বুধবার চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম সৈয়দ মাশফিকুল ইসলামের আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়ার পর তিনি সাংবাদিকদের আরো বলেছেন, অপহরণের সময় ‘র্যাব-ডিবির লোক’ পরিচয় দিলেও পরে অপহরণকারীরা নিজেদের ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে পরিচয় দিয়েছিল।
গত ১১ ফেব্রুয়ারি বন্দর নগরীর কোতোয়ালি থানাধীন পুরাতন টেলিগ্রাফ সড়ক থেকে অপহৃত হওয়ার পর গত সোমবার কুমিল্লার বুড়িচংয়ে আহত অবস্থায় পাওয়া যায় মৃদুলকে।
সোমবার বিকাল থেকে নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন এই ব্যবসায়ী। সেখান থেকে বুধবার দুপুরে পুলিশ পাহারায় আদালতে হাজির হন তিনি।
৮০ ভরি স্বর্ণ লুটের অভিযোগ এনে র্যাবের এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন মৃদুল।
এরপর অপহরণ হলে তার পরিবারের সদস্যরাও এর সঙ্গে র্যাবের ওই কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।
তবে মুক্ত হওয়ার পর থেকে মৃদুলের পরিবার এই বিষয়ে নিরব। তার ভাই অপহরণ মামলার বাদি শিমুল চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, র্যাবের কেউ জড়িত ছিলেন কি না, তা তাদের জানা নেই।
এই অপহরণকাণ্ডে অভিযোগের মুখে থাকা র্যাবের সন্দেহ, মৃদুল নিজেই হয়ত আত্মগোপন করেছিল।
বাহিনীর অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মৃদুল নিজেই আত্মগোপন করেছিল কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
”
গত বছরের শেষ দিকে গাড়িচালক বাবুল পালকে দিয়ে ৮০ ভরি স্বর্ণ ঢাকায় পাঠান মৃদুল, যা র্যাব-২ এর কর্মকর্তা মেজর রকিবুল আমিন আটক করেছিলেন বলে তার অভিযোগ।
ওই স্বর্ণ আর ফেরত পাননি বলে মামলা করেন মৃদুল। সেদিনের পর থেকে বাবুলও লাপাত্তা।
ব্যবসায়ী মৃদুলের করা এই মামলাটি বর্তমানে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) তদন্ত করছে।
বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে বিচারকের খাস কামরায় মৃদুল জবানবন্দি দেয়া শুরু করেন।
সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন। এরপর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি।
‘র্যাব-ডিবি পরিচয়ে অপহরণ’
অপহরণের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মৃদুল সাংবাদিকদের বলেন, ১১ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ১০টার দিকে দোকানে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হন তিনি।
চট্টগ্রাম নিউ মার্কেটের দুলহান জুয়েলার্সের মালিক মৃদুলের হাজারিগলিতেও একটি গহনার দোকান রয়েছে।
“এসময় পূর্ব দিক থেকে একটি কালো নোয়া মডেলের গাড়ি আসছিল।
চালকের পাশের আসনের ব্যক্তিসহ কয়েকজন নেমে আসেন। তারা নিজেদের র্যাব-ডিবির লোক বলে পরিচয় দেয়। গাড়িতে তুলেই আমাকে মুখোশ ও হ্যান্ডকাপ পরিয়ে দেয়। ”
এই ঘটনা মৃদুলের কর্মচারী ঝুনু দাশ দেখতে পেয়ে প্রতিবাদ জানালে তাকে গুলি করার হুমকি দেয় অপহরণকারীরা।
মৃদুল জানান, গাড়িতে মুখোশ পরানো অবস্থায় পাশে বসা একজন তার হাঁটুর ওপর মাথা চেপে ধরে।
আধ ঘণ্টা চলার পর গাড়ি বদল করা হয়। দ্বিতীয় গাড়িটি অল্প কিছু সময় চলার পর আবার তাকে অন্য গাড়িতে তোলা হয়।
তৃতীয় গাড়িটি প্রায় আড়াই ঘণ্টা চলে বলে জানান মৃদুল। এরপর গাড়ি দাঁড় করিয়ে অপহরণকারীরা খাওয়া-দাওয়া করে। তখন তাকে গাড়ির পেছনের আসনের নিচে শুইয়ে রাখা হয়।
মৃদুল জানান, তৃতীয় গাড়িটি আবার চলতে শুরু করার পর এক পর্যায়ে একটি ফ্লাইওভার অতিক্রম করে বলে মনে হয়েছে তার।
সর্বশেষ চতুর্থ গাড়িতে তুলে নেয়ার পাঁচ-সাত মিনিট পর গাড়ি থামলে একটি ভবনের দ্বিতীয় তলায় তোলা হয় মৃদুলকে।
‘মামলা করেছিস কেন?’
