আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জাদিপাই, ঝরনার রাণীর কথা বলছি

জাদিপাই ঝরণা, বান্দরবান অন্যের ব্লগ দেখতে দেখতেই সারাদিন কেটে যায়। তাই নিজের ব্লগ লেখা হয়ে উঠে না। মাঝে মাঝে নিজের ভ্রমন নিয়ে লিখতে ইচ্ছে হয়, যেন ঐ জায়গাগুলো কেউ যেতে চাইলে একটা রেফারেন্স অন্তত পায়। কিন্তু এ কাজটি অনেক ব্লগার করে গেছেন তাই অহেতুক প্যাঁ চাল করতে মন চায়না। তবে কিছুদিন আগে জাদিপাই ঝড়না ঘুরে এসে অনুভুতি টুকু সবার সাথে শেয়ার করার লোভটা সামলাতে পারলাম না।

নিজের এবং ক্যামেরার মায়া ছেড়ে কিছু ছবিও তুলেছি ঝড়নার অনেক বিপদজ্জনক অবস্থান থেকে। আশা করি সবার ভাল লাগবে। যাত্রা শুরু করেছিলাম ১৭/০৮/২০১২ তারিখ রাত ১.৩০ টায় চট্টগ্রাম থেকে। যাত্রার উদ্দেশ্য ছিল নাফাখুম। রাত ৩.০০ টার কিছু আগে কেরানীহাট পৌছালাম।

যাত্রা শুরু করার জন্য রাত টা বেছে নেওয়ার কারন হল সকালের পুরো সময়টা আমরা কাজে লাগাতে চেয়েছিলাম। যেকোন প্রকারে রেমাক্রি পৌছানো ছিল মূল উদ্দেশ্য। রাত ৩.০০ টায় কেরানীহাট পৌছানোর পর একটা হোটেলে বসে চা খেতে খেতে ভোরের বান্দরবান এর গাড়ীর জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। কিন্তু সেহেরীর খাবার খেতে একে একে লোক আসতে থাকায়, হোটেল মালিকের কটমট চাহনিতে বাধ্য হয়ে বাইরে অপেক্ষা করতে থাকলাম। গাড়ী না পেয়ে ভোর প্রায় ৫.৩০ টায় বান্দরবান অভিমূখী একটা ট্রাকে উঠে পড়লমাম আমাদের লাইনম্যান হিল্লোল দা'র শত আপত্তি সত্ত্বেও।

বান্দরবান এ নাস্তা শেষ করে উঠে পড়লাম থানচি’রি বাসে। দূপুর ১২.৩০ টায় থানচি পৌছালাম। কিন্তু থানছি থেকে রেমাক্রি যাওয়ার জন্য বি.জি.বি’র অনুমতি না পাওয়ায় বুকে পাথর চেপে বান্দরবান চলে এলাম সন্ধ্যা নাগাদ। তবে এই ব্যাপার টা একেবারে অপ্রত্যাশিত ছিল না। আগেই শুনেছিলাম নাফাখুম যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছেনা বি.জি.বি।

আরাকান এর কিছু সন্ত্রাসী গ্রুপ বেশ কিছুদিন ধরে অপহরন/চাঁদাবাজি শুরু করেছে ঐ এলাকায়। তাই আমাদের পরিকল্পনা ছিল ৩ টি। প্ল্যান-এ- নাফাখুম, অনুমতি না মিললে প্ল্যান-বি:- জাদিপাই, খুব বেশী বৃষ্টি হলে প্ল্যান-সি:- সেন্টমার্টিন। রাতে হোটেলে বসে প্ল্যান-বি অনুযায়ী গন্তব্য ঠিক করলাম জাদিপাই। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে সোজা চলে গেলাম রুমা বাস স্টেশন।

এ ধরনের ভ্রমনে সবসময় মনে রাখবেন এক মূহুর্ত দেরী আপনাকে আপনার গন্তব্য থেকে একটা দিন পিছিয়ে দিতে পারে। তাড়াতাড়ি বগালেক পৌঁছাতে পারলে জাদিপাই পাড়া এর দিকে আরো কিছুদূর এগিয়ে যেতে পারবো এটাই ছিল আমাদের উদ্দেশ্য। কিন্তু যা ভেবেছিলাম তা গাড়ীর অব্যবস্থাপনা(বাঙ্গালী সিন্ডিকেট), সীমিত বাজেট এবং বৃষ্টির'র কারনে বাস্তবায়ন করা যায়নি। তারপর ও আমরা খুশি এই কারনে যে, বগালেক এ বিকেল নাগাদ পৌঁছাতে পেরেছি এবং লেক এর পানিতে সারাটা বিকেল দাপাদাপি করতে পেরেছি। গাড়ীতে যাদের ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যেস নেই তাদের জন্য বান্দরবান থেকে রুমা যাত্রাটা বেশ উপভোগ্য হবে।

