I am great; tell it others
লিমনের পঙ্গুত্ববরণের ঘটনায় দেশের কিছু বুদ্ধিজীবী ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান র্যাবের প্রতি খড়্গ উঁচিয়ে ধরেছেন। একইসঙ্গে কিছু মিডিয়া তাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছে। কিছু দিন আগে(গত মাসে) র্যাবের সোর্স মৃত্যুর ঘটনায় লিমনদের পরিবারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার বিষয় নিয়ে তুলকালাম ঘটনা ঘটতে দেখা গেল। অথচ তার সঙ্গে র্যাবের কোন সংশ্লিষ্টতা নেই বলে প্রেস-রিলিজ দেয়া হলেও ডেইলি স্টারসহ অনেক পত্রিকা বিষয়টি প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকে। বিরোধী গোষ্ঠীর নানা তৎপরতা সত্ত্বেও র্যাবের প্রতি মানুষের আস্থার জায়গাটি তৈরি হয়েছে।
গত ৩ সেপ্টেম্বর আমার এক আত্মীয়কে অপহরণকারীদের হাত থেকে ফিরিয়ে এনেছেন র্যাবের চৌকস সদস্যরা। তাদের প্রতি আমি যেমন কৃতজ্ঞ তেমনি তাদেরকে অনেকেরই ধন্যবাদ দেয়ার মতো ইস্যু রয়েছে। অপরাধ দমনে র্যাবের কৃতিত্ব এ নিবন্ধে পরিসংখ্যানের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে।
উল্লে¬খ্য, র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন(র্যাব) গঠিত হয় বিএনপি-জামাত জোট আমলে, ২০০৩ সালে। একই সময়(তৎকালীন) সরকারের প্রত্যক্ষ ইন্ধনে জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান ঘটে সারাদেশে।
সন্ত্রাসী চক্রের নেটওয়ার্ক বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। জোট সরকারের ওপর চাপ আসতে থাকে। ফলে এলিট ফোর্স ‘র্যাব’ গঠন করে পরিস্থিতি সামলাতে সচেষ্ট হয় প্রশাসন। কিন্তু অনেকের ধারণা, জামাতি ইসলামীর ধর্ম-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য হাসিল এবং তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগকে দমানোর জন্য ‘র্যাব’ সৃষ্টি করা হয় এবং ক্রসফায়ারের নামে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের লজ্জাজনক ঘটনা ঘটে। খালেদা-নিজামী জোট আমলে ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ পরিচালনাকালে হার্ট অ্যাটাকের নামে ৫৮ জন এবং ক্রসফায়ারের নামে র্যাব ও পুলিশ কর্তৃক ২০ মে ২০০৬ পর্যন্ত ৬২০ জন মানুষকে বিনা বিচারে হত্যা করা হয়।
এছাড়া আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসমূহের হেফাজতে কয়েকশত মানুষ হত্যা করা হয়। আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের অর্ধশতাধিক স্থানীয় প্রভাবশালী, ত্যাগী ও সৎ নেতা-কর্মীকে ক্রসফায়ারে হত্যা এবং এসব হত্যাকাণ্ডের মামলা গ্রহণ না করা; বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিন্দা ও প্রতিবাদ সত্ত্বেও এই ধারা অব্যাহত থাকে। জোট সরকারের নির্দেশনায় বিনা বিচারে মানুষ হত্যার জন্য যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে অভিযোগ উত্থাপন এবং তাদের বিচার করা যাবে নাÑ এই মর্মে ‘যৌথ অভিযান দায়মুক্তি’ আইন পাশ করা হয়, যা সংবিধানের মৌলিক চেতনার পরিপন্থি ছিল। সুখের বিষয় এ বছর ২৯ জুলাই হাইকোর্ট আইনটি বাতিলের জন্য রুল জারি করেছেন এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দিতে ১০০ কোটি টাকার তহবিল গঠনের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, রুলে তাও জানতে চাওয়া হয়েছে।
তবে বিএনপি-জামাত জোট আমলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার উদ্দেশ্যে র্যাবকে ব্যবহার করার বিষয়টি বিবেচনায় রেখেও বলা যায়, এ সংস্থাটির রয়েছে ব্যাপক সাফল্য।
জঙ্গি সংগঠন জিএমবি’র নেতাদের গ্রেফতার ও তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীসহ অন্যান্য মৌলবাদী সংগঠনকে আইনের কাছে উপস্থিত করতে সক্ষম হয়েছে সংস্থাটি। বর্তমানে তাদের প্রতি মানুষের আস্থার জায়গাটি এমনভাবে তৈরি হয়েছে যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বিরল একটি ঘটনা। প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায় ১৫ এপ্রিল ২০১২ পর্যন্ত র্যাব ১,১৮,৩৩২ জনকে বিভিন্ন অপরাধে আটক করেছে। এদের মধ্যে রয়েছে : ধর্মভিত্তিক জঙ্গি সংগঠনের সদস্য, চিহ্নিত সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ী, অর্থ পাচার ও প্রতারক, নারী ও শিশু পাচারকারী এবং অপহরণকারী। তাদের তৎপরতায় ৯৫২০টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং বিপুল পরিমাণে বিস্ফোরক উদ্ধার হয়েছে।
