বাস্তবতার দুস্টচক্র এমন অসংখ্য রাত কেটেছে, আমার স্ত্রী পুতুল ঘুমাচ্ছে আর আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সারারাত পার করে দিয়েছি। আমার ধারনা আমার এই পাগলামির কথা পুতুল খুব ভাল করেই জানে। জেনেও না জানার ভান করে থাকাটা ওর অভ্যাস এ পরিনত হয়েছে। অবশ্য এসব নিয়ে আমার কোন অভিযোগ নেই। সাদা জমিনে কালো প্রিন্টের শাড়িতে পুতুলকে কাশফুলের মত মনে হয়।
খুব ইচ্ছে করে ছুয়ে দেখি! ঘুমন্ত একজন মানুষের ঠোটে কিকরে সারাক্ষণ চিকন একটা হাসি লেগে থাকে আমি জানি না। পুতুলকে খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করত। কখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি।
পুতুলের ঘুমের প্রিপারেশনটাও চমৎকার। ঘুমানোর আগে সুন্দর শাড়ী পড়বে, যত্ন করে চুল আঁচড়াবে, হাত ভর্তি করে চুড়ি পড়বে, চোখে কাজল আর ঠোটে হাল্কা লিপস্টিক নিবে।
দেখে মনে হয় ঘুমের দেশে বেড়াতে যাচ্ছে। ওর এই সাজগোজের গোটা বিষয়টা আমিও খুব যত্ন করে দেখি। অসম্ভব ভাল লাগে। সবচেয়ে মজার বিষয় হল, ঘুমানোর ঠিক আগে একটা কালো টিপ হাতে নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াবে। এরপর আমার গলা জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বলবে – টিপটা পড়িয়ে দাও।
এই কাজটা আমি আমার পৃথিবীর সবটুকু মায়া, সবটুকু ভালবাসা দিয়ে করি। বাম হাতে ওর কোমর জড়িয়ে ধরে ডান হাত দিয়ে কপালে টিপটা বসিয়ে দেই। এরপরই স্বর্গের সব দেবতারা এসে আমাদের সারা ঘরে মোমবাতি জ্বালিয়ে দিয়ে যায়। পুতুল দুহাত দিয়ে শক্ত করে আমার গলা ধরে পেছনের দিকে ঝুকে মুখটা উপরে তুলে হালকা দুলতে থাকে। আমি পুতুলের নাকের সাথে নাক লাগিয়ে এক দৃষ্টিতে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি।
পুতুল এই সময় ওর চুলগুলো পেছন থেকে টেনে এনে কাঁধের পাশ দিয়ে ঝুলিয়ে দেয়। পুতুলের চুলে এক অদ্ভুত স্বর্গীও গন্ধ আছে। সেই গন্ধ নাকে আসতেই আমি আমার নিজের ভেতরে হিংস্রতা অনুভব করি। কিন্তু আজ এসব কিছুই হয়নি। পুতুল ঘুমাচ্ছে।
ঘুমন্ত পুতুলের ঠোটের চিকন হাসি কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে।
পুতুলের বয়স একুশ এ আটকে আছে। বাড়ছে না, কখনো বাড়বেও না। এটিই স্বর্গের সবচেয়ে বড় সুবিধা। আমার জগতে এই মেয়েটি ছাড়া আর কোন মানব মানবী নেই।
শুধু আমরা দুজন আর আমাদের অদ্ভুত সব স্বপ্ন। স্বর্গে অন্য যারা বসবাস করছে তাদের জগতও আলাদা, নিজস্ব। তবে সেই জগতের সাথে আমাদের কোন যোগাযোগ নেই। কাজেই সামাজিক কোন যন্ত্রণাও নেই। মানুষ যখন অনাকাঙ্ক্ষিত কোন পরিস্থিতির মুখোমুখি পড়ে তখন জীবনে ঘটে যাওয়া সব কিছুতেই নিজের দোষ খোজার চেস্টা করে।