পাহাড় গিরিপথে উঁচু নিচু সরু রাস্তা ধরে কৈক্ষ্যংঝিরি নামার পর কৈক্ষ্যংঝিরি থেকে ইঞ্জিন নৌকায়(জন প্রতি ৪০ টাকা) সাঙ্গু নদী হয়ে চলে আসলাম রূমা বাজার। নৌ পথে একটা টুপি মাথায় চেপে নৌকার উপর উঠে পড়লাম। দুপাশের পাহাড়, ছোট ছোট ঝরণা, গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি ভ্রমনে বাড়তি আনন্দ এনে দিল। রূমা বাজারে সবাই দূপুরের খাবার সেরে নিলাম। প্রত্যেকের জন্য পাহাড়ে হাঁটার স্যান্ডেল কিনলাম ১২০ টাকা দিয়ে।

তারপর ১০০ টাকা দিয়ে “ইয়াং বম এসোসিয়েশনের” একটা ফরম কিনে সবার নাম ঠিকানা মোবাইল নাম্বর লিখে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ফটোকপি করলাম। তারপর আর্মি ক্যাম্প থেকে অনুমতি নিতে নিতে ঘন্টাখানেক সময় নষ্ট করে দৌড়ালাম বগালেক যাওয়ার জিপ ভাড়া করতে। আমাদের হিসেব অনুযায়ী এই সময়ে লোকাল জীপ থাকার কথা কিন্তু বৃষ্টির জন্য ট্যুরিষ্ট কম থাকায় লোকাল জীপ যাওয়া বন্ধ। আমাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে জীপ ভাড়া না কমানোতে আমরা রাগের মাথায় ঠিক করালাম হেঁটেই বগালেক রওনা দিব। হাঁটতে হাঁটতে পুলিশ ক্যাম্পে গিয়ে আবার সেই নাম, ঠিকানা, মোবাইল নাম্বার লিখতে লিখতে আমাদের মূল্যবান সময়গুলোর মৃত্যু হচ্ছিল।

মজার ব্যাপার হলো পুলিশ ক্যাম্প থেকে বের হয়ে হেঁটে কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ পিছন থেকে একটা জীপ আসায় উঠে পড়লাম জন প্রতি ১০০ টাকা ভাড়ায়। কপাল টা ভালই বলতে হয়। বৃষ্টির কারনে রাস্তার অবস্থা খারাপ হওয়ার জীপ আমাদের নামিয়ে দিল শৈলাতং পাড়া(জায়গাটি ১১ কি.মি নামে পরিচিত)। শৈলাতং পাড়া খেকে বগালেক ৮ কি.মি। চা খেয়ে আমাদের গাইড মিশুক এর অনুরোধে অল্প মহুয়া কিনে রওনা দিলাম বগালেক এর উদ্দেশ্যে।

শুরু হলো প্রচন্ড বৃষ্টি। রেইন কোট, পলিথিন যার যা আছে চাপিয়ে রওনা দিলাম। পথে যেতে যেতে মিশুক এর সাথে মহুয়ায় ‍দু চারটে চুমুক দিলাম আর পথের ক্লান্তি ভুলে গেলাম। বৃষ্টি, কাদা, দুপাশে সবুজ পাহাড় মহুয়ার মাদকতা সবকিছু মিলিয়ে অন্যরকম এক অনুভুতি। এভাবে সারাজীবন হাঁটলেও যেন ক্লান্তি আসবেনা।

সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ২৭০০ ফুট উচ্চতায় বগালেক এর খাড়া পাহাড়ে উঠতে গিয়ে আমাদের ম্যানেজার সুমন দা আর পারছিনা গুরু বলে পাহাড়ের গা বেয়ে সোজা শুয়ে পড়লেন। আমি আতঙ্কিত হলাম আগামীকাল এর কথা ভেবে। বগালেক সবুজ পাহাড় ঘেরা মনোরম লেক, আদিবাসী বম, মারমাদের বসতি... অদ্ভুত এক নীরবতা... যেন এক টুকরা স্বর্গ। গতবছর কেওক্রাডং যাওয়ার সময় বগালেক এ সিয়াম দিদির এর কটেজ এ ছিলাম। এবার আমাদের গাইড মিশুক এর অনুরোধে “দিন পুই” দিদির কটেজ(জিং মুন লিন) এ থাকলাম।