এমনকি সন্ত্রাসী গ্রেফতারের অভিযানে গোলাগুলির মধ্যে পড়ে ১৩ র্যাব সদস্য নিহত এবং দু’শরও বেশি মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন।
আসলে কি ঘটেছিল ২০০৪-০৬ সালের গ্রেফতাকৃত লোকদের ক্ষেত্রে অথবা ২০০৭ থেকে ০৮ পর্যন্ত সামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে? পক্ষান্তরে বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলে সেই পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে রয়েছে? বর্তমান সরকারের সময় বিচার বহির্র্ভূত হত্যাকাণ্ড যে কমে এসেছে তা পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে। বিএনপি-জামাত জোট আমলের শেষ তিন বছরে মোট গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির শতকরা ২.২৪ ভাগ অর্থাৎ ৩৪০ জন এনকাউন্টারে নিহত হয়। সামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ০.৭৪ ভাগ অর্থাৎ ২০৬ জন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। এ ধারা বর্তমান সরকারের প্রথম তিন বছরে নেমে আসে ০.২৩ ভাগে অর্থাৎ ১১৭ জন মারা পড়ে এনকাউন্টারে।
বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বর্তমানে শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। এর প্রধান কারণ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের বিভাগীয় শাস্তির ব্যবস্থা কঠোর করা হয়েছে। ভয়ঙ্কর অথবা সাধারণ যে কোন ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্তকে শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে গত তিন বছরে শাস্তি দেয়া হয়েছে। ২০১০-১১ সালে অভিযুক্ত ১৪২৯ জন র্যাব সদস্যকে তদন্ত, বিচার ও শাস্তির আওতায় আনা হয়। ফৌজদারি আদালত এবং প্রশাসনিক শাস্তির ফলে ৫২৫ জনের জেল ও ৯০৪ জনকে বরখাস্ত কিংবা বিভাগীয় শাস্তি দেয়া হয়েছে।
অর্থাৎ আগেকার সরকারের র্যাবের মতো সংস্থাটির অপরাধী সদস্যদের অব্যাহতি দেয়ার সংস্কৃতি বদলে গেছে। বর্তমানে যে কোন র্যাব সদস্য অপরাধী হিসেবে গণ্য হলে কিংবা অপকর্মে লিপ্ত হলে তাকে জেল, চাকরি থেকে পাওনা ছাড়াই বরখাস্ত এবং সিভিল কোর্টে বিচারের সম্মুখীন করা হচ্ছে। এছাড়া র্যাব সদস্যদের আরও বেশি জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় এ বছর(২০১২) জানুয়ারিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে 'ওহঃবৎহধষ ঊহয়ঁরৎু ঈবষষ' (ওঊঈ)। এ সেলটি স্বাধীনভাবে ডিজি’র(র্যাব) অধীনে কাজ করছে। র্যাব সদস্যদের বিরুদ্ধে কোন নাগরিকের অভিযোগকে তদন্ত করা সেলটির অন্যতম দায়িত্ব।
পূর্বেই বলা হয়েছে, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা কমেছে। কারণ র্যাব সদস্যদের বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০১২ পর্যন্ত র্যাবের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার পরিসংখ্যান হলো- র্যাবের এখতিয়ারে ১৩২৭ জন, ১২ জন ক্রিমিন্যাল কোর্টে, ৩৯২ জনকে অন্যান্য সংস্থা কর্তৃক বিচার করা হয়েছে। র্যাব কর্তৃক ১ জন ও ক্রিমিন্যাল কোর্টে ৫ জন বিচারের অপেক্ষায় রয়েছে। গুরুতর অপরাধের জন্য জেল হয়েছে ৫২৫ জনের, ছোটখাট অনিয়মের কারণে ৯০৪ জন শাস্তি ভোগ করছে।
বাংলাদেশ পুলিশের ওয়েবসাইটের ক্রাইম রিপোর্ট থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায় ২০০১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত নথিভুক্ত খুনের সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার। বিএনপি-জামাত জোট আমলে খুন হয়েছে বিশ হাজারের বেশি মানুষ। ২০০৭-০৮-এ সংখ্যা ছিল প্রায় ১৩ হাজার। বর্তমান সরকারের প্রথম দু বছরে সাত হাজার খুন হয়েছে। অর্থাৎ পূর্বে উল্লি¬খিত ক্রসফায়ারে হত্যার সংখ্যার সঙ্গে এ পরিসংখ্যানের অনেক পার্থক্য রয়েছে।