যেমন এইমুহুর্তে আমার বারবারই মনে হচ্ছে পুতুলকে এতটা ভালবেসেছি বলেই আমাদেরকে পৃথিবী নামক গ্রহে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। আজ রাতটিই স্বর্গে আমাদের শেষ রাত। কাল আমি যখন পৃথিবীতে যাব তখনও জানবোনা কবে পুতুল আবার আমার পৃথিবীতে ফিরে আসবে, ওর পাশে সারারাত জেগে কাটিয়ে দিব। এসব ভাবতে ভাবতে আমার চোখ ভিজে উঠেছে। হঠাত আমাকে চমকে দিয়ে প্রথমবারের মত পুতুল ঘুমের মধ্যে আমার হাত ধরে ফুপিয়ে কাঁদছে।
আমি আমার গায়ে জড়ানো সাদা রঙের মখমলের চাদরে পুতুলকে জড়িয়ে বসে আছি। নিরবতা ভেঙ্গেছে পুতুল –
- আমি তোমাকে প্রচন্ডরকম ভালবাসি।
আমি ওকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছি। বুকের ভেতরে কত অসংখ্য কথা জমে আছে অথচ কিছুই বলা হচ্ছে না। পুতুল আমার মুখোমুখি ঘুরে বসেছে।
দুহাত দিয়ে আমার কাঁধের দুপাশে শক্ত করে ধরে শেষ কথাগুলো একাই বলে যাচ্ছে
- শুধু এটুকু ভেবো কেউ একজন বহু দূরে তোমার পথ চেয়ে বসে আছে। আমাদের যখন আবার দেখা হবে আমি শুধু এই তোমাকেই ফেরত চাই। মনে থাকে যেন! - বলতে বলতে আমার পুতুল কাঁদছে।
আমি শুধু একটা কথাই বলতে পেরেছি - তোমার এই কথাগুলো নিয়েই আমি বেঁচে থাকব পুতুল
২৮ বছর পর
আজ বিকেলে কক্সবাজারের যে হোটেলটিতে আমাদের বিয়ে হয়েছে সেখানেই অতিথিদের থাকার ব্যাবস্থা করা হয়েছে। ডিনার শেষে আতিথিরা যখন যার যার রুমের দিকে যাচ্ছেন তখনই একজন এসে কানে কানে বলে গিয়েছে - আমাদের থাকার জন্য পাশের একটি বাংলো টাইপ বাড়ি ভাড়া করা হয়েছে নন্দিনীর পছন্দে।
নন্দিনী চারুকলার তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। আমার সঙ্গে পরিচয়ের ছোট্ট একটি গল্প আছে।
বিকেল ৪টার দিকে শাহবাগে শিশুপার্কের পাশে জলিলের দোকানে বসে চা খাচ্ছিলাম। হঠাত চোখে পড়ল মেয়েটি সবগুলো ফুলের দোকানে ঘুরে ঘুরে রক্তকরবী দেখছে। কিন্তু তার মনমত হচ্ছে না।
আশ্চর্য আমার পাশের দোকানটিতেই তাজা রক্তকরবী অথচ মেয়েটির চোখেই পড়ছেনা। মনের মধ্যে খুত খুত করতে লাগলো। খুতখুতি নিয়ে বসে থাকা যায় না। একধরনের অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। কৌতুহল আটকাতে না পেরে এগিয়ে গেলাম- --
অদ্ভুত মানুষতো আপনি!! এত ভীড়ের মধ্যে সবগুলো দোকান ঘুরে ঘুরে রক্তকরবী খুজছেন, অথচ যে দোকানটিতে সবচেয়ে ভাল ফুলগুলো আছে, তার সামনে দিয়ে বার বার ঘুরাঘুরি করেও আপনার চোখে পড়ছেনা!
শুনে মেয়েটির চোখ চিক চিক করতে লাগলো।
উত্তেজনায় বলে বসল - কোনটা আপনার দোকান???
কি উত্তর দিব বুঝতে পারছিনা। নিজেকে গাধা শ্রেনীর কিছু একটা মনে হচ্ছে। আঙ্গুলের ইশারায় দেখিয়ে দিলাম - ঐটা।
- স্টাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?? চলুন ....
