মাছি ভন ভন
থালা ঝন ঝন
ফোড়া টন টন
বায়ু শন শন
ঘোরে বন বন
ছুটে পন পন...
মজা করে পড়ছি আর অমিওর কানে সুড়সুড়ি দিচ্ছি। ও গভীর মনোযোগ দিয়ে বইয়ের পাতায় কি যেন দেখছে। দ্বিতীয়বার দিতেই চিল্লিয়ে ওঠে- “আম্মা! দেখেন তো জ্বালাচ্ছে। “ রান্নাঘর থেকে আম্মার চিল্লানি-“আমি আসলে কিন্তু মার খাবি বলে দিলাম। “ এরপর একদম চুপ।
শুধু পড়া। জোরে জোরে সুর করে।
ছোটবেলায় সুর করে নামতা পড়ার কথা মনে পড়ে। আরোও মনে পড়ে সেই কবিতাগুলোর কথা। "মনারে মনা কোথায় যাস…….."
"ঝকঝকাঝক ট্রেন চলেছে রাত দুপুরে ঐ……"
"মোমাছি মৌমাছি, কোথা যাও নাচি নাচি, দাঁড়াও না একবার ভাই……"
"আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে..."
আমি পড়ছি আর আম্মা পাশে বসে বলছেন আরো জোরে পড়।
আমি আরোও জোরে জোরে পড়া শুরু করে দিলাম।
"সবার সুখে হাসবো আমি, কাঁদবো সবার দুখে..."
-আম্মা! একটু টিভি দেখবো।
-পড়।
-একটু দেখি না!
-মার খাবি কিন্তু!!
আবারো "আমার বাড়ির ফুলবাগিচা ফুল সকলের হবে......"
রাত বাড়তে থাকে। আব্বা আসে।
খাওয়া দাওয়া শেষে ঘুমিয়ে পড়া। আর মনের মধ্যে উসখুস- "কবে শুক্রবার হবে? আলিফ লাইলা দেখবো? সেদিন কারেন্ট থাকবে তো?"
পাশের বাড়ির তামান্নার সাথে এক রিক্সায় স্কুলে যাই। সাথে ওর চাচ্চু থাকে। চাপাচাপি করে বসতে হয়। ওর চাচ্চু আমার দিকে বিরক্তি ভরা চেহারা নিয়ে তাকায়।
আমার ভাল লাগে না। আম্মাকে বলি, আমার জন্য আলাদা রিক্সা ঠিক করে দিতে। কিন্তু আম্মার সেদিকে কোন খেয়ালই নেই। একদিন গোঁ ধরেছিলাম যাব না। সেদিন যেতে তো হলই, মারও খেতে হল।
তামান্না মেয়েটা খুব ফরসা, চ্যাপ্টা থালার মত মুখ। আমার আম্মাও ফরসা।
-আম্মা, আমি কেন ফরসা হলাম না।
-তোর দাদি কালো ছিলো, তাই।
-আপনার দাদি মনে হয় খুব ফরসা ছিল, তাই না।
-হ্যা। এখন যা, চার্যারে চার্য দে। নইলে রাতে অন্ধকারে থাকতে হবে।
- আম্মা কারেন্ট কেনো থাকে না। ওরা যায় কোথায়?
-নাটোরে যায়।
-নাটোরে কি আছে? ঐ জায়গাটা কি খুব সুন্দর?
-হ্যা।
আমি বুঝি না অনেক কিছুই। বিড়বিড় করতে করতে মেহগনি গাছে ঘেরা উঠানটাতে আসি। দেখি অমিও আমার খেলনা পিস্তলটা নিয়ে খেলছে।
-ঐ অমিও! আমার পিস্তল দে।
-দিবো না।
-মার খাবি কিন্তু!
-মারবি? আমাকে ধর তো দেখি। বলেই ভো দৌড়।
আমি কাঁদো কাঁদো স্বরে আম্মাকে নালিষ দেই। আম্মা চেঁচিয়ে ওঠেন- "অমিও!!! বদমায়েশি করছিস ক্যানো? ওকে ওর পিস্তল দে।
" কিন্তু কোথায় অমিও? বাইরে এসে এদিক ওদিক খুঁজে পাওয়া গেলো না। কি বদমাস? বড় ভাই হিসেবে আমাকে তোয়াক্কাই করে না!!
সেবার বিলে খুব পানি হয়েছে। চারিদিকে পানি বেষ্টিত দ্বীপের মত জেগে আছে সোনিয়া আপুদের দোতলা বাড়িটা। নীচতলায় আমরা ভাড়া থাকি। রাত হলেই একটা আতঙ্ক।
সাপ! টেবিলে বসে পড়ছি। হঠাৎ আপু চিৎকার দিয়ে ওঠে, "ও মাগো! সাপ!!" আমিও এক ঝটকায় পা উপরে তুলে নিচে তাকায়। ভয়ার্ত দৃষ্টি। আম্মা দৌড়ে আসে, "কই? সাপ কই?" আপু টেবিলের নীচে আঙ্গুল দিয়ে দেখায়। আম্মা আবার বলে, কই? কই? তারপর টেবিলের নীচে পড়ে থাকা বস্তাটা সরাতেই বেরিয়ে আসে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকা সাপটি।
দেখেই আঁতকে উঠে আম্মা চেচায়, “সাপরে! সাপ! অমিত তোর আব্বাকে তাড়াতাড়ি ডেকে নিয়ে আয়। “ আমি টর্চ নিয়ে বাইরে দৌড় দিই। কিন্তু সাপ যে বাইরেও থাকতে পারে সে কথা ঘটনার উত্তেজনায় আর খেয়াল থাকে না। সাপের ভয়ে আমি দৌড়াতে থাকি। উর্ধ্বশ্বাসে।
পেছনে কি আছে, দেখার সাহস নাই। কোনমতে বাসস্ট্যান্ডের মোড়ে গিয়ে আব্বাকে ডেকে আনতে হবে। দৌড়াতে দৌড়াতে আমি পড়ে যাই। ব্যাথা! কোমরের হাড্ডিতে ভীষন ব্যাথা। ঘুম ভেঙ্গে গেলো।
হাঁফাচ্ছি। নিজেকে আবিষ্কার করি ফাঁকা একটা ঘরে। তোষোক ছাড়াই শুধু চাদর বিছিয়ে টাইলস করা মেঝেতে ঘুমানোর কারণে হাড্ডিতে ব্যাথা ধরে গেছে।
আজ সবাই আমার থেকে অনেক দূরে। হয়তো ভালই আছে।
ওরাও হয়তো ভাবে আমার কথা। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে পূব দিগন্তে তাকাই। শনে শনে মৃদু বাতাসে দুলে ওঠে নারকেল গাছের পাতাগুলো। ফিকে লাল আলোয় দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবতা হো হো করে হেসে ওঠে...। ।
-রাকিব- ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।