আমি তুমি, আমরাও 'এক' হতে যেয়ে 'অনেকে' হয়ে গেছি। মাঝে মাঝে পুরোনো বন্ধুদের কাছ থেকে তোমার খোঁজ পাই কিছু, অল্প কিছু তথ্য পাওয়া যায়, এ ছাড়া ত্যামন বিশেষ কিছু আর জানা হয়ে ওঠেনি তোমার ব্যাপারে।
তোমার শেষ দুটো চিঠি পেয়েছিলাম, উত্তর দেয়া হয়নি ব্যস্ততার কারনে। তোমার এই গুন টা আমার খুব ভালো লাগে এই আধুনিক যান্ত্রিকতায় ও তুমি চিঠির মত একটা অপ্রয়োজনীয় জিনিষকে খুব প্রাধান্য দাও।
তুমি চিঠিতে লিখেছিলে আমি যেন আবারো আমার একাডেমিক পড়াশোনা শুরু করি, তুমি চাও আমি সমাজে প্রতিষ্ঠিত হই, সুখি হই।
বলেছিলে 'তিন বছর কোন ব্যাপার নয়, আবারো সি এ টা শুরু কর শেষ করাটা তোমার জন্য কোন কষ্ট হবে না। '
আমি চাইলেই তা পারি অপরাজিতা, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে তুমি যে সমাজে আমাকে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চাও, আমি কি আদৌ সেই সমাজের মানুষ?
আমিতো তোমাদের হাতে গড়া সমাজের মানুষ না, এই সমাজকে আমার আপন মনে হয়না তা তুমি জান।
এই সমাজ এই শিক্ষা আমাকে আমি হতে দ্যায় নি, আমাকে শিখিয়েছে কিভাবে মধ্যবিত্ত হতে হয়, কিভাবে পুঁজিপতিদের গোলাম হতে হয়, একটা ভুল রাস্তায় ভুল মেনে নিয়ে মাথা নিচু করে চলতে শিখিয়েছে। শিশুকালে আমাকে বাবা মা শিক্ষকেরা পড়িয়েছেন
'সদা সত্য কথা বলিবে'
অথচ ঘুম থেকে উঠেই তারা মিথ্যা দিয়ে দিন শুরু করেছে।
তারা শিখিয়েছে-
'সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি
সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি
আদেশ করেন যাহা মোর গুরুজনে
আমি যেন সেই কাজ করি ভালো মনে'
তারা একি সঙ্গে আমাদের ভালো হয়ে চলার উপদেশ দ্যান একি সঙ্গে আমাদের শৃঙ্খলিত জীবনে বেধে ফ্যালেন। যে শিক্ষন আমাকে সদা সত্য কথা বলিবে, সৎ পথে চলিবে উপদেশ দিয়েছেন, তাকেই আমি দেখেছি পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র ফাঁস করতে।
তারা শিখিয়েছেন
'সকলের তরে সকলে আমরা
প্রত্যেকে মোরা পরের তরে'
অথচ বিশ্বাস কর রাস্তাঘাটে ভিখারী বা রিকশাওয়ালার সাথে কি দুরব্যাবহারটাই না করতে দেখেছি আমি তাদের!!!
অপরাজিতা, তাদের বাস্তব জীবনের সাথে বই এর জীবনের কোন মিল নেই, এটা তুমিও জান আমিও জানি।
তারা তাদের বাস্তব জীবনের ওপর একটা পাতলা ফিনফিনে পর্দা দিয়ে আমাদের আড়াল করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সেই শিশুকালেই আমরা সব নোংরামি দেখেছি, আমরা শিখে গেছি যা তারা ঠুনকো বুলি আর বই এর পাতার কথায় আড়াল করার চেষ্টা করেছে।
অপরাজিতা মনে আছে একদিন তোমার ফুফুর সাথে দ্যাখা হয়েছিল, তিনি বলেছিন 'মানুষ হও বাবা'
অপরাজিতা, আমি মানুষ হওয়া ব্যাপারটাকে তখনো সংজ্ঞায়িত করতে পারিনি এখনো পারিনা। মানুষ হওয়া বলতে তোমরা বোঝ এই সমাজের একটা সুস্থ বেতনের চাকরি, ছাদের নীচে রাত্রি ব্যালা আরাম করে ঘুমাবার নিশ্চয়তা। কিন্তু আমার তা মনে হয়নি অপরাজিতা। যে কোটি কোটি মানুষ খেতে পারছে না, সকাল সন্ধ্যা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে পরিবারের তিনব্যালা খাবার চাহিদা পুরন করতে পারেনা, যাদের ঘরে বর্ষার পাণি ঢোকে তারা কি তবে মানুষ নয়? আমি যদি খেটে খাওয়া দের একজন হই আমি কি মানুষ হবনা?