বিভিন্ন সরকারের সময় খুনের পরিসংখ্যান থেকে আমরা কি দেখতে পাই? কারা মারা পড়েছে? এরা কি রাজনৈতিক কারণে প্রতিপক্ষের হামলায় খুন হয়েছে? নাকি ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। হিংসা-দ্বেষ, ভূমি সংক্রান্ত দ্বন্দ্ব-বিবাদ থেকে খুন হলে সেটা ব্যক্তি পর্যায়ের বিষয়। তার জন্য সরকার, বিরোধী দল, বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ কেউ-ই দায়ী নন। এর প্রধান কারণ নৈতিক অবক্ষয়; মানুষের সামাজিক মূল্যবোধের অবনতি। অথচ বাইরের রাষ্ট্রের মানবাধিকার সংস্থা র্যাব বিলুপ্ত করার দাবি জানাচ্ছে; আমাদের কাছে আশ্চর্যের বিষয় এটি! বর্তমান সরকার কি গণ-বিরোধী শাসক? র্যাবের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে জনগণের মঙ্গলের জন্য।
সন্ত্রাসীদের গুলিতে আমার আপনজন নিহত হলে আমরা কি বলব? প্রতিটি ব্যক্তির বেডরুম পাহারা দিতে সরকার পারবে না এটা আমরা জেনে গেছি; জনে জনে মানুষের নিরাপত্তা দিতেও সরকারকে বেগ পেতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে সন্ত্রাসীদের হাত থেকে দেশের মানুষকে মুক্ত করার প্রচেষ্টা গ্রহণ অন্যতম উপায় হতে পারে। সন্ত্রাসীদের আইনের হাতে সমর্পণ করে শাস্তি নিশ্চিত করলে ব্যক্তি পর্যায়ে নিরাপত্তা সম্ভব হবে বলে আমরা মনে করি। অপরাধীরা আদালত থেকে জামিন নিয়ে বের হয়ে এসে পুনরায় অপরাধে যুক্ত হতে যেন না পারে; সেজন্য সতর্ক থাকতে হবে। কিছুদিন আগে একটি পত্রিকার সংবাদ থেকে আমরা জানতে পেরেছি সুব্রত বাইনের মতো কিছু শীর্ষ সন্ত্রাসী দেশে ফিরেছে।
অর্থাৎ আন্ডারওয়ার্ল্ড আবার সক্রিয় হয়ে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে। বিএনপি-জামাত জোট আমলে এরা দিনের পর দিন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়েছে; এমনকি পুলিশের হাতে ধরা পড়ে জামিনে ছাড়া পেয়েছে। এ ধরনের অপরাধী ছাড়া পায় বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে। এসব পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য ‘র্যাবে’র মতো এলিট ফোর্সের প্রয়োজন রয়েছে। অর্থাৎ এ ধরনের ফোর্স সামাজিক অবক্ষয় ও বিচার ব্যবস্থার ত্র“টির কারণে আরও বেশি আস্থাশীল সংস্থায় পরিণত হয়েছে।
এটা সত্য যে, বর্তমান সরকারকে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় আরও বেশি সচেষ্ট হতে হবে। আইনের শাসন কার্যকর করার জন্য নিবেদিত প্রাণ শাসক আমাদের দরকার। এ দেশের সকল নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষা এবং জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সন্ত্রাস সম্পর্কে জিরো টলারেন্স নীতিতে বিশ্বাসী হওয়া প্রয়োজন। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বিচার বহির্র্ভূত হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে দেশের মধ্যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা লঙ্ঘন করলে তা হবে একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য অবমাননাকর ও জঘন্য অপরাধ। একারণে তাদের ব্যক্তি অধিকারের সীমারেখা ও প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা বজায় রাখার জন্য সচেতন থাকতে হবে।
উল্লে¬খ্য, পুলিশের ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত সার্বজনীন মানবাধিকারের ত্রিশটি ধারার মধ্যে ৩ ও ৫ অনুচ্ছেদে স্পষ্টত বলা হয়েছে, জীবনের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা বিধানের অধিকার রয়েছে প্রত্যেকের। কাউকে নৃশংস অত্যাচার ও খুন করা স্পষ্টত মানবাধিকার লঙ্ঘনের চূড়ান্ত পর্যায়। বর্তমানে এসব বিষয়ে সতর্ক রয়েছেন র্যাব সদস্যরা। তারা অপরাধ দমনে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছেন- এ ধরনের অভিযোগ আর নেই। এখন র্যাব মানুষের নির্ভরশীল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।