এবং ঠিক করেছি এর পর যতোবার যাবো ততোবার “দিন পুই” দিদির ওখানেই থাকবো। বাঁশের এই কটেজ গুলাতে কি আছে বুঝিনা। পুরা নেশা ধরে যায়। ‍দিন পুই দিদির আতিথেয়তায় আমরা মুগ্ধ। প্রথম দিন খেলাম ভাত, ডাল, আলু ভর্তা, সবজি(৭০ টাকা) আর থাকা প্রতি দিন ১০০ টাকা করে।

খাওয়ার ক্ষেত্রে আপনার প্রথম যে সমস্যাটা হবে তা হলো, আপনাকে রাত ৮.৩০ টার মধ্যে খাওয়া শেষ করতে হবে এবং শহরের খাবারের টেষ্ট আপনি ঐ পাহাড়ে পাবেন না। রাতে দোতলায় বেলকনিতে বসলে বগালেকের নিস্তব্দতা আপনাকে কোন স্বপ্নের জগতে নিয়ে যাবে। অনেকে লেকের পাড়ে হৈচৈ করে বারবিকিউ করে। খুব জগন্য মনে হয় এই কাজটা। পুরো লেকটাই তখন নরকে পরিনত হয়।

পরদিন সকালের পরিকল্পনা করে সবাই সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। রাতে টের পেলাম বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ যতোই উপভোগ্য হোক, সকালের কথা ভেবে ঘুম আর আসছিল না। ঘর পোড়া গরু ‍সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। নাফাখুম যেতে না পারার কষ্ট আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল।

জাদিপাই এর রাস্তা সম্পর্কে আমার অল্প সল্প ধারণা আছে। বৃষ্টিতে এর চেয়ে ভয়ঙ্কর পাহাড়ী রাস্তা আর হতে পারেনা। সকালে উঠে সবাই যাবে কি যাবেনা এই নিয়ে চিন্তিত। দরজা ধাক্কায়া গাইডকে ঘুম থেকে তুললাম। ওই বেটাও যেতে চাইছেনা।

আমি গাইড কে বললাম, সবার জন্য বাঁশ কেটে নিয়ে আসো। আরও বললাম কেউ না গেলে শুধু আমরা দুই জন যাবো। যা হবার তা পরে দেখা যাবে। অবশেষে অনেক তর্ক বিতর্কের পর সবাই সকাল ৭.০০ টার দিকে জাদিপাই এর পথে রওনা দিলাম। বৃষ্টির লুকোচুরি সারাপথ জুড়ে আমাদের দ্বিধাবিভক্ত করলেও শেষ পর্যন্ত হতাশ করেনি।

পথে চিংড়ি ঝড়না ফেলে খুমি পাড়ার পাশে একটা যাত্রী ছাউনী মতন জায়গায় ১০ মিনিটের মতো বিরতি দিয়ে ৮.৩০ টার দিকে দার্জিলিং পাড়াতে চা বিরতি দিলাম। চিংড়ি ঝরণাতে সাবধানে থাকবেন। প্রচুর জোঁক আছে। গত বারের মতো এবারও এই ঝরণায় জোঁকাক্রান্ত হয়েছি। দার্জিলিং পাড়া পথে অনেক রকম পাহাড়ী ফুল, প্রজাপতি, আদিবাসী নারী পুরুষ এর জীবনযাত্রা চোখে পড়বে।

যা সম্পুর্ণ নতুন এক অনুভুতি। যারা সবসময় গন্তব্যের চিন্তা মাথায় রাখবেন তারা অতি দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়বেন। প্রতিটা মুহুর্ত যদি আপনি উপভোগ করতে পারেন তাহলে ট্রেকিং আপনার জন্য ডাল ভাত। আমাদের লাইনম্যান হিল্লোল দা’র মতো মাথায় অল্প সল্প বুদ্ধি থাকলে পথে টুক টাক খাবারের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। (আমলকি আহড়ন) সকাল ১০.০০ টার দিকে কেওক্রাডং এর চুড়ায় উঠলাম।