সি এ পড়ে আমি কি হব? একজন পুঁজিপতির ছাপোষা, যে এই কোটি কোটি মানুষ কে শুষে ফুলে ফেঁপে উঠছে? আমার নিজস্বতা কোথায় থাকবে তাহলে? তুমি মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে কি হয়েছো ? একটা বহুজাতিক কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার? তাতে তোমার স্বকীয়তা কোথায়? তুমি ই আমাকে বলেছিলে যে তুমি ডিজাইনার হতে চাও, কিন্তু বেছে নিলে ইঞ্জিনিয়ারিং , কেন? নিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য? এখন একটা নিশ্চিত ভবিষ্যৎ পেয়েছো নিশ্চই? এই নিশ্চিত ভবিষ্যত কি তুমি সুখি অপরাজিতা? এমন এক ভবিষ্যৎ যেখানে তুমি তুমি নেই।
আমি কোন ভবিষ্যতের জন্য নিজেকে হারাতে চাইনা, আমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাটাও পুরন হবেনা। আমার তোমাদের সমাজের শিক্ষিত হওয়া হবেনা। কিন্তু বিশ্বাস কর এই অশিক্ষিত, মূর্খ নিজেকে নিয়েই আমি সুখি এবং স্বাধীন।
অপরাজিতা, তোমার মনে আছে হয়ত, একদিন বাসে তোমাকে একজন পুরুষের পাশে বসিয়েছিলাম, তুমি ভিষন রেগে গিয়েছিলে, বলেছিলে- 'তোমার কোন বোধ নাই, আমাকে তুমি নির্দ্বিধায় অন্য পুরুষের হাতে তুলে দিতে পারবা '
হা হা হা
অপরাজিতা, দু বছর আগে রাজশাহীর প্রত্যন্ত এক এলাকায় গিয়েছিলাম ঘুরে দেখতে, সেখানে গিয়ে দেখলাম ভিশন সোরগোল বাজারের মাঝে, ঘটনা হচ্ছে মোহাম্মদ রব নামে এক তাড়িখোড় মাতাল দুদিন আগে তার বউকে তিন হাজার টাকার বদলে বিক্রি করে দিয়েছে, তুমি হয়তবা খবরের কাগজের কোনে পরে থাকবে সংবাদ টা। সমাজপতিরা তাঁকে দোশি সাব্যস্ত করেছে, ন্যাড়া করে গ্রাম ঘুরিয়েছে, তারপর তাড়িয়ে দিয়েছে।
কিন্তু কেউ খোঁজ নিতে যায়নি একজন মানুষ কিসের তাড়নায় তার নিজ স্ত্রী কে বিক্রি করে দিয়েছে। পুরা বিচারকার্যে মোহাম্মদ রব একটা কথাও বলেনি, শুধু চোখের পাণি ফেলেছে। আমি তার চোখে রাগ ক্ষোভ লালসা দেখিনি, এই সমাজের প্রতি একটা ভয়াবহ ঘৃণা দেখেছি অপরাজিতা।
অন্য পুরুষের হাতে নিজ ভালোবাসা তুলে দেয়ার ভয়াবহতা সম্পরকে তোমার ধারনা নাই অপরাজিতা, তাই তুমি সেদিন বোঝো নি।
তুমি বলেছিলে শরীরের যেন খেয়াল রাখি, ঠিকমত যেন খাওয়া দাওয়া করি।
তুমি শুনে খুশি হবে, আমি এখনো তিনব্যালা খেতে পাই, মাছ মাংশ দিয়ে না হলেও শাক পাতাড়ি দিয়ে চলে যায়, সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে এদেশে আলু নামে একটা খাদ্য আছে, এবং এটার জন্যই বোধয় এখনো বেঁচে আছি তবু ভালো আমি তিন ব্যালা খেতে পাই অপরাজিতা, পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ আছে যাদের তিন ব্যালা আহার জোটে না। আমি এখনো তাদের কাতারে পড়িনি।
তুমি হয়তোবা শুনে অবাক হচ্ছ এমন মানুষ কোথায়!!! তোমার অবাক হওয়াটাই স্বাভাবিক, কারন তোমাদের সমাজবিজ্ঞানে এসব মানুষের স্থান নেই তাই তোমরা এসব মানুষের সঙ্গে পরিচিত নও। তোমরা প্রান্তিক মানুষ বলতে বোঝ ঢাকা শহরে চলাচলের সময় রাস্তায় চোখে পড়া জরাজীর্ণ কিছু কুৎসিত মানুষ। তাদের দুটাকা দিয়ে তোমরা ভাব সমাজের উপকার করে ফেললাম, সমাজ শুদ্ধ হয়ে যাবে।
