হয়তো আমি একাই... Lagaan : Once Upon a Time in India
পরিচালনাঃ আশুতোষ গোয়ারিকার
কাহিনীঃ আশুতোষ গোয়ারিকার
স্ক্রিন প্লেঃ আশুতোষ গোয়ারিকার, কুমার দেব, সঞ্জয় দায়মা।
ডায়লোগঃ কে.পি.সাক্সেনা
শ্রেষ্ঠাংশেঃ আমির খান,গ্রেসি সিং,র্যা চেল শেলী,পল ব্ল্যাকথর্ন,সুহাসিনী মুলে,
কুলভূষান খারবান্দা,রাজগুভির ইয়াদব,রাজেন্দ্র গুপ্ত,রাজেশ বিবেক,শ্রী বল্লভ বাস,
জাভেদ খান,রাজেন্দ্রনাথ জুতশি,অখিলেন্দ্র মিশ্র,দয়া সংকর পান্ডে,ইয়াশপাল শর্মা,
আমিন হাজী,আদিত্য লাখিয়া,এ.কে.হাংগাল,জন রো,ডেভিড গ্যান্ট,জেরেমি চাইল্ড,
বেন নেলন,অনুপম শ্যাম প্রমুখ।
বর্ননাকারীঃ অমিভাত বচ্চন।
প্রযোজনাঃ আমির খান,রীনা দত্ত।
সঙ্গীতঃ এ আর রহমান
লিরিক্সঃ জাভেদ আখতার
চিত্রগ্রহণঃ আনিল মেহথা
সম্পাদনাঃ বাল্লু সালুজা
বিপণনঃ আমির খান নির্মাতা সংস্থা,
সোনি পিকচারস ক্লাসিক,
কলাম্বিয়া ত্রিইস্টার ।
মুক্তির তারিখঃ জুন ১৫, ২০০১
দৈর্ঘ্য ২২৪ মিনিট
বাজেটঃ ২৫০ মিলিয়ন
সর্বমোট আয়ঃ ৩৮৯ মিলিয়ন
অর্জনঃ ভারতীয় বিভিন্ন পুরস্কারের পাশাপাশি এটি ৩য় ভারতীয় চলচিত্র হিসেবে শ্রেষ্ঠ বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র হিসেবে একাডেমী অ্যাওয়ার্ড এর জন্য মনোনয়ন পায়।
কাহিনী বিশ্লেষণ
১৮৯৩ সালে বৃটিশ ভারতের গুজরাটের চম্পানীড় নামক গ্রামের গরিব কৃষক শ্রেণীর সাধারণ মানুষের সাথে বৃটিশ শাসকগোষ্ঠীর যে দন্দ্ব/সংঘাত বা conflict তার উপর ভিত্তি করে এই চলচিত্রের কাহিনী গড়ে উঠেছে। খাজনার উপর ভিত্তি করে বৃটিশ সেনাবাহিনী পরিচালিত হত। আর এই খাজনা বহন করতো গ্রামের অসহায় মানুষ। আধুনিক সুযোগ সুবিধার অভাবে সে সময় ফসল ফলানোর খাতিরে কৃষ্ক কে আকাশে দিকেই হাত বাড়াতে হত।
সে বার বৃষ্টি হয়নি গ্রামে। এরপর আবার ২ গুন লগান (খাজনা) বহন করা কোনো ভাবেই প্রজাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এ ব্যাপারে তারা কথা বলতে গিয়েছিল রাজ়ার কাছে। তবে রাজার পায়েও যে শিকল বাধা। তিনিও যে বৃটিশদের হাতের পুতুল ছাড়া কিছুই নন।
চম্পানীড় ক্যান্টনমেন্টের দায়িত্ব প্রাপ্ত অফিসার উগ্র মেজাজের অ্যান্ড্রু রাসেল,যিনি লগান মওকুফের ভ্রান্ত সুযোগ দেন ভূবন সহ গ্রামের অসহায় লোকজন কে। বলা হয় একটি ক্রিকেট ম্যাচে ক্যাপ্টেন রাসেলের দল কে হারাতে পারলে ৩ বছরের জন্য খাজনা দেয়া লাগবে না। তবে হেরে গেলে ৩ গুন খাজনা দিতে হবে। তার এই তীর আসলে ভূবন এর দিকে নিক্ষিপ্ত হলেও পুরো গ্রামবাসীর উপর দুর্ভোগ নেমে আসে। তবে হার মানে না ভূবন।