কথা না বাড়িয়ে আমি মেয়েটির পেছনে পেছনে হাটতে শুরু করেছি। আমার হাতে তখনো চায়ের কাপ।
এই মেয়ের মহা খুতখুতে স্বভাব। ফুলওয়ালার সাথে তর্ক শুরু করে দিয়েছে। আমি চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে মনোযোগ দিয়ে তাদের তর্ক শুনছি। একপর্যায়ে দোকানদার ছেলেটি বলে বসল-
- আফা, ভাইজানেরে নিয়া আসছেন, আপনেরে খারাপ ফুল দিমু না। ।
উনি সবসময় আমাগো দোকান থেইক্কা ফুল কিনে।
শুনে মেয়েটি লজ্জায় লাল হতে শুরু করেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আমি কথা বলতে শুরু করেছি - "সবাইতো এসে গোলাপ, রজনীগন্ধা, বেলী এসব খোজে, আপনার হঠাত রবীন্দ্রনাথের নায়িকা হবার শখ হল কেন???"
- আমার নাম নন্দিনী। আজ সন্ধায় শিল্পকলা একাডেমিতে রক্তকরবী মঞ্চস্থ হবে। সব বন্ধুরা মিলে একসাথে দেখতে যাব।
এভাবেই নন্দিনীর সাথে পরিচয়। বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। আমার পরিচয় জানতে চাওয়ার সাথে সাথে ভিজিটিং কার্ড ধরিয়ে দিয়েছি -
"আমি ফুল বিক্রি করিনা। তবে এখন মনে হচ্ছে ছোটখাটো একটা রক্তকরবীর দোকান দিলে ভালোই হতো। " - আমার কথা শুনে নন্দিনীর লাজুক হাসি চোখে মুখে স্পস্ট হয়ে উঠেছে।
এই হাসির অর্থ বুঝতে আমার খুব একটা সমস্যা হয়নি। ২ দিন পর আমার ফোনে ম্যাসেজ এলো। দুয়ে দুয়ে চার মিলতে শুরু করেছে। আমাদের টিউনিং হচ্ছিল চমৎকার। প্রেম করার বয়স নেই, ৩ সপ্তাহের মাথায় নন্দিনীর সম্মতিতে সরাসরি বাড়ীতে বিয়ের প্রস্তাব।
আজ ভরা পুর্নিমা। এতটা চাঁদের আলো আমি কখনো দেখেছি বলে মনে পরেনা। ছোট্ট এই বাংলো বাড়িতে সারা ঘর আলোকিত করে যে মেয়েটি আমার সামনে বসে আছে তার নাম - নন্দিনী। সারা ঘরে অসংখ্য মোমবাতি দেখে বুকের ভেতর কোথায় যেন একটু ধাক্কার মত লাগলো। বিয়ের প্রথম রাতে এই মেয়েটি সাদা জমিনে কালো প্রিন্ট এর শাড়ি পরে বসে আছে কেন বুঝতে পারছিনা।
নন্দিনী মুখ তুলে আমার দিকে তাকাতেই আমার সারা শরীর থর-থর করে কাপতে শুরু করেছে। কপালে কালো টিপ পরে বসে আছে মেয়েটি। বিকেলে বিয়ের অনুষ্ঠানেও ওর কপালে লাল টিপ দেখেছি। আমি কেমন করে ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে সমুদ্রের পাশে এসে দাড়িয়েছি ঠিক বলতে পারবনা। নন্দিনী আমার গলা জড়িয়ে ধরে হালকা দুলতে শুরু করেছে, সাথে সাথে আমার পৃথিবীও দুলছে।
ঘোর কেটে আপাকে ফোন করে শুধু এটুকু বলেছি – আপা বাহিরে এসে দেখ! চারদিকে অসংখ্য চাঁদের আলো। ছোট ছোট গল্পে আমি আর নন্দিনী হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছি।
------------------------------------------------------------------
সোউলম্যাট সারা বিশ্বেই একটি বিতর্কিত বিষয়। আমি বিশ্বাস করি বলেই আমার কল্পনায় পুতুল নন্দিনী হয়ে ফিরে এসেছে।
-------------------------------------------------------------------
উতস্বর্গঃ প্রিয় আপা –শিখা ফাতেমা হক, যিনি আমাকে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছেন।
আমি অনেক লাকি ফিল করি যে এত সুন্দর মনের একজন মানুষের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে।
-----------------------------------------------------------------
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।