দ্বিতীয় বারের মতো কেওক্রাডং জয়। অসাধারণ অনুভুতি। কেওক্রাডং এর নীচে লালা বাবুর কটেজ। শুনলাম সে নাকি এরশাদ সরকারের আমলে ৯৯ বছরের জন্য এই পাহাড় টা লিজ নিয়েছে। তবে আমার মনে হলো, কেওক্রাডং এর এক্কেরে নীচে কটেজ দেওয়াটা উচিৎ হয়নি।

যাই হোক, লালা বাবুর ছেলের বউটা বেশ ভাল। আমাদের দুই বোতল পানি দিল। ঝিরির পানি। খেতে ভারী মিষ্টি। এই কয়দিন ঝিরির পানি খেয়েই ছিলাম।

সারাদিন মিনারেল ওয়াটার এর বোতল নিয়ে ঘুরবেইবা কে। পেটের কোন সমস্যাই হয়নি। নতুন উদ্যোম নিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলাম। পথে যে পাড়াটা পড়লো ওটার নাম পাসিং পাড়া। পাসিং নামে এর ভদ্রলোকের নামে এই পাড়ার নামকরন(শ্রুত)।

পাসিং পাড়ায় কলা খেতে ভুলবেন না। স্বাদটা এখনো মুখে লেগে আছে। “দিনমই” এর দোকানে “লংসাম্বো” নামে যে মেয়েটি ছিল, খুব খাতির করে খাওয়াল। কিছু কিছু জায়গায় পাহাড়ীদের আতিথেয়তায় আমরা মুগ্ধ। পাসিং পাড়া পথে প্রতিটি আদিবাসী পাড়া আমাদের জন্য পাওয়ার হাউস এর মতো কাজ করছিল।

অনেক্ষন হাঁটার পর একটা পাড়া দেখেলেই মনটা উৎফুল্ল হয়ে উঠে। দুপুর ১১.৩০ এর দিকে জাদিপাই পাড়ায় এসে পৌঁছালাম। জাদিপাই পাড়া এবার বিশ্রাম না নিয়ে হাঁটতে থাকলাম। সময়ের ব্যাপার টা মাথায় রাখতে হচ্ছে। একটা সময় এসে বাঁশের বেড়া ডিঙ্গিয়ে খাড়া পাহাড় ধরে নিচের দিকে নামতে থাকল রাস্তাটা।

শুধু নামছি আর নামছি। ফিরে আসার সময় এই রাস্তা উঠতে জান কোরবান হয়ে যাবে কোন ভুল নেই। কিছুদূর যাওয়ার পর ঝরণার শব্দ পেলাম। শব্দ শুনেই ঝরণার আকৃতি সম্পর্কে একটা অনুমান করে নিলাম কতো বড়ো হতে পারে। কিন্তু হাঁটছি তো হাঁটছি, ঝরণা দেখা নেই।

এ যেন মরিচীকা। একটু পর যে পথে পৌঁছালাম সেটা হলো জোঁকের স্বর্গরাজ্য। কাদা এবং ঝোপের মতো ১৫-২০ মিনিটের পথটাতে যতোটা সম্ভব জোরে হাঁটবেন কিংবা দৌড়াবেন। তাহলে আপনি বেঁচে যাবেন। অবশেষে বেশকিছু জোঁক সঙ্গে নিয়ে যে জায়গায় এসে পৌঁছালাম সে জায়গাটা ঝরণায় যাবার সবচেয়ে বিপদজনক ট্র্যাক।

প্রায় ৭০ ফিট খাড়া নিচের দিকে নামতে হয়। তাছাড়া বৃষ্টিতে এতোটাই পিচ্ছিল ছিল ঠিক মতো শরীরের ব্যালেন্স রাখা কষ্টকর। লতা, গাছ, বাঁশ যা সামনে পাচ্ছি আঁকড়ে ধরে নিচে নামতে থাকলাম। শেষ পর্যন্ত যেখানে গিয়ে পৌঁছালাম আমরা কেউই তা দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। একি দৃশ্য!!!!!! বিশ্বাস করুন মনে হবে আপনি যেন অন্য এক জগতে।