গ্রামবাসীকে বোঝায়,তাদের মধ্যে মানুষে মতো বাচার স্পৃহা জন্মায়। তারা দল গঠন করে। তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন ক্যাপ্টেন রাসেল এর বোন এলিজাবেথ। একজন বৃটিশ হয়েও তিনি হাত বাড়িয়ে দেন দরিদ্র কৃষক ও ভূবন কে সাহায্য করতে। এরপরেও বাধা আসে।
তবে লাখার বিপক্ষ গ্রহণ,কিংবা কাচরার দলে অন্ত্ভুক্তিতে গ্রামের মানুষের আপত্তি কোনো কিছুই বাধা হতে পারেনি ভূবনের সামনে। দলকে সামনের থেকে নেতৃত্ব দিয়ে জয়ের বন্দরে পৌছে দেন আর পূরন করেন গ্রামের মানষের স্বপ্ন। ভালোবাসার মানুষ গৌড়ীর সাথে ভূবনের বিয়ে হয় ধুমধামের সাথে। এলিজাবেথ লন্ডনে ফিরে যায় আর ভূবনের স্মৃতি বুকে নিয়ে আজীবন অবিবাহিত জীবন যাপন করে। এই মোটামুটি কাহিনী।
দ্বন্দ কাকে বলে?
আমরা প্রতিটি মানুষ ই জীবনে শান্তি খুঁজি। একবিন্দু শান্তির জন্য কত কিছুই না আমরা করি। কিন্তু আমরা এটাই ভুলে যাই যে শান্তির আনন্দ তখনই উপভোগ করা যায় যখন জীবনে দ্বন্দ/সংঘাত আসে। দ্বন্দ কি?conflict বা দ্বন্দ এর ব্যাপারে বলা যায়,
"A struggle to resist or overcome; contest of opposing forces or powers; strife; battle. A state or condition of opposition, antagonism, discord. A painful tension set up by a clash between opposed and contradictory impulses."
অর্থাৎ,দ্বন্দ/সংঘাত বলতে শুধু যুদ্ধ-বিগ্রহ বোঝায় না। দ্বন্দ ছড়িয়ে আছে সমাজের প্রতিটি স্তরে,প্রতিটি ক্ষেত্রে।
সৃষ্টিকর্তা আমাদের প্রত্যেককে আলাদা ভাবে সৃষ্টি করেছেন এবং আমাদের চিন্তা-ভাবনা করার ক্ষমতা দিয়েছেন। ফলে আমরা প্রতিটি মানুষ যে কোনো একটি ঘটনা সম্পর্কে আলা্দা ভাবে চিন্তা করি এবং নিজের মনে একটি ব্যাখ্যা দাঁড় করাই যা হয়তো অন্য আরেকজনের সাথে মেলে না। তাই,আ্মরা যখন জীবনে চলার পথে বিভিন্ন মানুষের সাথে পরিচিত হই,বিভিন্ন সম্পর্ক গঠন করি তখন এই চিন্তা ধারার পার্থক্যের কারণে আমরা কছু বিষয়ে একমত হতে পারি না। ফলে দ্বন্দ সৃষ্টি হয়। আমরা চাইলেই দ্বন্দকে এড়ানো যায়না,আমাদের জীবনের সাথেই তা মিশে আছে।
চলচিত্রে গড়ে ওঠা দন্দ্ব
মূলত ভারতের স্বাধীনতাকামী মানুষের সাথে বৃটিশ রাজের দন্দ্ব চলচিত্র টি তে প্রতিয়মান হলেও এর আড়ালে ছিল আরো বেশ কিছউ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দন্দ্ব-সংঘাত যা চলচিত্র টি কে পরিপূর্ণতা দান করেছে। তার মধ্যে কয়েকটি হলঃ
ভূবনের সাথে রাসেলের দ্বন্দ;
রাজা পুরান সিং এর সাথে রাসেলের দ্বন্দ;
ভূবন কে পাওয়ার নেশায় গৌড়ীর সাথে এলিজাবেথের সাথে দ্বন্দ;
গৌড়ি কে পাওয়ার জন্য ভূবনের সাথে লাখার দ্বন্দ;
এলিজাবেথ ও রাসেল ২ ভাই-বোনের দ্বন্দ;
দন্দ্ব নিরসন কৌশল