তারা প্রান্তিক মানুষের ০০০১ শতাংশও নয় অপরাজিতা। তুমি কলেজে থাকা অবস্থায় বেশ কিছু চ্যারিটি করেছো, সারাদিন ঢাকায় খুজে খুজে অভাবি মানুষ বের করে তাদের হাতে দু চার হাজার টাকা দিয়েছো, রাস্তার শিশুদের দু বছর পড়িয়েছো, সন্ধেব্যালা কিছু করার সার্থকতা নিয়ে শান্তিতে ডিনার করে আমাকে ফোন করে সারাদিন কত উপকার করলা তার গল ফেঁদেছ। রাত্রে ঘুমাবার সময় ভেবেছো এভাবেই সমাজ পাল্টে যাবে, পাল্টে দিয়েছো। সমাজ এভাবে পালটায় না অপরাজিতা, এই ০০০১ ভাগ মানুষকে তোমরা উদ্ধার করতে পারোনি, শুধু তাদের ঢুকে ঢুকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করেছো, যেন সমাজপতিরা তাদের নতুন উদ্যমে শোষণ করতে পারে। এটা সমাজ পাল্টানো নয়, তমাদের এই সমাজকেই শুধু সচল রাখার একটা ধূর্ত উপায় মাত্র।
তুমি বলেছিলে এতই যখন বোঝ তখন কিছু কর না কেন সমাজের জন্য। আমি কিছুই করতে পারিনি অপরাজিতা, কারন কি করতে হবে তা আমি জানিনা। তবে কি বর্জন করতে হবে তা আমি জানি, আমি তা বর্জন করেছি, এখন খুজছি কি গ্রহন করতে হবে, যদি আমি তা নাও পাই আমার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পাবে নিশ্চিত।
এই আধুনিক যুগে তোমরা বিদ্রোহের নতুন অস্ত্র পেয়েছো, ফেসবুক, ব্লগ, টুইটার। সারারাত তোমরা আন্দোলন কর ব্লগে ব্লগে।
যে আন্দোলনের নব্বই শতাংশই হচ্ছে তমাদের মধ্যবিত্ত সমাজের সুযোগ সুবিধা নিয়ে, তোমাদের গাড়ি আটকে যায় জ্যামে তা নিয়ে আন্দোলন, তোমাদের ইলিশ মাছ ৮০০ টাকা কেজি তা নিয়ে আন্দোলন, তোমাদের স্কুল কলেজের ভর্তি বানিজ্য নিয়ে আন্দোলন। দু দশখানা স্ট্যাটাস। কালে ভদ্রে দশ শতাংশ প্রান্তিক মানুষদের কথা বল তোমরা। কিন্তু তাও সেই প্রান্তিক মানুষের ০০০১ শতাংশ মানুষ যা তোমরা রিকশায় বসে বা গাড়িতে বসে দ্যাখো।
অথচ তুমি কি জান অপরাজিতা বাংলাদেশের ৭৫ ভাগ মানুষ প্রান্তিক? অর্থাৎ ষোলো কোটি মানুষের মাঝে প্রায় বার কোটি মানুষ প্রান্তিক।
সত্যি করে বল তো তোমার কি এই বার কোটি মানুষের মাঝে একজনের সঙ্গেও পরিচয় আছে? একজঙ্কেও কি তুমি চেন? তুমি কি ব্যক্তিগত ভাবে দেখছো অন্তত একজন মানুষের কষ্ট ?
আমি জানি তুমি জাননা, তুমি মিশেছ বাকি চার কোটি মানুষের সঙ্গে। তোমার সমাজ এই তিন কোটি মানুষ নিয়ে অপরাজিতা।
তোমরা কৃষক বলতে বোঝ যারা জমি বরগা নিয়ে চাষাবাদ করায় , যারা অবস্থাপন্য তাদের। অথচ মূল কৃষক রা আজ জমি হারিয়ে, দিন মজুর ক্ষেত মজুরের কাজ করে।
আমি এই বারো কোটি মানুষের অন্তর্ভুক্ত অপরাজিতা।
তোমাদের সমাজবিজ্ঞানে আমাদের স্থান নেই। কিন্তু একদিন সমাজবিজ্ঞানের ব্যপ্তি পাল্টে যাবেই। কি গ্রহন করতে হবে তা না জানলেও আমি জানি আমাকে কি বর্জন করতে হবে। আমি তা করছি প্রতিনিয়ত।
কিন্তু আমার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অবশ্যই জানবে তাদের কি গ্রহন করতে হবে।
সেদিন তুমি বা তোমরা বা তোমাদের প্রজন্ম লুকোনর জায়গা পাবে না অপরাজিতা।
তুমি বলেছিলে যদি কখনও তোমার আমার দ্যাখা হয়ে যায়, জেন ভুলে না যাই। আমি তোমায় ভুল্বোনা অপরাজিতা। কিন্তু তোমারে আর আমার দ্যাখা হোয়ার কোনই সম্ভাবনা নেই। আমরা দুজন যে দুটা ভিন্ন জগতের বাসিন্দা।
ভালো থেকো, মানুষ এর মাঝে বেঁচে থেকো। ভালোবাসা রইলো।
(এই চিঠির অপরাজিতা আমার প্রাক্তন প্রেয়সী, আর কোন কিছুর সাথেই পৃথিবীর বাস্তবতার মিল নাই, পৃথিবী এই চিঠির মত চলছে না, পৃথিবী সুন্দর ও সঠিক আছে) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।