এ আমাদের চেনা জানা পৃথিবী নয়। বিশাল এক ঝরণার ধারা থেকে পানির ঝাপটা এসে ভিজিয়ে দিবে আপনাকে। যদি দূর থেকে ঝরণাটা দেখা যেত, ধীরে ধীরে আমরা কাছে আসতাম, তাহলে এমনটা মরে হতো না। এ যেন জাদিপাই এর জঙ্গল ফুঁড়ে হঠাৎ বেরিয়ে আসা অন্য এক জগৎ। ঝরণার বিশালত্ব বোঝানোর জন্য নিচে ডান পাশে একটা প্রসঙ্গ বস্তু দেওয়া হল (বস্তু টা হইল আমাদের ভ্রমনসঙ্গী দেবু) বর্ষাকাল বলে হয়তো পানিটা একটু বেশী।

আনন্দে এদিক ওদিক দৌড়াতে গিয়ে বেশ কয়েকবার পড়ে গিয়ে হাত পা ছিঁড়ে গেল। খুবই পিচ্ছিল জায়গাটা। শুনেছিলাম জাদিপাই এর পূর্ণাঙ্গ ছবি তোলা যায়না। খুব সংর্কীর্ণ জায়গাটা। এসে বুঝলাম আসলে সবাই এখানে পানির ঝাপটার ভয়ে ক্যামেরা বের করতে ভয় পায়।

এতো সুন্দর ঝরণা দেখে ক্যামেরার মায়া ত্যাগ করে পাহাড়ের গা বেয়ে উপরে উঠে বেশ কিছু ছবি তুললাম। বেশকয়েকবার পড়েও গেলাম। ভাগ্যিস আমাদের ম্যানেজার সুমন দা পাশে ছিলেন। নইলে আমার ক্যামেরাটা আস্ত আনতে পারতাম না। এ ধরনের ভ্রমনে শুধুমাত্র নিজের দিকে খেয়াল রাখলে চলে না।

সবাই সবার দিকে নজর না রাখলে অনেক সময় অপূরনীয় ক্ষতি হয়ে যায়। ঝরণার নিচে বসে সবাই চিনি দিয়ে শুকনো চিড়া খেলাম। প্রচুর ঝরণার পানি খেয়ে কিছু বোতলে ভরে ফিরে আসার প্রস্তুতি নিলাম। সব মিলিয়ে প্রায় ৪৫ মিনিট ছিলাম ঝরণায়। খুব কম সময়।

কিন্তু এর বেশী থাকার ‍উপায় নেই। সন্ধ্যার আগে বগালেক ফিরতে হবে। বেশী সময় কাটাতে চাইলে আপনাকে জাদিপাই পাড়া অথবা কেউক্রাডং এ লালা বাবুর কটেজ এ থাকতে হবে। কিন্তু নাফাখুম যাওয়ার জন্য থানচি গিয়ে আমাদের একটা দিন নষ্ট হওয়াতে সেটা আর সম্ভব হলোনা। পরের বার আসলে অবশ্যই জাদিপাইপাড়া থাকবো।

প্রচন্ড অনিচ্ছায় অপার সৌন্দর্যের ঝরণার রাণী জাদিপাই কে পিছনে ফেলে ফিরতে থাকলাম বগালেক। ঝরণা থেকে কেউক্রাডং পর্যন্ত শুধুই পাহাড়ে উঠতে হবে আপনাকে। পুরো ভ্রমনে যা সবচেয়ে কষ্টকর। তবে পাহাড়ে উঠাকে কষ্টকর মনে হলে আপাতত আমার এই ছবি গুলো দেখুন। কিছুদিন পর একটা ভিডিও আপলোড করবো, ওটার লিংকও দিয়ে দিব।

ঘরে বসে জাদিপাই ঝরণার একটা হালকা পাতলা টেষ্ট পেয়ে যাবেন। অবশেষে জোঁকের কামড়ে রক্তাক্ত আমরা ক্লান্ত শরীরে রাত ৮.০০ টার দিকে বগালেক ফিরলাম। এবার আসি কাজের কথায়। কিভাবে যাবেন কোথায় খাকবেন তা একটু দেখি। (আসলে সবকিছুই লিখে রাখছি নিজের জন্য।

কয়েকদিন পর নিজেই হয়তো ভুলে যাবো কেমনে গিয়েছিলাম, কোথায় ছিলাম... ইত্যাদি)। আমি চট্টগ্রাম থেকে শুরু করলাম: খরচাপাতি: ১. চট্টগ্রাম টু বান্দরবান: বাস জন প্রতি ১২০ টাকা। ২. বান্দরবার টু কৈক্ষ্যংঝিরি: বাস জন প্রতি ৯০টাকা। ৩. কৈক্ষ্যংঝিরি টু রুমা বাজার(নৌকা): জন প্রতি ৪৫ টাকা / রিজার্ভ ১৫০০ টাকা। ৪. রুমা বাজার খেকে ১০০ টাকা দিয়ে গাইড এসোসিয়েশনের ফরম কিনে গাইড ঠিক করবেন।