পরিচালক ও কাহিনীকার অত্যন্ত যত্নের সাথে চলচিত্র টির মধ্যে সংঘাত ও সংঘাত নিরসনের চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। চলচিত্রের এই সকল দন্দ্বের নিরসন কৌশল বিশ্লেষণ করলে যে সকল বিষয় ফুটে ওঠে সেগুলো দেয়া হলঃ
ভূবনের সাথে রাসেলের দ্বন্দঃ
এর শুরুটা হয় বনের শিকারের সময় থেকে। ভূবন স্বাধীনচেতা। নিজের মাটিতে বৃটিশ রাজের হুকুম তার ভাল লাগে না।
অপর দিকে ক্যাপ্টেন রাসেল এই দমননীতির পক্ষে। এরপর এই দন্দ্ব চলে খাজনা নিয়ে রাজার সাথে কথা বলতে যাওয়ার সময় ও। দৃঢ় চিত্তের ভূবন রাসেলের অবিবেচক শর্ত ও মেনে নেয় আত্মসম্মান এর জোরে। প্রথমে গ্রামের লোক ভূবন এর বিরুদ্ধে গেলেও পরে ভূবন তাদের মনেও আশার সঞ্চার করে। পরে ভূবনের বীরত্বগাথা লিখিত হওয়ার মাধ্যমে ভূবনের জয় হয়।
এটি ছিল মূলত content conflict বা বিষয়ভিত্তিক দ্বন্দ। এই দ্বন্দ ছিল মতামতের দ্বন্দ,প্রতিদ্বন্দ্বীতার দ্বন্দ। এই দ্বন্দ নিরসনের জন্য ভূবন মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ করে গেছে। নিজের চেষ্টা,সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ,মায়ের দোআ,গৌড়ীর ভালবাসা,বিদেশিনী রমণী এলিজাবেথ এর সাহায্য এবং গ্রামের অন্য সকলের সাহায্য ভূবন কে এই দ্বন্দ নিরসনে সহযোগীতা করেছে।
রাজা পুরান সিং এর সাথে রাসেলের দ্বন্দঃ
এর শুরুটা হয় যখন রাজা পুরান সিং ক্যাপ্টেন রাসেলের কাছে খাজনা মওকুফের জন্য আসেন।
রাসেল রাজা কে শর্ত দেন তাকে মাংস খেতে হবে তাহলে তার প্রজাদের খাজনা মওকুফ হবে। অথচ রাজা হলেন শাকাহারী। মাংস খেলে তার ধর্ম নষ্ট হবে। তিনি রাজা হয়েও ভাগ্যের দোষে সামান্য একজন সেনা বাহিনীর ক্যাপ্টেনের কাছে মাথা নত করছেন তার প্রজাদের জন্য,তার উপর তাকে মাংস খেতে বলা হচ্ছে। এ তো ঘোর অন্যায়।
সবই রাজা মুখ বুঝে সহ্য করেন। শর্ত না মানায় তার প্রজাদের উপর দুর্ভোগ নেমে আসে। তিনি এটাও মুখ বুঝে সহ্য করেন। কারন তার পায়েও যে সাম্রাজ্যবাদের পরাধীনতার শিকল। কিছু না করতে পেরে তিনি ভূবনের ক্রিকেট দলকে নির্দেশ দেন রাসেল এর অহংকার ভেঙ্গে দিতে।
রাজার আশীর্বাদে ভূবন ও সফল হয় তার কাজে।
ভূবন কে পাওয়ার নেশায় গৌড়ির সাথে এলিজাবেথের সাথে দ্বন্দঃ
এটা কে ঠিক কয়েকটি ক্ষেত্রে দ্বন্দ বলা যায় না। তবে এটিও দ্বন্দ। এ দ্বন্দ প্রতিযোগীতার, প্রতিদ্বন্দ্বীতার। তবে তা দুজনের মধ্যে সদ্ভাব বজায় রেখে।
গৌড়ী ভালবাসে ভূবনকে। নানা ভাবে সেটা সে ভূ্বন কে বোঝানোর চেষ্টা করে। ভূবন ও মনে মনে গৌড়ীকেই চায়। এর মধ্যে আসে বৃটিশ রমণী এলিজাবেথ। মূলত ক্রিকেট শেখানোর উদ্দেশ্যে আসলেও সে মনে মনে ভালবাসতো ভূবনকে।
সে ইংরেজি তে ভূবনকে সেটা বলেওছিল। কিন্তু ভূবন বোঝেনি। একসময় এলিজাবেথ বুঝতে পারে ভূবন-গৌড়ী একে অপরের জন্য তৈরি হয়েছে। তাই সে আর দ্বন্দ বাড়ায় না। নিজের ভালবাসা আত্মত্যাগ করে।