তুলে নেয়ার পর রাতে মৃদুলের সঙ্গে কোনো কথা না বলে তাকে ঘুমাতে দিয়েছিল অপহরণকারীরা। তবে নির্যাতনের এক পর্যায়ে র্যাবের বিরুদ্ধে কেন মামলা করেছিল তা জানতে চায় বলে জানান তিনি।
মৃদুল বলেন, পরদিন সকালে আমাকে গোসল করতে দেয়া হয়।
যে ঘরে রাখা হয় সেখান থেকে প্লেন, ট্রেনের হুইসেল ও গাড়ির শব্দ শুনতে পাই।
গত ১১ থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি (মঙ্গল থেকে শুক্রবার) ওই কক্ষেই হ্যান্ডকাপ পরিয়ে ও চোখ বেঁধে রাখা হয় বলে দাবি করেন মৃদুল।
মৃদুল চৌধুরী, অপহরণকারীদের হাত থেকে সোমবার মুক্ত হওয়ার পর।
মৃদুল বলেন, “আমি বলি- স্যার আমার অপরাধ কী? তারা বলে, মামলা করেছিস কেন? বেশি কথা বললে খবর আছে।
”
মারধরের কারণে অজ্ঞান হয়ে পড়েন বলে এই ব্যবসায়ী জানান। তিনি বলেন, পরে তাকে হাত-পা বেঁধে হাঁটু থেকে নিচের দিকে ইলেকট্রিক শক দেয়া হয়।
নির্যাতনের পর মৃদুলকে গোসল করার সুযোগ দেয়া হয় এবং এক অপহরণকারী তার ক্ষতস্থানে লাগানোর জন্য ওষুধও দেন।
মুক্তিপণ দাবি, না নিয়েই মুক্তি
মৃদুলের ভাষ্য অনুযায়ী, ১৬ ফেব্রুয়ারি অপহরণকারীরা তার কাছে ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে।
“বাঁচার আশায় আমি ৪০ লাখ টাকা দিতে রাজি হই।
এরপর আমাকে ওই কক্ষ থেকে নিয়ে যেতে চায়। কোথায় নিচ্ছেন জানতে চাইলে তারা বলে, এখন সরিয়ে নেব। পরে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে টাকা পেলে ছেড়ে দেব।
“এসময় অপহরণকারীরা বলে, তুই কী করস। জবাবে বলি, ব্যবসা করি।
”
“এতে অসন্তুষ্ট হয়ে অপহরণকারীরা বলে, তোর হাত মনে হয় অনেক উপরে আছে। মিডিয়া যেভাবে লেগেছে, মনে হয় দেশে থাকতে পারব না। ডিবি-পুলিশ-র্যাব আমাদের পেছনে লেগেছে। ”
মৃদুল বলেন, “তুলে নেয়ার সময় নিজেদের র্যাব-ডিবি পরিচয় দেয়ার পর এই পর্যায়ে তারা বলে, ‘আমরা র্যাব-ডিবি না, সন্ত্রাসী’। ”
১৭ ফেব্রুয়ারি চোখ বাঁধা অবস্থায় একটি গাড়িতে তোলা হয় মৃদুলকে।
প্রায় চার ঘণ্টা চলার পর হাত ও চোখ বাঁধা অবস্থায় একটি ধানক্ষেতের পাশের সড়কে তাকে নামিয়ে দিয়ে যায় অপহরণকারীরা।
মৃদুলকে যে স্থানটিতে ফেলে যাওয়া হয়, তা কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার কংসনগর বাজারের দক্ষিণে কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কের পাশের একটি ক্ষেত।
হাত-পায়ের বাঁধন খুলে রাত পৌনে ৩টার দিকে কংসনগর বাজারের নৈশপ্রহরীর কাছে আশ্রয় নেন মৃদুল। তার মোবাইল ফোন থেকে চট্টগ্রামে স্ত্রী শেলী চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলেন।
মৃদুল বলেন, অপহরণকারী দলে ছয় জন ছিলেন।
তবে তাদের চেহারা তিনি দেখেননি। মুক্তিপণ না নিয়েই তারা তাকে ছেড়ে দেয়।
অপহরণকারীরা কোনো বাহিনীর সদস্য বলে মনে হয়েছিল কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “চেহারা না দেখে কী করে বলব তারা কে?”
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।