আমরা তিন দিনের জন্য ১৫০০ টাকা+২০০ টাকা(বখশিস)=১৭০০ টাকা দিয়েছিলাম। গাইড মিশুক(মো: ০১৫৫৪৫৬৭২৯৬) ৫.রুমা বাজার থেকে বগালেক(জীপ): জন প্রতি ৮০ টাকা/রিজার্ভ ২২০০ টাকা(প্রায়) ফিরতি পথে রুমা বাজার থেকে রিজার্ভ নৌকা(২৫০০ টাকা) নিয়ে সরাসরি বান্দরবার চলে আসতে পারেন। হলফ করে বলতে পারি, পুরো ভ্রমনের ক্লান্তি ভুলে যাবেন। সাথে কি কি নেবেন: ১. ঔষধ: (ওডোমাস, প্যারাসিট্যামল, খাওয়ার স্যালাইন, গ্লুকোজ, ব্যান্ডেজ, কাঁটা ছেঁড়ার মলম,স্যাভলন, ব্যাথার ওষূধ) ঝরণার জায়গাটা খুবই পিচ্ছিল। কোন বিপদ হলে ডাক্তার এর দেখা পেতে ২ দিন সময় লাগবে।

২. শুকনো খাবার চিড়া, খেজুর, চকলেট। ৩. প্রত্যেকের সাথে পানির বোতল(খালি হলেও সমস্যা নেই। পথে ঝিরির পানি ভরে নিতে পারবেন। ঝিরির পানি খেয়ে আমাদের কারো পেটে কোন সমস্যা হয়নি)। ৪. ব্যাকপ্যাক(সুটকেস,হ্যান্ডব্যাগ টাইপ কিছু অবশ্যই নিবেন না) ৫. পাহাড়ে হাঁটার জুতা বা স্যান্ডেল(রুমা বাজার পাবেন ১২০ টাকা করে)।

৬.বৃষ্টির দিন হলে পর্যাপ্ত পলিথিন। (বড় পলিথিন দিয়ে নিচের দিকে হাত ও মাথার জায়গাটা কেটে সুন্দর করে রেইনকোট বানানো যায়। খুব কাজ দেয়) ৭. চার্জার। (বগালেক চার্জ দেওয়ার ব্যবস্থা আছে)। ৮. লাইটার, টর্চ, ছুড়ি, Toothpaste, Tooth Brush, Bath Soap, Shampoo, ক্যাপ, গামছা (যা সব ভ্রমনেই লাগে।

হুদাই লিখলাম। ) খালি হাতে ফিরে আসিনি জাদিপাই খেকে। ফিরে এসেছি অসম্ভব ভাললাগা এক অনুভব আর মজার একটা জোকস(জীবন থেকে নেয়া) নিয়ে। জোকস টা হলো… রুমা বাজার থেকে বান্দরবান ফেরার পথে রিজার্ভ নৌকা ঠিক করার সময় আমাদের সাথে আরো দুজন এসে জুটল। হাফ পেন্ট, গেঞ্জী(বুকে বড় বড় অক্ষরে Adventure লিখা), কাঁধে ব্যাগ… স্বভাবতই জিজ্ঞেস করলাম কতদূর গেলেন কোথায় কোথায় গেলেন।

উনারা বললেল বগালেক-কেওক্রাডং-তাজিংডং-থানচি-বান্দরবান যাওয়ার প্ল্যান ছিল। কিন্তু বগালেকও যাওয়া হয়নি। কারন একজন জানতেনা যে পুরোটা পথ হাঁটতে হবে। অন্যজন কোনদিন দোতলা বাসায় থাকেননি, সবসময় নীচতলাতেই খাকেন। কারন তার উচ্চতা ভীতি আছে!!!!! চোখেমুখে আমি সমবেদনা জানালেও বহু কষ্টে হাসিটা চেপে রেখেছি।

কারন প্ল্যানটা উনারা ঢাকাতে বসেই করেছিলেন। আশা করছি আপনারা পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়ে জাদিপাই ভরপুর আনন্দ করে যাবেন। সবার প্রতি শুভকামনা রইল।  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.