ভালবাসার মানুষ কে গৌড়ীর হাতে তুলে দিয়ে সে স্বদেশে ফিরে যায়।
গৌড়ি কে পাওয়ার জন্য ভূবনের সাথে লাখার দ্বন্দঃ
লাখা পছন্দ করত গৌড়ীকে। কিন্তু গৌড়ী ভালবাসতো ভূবন কে। তাই ভূবনের সাথে লাখার দ্বন্দ সৃষ্টি হয়। প্রথমে সে ক্রিকেট খেলা সংক্রান্ত ব্যাপারে ভূবনের বিরোধীতা করে।
পরে সবাই ভূবন কে সাহায্য করতে গেলে সে ভূবন কে গৌড়ীর কাছে ছোট দেখানোর জন্য ইংরেজ পক্ষ গ্রহন করে। পরে ব্যাপারটা জানাজানি হলে লাখা জীবন বাঁচানোর জন্য মন্দিরে ঢুকে পরে। তার সাথে কথা বলতে যায় ভূবন। এই দ্বন্দ নিরসনে বিচক্ষনতার পরিচয় দেয় ভূবন। সে লাখার সাথে কথা বলে।
তাকে বোঝায়। লাখাও বুঝতে পারে। এবং সে ভূবনের সাথে একসাথে মিলে কাজ করার জন্য রাজি হয়।
এলিজাবেথ ও রাসেল ২ ভাই-বোনের দ্বন্দঃ
এলিজাবেথ ক্যাপ্টেন রাসেলের বোন। স্বাভাবিক ভাবেই রাসেল ভেবেছিল সে নিজের ভাই এর পক্ষই গ্রহন করবে।
কিন্তু তার ধারণা ভুল ছিল। এলিজাবেথ তার পকষ নেয় নি। সে ন্যায় এর পক্ষ,সত্যের পক্ষ গ্রহন করেছে। সে সাহায্য করেছে ভূবনের দল কে। তাদের হাতে কলমে ক্রিকেট খেলা শিখিয়েছে।
এর পিছনে আরেকটা কারণ ছিল যে সে ভূবন কে পছন্দ করত। এই প্রজা দের খেলা শেখানো রাসেল মেনে নিতে পারে নি। এ নিয়ে ২ ভাই-বোনের মধ্যে দেখা দেয় দ্বন্দ। দৃঢ়চেতা এলিজাবেথ ভাই এর কথায় পিছপা হয় না। নিজের হাতে গড়া দল কে জয়ের বন্দরে পৌছিয়ে দেয়।
শেষ কথা
অস্কার মনোনয়ন প্রাপ্ত চলচিত্র "লগান" এ গ্রাম্য পরিবেশে ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিক আমলে খাজনা নিয়ে কৃষকদের সাথে ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর যে সংঘাত তার বিবরব অত্যন্ত সুন্দর ভাবে দেয়া হয়েছে। অসাধারন কাহিনী,দক্ষ পরিচালনা,পরিপাটী চিত্রনাট্য,অভিনয় দক্ষতা,ক্যামেরার কাজ,সঙ্গিত,সেট সব মিলিয়ে ছবি টি কে উপমহাদেশে নির্মিত অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচিত্রের মর্যাদা দেয়া যায়। ২০০১ সালের ১৫ মে চলচ্চিত্র টির প্রযোজক এবং অভিনেতা আমির খান ছবি টির নিজস্ব ওয়েবসাইট এ এর সম্পর্কে বলেন,
“Lagaan began as a dream, a nebulous dream dreamt for the first time as far back as 1996 by a man called Ashutosh Gowariker. Over the last 3 years I, and the entire cast and crew of Lagaan, have tried to help and support the man leading us to realize his dreams.The journey has led us all to become a part of this dream.”
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।